জীবনানন্দ দাশের প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ‘মাল্যবান’। উপন্যাসের নায়িকা উৎপলা। আর নায়ক মাল্যবান। উপন্যাসে মাল্যবান উৎপলা সম্পর্কে কিছু মন্তব্য করেছে। সেই মন্তব্যে একটু নজর বুলিয়ে নিই-
‘মরা নদীর বালির চেয়েও বেশি বিরসতায়’
‘একটা অদ্ভুত নিরেট নিগ্রহময়তায়’
উৎপলা ‘জলভারানত নীল মেঘ নয়-সাদা কড়কড়ে মেঘ-দূরতম আকাশের’
‘ভাল বংশের সুন্দর শরীরের নিচু কাণ্ডজ্ঞানের নিরেস মেয়েমানুষ’
‘চেহারা যদি কাল, খারাপ হত, তা হলে তো চামারের মেয়েরও অযোগ্য হত’
উপন্যাসজুড়ে এরকম মন্তব্য আরো আছে। যেমন উপন্যাসে বেশ কয়বার উৎপলাকে ‘শঙ্খিনী’ মানে সাপ বলা হয়েছে।
‘মাল্যবান’ উপন্যাস তল্লাশি করে এগুলো তুলে আনা আসোলে উৎপলা আর মাল্যবান, যারা আসলে স্বামী-স্ত্রী তাদের দাম্পত্য জীবনকে দেখতে। উপরে উৎপলা সম্পর্কে মাল্যবানের মন্তব্যগুলো পড়লে বোঝা যায় কেমন ছিল তাদের দাম্পত্য সম্পর্ক। আচ্ছা, উপন্যাস থেকে আরো একটু তুলে এনে স্পষ্ট করি ব্যাপারটা। যেমন একদিন রাতে কি হয়েছে, মাল্যবান এসেছে উৎপলার শোবার ঘরে, এসে সোফায় বসে অপেক্ষা করছে। বাইরে হিম শীতের রাত। তবুও সে এসেছে শরীরের টানে, একটু উষ্ণ হতে। উৎপলা তাকে তাড়িয়ে দিতে দিতে বলছে: ‘আ, গেল যা! বসলে! রাত দুপুরে ন্যাকড়া করতে এল গায়েন। হাত পা পেটে সেঁধিয়ে কম্বল জড়িয়ে এ কোন বলির কুমড়ো সেজে বসেছে দেখ।... বেরোও! বেরোও বলছি!’
অনেকেই বলে থাকেন ‘মাল্যবান’ আর কেউ নন, স্বয়ং জীবনানন্দ দাশ! আর এই উপন্যাসটি একটি আত্মজৈবনিক উপন্যাস। যারা তার দিনলিপি পড়েছেন, তারা আরো বেশি করে মানেন এ কথা। জীবনানন্দের মৃত্যুর পর তার প্রকাশিত লেখাগুলো যখন প্রকাশ পাচ্ছিল কবিপত্নী লাবণ্য দাশ ‘মাল্যবান’ প্রকাশ করতে চান নি। কবি শঙ্খ ঘোষ একবার জীবনানন্দ দাশের রচনাসমগ্র সম্পাদনার দায়িত্ব পেয়েছিলেন। তখন তিনি রচনার পাণ্ডুলিপি দেখতে চান। লাবণ্য দাশ জানান, ‘মাল্যবান’ উপন্যাসটি দেখাও যাবে না, ছাপাও যাবে না। এ ঘটনাটির কথা জানা যায়, জীবনানন্দ বিষয়ক গবেষক ভূমেন্দ্র গুহর একটি লেখা থেকে। এ ঘটনাও খানিকটা আভাস দেয়, ‘মাল্যবান’ আসোলোই জীবনানন্দ দাশেরই জীবনচিত্র হবে হয়তো! লাবণ্য দাশ চান নি তাদের দাম্পত্যের প্রতিচিত্র সবাই দেখুক। আবার জীবনানন্দ দাশ নিজেও উপন্যাসটি নিজ নামে প্রকাশ করতে চান নি। পূর্বাশা সম্পাদক সঞ্চয় ভট্টাচার্যকে লেখা একটি চিঠি থেকে সে ঘটনা জানা যায়। চিঠিতে তিনি লিখেছেন, ‘আমার একটা উপন্যাস (আমার নিজের নামে নয়- ছদ্মনামে) পূর্বাশায় ছাপাতে পারেন।’ ধারণা করা হয়, তিনি ‘মাল্যবান’ উপন্যাস নিয়েই এ কথা বলেছিলেন।
জীবনানন্দ গবেষক ক্লিন্টন বুথ সিলি জীবনানন্দের সাহিত্যিক জীবনীগ্রন্থ ‘অ্যা পোয়েট অ্যাপার্ট’-এ জীবনানন্দের দাম্পত্য জীবনের সাথে শুধু ‘মাল্যবান’ উপন্যাসের মিল খুঁজে বের করেন নি, তিনি চরিত্র, পদবির নামগুলোর মিলও খুঁজে পেয়েছেন। এসব মিলিয়ে ‘মাল্যবান’কে জীবনানন্দ দাশের দাম্পত্য জীবনের প্রতিচ্ছবিও বলা যায়।
যারা জীবনানন্দের লেখা পড়েছেন, তারা জীবনানন্দ দাশের এই জীবনের সাথে ভালোভাবেই পরিচিত। যদিও এই দাম্পত্য ছবি আমাদের আসোলে জীবনানন্দ দাশের চোখ দিয়েই দেখা। কিন্তু জীবনসঙ্গী লাবণ্য দাশ সেই দাম্পত্য জীবনকে কীভাবে দেখেছেন, ভেবেছিলাম সেটা জানার সুযোগ হবে ‘মানুষ জীবনানন্দ’ পড়ে। বইটির প্রথম বাংলাদেশ সংস্করণ বের হয়েছে এবারের বইমেলায়। বইটি বইমেলাতেই কেনা হয়েছিল। কিন্তু পড়া হয়ে উঠলো এতোদিনে। কিন্তু হায়, আমরা যে জীবনানন্দকে জানি- দাম্পত্যের অপ্রেমে, তার ছিঁটেফোঁটা দেখা নেই এই বইটিতে। হ্যাঁ, বাবা হিসেবে, স্বামী হিসেবে, শিক্ষক হিসেবে, লেখক হিসেবে জীবনানন্দ দাশ কেমন ছিলেন তার অনেককিছুই জানা যায়। জানা যায়, নারীদের এগিয়ে যাওয়া নিয়ে তার চিন্তার রেশটুকুও (এটা আমার কাছে নতুন লেগেছে। কারণ, জীবনানন্দ বিষয়ক যতগুলি আলোচনা দেখেছি, কোথাও এই বিষয়টির উল্লেখ দেখিনি।)। কিন্তু তার লেখালিখিতে, তার কবিতায় দাম্পত্য জীবনের যে ছবি আমরা দেখি, সেই ছবি লাবণ্য দাশের ‘মানুষ জীবনানন্দ’-তে অনেকটাই অনুপস্থিত। জীবনানন্দ দাশকে জানতে গিয়ে এই অনুপস্থিতিটুকু অতৃপ্তি দিয়েছে।
মন্তব্য
বস তৃষ্ণা ঠিক মিটল না।
আরো জানতে ইচ্ছে করছে এই নিয়ে।
দেখা যাক অন্যেরা কে কী বলেন।
এই লোকটাকে জানার খুব আগ্রহ আমার। অতলস্পর্শী বিষাদ আর আপাদমস্তক মৃত্যুময়তায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকা কবিতাগুলোর লেখক যাপিত জীবনে কতটুকু এইসবের প্রতিনিধিত্ব করেছেন--জানার খুউব ইচ্ছা।
লেখাটা বরাবরের মতই সুখপাঠ্য।
শুভেচ্ছা নিরন্তর।
বস, সেইটা জানতেই তো বইটা পড়তে গেছিলাম। কিন্তু সেটা না পেয়ে যে হতাশা, তাই নিয়েই চটজদলি এই লেখা!
এত অল্পতেই শেষ!!!
যাক, তবুও তো কিছু লিখলেন।।।
হ!
তৃষ্ণা জাগাইলেন, পানিও দেখাইলেন কিন্তু পুরাপুরি খাইতে দিলেন না। এই বিষয়ে অবশ্যই আরও বড় পরিসরে লেখা আশা করছি আপনার কাছে থেকে। পোস্টে
হিল্লোল
হিল্লোলদা, চেষ্টা করবো!
অনেকদিন পর তোর লেখা পড়লাম।
লিখলাম তো অনেকদিন পর।
কেমন আছেন আপনি?
পোস্ট পড়ে পড়ার তৃষ্ণা মিটলো না।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
আহারে!
তিথী কেন তিথিডোরে বাঁধা রে!
ভালো লাগল, কিন্তু কলেবরে আরো বড় হলে বেশী ভাল লাগত, কেমন যেন উপভোগের আগেই শেষ হয়ে গেল !
facebook
সত্যিকারের অতৃপ্তি যারে বলে। আর বড় লেখা চাই জীবনানন্দ সম্পর্কে । ভালো লেগেছে অনেক।
জীবনানন্দের যে কোন লেখা খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ি, হয়তো প্রিয় কবি বলেই। এবার যেমন গল্প সমগ্র পড়লাম। হয়তো কবিতার নিরিখেই গল্পগুলোর শক্তিমত্তা মাপতে যাই বলেই হতাশ হই। যাহোক, আপনার লেখাটা বইটা পড়ার জন্য উৎসাহ জাগালো।
বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।
"মানুষ জীবনানন্দ"তেই আর কী পড়লেন- সেইগুলো লেখেন না । মনে হচ্ছে কিছুই পড়লাম না...
ভালো লিখেছেন। যদিও আমি বুঝতে পারিনি লেখার মূল উদ্দেশ্য কি ছিল। বইটির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া, নাকি জীবনানন্দের জীবন সম্পর্কে কোন অংশ বলা নাকি মাল্যবান উপন্যাসটি নিয়ে বলা। লেখার আসল উদ্দেশ্যটাই ধোঁয়াটে লাগছে।
শুধু জীবনানন্দ দাশই নয় লাবণ্য দাশের জীবন সম্পর্কে জানতে হলেও ভূমেন্দ্র গুহ পড়তে হবে।
জীবনানন্দ দাশের আম-জীবনীকারেরা লাবণ্য দাশকে villain বানানোর যে চেষ্টা করে থাকেন তার বিপরীতে লাবণ্য দাশ বোধকরি একটা wishful past নির্মাণ করতে চেয়েছেন। এরচেয়ে তিনি নিজের অবস্থানের যৌক্তিকতা তুলে ধরতে পারতেন। জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যকীর্তিকে দূরে সরিয়ে রেখে একজন সংসারী মানুষ হিসেবে তাঁর আচরণকে বিচার করলে লাবণ্য দাশের জীবনের যাতনা-বঞ্চনাগুলো যে কোন সংবেদনশীল মানুষের চোখে পড়বে। কিন্তু জাতিগতভাবে আমরা তো পৌত্তলিকভাবনার মানুষ তাই জীবিত বা মৃত ঈশ্বরদেরকে আমরা ঐশ্বরিক মহিমার ফ্রেমেই আবদ্ধ রাখতে চাই।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
আমার মতে জীবনানন্দকে কম জানাই ভালো। আমি চাই জীবনানন্দ আমার কাছে চিরকালের রহস্যময় মানুষ হয়ে থাকুক তার কবিতাগুলোর মতো। মানুষ জীবনানন্দকে আমি দেখতে চাই না। সত্যি চাই না। প্রিয় মানুষের সবগুলো গোপনীয়তা জেনে ফেলার মতো হতাশা আর কিছুই হতে পারে না। কে না জানে রহস্যময়তাই ভালো লাগা দীর্ঘায়িত করে। ভালো লাগা জারি থাকুক।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
ভাল্লাগছে আলোচনা।
ভালো লাগলো
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
তারপর?
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
এতটা তৃষ্ণার্ত করলেন যখন,তখন দয়া করে জলের ব্যবস্থাটাও করুন।
পার্থসারথি চক্রবর্তী
নতুন মন্তব্য করুন