সমালোচনা প্রসঙ্গে অনেকে অনেক কথা বলে গেছেন। তবে মোক্ষম কথাটি বলেছেন জীবনানন্দ দাশ, ‘সমারূঢ়’ কবিতায়। সমালোচককে কবিতা লেখার আহবান তো জানিয়েছেন-ই সাথে তাকে ‘অধ্যাপক, দাঁত নেই- চোখে তার অক্ষম পিঁচুটি’ ইত্যাদি বলে গালমন্দও করেছেন। জীবনানন্দের যে স্বভাব তাতে এরকম বলাটা কেমন বেমানান লাগে যেন! তবে তিনি সমালোচকদের এরকম বলতে বাধ্যই হয়েছিলেন।
জীবনানন্দের সবচে’ বেশি সমালোচনা করেছেন বোধহয় সজনীকান্ত, তার শনিবারের চিঠিতে। ‘ক্যাম্পে’ কবিতায় সমালোচনায় সজনীকান্ত লিখেন- ‘কবিতাচ্ছলে কবি যে বিরহিণী ঘাইহরিনীর আত্মকথা ও তাহার হৃদতুতো দা’র মর্মকথা কহিয়াছেন তাহা পরম রমণীয় হইয়াছে...’। তাছাড়া তিনি তাকে কবি গণ্ডারও বলতেন। পূর্ববঙ্গের লেখক বলে গালমন্দ করতেন।
সমালোচনায় অতিষ্ঠ জীবনানন্দের তাই অমন বক্তব্য- ‘বরং নিজেই তুমি লেখো নাকো একটি কবিতা-’
আমার এ লেখা কবিতা বা জীবনানন্দ কোনোটাই নিয়ে নয়। তথ্যপ্রযুক্তির এই সময়ে মূলধারার মিডিয়া নির্ভরশীলতার বিপরীতে নিজেই যে মিডিয়া তৈরি করা যায় তা নিয়ে লেখা।
আমরা সবকিছুই মিডিয়াতে দেখতে চাই। আর না দেখতে পেলে মিডিয়া কিংবা সাংবাদিকদের দোষ দেই। যেমন আমাদের গ্রামের কথাই বলি- আমাদের গ্রামটি মূলত তাঁতশিল্প নির্ভর। প্রায় সব বাড়িতেই তাঁত আছে। আগে চিত্তরঞ্জন তাঁতে লুঙ্গি, শাড়ি বানানো হতো। এখন গ্রামে পাওয়ারলুম এসেছে। গ্রামের বেশিরভাগ মানুষের রুটি-রুজি তাঁতের ওপর নির্ভরশীল। বাড়ি গেলে প্রায়ই শুনি- ব্যবসার অবস্থা ভালো না, সারাদিন এতবার কারেন্ট যায়- প্রডাকশন হচ্ছে না ঠিকমতো, সুতো-রংয়ের দাম বাড়ছে, ভারতীয় কাপড় এসে বাজার ধ্বংস করে দিচ্ছে। এসবের কিছু কোনো কিছুই সাংবাদিকরা লিখে না। সবাই আছে শুধু ঢাকা নিয়ে।
গ্রামের মানুষের ধারণা, তাদের এইসব অভিযোগ পত্রিকায় আসলে, অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে।
পত্রিকায় লিখলে কাজ হবে, অথবা প্রেশার তৈরি হবে এই বিশ্বাস আমাদের অনেকেরই আছে। সেজন্য মিডিয়ায় এগুলো দেখতে চাই, নির্ভরতার আশ্রয় খুঁজতে চাই। যদিও পত্রিকা আজ আর সেই জনসেবকের ভুমিকায় নেই। এখন তাদের হাজারো হিসেব-নিকেশ আছে। সেই হিসেব-নিকেশের ছকেই খবর পরিবেশিত হয়। সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার চিত্র সেখানে বাহ্য।
তবে তথ্যপ্রযুক্তির চরম বিকাশের এই সময়ে মূলধারার মিডিয়ার ওপর নির্ভর আমরা না করলেও পারি। কারণ মিডিয়া তৈরির অনেক উপকরণ এখন আমাদের হাতের নাগালে। আপনি আমার এই লেখাটি পড়ছেন সচলায়তনে। এটাও একটা মিডিয়াম। এখানে আপনার যদি কোনো অ্যাকাউন্ট না থাকে, তাহলে নিবন্ধন করে অথবা অতিথি নিকে লিখতে পারেন আপনার ভাবনাচিন্তা কিংবা অভিযোগগুলো। যদি লিখতে আড়ষ্টতায় ভোগেন, তাহলে সেগুলো রেকর্ড করে পডকাস্ট করুন। আপনার হাতে তো মোবাইল ফোন আছে, তাতে ক্যামেরাও নিশ্চয় আছে, ছবি তুলে সেটাই পোস্টান। এভাবেই তৈরি করুন আপনার মিডিয়া।
হ্যাঁ, এসব করতে ইন্টারনেট সংযোগ থাকতে হবে। আমি আমাদের গ্রামের কথা বলছি। সেখানে অনেকের কাছেই স্মার্টফোন আছে, কম্পিউটার আছে। ফেসবুকেও অনেকের অ্যাকাউন্ট আছে। সেখানে তাদের প্রায়ই নানান অ্যাক্টিভিটিতে দেখা যায়। তাদের হাতে থাকা প্রযুক্তি ব্যবহার করে গ্রামের ব্যবসার মন্দার চিত্র অথবা অন্য কোনো খবর বা বিষয় ফেসবুকের মাধ্যমে সবার কাছে পৌঁছানো খুব কঠিন কিছু নয়। আমার মনে আছে, মুস্তাফিজ ভাই একবার সুন্দরবনের বাঘের একটি ছবি শেয়ার করলেন ফেসবুকে। বাঘটি লোকালয়ে হানা দিয়েছিল। পরে মানুষের তাড়া খেয়ে একটি ঘরের চালে আশ্রয় নিয়েছে। ছবিটি কিন্তু মুস্তাফিজ ভাই তোলেননি। তুলেছিলেন সুন্দরবন সংলগ্ন একজন। সেখান থেকে এসেছিল মুস্তাফিজ ভাইয়ের হাতে। সেটাই তিনি প্রচার করেছেন। বাঘের এই বিপন্নদশার ছবি প্রকাশে তিনি কোনো পত্রিকা বা টেলিভিশন চ্যানেলের কাছে ছুটে যাননি, সেখানে তার পরিচিত বন্ধুবান্ধব থাকা সত্ত্বে। তিনি নিজেই মিডিয়া তৈরি করেছেন।
মিডিয়া তৈরি করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে সবচে’ ভালো উদাহরণ বোধহয় সচলায়তনের ব্লগার সাবরিনা সুলতানার ব্লগ। ডিজঅ্যাবল মানুষের অধিকার নিয়ে তিনি ব্লগে লিখে থাকেন। তিনি মূলধারার মিডিয়ার কাছে যাননি, তাদের বলেননি, সাংবাদিক ভাইয়েরা একটু লিখুন- হুইলচেয়ার নিয়ে কেন বাসে ওঠা যায় না! হুইলচেয়ার চেয়ার নিয়ে বাসে উঠতে না পারায় আমার কত সাধ-আহ্লাদ জলাঞ্জলি দিতে হচ্ছে! বরং তিনি নিজেই বিষয়টা নিয়ে ব্লগে লিখেছেন। পাঠক হিসেবে জুটে গেছি আমরাও। এভাবে সাবরিনা মিডিয়া তৈরি করে নিয়েছেন।
বাংলাদেশে দৈনিক পত্রিকার পাঠকসংখ্যার চেয়ে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেশি। বর্তমানে পত্রিকার পাঠকসংখ্যা ২৭ লাখের মতো। আর ২০১৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৩৩ লাখের উপরে। এরমধ্যে ৩১ লাখই মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। বাকিরা ব্যবহার করেন আইএসপি এবং ওয়াইমাক্স। ইন্টারনেটের পেনিট্রেশন রেট ২০.৩ শতাংশ। বোঝাই যাচ্ছে আগামীতে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা আরো বাড়বে।
তাই নিজের ভাবনাচিন্তা কিংবা চারপাশের সমস্যা যেটাই হোক, পত্রিকার দ্বারে না ঘুরে সেসব নিজেই ব্লগে লিখুন, অথবা ছবি তুলে পোস্টান, অথবা রেকর্ড করে পডকাস্ট করুন। দেখবেন, আপনার অভিযোগ কিংবা ভাবনাচিন্তার নিয়ে কথা বলার কিছু পাঠক জুটে গেছে! তাদের সাথে আলোচনায় যোগ দিন। আর এভাবেই, এগুলোর মধ্যে দিয়ে আপনার মিডিয়াও তৈরি হয়ে যাবে।
মন্তব্য
এটা খুবই ভালো!
ধন্যবাদ সুমি'পা, পড়ার জন্য!
প্রযুক্তির এই সুবিধাটা সম্পর্কে যত বেশি লোকজন সচেতন হবে তাতে দুটো গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে। প্রথমত, অন্যের উপর নির্ভর না করে নিজের সমস্যাটা নিজেই প্রচার করার চর্চাটা বৃদ্ধি পাবে। দ্বিতীয়ত প্রচলিত সংবাদ মাধ্যম কর্মীরা যখন দেখবে যে কেউ তাদেরকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত গুরুত্ব দিচ্ছে না তখন নিজেদের মুই-কী-হনুরে ভাবটা নিয়ন্ত্রণ হবে।
একান্ত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা যদি বিবেচনা করি, তাহলে ২০০৬ এর আগ পর্যন্ত ঢাকা আসার আগে যখন মফস্বলে চাকুরিরত ছিলাম তখন ইন্টারনেট সুবিধা নাগালে ছিলো না বলে লেখালেখির বদ খাসিলতের কারণেই ডাকে পত্রিকায় লেখা পাঠিয়ে তীর্থের কাকের মতো বসে থাকতাম কখন ছাপা হয়। কিন্তু ঢাকায় আসার পর নিজ থেকে কখনোই কোন লেখা আর পত্রিকায় দেই নি। এরপর যেগুলি ছাপা হয়েছে তা পত্রিকা থেকেই অনুরুদ্ধ হয়ে পাঠিয়েছি। কারণ, পত্রিকায় না পাঠালেও নিজের লেখাটা প্রকাশ করতে সমস্যা নেই। কমিউনিটি ব্লগের পাশাপাশি ব্যক্তিগত ব্লগও খুলে নিয়েছি। ফলে কারো মুখাপেক্ষি হবার প্রশ্নই আসে না। পত্রিকায় পাঠানো লেখাও লেখকের অনুমতি ছাড়া সম্পাদনা করে এদিক-ওদিক করতে গেলে দৃঢ়তার সাথে নিজ অবস্থানে থাকা যায়।
ইচ্ছে হলে লেখবো নইলে লেখবো না, এই আত্মবিশ্বাসই লেখালেখিতে অনুপ্রেরণাও দেয়। লেখা মানসম্পন্ন হলে এমনিতেই চেয়ে নেবে। দরকার কী আগ বাড়িয়ে অন্যের করুণার উপর নিজেকে সমর্পণ করার !
ধন্যবাদ পান্থ। অনেকদিন দেখা হয় না।
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
পুরোপুরি একমত। কেউ অনুরোধ না করলে নিজের ব্লগে বা যেইখানে নিজের মতামত-ই চূড়ান্ত সেইখানে ছাড়া অন্য কোথাও লেখা দিয়ে অন্যের ইচ্ছার মুখাপেক্ষী হয়ে থাকার কোন মানে হয় না। (আর একটা দিক-ও আছে। এতে করে যে মানুষগুলিকে বাতিল করার আগে আমার হতচ্ছাড়া লেখা পড়ে তার দোষ-গুণ ঠিক করতে হয় তাদের অনেক যন্ত্রণার হাত থেকে রেহাই দেওয়া যায়। বিশেষ করে তারা যদি আবার প্রিয় মানুষ হন, যেমন সচলায়তনের মডারেটররা। হ্যাঁ, কোন মানেই হয় না। বার দুয়েক কষ্ট দেওয়ার ভুল করে ফেলেছি। আর ওই অশান্তি পাকাচ্ছি না )
প্রযুক্তির সুবিধা যতোটা পারা যায়, নেয়া দরকার।
হ, রণদা, প্রযুক্তির বারান্দায় আপনাকে প্রতিদিন দেখলেও মুখোমুখি দেখা হয় না অনেকদিন।
একটা নুতন যুগ এসে গেছে! এই লেখা সেই যুগটার একটা সুন্দর পরিচিতি দিয়েছে আর আহ্বান জানিয়েছে তার অংশ হয়ে ওঠার। কতজন এতে অনুপ্রাণিত হবেন জানা নেই। কিন্তু এটা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় যে ভাবীকালের গবেষক এই লেখা হাতে পেলে আশ্চর্য হয়ে ভাববে যে এক সময় এই ভাবে লোককে সূর্য চেনাতে হত, তারা বুঝতে পারতনা যে নুতন সূর্য উঠে গেছে পরিচিত আঁধার আকাশে!
অনেক অভিনন্দন এই চমৎকার লেখাটির জন্য।
- একলহমা
ধন্যবাদ স্যাম ভাই।
চমৎকার প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন। দৈনিক পত্রিকার মুখাপেক্ষী হয়ে থাকার দিন শেষ। দৈনিক পত্রিকায় ওই সেই মান্ধাতা আমলের লেখক, যারা প্রত্যেকদিন একটা দায়সারা গোছের ফরমায়েশি লেখা দেন আর তাই নিয়ে আমরা গদগদ হই। নতুন যুগ আমাদের অজান্তেই আমাদের কাছে দিয়েছে স্বাধীনভাবে চিন্তা করার এবং লেখার তাড়না। আমরা নতুন লেখক চাই, চাই নতুন ভাবনা, নতুন চিন্তা। পুরনো সব জঞ্জাল মুছে ফেলার দিন এখন। কারও মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার দিন শেষ। ধন্যবাদ পুনরায়।
হ্যাঁ, সেটাই!
Onek vhalo laglo Pantho....bohudin por tomar lekha porlam.
ধন্যবাদ।
অক্ষরযাপনে বিজ্ঞাপনবিরতি চলছে, তাই লেখা দেখছেন না!
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে
হ
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
ইন্টারনেট মিডিয়ার সমস্যাটা আপনি উল্লেখ করেছেন। দেশের একটা বিশাল জনগোষ্ঠী এই মিডিয়ার সুযোগ বঞ্চিত।
তোমার ইদানিংকার লেখাগুলো অন্যরকম। ভালো লাগছে। লিখতে থাকো।
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
facebook
ইন্টারেস্টিং
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
নতুন মন্তব্য করুন