জেমস জয়েসের প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘ডাবলিনার্স’। ১৯০৬ সালে বইটি প্রকাশকের কাছে পাঠালে প্রকাশক তা ফেরত পাঠিয়ে দেন। প্রকাশকের অভিযোগ, বইটি একই সঙ্গে অশ্লীল ও অশোভন ভাষা ব্যবহারে দুষ্ট। এর মাঝে আরো তিনবছর যায়। এ সময়ে প্রকাশক থেকে প্রকাশকের দপ্তরে ঘুরে বেড়ায় ‘ডাবলিনার্স’-এর পাণ্ডুলিপি। একদিন এক প্রকাশক উদ্যোগী হন। বইটি ছাপিয়ে ফেলেন। কিন্তু পরেই আবার তা নষ্ট করেন। কারণ, ওই একই অভিযোগ। পরে অবশ্য, এই প্রকাশকই বইটি বের করেন। তাও বেশ পরে। ১৯১৪ সালে। বেচারা জেমস জয়েস। পরে খ্যাতি পেলেও প্রথম বই বের করতে কি নাকাল-ই না হতে হয়েছিল।
এমন বেদনা আছে নব্বইয়ের গল্পকার প্রশান্ত মৃধা’র। গেল বইমেলায় শুদ্ধস্বর থেকে প্রকাশিত সন্ন্যাসের সহচর বইতে প্রথম বই প্রকাশ নিয়ে বলেছেন সে কথা। সুশান্ত মজুমদারের পরামর্শে পাণ্ডুলিপি নিয়ে যান মাওলা ব্রাদার্স-এ। বেশ কিছুদিন পরে থাকে সেটা। একদিন খোঁজ নিতে যান, কি হলো জানতে। প্রকাশক তাকে চা-টা খাওয়ান। মিষ্টি মিষ্টি কথা বলেন। লেখকের কাছে জানতে চান, কেন এই বই প্রকাশ করা উচিত। লেখক যথাসাধ্য উত্তর দিয়েছিলেন সেদিন। কিন্তু একজন লেখকের সে উত্তর মন:পুত হয়নি। উল্টো লেখককে দু’চার কথা শুনিয়ে দিয়েছিলেন। প্রশান্ত মৃধা’র বই বের হয়েছিল সেবার, তবে তা অন্য আরেকটি প্রকাশনী থেকে।
গেল বইমেলায় প্রায় ৩ হাজারের মতো বই বেরিয়ে ছিল। এদের ভিতরে অনেকের হয়তো প্রথম বই ছিল। ঠিক কতজনের প্রথম বই প্রকাশে এরকম হয়েছিল তা কে জানে! তবে, আমি বোধহয় একটু ভাগ্যবানই। গেল বইমেলায় প্রথম বই কোনো ঝামেলা-বিপত্তি ছাড়াই বেরিয়ে যায়। প্রকাশক ছিলেন আমার এক কলিগের দুলাভাই। উনার সাথেই একদিন প্রকাশকের বাসায় যাই। পাণ্ডুলিপি দিয়ে আসি। এক সপ্তাহ পরে তিনি জানান, বই বের করবেন। প্রচ্ছদ ও অলংকরণ করে দেন সেই কলিগ। মেলার প্রথম সপ্তাহেই বই স্টলে আসে। এবারো বেরিয়ে গেছে একটা। আরো একটা আসছে। ছোটদের ইতিহাস বই। ছোটদের বইপত্তরের প্রজেক্টের আওতায় বের করছে শুদ্ধস্বর। একদিন শুদ্ধস্বরের টুটুল ভাই ফোন দিয়ে বই লিখে দিতে বললেন। ব্লগে শখের লেখালিখি আমার। তার কাছে কি না প্রকাশক বই চাইছে। কোনো কিছু না ভেবেই রাজি হয়ে যাই তাড়াতাড়ি। আমি লেখা দিয়েই খালাস। বই প্রকাশে প্রকাশকের সহযোগী কবি পিয়াস মজিদ খাটাখাটুনি দেন। আমি বইমেলায় গিয়ে নতুন বইয়ের ঘ্রাণ নিই। আনাড়ি অটোগ্রাফ দিই। এর মাঝেই রণদা’র মৃদু বকা খাই! ওই বই নিয়েই_ আর কি করা উচিত ছিল।
বই নিয়ে আসলে খুঁতখুঁতানি বোধহয় শেষ পর্যন্ত যায় না। বইমেলায় ঘুরতে ঘুরতেই লীলেন ভাই জানান, তার সাকিন সুন্দরবন এখনো প্রকাশকের দপ্তরে জমা দিতে পারেন নি। এ পর্যন্ত আটবার রিরাইট করেছেন। এখনো তৃপ্ত নন। ফর্ম ভাঙ্গছেন আর গড়ছেন। লেখকের এত এত চেষ্টা আর আন্তরিকতার পরেও বই-এ ভুল থেকে যায়। নিজের বইয়ের এমন ভুল থাকার কথা শুনে আঁতকে উঠলেন গল্পকার আহমাদ মোস্তফা কামাল। আমি তার গদ্যের বেশ ভক্ত। বইমেলায় ঘুরতে ঘুরতে অ্যার্ডন -এর স্টলে পেয়ে যাই তার গদ্যগ্রন্থ শিল্পীর দায় শিল্পের শক্তি বইটি। পাতা উল্টাতে উল্টাতে দেখি ২৮-৩২ পৃষ্ঠা গায়েব। তার আগের একটা বই কিনেও ধরা খেয়েছিলাম। আজিজ সুপার মার্কেটের বিদিতা থেকে তার সংশয়ীদের ঈশ্বর বইটা কিনে আনি। কেনার সময় পাতা উল্টে দেখিনি। বাসায় এনে দেখি মলাট সংশয়ীদের ঈশ্বর হলেও ভেতরে ইকবাল আজিজের এক অমানুষের ছায়া উপন্যাসটি। কাকতালীয় ভাবে দুটি বই-ই প্রকাশিত হয়েছে অ্যার্ডন থেকে। বই প্রকাশের বসন্তকাল ফেব্রুয়ারি মাস। সৃজনশীল বইয়ের সিংহভাগই প্রকাশ হয় এই মাসে। তখন বই প্রকাশে এত তাড়া লেগে যায় যে, এইসব ভুল থাকা খুবই স্বাভাবিক। যতদিন না এই বসন্তকাল থেকে বের হতে না পারছি, ততদিন এ ধরনের ভুল হতে থাকবে। তাই, ফেব্রুয়ারিতে বই প্রকাশের স্রোতের বিপরীতে হাঁটা জরুরি।
মূলধারার সাহিত্য স্রোতের বিপরীতে হাঁটার দাবী করে থাকে লিটলম্যাগ। দাবীদার বললাম বটে, এ বিষয়ে কোনো যুক্তি আমার কাছে নেই। তবে, এবারের বইমেলায় লিটলম্যাগ চত্বর দেখে মনে হলো, কেমন যেন মিইয়ে পরা। লিটলম্যাগকর্মীরা আর আগের মতো সেখানে আড্ডায় মাতেন না বুঝি। মেলা উপলক্ষে নতুন প্রকাশিত সংখ্যাও দেখলাম না খুব একটা। পুরোনোগুলো নিয়েই বসেছেন। কিছু কিছু লিটলম্যাগ ও লিটলম্যাগকর্মীদের বই দেখলাম প্রায়ই সব স্টলেই রাখা। ব্যাপারটা আমার কাছে একটু পীড়াদায়ক লাগলো। একই জিনিস বিভিন্ন স্টলে দেখতে নিশ্চয় কেউ আশা করবে না। সাদ কামালীর গল্পপ্রবন্ধ বইটি কিনতে কিনতে এ নিয়ে শালুক সম্পাদক কবি ওবায়েদ আকাশকে বললামও! কই, দু’তিনটা স্টলে মাত্র! ওবায়েদ আকাশের সাথে ব্যক্তিগতভাবে পরিচয় না থাকায় আর কথা এগোয় না। উনিও পাশের জনের সাথে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
তবে লিটলম্যাগ আন্দোলনের আগের শক্তি আর নেই। লেখালিখির মাধ্যম হিসেবে ‘ওয়েব’ আবির্ভূত হওয়ায়, এমনটা হয়েছে বলে প্রতীয়মান। 'ওয়েবে' লেখা প্রকাশের তুমুল স্বাধীনতা যা তাকে লিটলম্যাগেরই আস্বাদ দিচ্ছে। একই সাথে পাঠকের সঙ্গে থাকছে ইন্টারঅ্যাকশনের সুযোগ। আর তাই লিটলম্যাগ চত্বরে জায়গা করে নিচ্ছে বিভিন্ন ব্লগমাধ্যমের লেখকরা। তারা নিয়মিত বইমেলায় আসছেন। আড্ডা দিচ্ছেন। তাছাড়া পাঠকদের সাথে মিথস্ত্রিয়ার সুযোগ থাকায় ব্লগের লেখকদের এক ধরনের যোগাযোগ ও পাঠকপ্রিয়তাও তৈরি হয়েছে। এতে করে যেসব ব্লগ লেখকের বই বের হচ্ছে, তাদের বইয়ের কাটতি বাড়ছে। প্রকাশকরাও তাদের বই প্রকাশে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। আমরা যারা ব্লগে লেখালিখি করি, এটা তাদের জন্য শুভ সংকেত। এখন এই সুযোগটা কিভাবে আরো ভালোভাবে কাজে লাগালো যায়, প্রকাশকদের সাথে যোগাযোগ বাড়ানো যায়, তা নিয়ে খানিকটা আলোচনা হওয়া দরকার।
মন্তব্য
সচল লেখকদের প্রথম প্রকাশনার ব্যাপারে জানতে চাই আরো। কোন ব-e কি আছে? অথবা কোন প্রাসঙ্গিক পোস্ট?
------------------------
[ওয়েবসাইট] [ফেইসবুক] [ফ্লিকার ]
কোনো ব-e নাই। তবে গেলবার কেউ কেউ পোস্ট দিয়েছিলেন নিজের বই নিয়ে। সেগুলোর লিংক খুঁজে বের করতে হবে!
কেমন জানি লেখাটা ঠাস করে শেষ হয়ে গেল মনে হল পান্থ'দা। আরাম করে পড়ছিলাম অথচ...
আরেক পর্বে আরো খানিকটা লেখেন
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
বেশ লাগল পড়তে। তবে আমারও মত রতন্দার মতনই। এটা নিয়ে আরো লেখেন।
জেমস জয়েস-প্রশান্ত মৃধা’র কথা পড়ে একটা কথা মনে পড়ে গেলো - লেখকদের জীবন ফুলশয্যা দিয়ে শুরু হয় না ।
লেখাটা পড়তে বেশ ভালো লাগল ।
লেখাটা এভাবে ধাম করে শেষ হয়ে গেল?
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
@রানাপু, কৌস্তভ দা, সংগীত
হুম, লেখাটা হুট করেই শেষ হয়ে গেল। আর কি লেখা যায়, ভেবে পাচ্ছিলাম না।
আরো লিখুন না, অন্তত সপ্তাহে দুই কিস্তি!
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
ভুল থাকা হয়তো স্বাভাবিক, তবে এটা প্রত্যাশিত নয়। বইমেলায় প্রকাশিত বইয়ের চুড়ান্ত পান্ডুলিপি প্রদানে লেখকদের সচেতনতা, প্রকাশকের কাজ বইমেলার আগে আগে শেষ করার চেষ্টা এই দু'টো একত্র হলে আমরা হয়তো আরো ভালো কিছুকে স্বাভাবিক বলতে পারবো।
পুরনো লিটলম্যাগাজিনের লোকেরা আসলে পাঠকের সাথে ইন্ট্যারাকশন করেন খুব একটা এরকম আমার মনে হয় না। নিজেদের স্তুতির দিকটাই পছন্দ করে বলে হয়েছে। এটা অবশ্যই মোটাদাগের অবজার্ভেশন এটা বলে নিচ্ছি।
নতুন জেনারেশন লিটল ম্যাগের দিকে না গিয়ে ব্লগ বা ওয়েবের দিকে ঝুকছে এটা সত্য। আর দশ বছর পরে হয়তো ছাপা কাগজে লিটল ম্যাগ দেখাই যাবে না।
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
একমত!
সিটি'র ভেতরে এক নির্জন গলিতে একটা আইরিশ বার আছে। নাম জেমস জয়েস। কখনো যাওয়া হয় নাই যথোপযুক্ত সঙ্গীর অভাবে। ভাবতেছি, আর নয় অপেক্ষা। ঢুঁ মারবোই এবার সুযোগ করে।
আচ্ছা, এইটা কেনো বললাম?
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
যখুন আপনাগো শহরে ছিলুম তখন এক মার্কিন(মূলে আইরিশ)দিদি ওই বারে নিয়া গেসিল। মন্দ না। ঘুইরা আসেন।
ধূগোদা, জয়েসীয় ঘোর হইতে পারে!
বস, সঙ্গী হিসেবে জয়েসের 'দ্য ডেড' গল্পের গ্যাবিয়েলের বউ গ্রেটাকে নিয়ে যান। তুষারপাতের ঝিমমারা সন্ধ্যাটা মন্দ কাটবে না!
পান্থ... এটার আরেক খণ্ড লেখেন... সেখানে আলাপ করুমনে
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
এইটার খণ্ড হবে না। আরেকখন অখণ্ড হতে পারে!
এবার লেখা কই পান্থদা?
আপনার বইয়ের নামধাম কিছু বললেন না যে...
-------------------------------------------------
ক্লাশভর্তি উজ্জ্বল সন্তান, ওরা জুড়ে দেবে ফুলস্কেফ সমস্ত কাগজ !
আমি বাজে ছেলে, আমি লাষ্ট বেঞ্চি, আমি পারবো না !
আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
নতুন মন্তব্য করুন