আঁকো তবে নিজের মতো করে

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি
লিখেছেন পান্থ রহমান রেজা (তারিখ: রবি, ২২/০৯/২০১৩ - ১২:৫৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আঁকাআঁকির হাত আমার কোনোকালেই ছিল না। ফুল, পাখি, বাড়িঘর কিংবা গ্রামের দৃশ্যাবলী কোনোদিনই আঁকা হয় নি। খুব ছেলেবেলায় গ্রামের যে স্কুলে পড়েছি, সেখানে আঁকাআঁকির কোনো বালাইও ছিল না। কিছুদিন আগে ফেসবুকে ‘বিটস্ট্রিপ’ খুব জনপ্রিয় হলো। সবাই নিজ নিজ কার্টুন অবতার এঁকে ফেললো। তার সাথে আরো কতো মজাদার সব সংলাপ। ভাবলাম আমিও একটা এঁকে ফেলি। সোনম কাপুরকে নিয়ে ‘বিটস্ট্রিপ’-এ চড়ে একটা ড্রিম ডেটে যাই। চোখ, মুখ, নাক, গায়ের রং সিলেক্ট করে আগানো হয়নি। কার্টুনের সাথে আমার এমন-ই দুরবর্তী সম্পর্ক।

তবে পত্রিকায় লেখালিখির সুবাদে বেশ কয়েকজন কার্টুনিস্টের সাথে খাতির হয়েছিল একসময়। এখন তাতে ধুলো পড়েছে খানিকটা। যদিও এ লেখা ধুলোপড়া স্মৃতি হাতড়াতে নয়। এই লেখার কারণ একটাই। সে হলো ম্যাট উয়ের্কার। ম্যাট উয়ের্কার একজন রাজনৈতিক কার্টুনিস্ট। ২০১২ সালে পুলিত্জার পুরস্কার পেয়েছেন। আরো কিছু পুরস্কার রয়েছে তার ঝুলিতে। কয়েকদিন আগে বাংলাদেশে এসেছিলেন। এক আড্ডায় পরিচয়। আড্ডায় বাংলাদেশী বেশ কয়েকজন কার্টুনিস্ট উপস্থিত ছিলেন। কার্টুনবিমুখ আমি উটকো জুটে গিয়েছিলাম সেখানে।

ম্যাট উয়ের্কার মূলত এডিটোরিয়াল কার্টুন আঁকেন। এখন পলিটিকো ম্যাগাজিনের বাঁধা কার্টুনিস্ট। আগে ফিল্যান্সার ছিলেন। ওয়াশিংটন পো্স্ট, লস এঞ্জেলস টাইমস, নিউ ইয়র্ক টাইমস, নেশনের মতো পত্রিকায় নিয়মিত কার্টুন আঁকতেন। ইতোমধ্যে কার্টুন নিয়ে তার দুটো বই-ও বের হয়ে গেছে।

আড্ডায় ম্যাটের সাথে এটা-সেটা নিয়ে বেশ কথা হলো। তার কার্টুন নিয়েও বললেন। একসময় অ্যানিমেশন করতেন। কিন্তু ভালো না লাগায় সেটা ছেড়ে দিয়েছেন। কার্টুনের আইডিয়ার জন্য সকালে অফিসে এসেই টুইটার খুলে বসেন। হাজার হাজার টুইট থেকেই পেয়ে যান আঁকানোর আইডিয়া। তারপর কানে হেডফোন গুঁজে গান শুনতে শুনতে এঁকে ফেলেন সিরিয়াস সব কার্টুন। নতুন যারা কার্টুন আঁকতে চায়, তাদের জন্য পরামর্শ দিলেন বেশি করে খবরের কাগজ পড়তে। কারণ আশ্চর্য সব আইডিয়া না কি খবরের ভাঁজে লুকিয়ে থাকে!

কথায় কথায় ম্যাটকে আমাদের আইসিটি আইনের ৫৭ ধারার কথা বললাম। শুনে ম্যাট আশ্চর্য হলেন এরকম একটি আইন আছে বলে। বললেন, কার্টুনিস্টদের তো ফুল-ফল-পাখি-লতাপাতা নিয়ে ফানি সব কার্টুন আঁকতে হবে এখন। সিরিয়াস কিংবা রাজনৈতিক কার্টুন আঁকা বাংলাদেশী কার্টুনিস্টদের জন্য কঠিন হয়ে যাবে। আমি বললাম, বাংলাদেশের কার্টুনিস্টদের জন্য তাহলে করণীয় কী? ম্যাট বাংলাদেশের কার্টুনিস্টদের করণীয়ের ব্যাখ্যায় গেলেন না। বললেন, আমি হলে নিজের মতো করেই কার্টুন এঁকে যেতাম। কেউ আমাকে আমার কাজ থেকে সরাতে পারতো না। কার্টুনিস্ট আরিফের কথা স্মরণ করিয়ে দিলে বললেন, আরিফের কথা আমি শুনেছি। খুবই দু:খজনক ঘটনা সেটা।

ম্যাটের কথায় মনে পড়ে গেল আমাদের রাজনৈতিক কার্টুনের অতীত ইতিহাসের কথা। পাকিস্তান শাসক কিংবা স্বৈরাচার কারো সময়ই কার্টুনিস্টরা কার্টুন আঁকানো বন্ধ করেননি। বরং আরো ধারালো হয়েছে।

ভাষা আন্দোলনের কথাই ধরা যাক। বাঙালির মুখের ভাষাকে কীভাবে জব্দ করা হচ্ছে, শৃঙ্খলিত করা হচ্ছে তার সব উঠে এসেছে সেসময়কার পোস্টার-ফেস্টুনে। আবার ষাটের দশকে আইয়ুব খানকে ব্যঙ্গ করে অনেক কার্টুন এঁকেছেন কামরুল হাসান এবং রফিকুন নবী। পেছন ফিরে দেখলেই আমরা তাদের আঁকা আইয়ুব খান কিংবা মোনায়েম খানের বিদ্রুপাত্মক চেহারা দেখতে পাবো। সত্তরের দশকে কামরুল হাসানের আঁকা ‘এই জানোয়ারকে হত্যা করতে হবে’ শিরোনামের কার্টুনচিত্রের কথা আমরা কে না জানি! স্বাধীনতার পরে আমাদের কার্টুন চিত্রে সবচে’ উজ্জ্বল আবির্ভাব বোধহয় শিশির ভট্টাচার্য। তার আঁকা এরশাদের ঘোড়ামুখের ছবি আজো আমাদের চোখে ভাসে। কিংবা এরশাদকে নিয়ে কামরুল হাসানের ‘বিশ্ববেহায়া’ কার্টুনের কথাও কেউ ভুলবে না।

এ অঞ্চলে কার্টুনের আবির্ভাব ইংরেজদের হাত ধরে। শুরুতে তা ফরামায়েশী কার্টুনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু পরে সেটা রাজনৈতিক প্রতিবাদে রূপ নেয়। পাকিস্তানি আমল কিংবা এরশাদের স্বেরাচারী শাসনকালে তা আরো বেগবান হয়েছে। সাম্প্রতিক শাহবাগ আন্দোলনেও যুদ্ধাপরাধীদের ব্যঙ্গচিত্র উপস্থাপনে কার্টুনিস্টদের সোচ্চার ভুমিকায় দেখা গেছে। তাই ধরে নেয়া যায়, আগামীতে ফুল, ফল, লতা, পাতা, পাখির কার্টুন নয়; আইসিটি আইনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তারা আঁকবেন নিজেদের কার্টুন, নিজের মতো করে। রেখা চিত্রে লিখে রাখবেন তাদের প্রতিবাদী ভাষ্য।

ম্যাট উয়ের্কারের কার্টুন দেখুন এই লিংকে

ছবি: 
20/04/2008 - 9:42পূর্বাহ্ন

মন্তব্য

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

চলুক

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

ধন্যবাদ পড়ার জন্য!

তারেক অণু এর ছবি
পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

ধন্যবাদ তারেকাণু ভাই!

ব্রুনো এর ছবি

চলুক

____________________________________________________________________________________
তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা।

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

ধন্যবাদ!

অতিথি লেখক এর ছবি

মানুষের মনের ভাষা,প্রতিবাদ কে কেউ কখনো আইন করে দমিয়ে রাখতে পারেনি,পারবেও না।বাঙালিকে ও পারেনি যুগে যুগে,সীমাবদ্ধতার সব দেয়াল ভেঙ্গে বাঙালি চিরকালি সামনে এগিয়েছে ৫২,৬৯ ৭১ আর স্বৈরাচার বিরোধী সহ জাতীয় জীবনের সকল উজ্জ্বলতম অধ্যায়ে।তাই ৫৭ ধারা আসুক কিংবা আসুক ৯৭ ধারা সব ধারাই হেরে যাবে মানবিক বিপ্লবের কাছে,বোধের জেগে ওঠাতে।

মাসুদ সজীব

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

হ, সেটাই!

 মেঘলা মানুষ এর ছবি

আচ্ছা, আপনি কার্টুনিস্ট জগৎটা ভালো চেনেন, তাই একটা প্রশ্ন করি। এই কার্টুনিস্টদের সাথে যারা অন্য কার্টুন স্ট্রিপ আঁকিয়েদের (যেমন, প্রথম আলোতে শাহরিয়ার এর বেসিক আলী, বা ডিলবার্ট) তো কিছুটা ভিন্নতা আছে। এই দুই ধারার আঁকিয়েদেরকে কি একসাথে 'কার্টুনিস্ট' নামে ডাকা হয় নাকি, যাঁরা পলিটিক্যাল কার্টুন আঁকেন তাঁদেরকে কি অন্য কোন বিশেষ ক্লাসে ফেলা হয়?

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

কার্টুন সম্পর্কে আমার মোটেও ভালো ধারনা নেই। সচলায়তনে সুজন্দার পোস্ট করা কার্টুন কিংবা পত্রিকায় পাতায় ছাপা কার্টুন দেখে মাঝেমধ্যে হেসে গড়াগড়ি খাই। কার্টুন নিয়ে আমার দৌড় ওই হাসাহাসি করা পর্যন্তই!
ক্যারিকেচার, কমিক স্ট্রিপ, পলিটিক্যাল, মুভি কার্টুন-সহ কার্টুনের ম্যালা ভাগ থাকলেও সাধারণ ভাবে যারা কার্টুন আঁকেন তাদের সবাইকে কার্টুনিস্ট বলেই ডাকা হয় বলে আমি জানি। তবে ম্যাট উয়ের্কারকে দেখলাম সব জায়গায় পলিটিক্যাল/এডিটোরিয়াল কার্টুনিস্ট বলে ডাকা হচ্ছে। অন্যদিকে আমাদের দেশের শিশির ভট্টাচার্য রাজনৈতিক ধারার কার্টুন আঁকলেও তাকে কোথাও পলিটিক্যাল কাটুনিস্ট বলা হয় না। তাই ব্যাপারটা আসলে কী আমি পরিষ্কারভাবে আপনাকে বলতে পারবো না। সুজন্দা এক্ষেত্রে ভালো বলতে পারবেন।

কড়িকাঠুরে  এর ছবি

চলুক

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

হাসি

এক লহমা এর ছবি

আগের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে অর্জিত আপনার আস্থা আগামী দিনেও অটুট থাকুক।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

সেই আশায় তো দিন গুনি!

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

ভালো লাগলো লেখাটা।
কার্টুন নিয়ে আমারও দৌড় ঐ হাসাহাসি করা পর্যন্তই। তাই আরো ভালো লাগলো কার্টুনের লিঙ্কটা।

____________________________

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

ধন্যবাদ স্যার!

তানিম এহসান এর ছবি

লেখা ভাল লাগলো। এতদিন পরপর লেখেন ক্যান মিয়া? রেগে টং

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

ধন্যবাদ তানিম ভাই!
লিখি তো মাঝেমধ্যে! হাসি

মাহবুব লীলেন এর ছবি

কত না মূখ রে ভাই আমি
ম্যাটের কার্টুন ম্যাটের কার্টন শুনতে শুনতে আমি ভাবতাম ওইটা বোধ হয় কার্পেট বা মাদুরের উপর কার্টুন আঁকার বিশেষ শাখা...

কিন্তু পরে দেখি... এই ম্যাট মূলত একজন বিদেশি শিশির ভট...

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

হাহাহহাহা! ব্যাপক বলেছেন লীলেন্দা!

আশালতা এর ছবি

আঁকতে টাঁকতে পারিনা, তবে লেখা ভাল্লাগসে। চলুক

----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি

জু্লহাজ মান্নান এর ছবি

চলুক

এস এম নিয়াজ মাওলা  এর ছবি

৫৭ ধারা পারবে নাকো আঁকাআঁকি বন্ধ করতে,
এই আমি বল্লুম,
এই কমেন্ট লিখে আমি
ম্যাটের কার্টুন দেখতে চল্লুম।

-নিয়াজ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।