ুনারীর চোখে বিশ্ব দেখুনচ্ কোনো এক নারী দিবসের শ্লোগান ছিলো। বিষয়টা আমাকে খানিকক্ষণ ভাবিয়েছিলো, নারীর চোখের বিশ্ব এবং পুরুষের চোখের বিশ্ব দর্শণ আলাদা এই বিষয়টা চিন্তার ভেতরে থাকলেও নারীর চোখের বিশ্বসম্পর্কিত কোনো তথ্য আমার কাছে ছিলো না, যার ভিত্তিতে বলতে পারতাম নারীরা বিশ্বকে ঠিক এভাবেই দেখে।
অবশ্য নারীর ভাবনা বোঝার একটা প্রচেষ্টা নিয়েছিলাম একদা, দেশের অর্ধেক মানুষ কি ভাবছে এটা অজ্ঞাত থাকা কখনও সঠিক মনে হয় নি আমার। নারীরা কি ভাবছে এটা জানার জন্য তাদের সাথে সরাসরি কথা বললে সঠিক উত্তর পাওয়ার সম্ভবনা কম, সামাজিক মনস্তত্ত্ব এ বিষয়ক তথ্য সরবরাহের একটা প্রধান বাধা। পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোতে নারীর অবস্থান চিহ্নিত, তার স্বাধীনতার সীমানা দাগ কেটে নির্দিষ্ট করে দেওয়া। এটা অবচেতনে ধারন করে বহমান নারী এই কাঠামোকে প্রশ্ন করবে না, একটা সামাজিক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে চলমান এই প্রথাকে প্রশ্ন করে নি এমন নারী খুব কম, তবে তারা নিজেরা যা বুঝতে পারে অনায়াসে, তাদের নিজস্ব বিষয়গুলো, তারা যেভাবে পারস্পরিক সমঝোতার ভেতর দিয়ে পুরুষশাসিত সমাজে নিজেদের অবস্থানকে চিহ্নিত করে ফেলেছে, সেই একই বোধ তাকে আপষকামী করে তুলেছে, তাই এই কাঠামোর ভেতরে গিয়ে তার নিজস্ব অবস্থানে গিয়ে তাকে প্রশ্ন করলে সঠিক উত্তর পাওয়ার সম্ভবনা কম।
অন্য উপায় হলো নারীরা যখন নিজেদের প্রকাশ করছে সেই জায়গাটাতে গিয়ে সামাজিক নারী এবং ব্যাক্তি নারীকে পৃথক করার একটা প্রচেষ্টা নেওয়া। একটু খুজে দেখা একজন শিল্পী হিসেবে তার দায়বদ্ধতার জায়গাটাতে নারী কতটা স্বাধীন তার ভাবনায়, তার নারী সত্ত্বা ও তার পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোতে বসবাসের জায়গাটাকে কতটা সুন্দর ভাবে সে আলাদা করতে পারছে, কিংবা আদৌ এই কাঠামো থেকে তার চেতনার মুক্তি হয়েছে কিনা এটা যাচাই করে দেখা। আমার অভিজ্ঞতা খুব কম এ বিষয়ে, কয়েক জন নারী ব্যাতীত আমার পঠনে আর এমন কেউ নেই। সেলিনা হোসেনের কয়েকটি, নাসরিন জাহান, তসলিমা নাসরিন, মল্লিকা, সূচিত্রা রায়, বানী বসু, এবং এদের বাইরে আরো সামান্য কয়েক জনের লেখা পড়ে কোনো সাধারনিকৃত মন্তব্য করা হয়তো উচিতও হবে না।
তবে এদের লেখার বিষয়বস্তু চয়ন করা, এদের চরিত্র বিশ্লেষন, এবং এদের চরিত্রের পরিনতি এসব দেখে সামান্য অনুমান করা যায় এরা কিভাবে পুরুষতান্ত্রিক কাঠামর ভেতরে নিজেদের অবস্থানকে চিহ্নিত করেছে। একটা অভিজ্ঞতার কথা বলতে পারি, প্রাসঙ্গিক অভিজ্ঞতা, আমার কয়েকজন বন্ধু সংগীতের সাথে জড়িত, মাঝে মাঝেই তাদের সংগীত আলোচনার বিমুর্ত ভূবনে আমি ঢোকার অনুমতি পেতাম। তাদের ইচ্ছা ছিলো ধর্ষন এবং নারীর উপর সহিংসতা বিষয়ক একটা গান করা হবে। বেশ কয়েকভাবে লেখার পরও মনে হলো সঠিক ভাবটা আসছে না, অগ্যতা নারীর শরণাপন্ন হওয়া, এক বন্ধুকে অনুরোধ করলাম তার অনুভব নিরেট গদ্যে তুলে ধরতে, বাকিটা আমরাই করে নিবো, সপ্তাহ গেলো, মাস গেলো, কিন্তু কেউই এক লাইন গদ্য দিতে পারলো না। এমন না যে ধর্ষন বিষয়টার ভয়াবহতা সম্পর্কে তারা সচেতন না, বরং এ বিষয়টা প্রকাশ করার জন্য তেমন কোনো শব্দ তাদের নেই। কিংবা তারা আড়ষ্ট হয়ে গেছে আমাদের অনুরোধে, সে প্রচেষ্টা সফল হয় নি।
এই জায়গা থেকে দাঁড়িয়ে দেখতে হবে বিষয়টাকে, নারীর শব্দভান্ডারে যতই শব্দ থাকুক না কেনো প্রকাশের সময় তাদের প্রকাশ ভঙ্গি তেমন প্রকাশ্য না।
সামাজিক নারীর ধারনাটা আমাদের তৈরি করা না, ইতিহাস, সময়, এই ধারনাটা আমাদের উপহার দিয়েছে, আমাদের সাহিত্য-শিল্পে নারীর চিত্রায়নের বিষয়টা দেখলেই বোঝা যাবে আমরা নারীকে কিভাবে দেখতে চাই। বাঙ্গালী সংস্কৃতিতে মা কালী স্বরস্বতী, লক্ষী, দুর্গা,মনসা থাকলেও তাদের সহায়ক হিসেবে অন্য দেবতারাও আছেন, শিব, শংকর, বিষ্ণু এরাই সব নিয়ন্ত্রন করছেন অলক্ষ্যে থেকে। দুর্গতিনাশিনী দুর্গা সেও দেবতাদের বিভিন্ন অস্ত্রে সজ্জ্বিত হয়ে অসুর বধের নিমিত্তে নেমে আসেন, তার এই শক্তির পেছনের কলকাঠি নাড়ছে যারা তাদের খেয়ালের পুতুল হয়েই থাকতে হয় তাকে। নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টা এভাবেই দেখছে পুরুষতান্ত্রিক মনস্তত্ত্ব। পুরুষ দিলেই সেটা সম্ভব, পুরুষের উপহার নারী স্বাধীনতা। নারীর ক্ষমতা তাও পুরুষের দাক্ষিণ্য।
বাংলাদেশের নির্দেশনায় আসা নারী নাট্যকার কম, নারী চলচিত্র পরিচালক কম, নারী লেখকের পরিমান কম, অন্তত শতকরা হিসেবে নারীর প্রতিনিধিত্ব করে এমন লেখকের সংখ্যা কম। ফটোগ্রাফী, কিংবা অঙ্কন শিল্পে আসা নারীর সংখ্যাও কম। এবং যারা আছে তাদের মেয়ে বিষয়ক লেখার পরিমান কম। বাংলা সাহিত্যে নারীপ্রধান উপন্যাসগুলোর অধিকাংশ লিখেছে পুরুষেরা। এবং নারীদের নিয়ে লিখিত নারী কিংবা দ্বিতীয় লিঙ্গ বইটাও এসেছে হুমায়ুন আজাদের লেখনীতে, যদিও নারী বইটা দ্বিতীয় লিঙ্গ বইটার সম্প্রসারিত অংশ, মৌলিকত্ব যতটা তার তুলনায় অনেক বেশী গ্রন্থনার পারদর্শীতা, এর পরও বলতে হবে এই বইটাই বাংলাদেশের নারীকে নিয়ে কিংবা নারীর সামাজিক অবস্থানের উপরে লিখিত প্রথম ও প্রধান গ্রন্থ। নাসরিন জাহানের নারীর প্রেম ও বিভিন্ন অনুভবের কথা স্বরণ করেই বলছি এই কথা।
ুনারীচ্ কিংবা ুদ্বিতীয় লিঙ্গচ্ নিয়ে আলোচনা করার প্রয়োজন নেই, সেখানে কিছু ভাবনা তুলে আনা হয়েছিলো, কেনো নারীর প্রতিনিধিত্ব করা লেখিকারা নারী বিষয়ক লেখা লিখছেন না, তবে সবাই যে বিষয়ে একমত তা হলো পুরুষ বুঝবে না, পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোর ভেতরে বসবাসকারী কোনো নারী বা পুরুষ উপলব্ধি করতে পারবে না বলেই নারীরা নিজেদের নিয়ে লিখছে না। যদিও আমার কাছে এখনও স্পষ্ট না ঠিক কি অর্থবহন করে এই ুনা বুঝবে নাচ্ শব্দগুচ্ছ, নারীর নিষ্পেষন নিয়ে উচচ কণ্ঠ পুরুষেরাই, নারীর অধিকারহরণের পক্ষেও পুরুষের সোচচার, পুরুষেরাই বলছে গৃহকোণে নারী অধিকার লুণ্ঠিত হচ্ছে , কর্মক্ষেত্রে, রাস্তায়, যৌনসামগ্রী হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে নারী এই কথাগুলোও বলছে পুরুষেরাই। আমাদের চারপাশের নারীবাদিতার সবকটা উপকরনই সেই অর্থে পুরুষের কাছে স্পষ্ট, একজন ধুসর প্রদেশের কথা আলোচনায় এনেছেন, ফ্রয়েডের অবদমিত কাম যেমন সর্বগ্রাসী একটা ধারণা, যেখানে সব কিছুই কোনো না কোনো ভাবে কামনা দিয়ে প্রকাশ করা সম্ভব, যেখানে শিশ্নহীনতার চেতনাটাও নারী নিজের ভেতরে নিয়ে ঘুরছে সারা জীবন তেমনই একটা ধারনা ধুসর প্রদেশ, যা নারীরও অজানা জগত, নারী অনুভব করে তবে সেই অনুভবকে ভাষা দিতে পারে না, তারা পরস্পর অনুভব করতে পারে, তারা সবাই জানে পুরুষশাসিত সমাজকাঠামর ভেতরে এমন একটা পুরুষের অগম্য প্রদেশ বিদ্যমান যা পুরুষশাসিত সমাজের পরিভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। হীনতার অনুভব কিছুটা , কিছুটা নিয়ন্ত্রনের অধিকার না থাকার আক্ষেপ, কিংবা অবস্থানহীনতার কিংবা অবস্থান খুজে না পাওয়ার যন্ত্রনা ,অনেক রকম ভাবনার মিশ্রন, যেহেতু কোনো স্পষ্ট ধারনা নেই তাই অনেক কিছুই প্রবেশ করান সম্ভব এখানে।
তবে আমরা যেই শব্দগুলো ব্যাবহার করলাম এখানে এইসব শব্দে ধরা যাবে না এমন কিছু একটা সেই ধুসর প্রদেশে বসবাস করে। যদিও এমন যেকোনো ধারনাই পুরুষ অনুভব করতে সক্ষম, তারাও এমন সব মানসিক অবস্থার ভেতর দিয়ে জীবন যাপন করছে, কিংবা এটা কোনো সোনার পাথরবাটি, পুরুষ তৈরী করে নারীদের সামনে তুলে দিয়ে বলেছে এই অপ্রকাশযোগ্য ধারনার সংমিশ্রনজাত যা সেটাকে ভিত্তি করে আপাতত ভাবতে থাকো, যথাপোযুক্ত শব্দ সরবরাহ করা হবে প্রয়োজন হলে।
সামাজিক নারীর ধারনাটা স্পষ্ট আমাদের কাছে, শরত বাবুর যেকোনো উপন্যাস হাতে নিয়ে বলে দেওয়া যাবে, আমরা নারীকে কিভাবে দেখতে চাই, নারীর ভালোবাসা, নারীর কোমলতা, নারীর সহিষ্ণুতা, নারীর ক্ষমাশীলতা, আমরা অনেক শব্দে এসবকে নির্দিষ্ট করে রেখেছি। আমাদের নারীর সংজ্ঞা খুজতে বেশী ভাবতে হয় না, আমরা জানি নারী শব্দটার সাথে কি কি অনুভব জড়িত, শরত বাবুর উপন্যাসকে চিরায়ত পুরুষতান্ত্রিক নারীর চিত্রায়ন ধরে নিয়ে আমরা এখন তসলিমা নাসরিন এবং নাসরিন জাহানের উপন্যাস নিয়ে আলোচনা করতে পারি।
ধর্ম পুরুষকতৃত্বপ্রবনতার নিয়মতান্ত্রিক রূপ এই স্পষ্ট দাবীটাকে আলোচনায় না এনেও তসলিমা নাসরিনের সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করা যায়, তার নির্বাচিত কলাম বাদ দিলে ধর্মবিষয়ক আলোচনা নেই তার বেশীর ভাগ উপন্যাসেই, আর উপন্যাস কিংবা গদ্য কিংবা কবিতায় তেমন বিধ্বংসি ভাবে ধর্মকে আক্রমন করা কঠিন। তবে তসলিমার উপন্যাসে নারীর অবস্থানবদল, চরিত্র বদলের ধারাটাকে চিহ্নিত করা যায়, পুরুষের বদলে নারীর কতৃত্ব গ্রহনের প্রবনতাকে চিহ্নিত করা যায়। নারীর আগ্রাসনের কথাও উঠে আসে উপন্যাসে, পুরুষকে যেভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে সেই একই রকম বৈশিষ্ঠ্য নারীরা গ্রহন করে, তারা বহুগামী হয়, তারা পুরুষের কতৃত্বকে দমন করতে চায়, পাঠকের অসস্থির কারন হয় পরিনতিতে। কিংবা নারীর ক্রমাগত হতাশা, তাদের চাহিদা পুরন না হওয়ার কথাও উঠে আসে, তার আত্মজীবনিতে যেভাবে পুরুষের কামুক চরিত্র উম্মোচিত হয়েছে, এটা সামাজিক ভাবে নারীকে প্রতিরোধ করতে হয়, যৌন আগ্রাসনের মুখোমুখি হতে হয়, শরীর সচেতন হয়ে উঠার বিষয়টা নারীর ভবিতব্য। পুরুষমনস্তত্ত্ব যোণিঅভিমুখী, এমন কোনো দাবী যদি উঠে আসে এটার সত্যতা বিদ্যমান।
এর বিপরীতে নাসরিন জাহানের উপন্যাস, নিরেট বাস্তবতা, নারী উপলব্ধি করলেও কখনই এর বিপরীতে কোন পদক্ষেপ নেয় না নারী চরিত্রগুলো, বরং তারা অনেকটা মর্ষকামী, পুরুষের কামুকতার মুখোমুখি হলে তারা তাদের অবস্থান ছেড়ে যায়, কখনও সেটাকেই মেনে নেয়, কিংবা নিজেরাই নেমে যায় একই রকম আচরন করতে, তবে নাসরিন জাহানের উপন্যাসের প্রধান বিষয় নারীর পলায়নপ্রবনতা, নারী পরিস্থিতির সাথে আপোষ করে, মানিয়ে নিতে চায়, এই পুরুষতান্ত্রিক ভাবধারার সাথে নিজেদের ভাবনাও বদলে গেছে তাদের এমন একটা বাস্তবতার মুখোমুখি করায় আমাদের। যদিও তার বেশ কিছু নতুন উপন্যাস পড়া হয় নি, তাই গত ৩ বছরে প্রকাশিত উপন্যাসগুলো এখানে বিবেচিত হয় নি, একই ভাবে তসলিমার ফরাসি প্রেমিকের আলোচনাও এখানে আসে নি।
তবে আমার মনে হয় এই একই বৈশিষ্ঠ্য খুজে পাওয়া যাবে অনেক পুরুষের লেখায়, নারী বিষয়ক ভাবনার নতুন কোনো জগত আসলেও তুলে ধরতে পারছে না আমাদের নারী শিল্পীরা, এটা আমাদের ভাষার দীনতা অথবা এটা এই সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করে যে আমরা এইসব সংজ্ঞা তৈরি করেছি পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোকে মাথায় রেখেই, কোথাও সেই ধুসর জগতের অস্তিত্ব নেই।
মন্তব্য
নতুন মন্তব্য করুন