প্রথম প্রথম যখন প্রেমের গল্প পড়ি, বয়স তখন ৬ কি ৭। মাথামুন্ডু তার কমই বুঝেছিলাম।
তবে ছেলে মেয়েতে যে রসায়ন ভিন্ন ধরনের তা বুঝতে বই পড়ার দরকার ছিল না। স্কুল ছিল সকল লিঙ্গের, সুতরাং বয়স কম থাকলেও ছেলে-ছেলে বা মেয়ে-মেয়ের রসায়নের চেয়ে ছেলে-মেয়ে রসায়ন ভিন্ন তা বুঝতে সময় লাগেনি।
প্রথম যখন প্রেমে পড়ি বয়স তখন ৭-৮। বিজ্ঞাপনের ললনার। “ জানো কি তুমি জানো কি, তুমি আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা।” লিপজেলের বিজ্ঞাপন সম্ভবত। সাথে শমী কায়সার আর গিলিয়ান এন্ডারসন ছিল।
যদিও তার একটু আগে থেকেই মামারা খেপাতো পিংকি নামক এক মেয়ের কারণে। বলে রাখা ভালো আমার বুঝ হবার আগের অংশ কেটেছে শান্তিনগর, পরের অংশ ধানমণ্ডি। ধানমণ্ডিতে আজ প্রায় ১৭ বছর। কিভাবে দিন কেটে যায়!
পিংকিতে ফেরত যাই। এখনো মামীরা বলেন ইতিহাস নাকি সাক্ষী(মামাদের কাছ থেকে শোনা কাহিনী আবার ইতিহাস!) আমি আর পিংকী জামাই আর বউ সেজে খেলতাম। মামারা এসব উস্কানির ফল সামনাসামনি সুদসহ পেয়েছেন, আফসোস এখন আমি কামড় দেই না আর নখও আমার তত বড় না, নাহলে মামীদের কি হত!
ইতিহাস সাক্ষী( এবার সত্যই), আমি কখনো কাউরে ছাড়ি নাই। যে যাবার সে আপনাতেই গেছে। প্রথম দু’জনের ক্ষেত্রে একটু টানাহেঁচড়া করবার চেষ্টা করেছিলাম, ফল ভাল হয় নাই। পরবর্তীকালে পুরোপুরি “ভাঙ্গা কাঁচ জোড়া লাগে না” এই তত্ত্বের অনুসারী হইছি। ধুমাইয়া প্রেম করছি।
কিন্তু সমস্যা এরপরও বিস্তৃত। ভাঙ্গা কাঁচ জোড়া না লাগলেও থেকে যায় এবং এর অস্তিত্বকে অস্বীকার করা যায় না।
মনটা এক অদ্ভূত নগর। এখানে পুরনো দালান ভাঙ্গে, ধ্বংসস্তূপ হয়। সেই ধ্বংসস্তূপ এক কোণায় রেখে আর এক নগর উঠে দাঁড়ায়। তবু সে থেকে যায়। সেই থেকে যাওয়া অংশ নিয়েই আমাদের কাহিনী।
২
হঠাৎ করেই ঘুম ভেঙ্গে যায়।
ঘুম ভাঙ্গার পর প্রথম কাজ হলো ঘড়ি দেখা। মোবাইলের ঘড়ি ঠিক নেই।ল্যাপটপটা চালুই ছিল। সময় ভোর ৫টা বেজে ৩২ মিনিট।
রাতে এত ক্লান্ত ছিলাম যে গোসল না করেই ঘুমিয়ে পড়ি। মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখি, একটা মিসকল আর একটা এসএমএস।কলটা বড় বোন করেছে। আর এসএমএস...কৈশোরের প্রেমিকা।
প্রথমও বলা যেতে পারে, পূর্ণাঙ্গ প্রেম ছিল। বিচ্ছেদও হয়েছিল। ৬ বছর কোন কথা পর্যন্ত হয়নি। এখন প্রায়ই কথা হয়। দেখা একেবারেই হয় না।
দেখা করতে চাই না যে তা নয়। কেন জানি দেখা করতে যাওয়ার কথা মনে উঠলেই মনে হয় দেখা হলে কি বলবো?স্বাভাবিক থাকতে পারবো তো? আবার মনে হয় হঠাৎ হঠাৎ জেগে ওঠা পুরনো অনুভূতিগুলো যদি পুরোপুরি বাঁধনছাড়া হয়।
যত সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে সে একলা থাকায়, মানে সে সিঙ্গেল। তার দোকলা থাকতে কি সমস্যা ছিল?
এসএমএস পড়ি আর মনে মনে চিন্তা করি। যাব দেখা করতে?এই সাত সকালে?
মেডিক্যালের ছাত্রী, ইন্টার্নিরত। এসএমএস পাঠাই। “এখন আসলে দেখা করতে পারবে?”জবাব মেলে সাথে সাথেই, “হুমম”।
আমি বিছানা থেকে উঠে পড়ি। হাতে সময় দেড় ঘণ্টার মত। সাড়ে সাতটার আগেই বাসায় ফিরতে হবে। পরনে যা ছিল তাই থাকলো। ট্রাউজার আর টি-শার্ট।
এখনও সকালের আলো ঠিক মত ফুটে উঠেনি। নামায পড়ে মুসল্লিরা ঘরে ফিরছেন। আমি সাইকেল নিয়ে রওনা হলাম।
বেশি দূর না, সকালে গান শুনতে শুনতে সাইকেল চালাতে খারাপ লাগে না। একটু ঠাণ্ডা পড়েছে। আর অনেকদিন পর এত সকালে সাইকেল নিয়ে।
নীলক্ষেতের সামনে এসে ফোন দিলাম ওকে। “কোথায় আসবো, কোন গেটে?”
“বকশিবাজারের দিকেরটায়।”
নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে চলে চাই মেডিক্যালের সামনে। এরপর কি মনে হল চলে গেলাম ইমার্জেন্সিতে। আবার ফোন দিলাম।
-আসছি, ইমার্জেন্সির সামনে।
-অতদূর কে যায়। বর্হিবিভাগের সামনে খারাও।
আমি আবার প্যাডেল চালাই। এতক্ষণ তেমন কিছু হচ্ছিল না মনে। এখন হঠাৎ করেই হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। নিজেকে বলি, “চিন্তিত বা আতংকিত হবার কিছু নাই।”
ইমার্জেন্সি থেকে আসার পথে দেখি লাইন ধরে গোটা পঞ্চাশেক অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়ানো। শীতাতপ, অশীতাতপ সকল ধরনের।
মন ভাবতে থাকে, একা একা কি বলবো। যখন প্রেম করতাম ( যদি সেটাকে প্রেম বলা যায়), তখন হাতটা ধরেছি একবার, তাও ২৯ সেকেন্ডের জন্য। খুব কম সময়ই আমরা একা একা থাকতাম। কম সময় বলাটাও ভুল। একেবারেই কখনো একা থাকিনি।
আমি বর্হিবিভাগের সামনে এসে আবার কল করি।
-আউটডোরের সামনে, কতক্ষণ লাগবে তোমার আসতে?
-একটু পরেই দেখতে পাবা।
একটু পরেই ওকে দেখতে পাই।
হাঁটা সেই আগের মতই, লেডী কিলার ভাব, ও ছেলে হলে যেকোন মেয়ে নির্ঘাত প্রেমে পড়ে যেত।
বাইরে আসে, চোখে ঘুম, কাজল দেয়া চোখ। আজও কাজল দিয়েছে!
-চা খাবা?
কথা শুরু হয় আবার। শেষ কবে আমরা এরকম একা ছিলাম মনে করার চেষ্টা করি। মনে করতে পারি না। আদৌ ছিলাম কখনো আমরা, একা?
দুটো চা, আর একটা বেনসন চাই মামার কাছ থেকে। চলতে থাকে নানান কথা।
চা খেয়ে হাটা দেই মেডিক্যালের ভিতরে। ও বলে ওঠে ওর ক্ষুধা লাগছে।
কলেজের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। ও গিয়ে রোগী দেখে আসে। দশ মিনিট, আবারো অপেক্ষা।
ও আসার পর আবার হাটা শুরু করি, গন্তব্য পলাশী। আমিই বলেছি, এই সময়ে পলাশীর মোড়ে কিছু না কিছু থাকবেই।
মেডিক্যাল থেকে বের হবার সময় ও হঠাৎ বলে ওঠে,
-আমরা বন্ধু থাকলে কত ভাল হতো! পাশাপাশি ছিলাম, ব্যাপক মজা করা যেত। তা না তুমি গ্যাঞ্জামগুলো বাধালা।
-আমি?খালি কি আমারি দোষ?আমি স্বীকার করি আমার দোষ ছিল কিন্তু আমার অবস্থাটা তখন চিন্তা কর।
চুপ থাকি কিছুক্ষণ দু’জন।
আবার শুরু হয় কথা। পরিবার, ভাই, বোন সবাইকে নিয়ে নানা কথা। আগের দিনের মত। সেই ২০০২ সালে বৃষ্টির দিনগুলোর কথা। মন খুলে কথা বলবার কথা।
পলাশীতে এসে দেখি সব বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। খাবার বিক্রি শেষ, মামারাও ঘুম দিতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। রাস্তার ও পাড়ে বাজারের কাছে গেলাম। গিয়ে দেখি, শুধু খিঁচুড়ি আছে।
অতঃপর এক প্লেট খিঁচুড়ি। ডাক্তারনী’র খিদা ভালই লাগছিল। হাত না ধুঁয়েই খাওয়া শুরু। ওকে অনেকক্ষণ দেখবার সুযোগ হল।
এভাবে দেখবার সুযোগ স্কুলেও পেতাম না। যদিও একসাথে ক্লাস করেছি দু’বছর। এখন অনেক অন্যরকম লাগছে। পরিণত, দুঃখী এবং বাস্তববাদী।
বাস্তববাদী ও আগেও ছিল। নিজেকে বলে উঠি।
খাওয়া শেষ হয়, আরও কয়েক মুহূর্ত ওর কাজল দেওয়া চোখজোড়া দেখি। সেই স্কুল জীবনে শেষ দেখা।
ও বিদায় জানায়। আমিও সাইকেলে উঠে পড়ি।
সকালের বাতাসটা অদ্ভূত। রোদটাও মিষ্টি।
অনেক বছর আগে এই মেয়ের নাম আমি দিয়েছিলাম রূপা। ওকে ডাকতামও তাই।
ভাঙ্গা কাঁচ জোড়া লাগাতে ইচ্ছা হয় অনেক। কিন্তু...
ভাঙ্গা কাঁচ আসলেই জোড়া লাগানো যায় না। রূপাদের কখনো দ্বিতীয়বার পাওয়া যায় না।
(চলবে)
মন্তব্য
ভাল্লাগতেছে।।। কৈশোরের প্রেম সে বড় মধুর। চলুক।
ভাল্লাগতেছে, কৈশোরের প্রেম সে বড় মধুর।
চলুক
-বেচারাথেরিয়াম
পলাশের দেখি লেজ নাই হয়ে গেছে, সচলাভিনন্দন
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
অলস সময়
চলুক
হিল্লোল
রূপাদের কখনো দ্বিতীয়বার পাওয়া যায় না।
ভালো লাগলো পলাশ দা। তাড়াতাড়ি বাকিটুকু পাঠান ।
অমি_বন্যা
চলুক প্রেমের গল্প
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
চলুক রুপাদের কাহিনি,তই চলাফেরা লেডিকিলার ভাব:-P
সাধু সাবধান
চলুক তবে কৈশোরের মিষ্টি প্রেম থেকে শুরু করেছেন তা যৌবনে গিয়ে চটকে দেবেন না, সেই আশাই করতে পারি। প্লেটোনিকই ভাল। (স্বপ্নীল সমন্যামবিউলিসট )
ভাল লাগছে। চলুক কাহিনী।।
যদি ভাব কিনছ আমায় ভুল ভেবেছ...
আপনি ব্যর্থ কেননা ভালবাসাকে শ্রদ্ধা করতে হয়,আপনার ভালবাসার প্রতি যদি শ্রদ্ধাবোধ থাকত তবে রূপা প্রতিনিধিত্ব করবে সেই রূপাদের যাদের ভালবাসার প্রতি শ্রদ্বাবোধ রয়েছে যাতে করে সেই রূপাদের আবার ফিরে পাওয়া যায় । ভালবাসতে জানেন কিন্তু মর্যাদা দিতে জানেন না !
নতুন মন্তব্য করুন