ভিউয়ার্স আজকে আমরা কি ভিউ কড়তে পারি

অপ বাক এর ছবি
লিখেছেন অপ বাক (তারিখ: মঙ্গল, ২০/০২/২০০৭ - ৪:৪১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

প্রতি বছর দিবস উদযাপন চলে। বিশেষ সংখ্যা আসে বাজারে, স্মৃতিচারণের বন্যা বয়ে যায়। বিশেষ সে দিনের সাম্ভাব্য সব ঘটনা আমরা জানতে পারি। এসব আয়োজন আসলে গুরুত্বপূর্ণ। দিবসজীবি আমরা কিছু উপলক্ষ্য খুঁজে পাই জীবনে। নিয়ম করে জন্মবার্ষিকি পালন, সে নিজের হোক আর বিখ্যাত লোকের হোক, অভ্যাস হিসেবে মোটেও খারাপ না।

আমি নিজে দিবস উদযাপনটাকে উপভোগ করতে পারি না। জাতিসংঘ 21শে ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস ঘোষণা করেছে। আমাদের 21 বললে ভালো লাগে শুনতে। আমরাই পৃথিবীতে একমাত্র জনগোষ্ঠি যারা ভাষার জন্য 2 বার লড়াই করেছি। প্রাণ দিয়েছি।

অবশ্য 21শে ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস ঘোষণার সাথে সহযোগী কিছু বক্তব্য আছে। মানুষের ভাষা মানুষের সংস্কৃতির ধারক- বাহক। মানুষের সংস্কৃতি চর্চায় ভাষা একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এবং বিভিন্ন সংস্কৃতিকে শ্রদ্ধা এবং সংরক্ষণ করার প্রচেষ্টা থেকেই এই আন্তঃ বৈশ্বিক উদ্যোগ জাতিসংঘের। ভাষার কথা বিবেচনা করলে দেখা যায় পৃথিবীতে রায় বিলুপ্ত ভাষার সংখ্যা অনেক বেশি। এবং এইসব ভাষা সব সময়ই সংখ্যালঘু আদিবাসী জনগোষ্টির। তারা অর্থনৈতিক ভাবে তেমন শক্তিশালী নয়, তাদের জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে অন্য প্রচলিত ভাষা ব্যাবহার করে কিংবা করতে বাধ্য হয়।
এখানে সুরঞ্জিত গত 21শে ফেব্রুয়ারীতে একটা আবেদন রেখেছিলো। তাদের নিজস্ব ভাষার স্ব ীকৃতি চেয়ে। হয়তো অর্থনৈতিক কারণে সেটা সম্ভব নয়। তবে তাদের ভাষা চর্চা এবং সংস্কৃতি চর্চায় সহায়তা করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। আমরা শুধু ভাষাভিত্তিক বৈষম্য সৃষ্টি করি না। আমরা জাতিসত্ত্বার উপর আগ্রাসন চালাই সমান ভাবে।
এমনই ভাষাভিত্তিক আগ্রাসন, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ধর্মের নামে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এমন কি সংস্কৃতিগত ঐক্য থাকার পরও ধর্মভিত্তিক বিভাজনের জন্যও মানুষের সাংস্কৃতিক দ্্বন্দ্ব আর সামপ্রদায়িক নখর লুকিয়ে থাকে নি। ইতিহাসে এসব আগ্রাসনের গল্প আছে অনেক।

আমার খারাপ লাগে যখন জানতে পারি পৃথিবীতে বিলুপ্ত প্রায় কয়েকটা ভাষায় কথা বলে মাত্র একটা দুইটা পরিবার। এবং এরা মরে গেলে এদের সাথে এদের ভাষা এবং সংস্কৃতিও মরে যাবে। এসব ভাষা সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই। বাইবেলের একটা অংশে, ব্যবেলের টাওয়ার অংশে, বলা আছে মানুষের ভাষাবিভাজন ইশ্বর সৃষ্ট। মানুষের ভেতরে ব্যবধান বিচ্ছেদ তৈরির জন্য এই ভাষাভিত্তিক ব্যবধান গড়া হয়েছে। এটা হয়তো এক ধরণের ব্যাখ্যা। সেমেটিক জাতি যখন আরব থেকে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলো এবং মিশর, সিরিয়া, প্যালেস্টাইনের মাঝামাঝি এলাকায় যেসব বানিজ্যনগরী জন্ম লাভ করলো, সেখান সব সময়ই ভাষাগত সংস্কৃতিগত বৈচিত্র বিদ্যমান ছিলো। এবং মিশরে যখন ইহুদি জাতির অবরুদ্ধ অংশ দাসবৃত্তি করছে, তাদের সাথে মিশরের অন্যান্য অধিবাসীদের ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত বিরোধ এবং তাদের লড়াই নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অক্ষুন্ন রাখার পরবর্তিতে মুসার নেতৃত্বে তাদের স্বদেশের খোঁজ, এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটা, কিংবা বনী ইসরাইলের সম্পূর্ণ সাংস্কৃতিক লড়াইটা বাইবেলের ওলড টেস্টমেন্টের অংশ।
তবে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষার লড়াইটা এখানে ভাষা ভিত্তিক নয়, গোষ্ঠিভিত্তিক, একটা জাতিসত্ত্বা তাদের সংস্কৃতি রক্ষার লড়াই করছে। যখন ধর্ম নিজেই আগ্রাসী সত্ত্বা হয়ে গেলো তখন আর এই একটা গোত্রের সংস্কৃতি রক্ষার লড়াইটা অন্য সব সংস্কৃতি হত্যার ছুতা হয়ে গেলো।
আফ্রিকায় মিশনারীদের কল্যানে খুন হয়ে যাওয়া সংস্ক ৃতি, কিংবা দক্ষিন আমেরিকায় স্প্যানিশ এবং পুর্তগীজ ঔপনেবিশিকতায় নিহত গোত্রগুলো, কিংবা ইংরেজ ও ফরাসী উপনিবেশ স্থাপনের পর উত্তর আমেরিকার আদিবাসী রেড ইন্ডিয়ানদের বর্তমান অবস্থা সবই আসলে একই রকম লড়াইয়ে হেরে যাওয়া জনগোষ্ঠির বিলুপ্তির ইতিহাস।

আমরা সভ্য হওয়ার চেষ্টা করছি প্রাণপনে। আমাদের অর্থনৈতিক এবং সাম্রাজ্যবাদী লালসা আমাদের সাংস্কৃতিক হত্যা করতে প্ররোচিত করে। এর বিপরীতে দাঁড়িয়ে যখন জাতিসংঘ ঘোষণা দেয় সকল জাতিসত্ত্বার সংস্কৃতি রক্ষার উদ্যোগ নিতে হবে, তখন আমাদের নিজেদের দিকে তাকাতে ইচ্ছা করে। আমরা প্রতিদিন, প্রতিবছর নানা ভাবে 21কে মহিমান্বিত করি, সংস্কৃতি রক্ষার লড়াই বলি। কিন্তু আমরা বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে এখানের আদিবাসীদের সংস্কৃতি রক্ষায় কি প্রচেষ্টা নিয়েছি। আমাদের বান্দারবান, রাঙ্গামাটি, এবং এর সংলগ্ন অঞ্চলে যেমন অবহেলিত এইক্ষুদ্্র ক্ষুদ্্র পাহাড়ী জনগোষ্ঠি এবং তাদের সংস্কৃতি, গাড়ো পাহাড়ের উপজাতিরা, যাদের জন্য বিরিশিরিতে একটা আদিবাসি পরিষদও আছে, তাদের কল্যানে সীমিতভাবে যতটুকু সংস্কৃতি রক্ষার প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছে এইসব পাহাড়ী জনগোষ্ঠির জন্য তেমন সরকারী প্রচেষ্টা হবে কবে।

আমাদের দ্্রাবিড় পূর্বপুরুষ এখন বিলুপ্তপ্রায়, তাদের রক্ষায় কোনো প্রচেষ্টা নেই, আমাদের প্রাচীন পিতারা এখনও নগরের রাস্তা পরিস্কার করে, আমাদের তথাকথিত সুশীল সমাজের পুরীষ পরিস্কার করে, তাদের আমরা হরিজন বলছি, বলছি ডোম, বলছি ঋষিজ, তাদের কোনো এককালে গান্ধি বাবা বুকে টেনে নিয়েছিলেন, তবে সেটা বোধ হয় আন্তরিক কোনো পদক্ষেপ ছিলো না। রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহনের জন্য বোধ হয় ছিলো বেশি।তবে এমন মহান 21শের দিন অবজ্ঞাভরে অবহেলিত আমাদের দ্্রাবিড় আদিপিতাদের বিভিন্ন নাগরিক সুবিধা প্রদানের উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানাতে পারি। জানাতে পারি আমাদের পার্বত্য অঞ্চলে কয়েক হাজার বছর ধরে বসবাসরত পাহাড়ি জন গোষ্ঠির সংস্কৃতি রক্ষার দাবী জানাতে পারি, কিংবা আশাবাদ জানাতে পারি যে তাদের সংস্কৃতি রক্ষার কোনো একটা প্রচেষ্টা গৃহীত হবে এই 212শে ফেব্রুয়ারীতে। আমাদের অতীত অবজ্ঞা ভুলে গিয়ে নতুন ভাবে 21শের চেতনা অনুধাবনের সুযোগ এখনই।


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।