" নিখিল ভারত মুসলীম লীগের এই অধিবেশনের বিশেষ সুচিন্তিত অভিমট এই যে, নিম্ন লিখিত মৌলিক নীতির ভিত্তিতে রচিত না হলে কোনো শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনা এ দেশে চালু করা সম্ভব নয় বা তা মুসলিম জনগনের কাছে গ্রহনযোগ্য হবে না। যথা প্রয়োজন মতো আঞ্চলিক পুনর্বিন্যাসের ভিত্তিতে ভৌগলিক বিচারে সনি্নহিত এলাকাগুলো নিয়ে এমন অঞ্চল গঠন করতে হবে যেনো সেখানে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ট যেমন ভারতের উত্তর পশ্চিম ও উত্তর পুর্বাঞ্চল, সেখানে তাদের নিয়ে এমন " স্বাধীন রাষ্ট্রসমুহ" গঠন করা যায় যার অংশগুলো হবে স্বায়ত্ব শাসনের অধিকারী ও সার্বভৌম-----" এই ছিলো লাহোর প্রস্তাবের প্রস্টাবনা, এবং এর পরে আছে
" এই মৌলিক নীতিসমুহের ভিত্তিতে একটি শাসনতন্ত্রের পরিকল্পনা রচনা করার জন্য এই অধিবেশন ওয়ার্কিং কমিটিকে ক্ষমতা দিচ্ছে যেনো বিভিন্ন অঞ্চলসমুহের দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র, যোগাযোগ, আমদানী-রপ্তানি শুক্ল ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয়ের উপর পূর্ণ কতৃত্ব গ্রহনের ক্ষমতা থাকে।"
এই প্রস্তাবের উপর ভিত্তি করেই পূর্ব বাংলার 97 শতাংশ মানুষ মুসলিম লীগকে নির্বাচিত করে। তবে বাস্তবতা হলো পশ্চিম পাকিস্তান সরকার খুব দ্রুতই এই লাহোর প্রস্তাবের নীতি থেকে সরে আসে। তারা পূর্ব বাংলার নাম পরিবর্তন করে পূর্ব পাকিস্তান করে এবং বাংলা সংস্কৃতিকে ধ্বংস করবার চেষ্টা করে। যদিও উর্দু মাত্র 7 শতাংশ ব্যক্তির মাতৃভাষা ছিলো এর পরও 1947 সনে প্রায় 61 শতাংশ নাগরিক বাংলা ভাষাভাষি হলেও সেই 1947 থেকেই উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করবার চক্রান্ত করা হয়।
দেশভাগের পর মুসলীম লীগের নেতৃবৃন্দ পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যান এবং সেখান থেকেই পূর্ব বাংলাকে তাদের উপনিবেশ বানানোর চেষ্টা করেন। ফলে মাত্র 23 পরিবারের হাতে সিংহভাগ সম্পদ চলে যায়।
সংগ্রামের ধারাবাহিকতা অব্যাহত ছিলো। তবে ইতিহাসের মূল সমস্যা হলো এর সঠিক দিন তারিখ নির্ণয় করা। এমনই একটা সমস্যা বারবার আমাকে বিভ্রান্ত করে।
প্রথমত বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছিলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষনা নিয়ে। এটা বেশ চলমান একটা বিতর্ক। অনেক দিন থেকেই চলছে। একটা সংকলনে 71 বিশ্ব সংবাদ পত্রে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সংক্রান্ত অংশে দেখলাম একজন প্রতিবেদক বলেছেন, ইয়াহিয়ার ভাষণের পর মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষনা করেন। যখন পড়লাম তখন একটা তথ্যই জানা ছিলো, মুজিবকে 25শে মার্চ রাতেই গ্রেফতার করা হয়। গভীর রাত হলেও সে সময়ে ইয়াহিয়ার ভাষন কি প্রচারিত হয়েছিলো। একটা সম্ভবনা মাথায় ঘুরছিলো তখন। হটে পারে রাত 12টায় কিংবা রাত 2টায় যখন পাকিস্টানের সেনাবাহিনী আক্রমন শুরু করে এর আগে আগে ইয়াহিয়া ভাষণ দেয়।
সেটা নিশ্চিত হওয়া গেলো না। তবে স্মৃতিচারণের একটা অংশে জানা গেলো 26শে মার্চ সকালে ইয়াহিয়া ভাষণ দিয়েছে একটা। এরপরও সংশয় যায় না কারণ তাজউদ্দিনের প্রদত্ত মুজিব নগরের ভাষনের একটা অংশে পেলাম ইয়াহিয়ার ভাষণ প্রচারিত হয়েছে 28শে মার্চ।
এবং মুজিব নগর সরকারের প্রন্তাবনায় পেলাম মুজিব স্বাধীনতার স্পষ্ট ঘোষনা দিয়েছেন 23শে মার্চ।
কোনটা সঠিক কে জানে। একটা ভাষণ নিয়ে জন্ম নেওয়া সংশয়ের পরে সেই ভাষনের প্রতিক্রিয়ায় দেওয়া স্বাধীনতার ঘোষনা নিশ্চিত হতে আরও কিছু তথ্য হাতে আসলো যা পরস্পর বিরোধী।
সংশয় আরও বাড়ে- প্রথমে ধারনা ছিলো সেই 25শে মার্চ রাতেই ইত্তেফাক ভবনে হামলা চালায় এবং সেখানে আগুন ধরিয়ে দেয় পাকিস্তানী বাহিনী। তবে ফয়েজ খানের স্মৃতিচারণে জানা যাচ্ছে আসলে 25শে মার্চ কিছু গোলাগুলি হলেও 26শে মার্চ সেখানে অগি্ন সংযোগ করা হয়। কারণ তার স্মৃতি কথা অনুসারে ইত্তেফাকের সিরাজুল ইসলাম খান এবং তিনি অন্তত 25 শে মার্চ রাতে আরও কয়েকজন প্রেস কর্মিকে নিয়ে সেখানে অবস্থান করছিলেন। সেখানেই তারা দুপুরের খাবার খান। অভিসার সিনেমা হলের সামনের দেয়াল থেকে পকিস্তানী সৈন্যরা তাদের উপর গুলি বর্ষণ করছিলো এমনটাও লিখেছেন তিনি।
খয়েজ খান এখনও জীবিত তাই আমাদের নিশ্চিত হতে হবে বিষয়টা।
এটা গুরুত্বপূর্ণ এ জন্য যে তাজউদ্দিন আহমেদ কিংবা মুজিব নগর সরকারের প্রতিনিধিরা জাতিসংঘে কিছু ট্রানসক্রিপশন জমা দেয় সেখানে ইত্তেফাকে আগুন লাগানো ও গুলি বর্ষণের জন্য নির্দিষ্ট সৈন্য বাহিনীর ট্রান্সক্রিপশনও জমা দেওয়া হয় এবং তাদের ভাষ্যমতে এটা 25শে মার্চ দিবাগত রাতের ঘটনা।
সেই রাতেই প্রেস ক্লাবের সামনের রাস্তায় ব্যরিকেড বানিয়েছিলো কিছু তরুন, তারা প্রতিবার ব্যারিকেড পার হয়ে সেনাবাহিনী যাওয়ার পর নতুন করে ব্যরিকেড তৈরি করতো। এর ফলে উত্তেজিত সেনাবাহিনী ট্রাংক নিয়ে এসে প্রেসক্লাবে শেল বর্ষণ করে।
সংশয়টা আসলে কোনো ভাবেই দুর হলো না। 23শে মার্চ স্পষ্টভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার সেই সংবাদ আছে মুজিব নগর সরকারের প্রস্তাবনায় সেটা ভুল? নাকি 25শে মার্চ রাতে মুজিবের স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার তথ্যটা ভুল।
আরও একটা অনুরোধ আসলে আমার। 1971 সালের আগস্টের শেষের দিকে সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক বাংলার বানী পত্রিকাটি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এই পত্রিকাটির 15টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকাটির উদ্যোগ নিয়েছিলো কারা। কারা ছিলো এর সংবাদ দাতা, কে ছিলো এই পত্রিকার সম্পাদক। প্রকাশিত হতো মুজিব নগর থেকে এমনটাই আছে পত্রিকাটির উপরে লিখিত।
এই পত্রিকাতেই 18ই ডিসেম্বর , 25শে ডিসেম্বর আর 1লা কিংবা 2রা জানুয়ারীতে যুদ্ধাপরাধীদের আটক করা এবং কঠোর শাস্তি প্রদানের বিষয় নিয়ে সম্পাদকীয় লেখা হয়।
এই পত্রিকাটির প্রথম 20টি সংখ্যা এবং এর সাথে জড়িত সাংবাদিকদের নাম পরিচয় জানা থাকলে সেটা যদি কেউ জানাতো খুবই ভালো হতো। এই পত্রিকাতেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বেশ কিছু রিপোর্ট প্রকাশিত হয়।
মন্তব্য
নতুন মন্তব্য করুন