মলিনা বেগম স্বপ্ন দ্যাখে, আধখানা চাঁদ ঝুলে আছে পশ্চিম আকাশে। ক্ষীণ আলোর ধারা ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে। একটু ঘোলাটে ধরনের। এই ঘোলাটে ধরন একটা ভৌতিক আবহ এনে দিয়েছে। আর এমন সময় সে কী’না খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। পায়ের নিচে ধান কাটা ক্ষেত। মলিনা বেগমকে দেখে একটি ইঁদুর পালিয়ে যায়। দূরে কোথাও একটা পেঁচা ডেকে ওঠে। মলিনা বেগম আরো ভয় পান। বুকের ধুকপুকানি বাড়ে। খোলা মাঠটা তার চেনা নয়। আবার কেমন যেন চেনাও লাগে। বাড়ির পাশের সেই মাঠটার সাথে মিলাতে গিয়েও মিলাতে পারে না। মলিনা বেগম চারদিকে তাকিয়ে আমীর হামজাকে খোঁজে। কোথাও চোখে পড়ে না তাকে। মলিনা বেগম এবার জোরে আমীর হামজার নাম ধরে ডাকে। কোনো সাড়া পাওয়া যায় না। শুধু দূরে কোথাও একটা প্রতিধ্বনি উঠে মিলে যায়। ভয়টা এবার আরো বেশি করে ঝেঁকে বসে মলিনা বেগমের মনে। সে ভেবে পায় না, এমন রাতে কেন এখানে এলো। এটা ভাবতে ভাবতে তার মনে পড়ে, গেল রাতে আমীর হামজা রাগ করে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছে। রাতে আর ফেরেনি। সে রাত বারোটা পর্যন্ত ভাত বেড়ে অপেক্ষা করেছে। তাকে এভাবে অপেক্ষা করতে দেখে পাশের ঘরের আকলিমা মুখ ঝামটা দিয়ে গেছে। ‘নাগরের জন্য এতো দরদ কীসের’ সেটা নিয়াও খানিকক্ষণ তামাশা করেছে।
আকলিমা যাওয়ার পর মলিনা বেগম আরো অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছে। রোকসানার জামাই আব্দুলকে জিজ্ঞেস করেছে, আমীর হামজাকে দেখেছে কী’না? তারপর বাড়া ভাতে পানি ঢেলে শুয়ে পড়েছে। এটা-সেটা ভেবেছে। ভেবেছে আমীর হামজার রাগটা একটু কমানোর উপায় খুঁজে বের করতে হবে। নইলে রেগে গিয়ে কখন কোথায় কার সাথে কী করে বসে!
আসলেই আমীর হামজা একটু বেশিই রাগী। হঠাৎ করেই মাথা গরম হয়ে যায়। এ কারণে গত এক বছরে দুইটা গামেন্টস থেকে চাকরি গেছে। মলিনা বেগম এইসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে স্বপ্ন দেখে। আর ওদিকে আমীর হামজা লোকমানের সঙ্গে রুমকি বিল্ডার্স-এর একটি নির্মীয়মাণ ভবনের নিচতলার খুপরি ঘরে গভীর ঘুমে ঘুমাচ্ছে। সে জানে না তার জন্য কী কঠিন বিপদ ওৎ পেতে আছে। যখন পুব আকাশ অন্ধকার ফুঁড়ে হালকা ফরসায় রাঙিয়ে যাবে, বিপদটা তখনই ঝাঁপিয়ে পড়বে তার ওপর।
মলিনা বেগম ধড়ফড় করে বিছানায় ওঠে বসে। তার সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে। বিদ্যুৎ কখন গেছে টের পায়নি। মলিনা বেগম আমীর হামজাকে নিয়ে এই মোল্লাপাড়া বস্তিতে গত দেড় বছর ধরে আছে। ইতিমধ্যে সে পোয়াতি হয়েছে। বস্তির ভেতরের দিকে ঘর বলে বাতাসের কোনো বালাই নাই। মলিনা বেগম তাই শরীর থেকে ব্লাউজ খুলে ফেলে। বিছানা থেকে উঠে গিয়ে কলসি থেকে পানি ঢেলে খায়। একটু শান্তি লাগে তার। এমন সময় একটা কুকুর ডেকে ওঠে কাছেপিঠে কোথাও। ডাক নয়, যেন কান্নাকাতর মিনতি। ঘরের কোণে একটা টিকটিকিও টিক টিক বলে কুকুরের ডাককে যেন সমর্থন দেয়। মলিনা বেগমের মন আবার অজানা আশংকায় কেঁপে ওঠে। তিনি স্বপ্ন নিয়ে ভাবতে থাকেন। আধখানা চাঁদ নিয়ে ভাবতে থাকেন। তার মনে পড়ে ছোটবেলায় কার কাছে যেন শুনেছিলেন, পোয়াতি মেয়েরা এ রকম স্বপ্ন দেখলে অপঘাতে জামাই মারা যায়! আর পেটের ছেলে তার বাবার মুখ দেখতে পায় না! সে কথা মনে হতেই অন্ধকার ফুঁড়ে একটা ভয়ার্ত আর্তনাদ শোনা যায়। আমরা জানি, এই আর্তনাদ আমীর হামজার সোহাগী বউ মলিনা বেগমের। তবে এই চিৎকার রাতের দেয়াল ভেঙ্গে লোকমানের খুপরি ঘরে আমীর হামজার কাছে পৌঁছায় না।
লোকমান লোকটা একটু পাগলা টাইপের। এই আধ পাগলা ক্ষ্যাপাটে লোকটার সাথে আমীর হামজার কী করে যে খাতির হলো তা আমীর হামজা নিজেও ঠাহর করতে পারে না! লোকমান লোকজনের সাথে খারাপ আচরণ করলেও আমীর হামজাকে সে খুব পছন্দ করে। আর তাকে পেলে রাজ্যের গল্পের ঝাঁপি খুলে বসে। কালকেও গল্প করছিল। বলছিল, সপ্তাহখানেক আগে কুদ্দুসের লোকদের সাথে তার তর্ক-বিতর্কের ঘটনাটি।
লোকমান রুমকি বিল্ডার্স-এর বেতনভুক্ত দারোয়ান কাম কেয়ারটেকার। মিরপুর দুই নম্বর থানার পেছনে রুমকি অ্যাপার্টমেন্ট বলে যে ছয়তলা ভবনটি নির্মাণ হচ্ছে, সেখানে এসে একদিন কুদ্দুসের লোকেরা বিশ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। তারা এসে মালিককে না পেয়ে লোকমানকেই সময় বেঁধে দেয়। লোকমান আধ পাগলা লোক। কুদ্দুসের লোকদের উল্টো শাসায়, “একটাকাও দিমু না। কী বাল ফালাইবেন, ফালাইয়েন।” লোকমানের কথা শুনে একজন চাপাতি বের করে। দলের নেতা গোছের ছেলেটি তাকে থামায়। লোকমানের চোখে চোখ রেখে বলে, “এক সপ্তাহ সময়।” আমীর হামজা শুয়ে শুয়ে লোকমানের মুখে এসব কথা শুনে ভয় পায়। আর মনে মনে হিসেব করে এক সপ্তাহ আবার আজকে না তো! এইসব সাত-পাঁচ ভেবে ঘুমে স্বপ্নে দেখে তার বউ মলিনা কাঁদছে।
আমীর হামজা ঘুম ভেঙ্গে দেখে, মাস্টার বাড়ির পাশ ঘেঁষে এক খণ্ড পুব আকাশ ফরসা রূপ মেলে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আরো দেখে লোকমান দূরে দাঁড়িয়ে দাঁত মাজছে। লোকমান দাঁত মাজা শেষে ট্যাপ ছেড়ে হাতমুখ ধোয়। এরপর হাতমুখ মুছে আমীর হামজার জন্য নাস্তা আনতে যায়। আমীর হামজা শুয়ে শুয়ে আলস্য কাটায়। আর সকালবেলা পুব আকাশ কেমন করে ফরসা হয়, তাই দেখে। দেখতে দেখতে বউ মলিনার কথা মনে পড়ে। বউ না জানি, কত দুশ্চিন্তা নিয়ে রাত পার করেছে। এইভাবে ঝগড়া করে বাড়ি ফিরে না যাওয়াটা তার ঠিক হয়নি। আর মলিনা এখন পোয়াতি। এ সময়ে তাকে কষ্ট দেয়া ঠিক না। আমীর হামজা মাথা নাড়ে। মাথা নাড়তে নাড়তে দেখে, চট দিয়ে ঢাকা দরজার ওপাশটা দুলে উঠলো। চারজন যুবক ঘরের ভেতরে ঢোকে। আর সকালবেলা আশেপাশের বাসাবাড়ির লোকজন শুধু শোনে, “আমারে বাঁচান, আমারে মাইরা ফালাইলো।” অবশ্য কেউ-ই আমীর হামজাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসে না। কারণ তারা জানে আমীর হামজার তীক্ষ্ণ চিৎকারের চেয়ে চাপাতির তীক্ষ্ণতা বেশি! তারা শুধু ঘটনা পরবর্তী কিছু দৃশ্যের জন্ম হতে দেখে!
মন্তব্য
গল্পের শেষটা, গল্পের মাঝখানেই দিয়ে দিছেন মনে হলো।
_____________________________________________
তুমি হতে পারো একটি স্বার্থক বিষাদের সংজ্ঞা। স্বার্থক নদী, স্বার্থক ক্লান্তি অথবা স্বার্থক স্বপ্ন।
____________________________________________________________________
"জীবনের বিবিধ অত্যাশ্চর্য সফলতার উত্তেজনা
অন্য সবাই বহন করে করুক;
আমি প্রয়োজন বোধ করি না :
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ হয়তো
এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।"
সত্যিই আশে পাশে কেবলই নতুন নতুন দৃশ্যের জন্ম হচ্ছে আর আমরা বোধহীন দর্শক
হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখছি। আবার কখনো কখনো নিলজ্জের মতো তা উপভোগও করছি। মলিনার
জন্য খারাপ লাগছে........
লেখা ভালো হয়েছে বালক
........................................................................................................
সব মানুষ নিজের জন্য বাঁচেনা
........................................................................................................
সব মানুষ নিজের জন্য বাঁচেনা
বার বার মলিনা বেগম মলিনা বেগম শুনতে খারাপ লাগে, এই যেমন প্রথম প্যারায় পাঁচ বার
.........................................
I think what I think because that's how I am. You think what you think because that's how you are.
...........................
Every Picture Tells a Story
আগাম সব কিছু বলে দিলে কেমনে হয়?
পরের দৃশ্যটাই বেশি বর্ণনার ছিলো...
তবুও আপনার গল্প ধরতে পেরেছি।
______________________________________________________
মধ্যরাতের কী-বোর্ড চালক
পান্থ, মনে হয় শেষে কি হবে তা আর একটু গোপনীয় রেখে দিলে আরো বেশী ভালো হতো। সব মিলিয়ে ভালো লাগছে।
_______________________________
শান্তিও যদি সিংহের মত গর্জায়, তাকে ডরাই।
--নরেশ গুহ
----------------------------------------------
We all have reason
for moving
I move
to keep things whole.
-Mark Strand
পান্থ
এতো সাদামাটা গল্প আপনাকে মানায়না।
আর অযত্ন করেছেন অনেক।
মলিনা বেগমকে একবার 'সে' আরেকবার 'তিনি' সম্বোধন করেছেন।
আমাদের পান্থ এর থেকে অনেক ভালো গল্প লিখতে পারে
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
প্লট ভালো।
ঘটনা বর্ণনায়, চরিত্র সম্বোধনে খানিকটা যত্নশীল হলে ভালো হয়
-----------------------------------------------------------
জানতে হলে পথেই এসো, গৃহী হয়ে কে কবে কি পেয়েছে বলো....
-----------------------------------------------------------------------------------------------------
" ছেলেবেলা থেকেই আমি নিজেকে শুধু নষ্ট হতে দিয়েছি, ভেসে যেতে দিয়েছি, উড়িয়ে-পুড়িয়ে দিতে চেয়েছি নিজেকে। দ্বিধা আর শঙ্কা, এই নিয়েই আমি এক বিতিকিচ্ছিরি
ভালো লাগলো পান্থ!!!!
আমি অতিথি তোমার দেশে.....
আমি অতিথি তোমার দেশে.....
ভাল লাগলো
ভালো লেগেছে, শেষ ঘটনা অনুমান করে গেছে, তবে টুইস্ট রাখতে পারতেন, আপনার লেখা, কাজেই কি করবেন সেটা আপনার ব্যাপার। আমি পড়ে শেষ করে মনে করেছিলাম টুইস্ট মিস করেছি।
=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদ্বপি গরীয়সী
=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী
নতুন মন্তব্য করুন