বাংলাদেশের মুসলিম

অপ বাক এর ছবি
লিখেছেন অপ বাক (তারিখ: বুধ, ২৭/০৬/২০০৭ - ২:৫০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মানুষের অসহায়ত্ব, মানুষের সংশয়, মানুষের সীমাবদ্ধতা এবং মানুষের অলৌকিকত্বের প্রত্যাশা ভক্তিবাদের পালে হাওয়া দেয়- বিষয়টা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া কার্যকরণ মেনে চলে।

বাংলাদেশের সামাজিক অবকাঠামো, এর অর্থনৈতিক স্তরবিন্যান যেকোনো অনগ্রসর সমাজের মতো এখানের মানুষকেও ভক্তিবাদের উগ্র সমর্থক করে তুলেছে, একই রকম সামাজিক অনুপ্রেরণায় ভন্ড পীর সুফিরা এখনওআত্মপ্রকাশের সুযোগ খুঁজছে বাংলাদেশে।

স্নেহ মামতা আর যাবতীয় মানবীয় আবেগ মানুষকে অসহায়ত্বের মুখোমুখি করে প্রতিনিয়ত, প্রতিনিয়ত মানুষকে সীমাবদ্ধ আর সংশয়ী করে, মানুষ এমন একটা হাঁফ ধরা অবস্থায় অলৌকিকত্বের প্রত্যাশা করে আর একজন মানুষ খুঁজে যে তাকে পরিত্রান দিবে।

মানুষের পরকাল সম্পর্কিত চেতনা অগভীর- সাধারন মানুষ বাস্তব ইহলৌকিক জীবনকে পুঁজি করে বেঁচে থাকে- অনিশ্চিত পরলৌকিক বিষয়াদি এবং বেহশত দোযখ তাকে বিন্দুমাত্র চিন্তিত করে না, অধিকাংশ মানুষের চেতনাই জীবনাবসানের বাস্তব ভয়ে গিয়ে শেষ হয়।

একদিন মৃত্যু অবসম্ভাবি এই মানসিক পীড়ন সে ভুলে থাকে যতক্ষণ না এই মৃত্যু তার সম্মুখে এসে উপস্থিত হয়-স্নহাস্পদ কারো মৃত্যু সন্নিকট হলে, জীবন বিপন্ন হলে হঠাৎ মৃত্যুভয় মাথাচাড়া দেয়- এ সময়টাতেই মানুষ ভক্তিবাদের সামনে অসহায় হয়ে পড়ে।
বংশানুক্রমিক পীরেরা অন্য একটা বাস্তবতা আমাদের সামনে নিয়ে আসে- এখানে অলৌকিকত্বের প্রদর্শনী মুখ্য বিষয় না- বরং বগনশানিক্রমিক পীরেরা এইসব মাজেজা দেখাতে ব্যর্থ অধিকাংশ সময়ই- তাই এই পীরভক্তি কিংবা টেকমোল্লার জন্মরহস্য খুঁজতে হবে আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় বৈদিক প্রভাব আর আমাদের ধর্মান্তরিত হয়ে নতুন ধর্ম গ্রহনের ইতিহাসের বিশ্লেষণে।

পারস্যের সমাজ ব্যবস্থাও বৈদিক চরিত্র ধারন করে- আধুনিক অবস্থা যে অনেক উন্নত তাও না- বরং সেখানে এখনও প্রভাবশালী রাষ্ট্র প্রধানকে নিজস্ব আচরণের জন্য সাফাই গাইতে হয়-

বৈদিক অবকাঠামোর একটা সীমাবদ্ধতা হলো এর বংশবিশুদ্ধতা- রক্তের বিশুদ্ধতা রক্ষার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা, একই কারণে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনে নানাবিধ বিধিনিষেধ বজায় রাখা- রক্তের শুদ্ধতা রক্ষার এই বাতিক বর্তমানে কমে আসলেও ৫০০ বছর আগেও এর ব্যপকতা ছিলো ভীষণ রকম।

বৈদিক অবকাঠামোর বর্ণবিচ্ছিন্নতা এবং বর্ণবিদ্বেষ উপমহাদেশ এবং ইরান উভয়স্থানেই সমান ভাবে ক্রিয়াশীল ছিলো- এটাকে এত গুরুত্ব দেওয়ার কারণ এর প্রভাবটাকে স্পষ্ট করে তোলা-

আমাদের বাংলাদেশর সামাজিক বিষয়গুলোতে, আমাদের বাংলাদেশি মুসলিমদের চেতনায় বৈদিক অবকাঠামোর প্রভাবটা সবসময়ই লক্ষ্যনীয়- বাঙ্গালী জাতি ধর্মনিরপেক্ষভাবে একটা ভাষিক জনগোষ্ঠি হয়ে উঠতে পেরেছে এর কারণটাও এর সুপ্রাচিন বৈদিক ঐতিহ্য-

জাতি শব্দটাকে স্পষ্ট করে তোলা দরকার- কোনো একটা নির্দিষ্ট ভৌগলিক অবস্থানে সাংস্কৃতিক এবং বাচনিক ঐক্য ধারণ করা সম্প্রদায় একটা জাতি- এখানে এই সাংস্কৃতিক এবং বাচনিক কিংবা ভাষিক ঐক্যটা গুরুত্বপূর্ণ- মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস কিংবা রাষ্ট্রীয় পরিচয়টা কোনো গুরুত্ববহন করে না।

বাংলাদেশের আদিবাসিদের বাদ দিলে অধিকাংশ মানুষই একই রকম সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার বহন করে- এবং তারা অদ্যাবধি একই ভাবে আদিবাসীদের অচ্ছুত করে রেখেছে- এই বিচ্ছিন্নতার কারণটাও বৈদিক সংস্কৃতিক অনুসরণ।

যখন আর্যরা উপমহাদেশে ক্ষমতাসীন হলো তখন এই আ্যদের প্রধান প্রতিপক্ষ ছিলো এখানকার আদিবাসীরা- এবং এদের নিজস্ব জাতিসত্ত্বা এবং এদের জাতিগত সংস্কৃতি অক্ষুন্ন রাখবার প্রচেষ্টার ভেতরেও একটা জাতীয়তাবাদের প্রভাব ছিলো। একই রকম ভাবে রামায়নে রাম রাবন যুদ্ধর ভেতরেও একটা জাতীয়তাবাদী চেতনা কার্যকর ছিলো- এবং একই সাথে মানবীয় অনুভুতি, মানুষের লোভ লালসা আর ক্ষমতালিপ্সুতার অনুভবগুলোও এখানে প্রচলিত ছিলো।

সভ্যতার ধারাবাহিকতায় আমরা বিভিন্ন ভাবে এই ক্ষমতালিপ্সুতার জন্য জাতিগত ঐতিহ্য ভূলুণ্ঠিত করে মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিয়ে অমানবিক আচরণের অনেক উদাহরন খুঁজে পাই- এই মোটা দাগের স্বার্থান্ধতা, গোত্রপ্রীতি, মানবীয় দুর্বলতাগুলো মানুষের অচেতন প্রবৃত্তির অনুসরণ।

আমাদের ভক্তিবাদ এবং যাবতীয় সমর্পনের জায়গাটাতেও এই অচেতন প্রবৃত্তির অনুগামীতা লক্ষনীয়- ভক্তিবাদ এবং সমর্পনের জায়গাটাতে প্রবৃত্তির অনুসরণ রোধ করতে প্রয়োজন সচেতন সক্রিয় প্রয়াস। ভক্তিবাদের সহচর হওয়াটা প্রবৃত্তির অনুসরন অধিকাংশ সময়ই- পীরের মুরিদ হয়ে যাওয়া কিংবা অতিরিক্ত ধার্মিকতা- সবটাই আপন প্রবৃত্তির বশে চলাচল।

এই প্রবৃত্তির সহগামীতায় একটা সচেতন অন্ধত্ব বিরাজ করে- আমার অনুসরণ করা মতবাদই সর্বশ্রেষ্ঠ এটা প্রমাণের বাসনা থাকা- একটিভিস্ট হয়ে ওঠা সবগুলোই একই রকম প্রবৃত্তির অনুসরণের ভিন্ন ভিন্ন মাত্রার পরিচায়ক।

ঘটনাটা সহজ ভাষায় বললে, যারা অসহায়ত্বকবলিত, যারা সংশয়ী, সীমাবদ্ধ বোধ করে তারাই তুমুল ভক্তিবাদী হয়ে উঠে- উগ্র জাতীয়তাবাদও একধরনের ভক্তিবাদ তবে আলোচনা এখানে ধর্মীয় ভক্তিবাদে সীমাবদ্ধ।

বাংলাদেশে কাবুল হয়ে মুসলিম আগ্রাসনের সময়কাল পুরোনো হলেও ইসলামের প্রসার সম্ভবপর হয়েছে বখতিয়ার খিলজির বাংলাদেশ দখলের পর- এই একটা অন্ধকার সময় কারণ এরপর থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত বাংলাদেশ মূলত অবাঙ্গালী শাসিত ছিলো।

বৌদ্ধ শ্রমণেরা সমতল বাংলায় নিষ্পেষিত জনগোষ্ঠি ছিলো, তারাই দলবেঁধে ইসলাম গ্রহনের পর বাংলাদেশের বৈদিক সামাজিক কাঠামো নতুন মুসিমদর হে প্রমাণিত করার জন্য এদের নেড়ে উপাধি দেয়- নেড়ে কিংবা নাড়িয়া আসে মুন্ডিত কেশ মানুষ- বৌদ্ধশ্রমণেরা নিজস্ব ধর্মের কারণের নিজেদের মাথার চুল ন্যাড়া করে রাখতো।

এরপর আরও কিছু অন্ত্যজ শ্রেনি ধর্মান্তরিত হলেও সমাজর মাঝের স্তর কিংবা উচ্চবর্ণের মানুষেরা খুব কমই ধর্মান্তরিত হয়েছে- বরং উচ্চ বর্ণের হিন্দুরা গণহারে ধর্মান্তরিত হয়েছে ১৯৭১এ প্রাণ বাঁচানোর তাড়নায়।

কেউ একজন বলেছিলো ইসলাম ইজ দি ফাস্টেস্ট গ্রোয়িং রিলিজন ইন দিস ওয়ার্ল্ড। ঘটনাটা সত্য , তবে এই সংখ্যাবৃদ্ধির কারণটা ধর্মান্তরিত হওয়ার কারণে না, বরং এই সংখ্যাবৃদ্ধি প্রজননের কারণে- বিশ্বে মুসলিমের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে কারণ মুসলিমরা কোনো রকম জন্মশাসন প্রক্রিয়ায় যাচ্ছে না- মুলত ইসলামের অনুসারী বাড়ছে হাসপাতালের লেবার রুমে-

যদি কোনো এক অভিশাপে মুসলিমদের প্রজনন ক্ষমতা লোপ পায় তবে এই ধর্ম ক্ষয়িষ্ণু একটা ধারা হয়ে যাবে- ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম হওয়া জনগোষ্ঠির তুলনায় বিশ্বে এখন ধর্ম উদাসীন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে বেশি। তেমন ভাবে প্রাক্টিসিং মুসলিম কেনো প্রাক্টিসিং ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা আসলে কমছে সময়ের সাথে।

ধর্মান্তরিত হয়ে যারা সমাজ অচ্ছুত না হয়ে থাকবার বাসনায় ধর্মান্তরিত হলো তারা একই রকম অন্ত্যজ থেকে গেলো বাংলাদেশে- এটা একটা দুঃখজনক বাস্তবতা।আশরাফী আর সিংহাসনের অধিকার পেয়ে যারা ক্ষমতাবান হয়ে উঠলো তারাই একই সামাজিক অবকাঠামোর জন্যই মুসলিম সমাজে আতরাফ বা অন্ত্যজ শ্রেনী গঠন করলো- এবং তারাই বললো আতরাফ কোনো ইমামের পেছনা দাড়িয়ে নামাজ পড়া যাবে না-

বংশাভিমানর সুন্নাহভিত্তিক প্রমাণ একটাই- আরবর জাতিগুলোর ভেতরে কুরাইশরা বংশগৌরবে শ্রেষ্ঠ= তবে বাংলাদেশের মুসলিমরা অর্থ সম্পদ বৃদ্ধির সাথে সাথে নিজেদের গাজী, শেখ থেকে নিজেদের সৈয়দ বংশের অন্তর্ভুক্ত করলো- সবই অর্থনৈতিক মারপ্যাঁচ।

আশরাফ আতরাফ বর্ণবিদ্বেষ এটার সাথে হিন্দু ধর্মের নিজস্ব স্থবিরতা কিংবা কঠোরতা অনেক কারণেই উচ্চ শ্রেনীর কতিপয় মানুষকে নিজেদের সমাজে অপাংক্তেয় করেছিলো- বিশেষত ক্ষমতালিপ্সু এই সব উচ্চবর্ণের হিন্দু মুসলিমদের সংস্পর্শে আসবার দরুন তারা হিন্দু সমাজে প্রবেশ করতে পারে নি- বাংলাদেশে ঠাকুর, মজুমদার, এসব হিন্দু উপাধি যুক্ত মুসলিমরা এই কারণেই মুসলিম সমাজের আশ্রয় গ্রহন করেছে- এবং এরা বংশগত ভাবে পতিত হয়েছে-

তবে গুরুভজনের প্রবণতা মরে যায় নি এদের হিন্দু থাকাকালীন সময়ে এরা বামুন পুরুতের হাতে ধর্মকে ন্যাস্ত করে দিয়ে আমোদে ছিলো- মুসলিম হয়ে উঠার পর সে সুযোগ নেই- তাই একই রকম প্রথার অনুসরণ করে তারা পরকাল এবং ধর্ম বিষয়ক কার্যাদি প্রতিপালনের জন্য পীর ফকিরদের আশ্রয় গ্রহন করলো-
বামুনদের যাজমান আর পীরদের মুরিদ বংশানুক্রম মেনে চলে- এটাও বৈদিক সংস্কৃতির অনুসরন-

বাংলাদেশী মুসলিমদের বৈদিক অনুশাসন মেনে চলবার অন্য একটা দৃষ্টান্ত হলো এদের পেশাভিত্তিক বংশ পদবি ব্যবহার- বাংলাদেশের কাজী বংশের মানুষেরা সবাই বিচারক নয়- তবে এদের বংশের কেউ কোনো এক সময় বিচারক ছিলো- একই ভাবে মুন্সি, মোল্লা , কানুনগে-সুবেদার, গোলন্দাজ, ব্যাপারী- আরও অনেক উপাধি আছে যা পুর্বপুরুষের গৃহীত পেশার পরিচায়ক, পাটোয়ারী বা পাটের কারবারী- এটা বংশপরিচয়- এবং এই বংশ পরিচয় নামের সাথে লেপ্টে দেওয়ার বিষয়টাও বৈদিক বংশবিশুদ্ধতা রক্ষার প্রচেষ্টার অনুসরণ।

বাংলাদেশি পীর ফকির বাড়ছে এবং অতীতেও এরা সবসময়ই বেশ সমৃদ্ধশালী ছিলো কারণ এই ব্যবসাটা ঝুঁকিবিহীন ব্যবসা, ভন্ড পীরদের উত্থান কিংবা ভন্গ সুফীদের উত্থানের সহায়ক ব্যবস্থা এখনও বিদ্যমান- একটা ধর্মীয় ভেক ধরলে এখনও অর্থ উপার্জনে সুবিধা হয়- প্রকৃত পীর এবং ভন্ডপীরের বাহ্যিক লেবাসে কোনো পার্থক্য করা সম্ভব না-

মূলত ১০০টা নির্বাচিত বানী মনে রাখলে বাংলাদেশে পীর বুজুর্গ সুফী কিংবা ফকির হিসেবে জমজমাট ব্যবসা করা যাবে- যাদের একটু উদভ্রান্ত দেখা যাবে এবং যারা কোনো ভেকধারী পীরের সামনে উপস্থিত হবে- তারা কোনো না কোনো ব্যক্তিগত সমস্যায় বিভ্রান্ত- তাদের জন্য অমোঘ বানী হলো- কিরে পারিবারিক অশান্তি? অর্থনৈতিক সমস্যা চলছে-

পীরগিরি করতে হলে ছেলে মাত্রকেই তুই বলা রপ্ত করতে হবে- সেটার বয়েস ৬৫ হোক আর ১৫ সবাই জাতি বর্ণ নির্বিশেষে তুই উপাধি পাওয়ার যোগ্য-

বামুন পূজা করে ঘর শুদ্ধ করতো আর পীর পানি পড়া দিয়ে তাবিজ দিয়ে ঘর বিশুদ্ধ করে তবে বাংলাদেশে যি মানসিক ও শাররীক চিকিৎসাসেবা সহজলভ্য এবং মানসম্মত হতো, যদি বাংলাদেশে নিয়মিত কাউন্সিলিংএর ব্যবস্থা থাকতো- যদি বাংলাদেশের মানুষ নিজস্ব মানসিক যন্ত্রনা লাঘবর ভিন্ন কোন ব্যবস্থা পেতো তবে আমরা অনকাংশই এই সব ভন্ড পীর আর সুফিদের উৎপাত থেকে রেহাই পেতাম
যদি ধর্মীয় লেবাস আমাদের ভেতরের প্রকৃত্তির ল্যাজটাকে লাড়াতে বাধ্য না করতো তাহলে আমরা টেকমোল্লা আর গুগলজ্ঞানীদের উৎপাত থেকে রেহাই পেতাম।


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।