মানুষেরা বলে,
অতঃপর আমরা যার যার পথে হেঁটে গেছি অথবা যাব
আমাদের মাঝখানে দাঁড়িয়েছে অথবা দাঁড়াবে সময় এবং নোনাপানি
আমাদের মাঝখানে ক্রমাগত না দেখার দিন
অতঃপর আমাদের সম্বল হয় কেবলই স্মৃতি
আমাদের থাকে শুধু সোনালি রোদন।
[শহীদুল জহিরের ডুমুর খেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প নামের বইটির উৎসর্গপত্র থেকে]
ওপরের কথাগুলি কি জীবনানন্দ দাশ নামের কোনো কবির লেখা কবিতার লাইন? জোরের সঙ্গে আমার সত্য বলবো। আমরা বলবো : না, এই কথাগুলি জীবনানন্দ দাশ নামের কোনো কবির লেখা কবিতার লাইন নয়।
শহীদুল জহির খুব বড়ো মাপের একজন লেখক। আমাদের সময়ের লেখকেরা তা স্বীকার করে নিয়েছে। আমার যারা শূন্য দশকের চিহ্ন ঘাড়ে নিয়ে লেখালেখি করি তারাও স্বীকার করছি। যদিও এই স্বীকারে জহিরের কিছু যায় আসে না। তিনি মৃত বলে যেমন কিছু যায় আসে না, তেমনি তিনি বেঁচে থাকলেও কিছু যেতো আসতো বলে মনে হয় না। তার চরিত্র ও ভাবভঙ্গি সম্পর্কে নানা লোকের লেখা তার মৃত্যুর পর পড়ে এরকমই মনে হচ্ছে।
একজন গল্পকারের একজন কথাসাহিত্যিকের বইয়ের উৎসর্গ-পত্রে এ ধরনের লেখা- যা এই লেখার শুরুতেই আমি উদ্ধৃত করছি- খুবই বিদপজনক। কথাসাহিত্যিকের তো এইরকম কবিতার ভাষায় জীবনের চরম সত্য কথা বলার কথা নয়। তিনি গল্প লিখবেন, উপন্যাস লিখবেন। সেইসব লেখায় জীবনের মানুষের এক একটা সময়-অবস্থার সত্য কথা থাকবে। তিনি তো জীবনের পরম সত্য কথা বলার কথা নয়, যেই দুঃসাহসটা শহীদুল জহির করছেন।
নস্টালজিয়া এমনই এক জিনিস যার অনুপস্থিতিতে কোনো মহৎ সৃজনকল্পনা সম্ভব নয়। এইখানে সৃজনকল্পনা শব্দটা ইংরেজি ইমাজিনেশন রসধমরহধঃরড়হ-এর পরিভাষা। যদিও আমার রসধমরহধঃরড়হ-এর বাংলা দাঁড় করাইছি কল্পনা। কল্পনায় সৃজনশীলতার যুক্ত থাকার বাধ্যবাধকতা নাই। কিন্তু সৃজনকল্পনায় সেই বাধ্যবাধকতা আছে।
ডুমুরখেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প নামের বইটাতে জহির নস্টালজিয়াকে সেই সম্মানটা দিছেন। নস্টালজিয়া যে মানুষের জীবনের শেষ ও পরম সত্য সম্পদ সেই কথা বাংলাদেশের আর কোনো কথাসাহিত্যিক-কবি কি তাদের বইপত্রে লিখছেন? জানি না।
একটা গল্পের জন্য কি একজন মানুষকে খুন করা যায়? একটা গল্পের জন্য কি সেই গল্পের লেখককে খুন করা যায়! কোনো পক্ষ কোনো লেখার জন্য কোনো লেখককে খুন করে ফেললো কি না তা নিয়ে আমাদের এই প্রশ্ন নয়। আমাদের প্রশ্ন একটা গল্পের জন্য একজন পাঠক একজন লেখককে খুন করতে পারেন কি না? অন্তত পক্ষে তার যদি লেখককে খুন করার ইচ্ছা হয় তাহলে পাঠককে আমরা দোষ দিতে পারি?
শহীদুল জহিরের চতুর্থ মাত্রা পড়ে তাকে আমার খুন করতে ইচ্ছা করে। কারণ কী? কারণ তিনি গল্পটার ভিতর দিয়ে আমাকে বিপন্ন করেন। গল্পটা দিয়ে খুব বড়ো একটা বারতা দিয়ে যে তিনি বিপন্ন বরেন তা কিন্তু নয়। তারও এই গল্পে কাহিনী খুব সামান্য। কাহিনীর কারুকাজও নেই। যদিও গল্পে কাহিনী থাকা উচিত। নইলে তো গল্প গল্পই নয়। তাহলে শহীদুলের চতুর্থ মাত্রা গল্প হচ্ছে কিভাবে?
শহীদুলের গল্পা আসলে গল্প না। শহীদুল কি গল্প বলার চেষ্টা করছিলেন মানুষকে? তার কাছ থেকে এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার আর কোনো সুযোগ নেই। কারণ শহীদুল জহির বেঁচে নেই। তিনি মৃত। কিন্তু তার যে-অপকীর্তি (!)- পাঠকের ক্ষোভ থেকে এই কথা বলা- পাঠককে মানুষকে বিপন্ন করে তোলার অপকীর্তি এর কোনো বিচার হবে না? না, শেষ পর্যন্ত মনে হয় শহীদুলের অপকীর্তির কোনো বিচার হবে না। কারণ মানুষ বিপন্ন হতে ভালোবাসে?
মানুষ আসলেই বিপন্ন হতে ভালোবাসে নাকি? নাকি বিপন্নতা মানুষের ভেতরে সারাজীবন থেকে থাকে? নাকি মানুষ জন্মের পর যখন তার বোধবুদ্ধি হয় সেই সময় থেকেই নিজের ভেতর বিপন্নতা লালন করে। সেই লালিত বিপন্নতা , সেই আজন্মরোপিত বিপন্নতা কোনো কোনো মানুষ এমনিতেই টের পেয়ে যায়। আবার কোনো কোনো মানুষ কখনোই টের পান না। যারা টের পান না তাদের কি শহীদুল তা টরে পাইয়ে দ্যান? যারা টের পান, কিন্তু বাস্তবতার ধাক্কায় বাস্তবতার চাকায় পিষ্ঠ হতে-হতে ভুলে থাকেন তাদের আবার স্মরণ করিয়ে দ্যান? শহীদুল মনে হয় দুটোই করেন।
কবি জীবনানন্দ দাশের অমর-অথচ-সত্য সেই পঙক্তিটি তবু এক বিপন্ন বিস্ময় মানুষের ভেতরে খেলা করে। জীবনানন্দ বিপন্ন বিস্ময়ের অস্তিত্ব দেখিয়ে দিয়ে সরে পড়েন। সেই দেখিয়ে দেওয়া পাঠককে বিপন্ন করে কি না তাতে সন্দেহ আছে। তার কথায় মানুষ জেনে নিতে পারে যে জীবনে বিপন্ন এক বিস্ময় আছে। যে-বিস্ময়ের ধাক্কায় মানুষ নিজেকে হত্যা করে; মানে মানুষ সেই বিপন্নতা থেকে মুক্তি নিতে চায়।
শহীদুল তো গল্পলেখক। তিনি তো কথাসাহিত্যিক। তিনি পাঠককে বিপন্ন কোনো বিস্ময়ের কথা বলেন না। তিনি পাঠককে বলেন না যে জীবনে বিপন্ন হওয়ার মতো কোনো বিস্ময় আছে। তিনি পাঠককে বলেন না যে মানুষের জীবন বিপন্ন এক বিস্ময়। শহীদুল শুধু মানুষকে চোকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দ্যান যে তার (মানুষের) জীবন এক আশ্চর্য বিস্ময়। এবং এই জীবন আসলে বিপন্নতারই নামান্তর। জীবনের কোনো অর্থ যে নেই তা শহীদুল গল্পে না বললেও শহীদুলের গল্প পড়ে পাঠক তা অনুভব করতে বাধ্য।
চতুর্থ মাত্রায় কেবলই পুনরাবৃত্তি ঘটে। সেখানে আব্দুল করিম এবং পেপারওয়ালার পেপার বিক্রি, করিমের বারবার গ্লাস ভাঙা গ্লাসের ভাঙা কাচের টুকরো ঘরের বাইরের শিশুদের কটকটি খাওয়ার জন্য রাখাÑ এই ব্যাপরগুলির পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে। একসময় নিজের বিক্রির পেপার শেষ হয়ে গেলে করিম পেপারওয়ালার কাছ থেকে পেপার কিনে আবার তার কাছেই পেপার বিক্রি করেন। এইভাবে করিম পেপার বিক্রির অভ্যস্ততা ধরে রাখেন। করিম কটকটিঅলার কাছ থেকে ভাঙা কাচের টুকরো কিনে তা থেকে অল্পঅল্প ঘরের বাইরে রাখেন। এই কাচের টুকরো বাচ্চারা কটকটিঅলার কাছে দিয়ে কটকটি খাবে। পুনরাবৃত্তি পুনরাবৃত্তি পুনরাবৃত্তি। এরই মধ্যে লেখক শহীদুল জহির আমাদের বারেবারে পুনরাবৃত্তি করিয়ে মনে করিয়ে দ্যান যে এই সময়টাতে ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলেছে। সময় থেমে নেই। গল্পটির কাহিনী এই সামান্যই।
কিন্তু গল্পটি পড়তে পড়তে পাঠক এক চরম অবসন্নতায় আক্রান্ত হন। তার মনে হয় যে জীবন এইরকমভাবেই স্থির একটি অর্থহীন চক্র। তার নিজের জীবনই একটি অনর্থক চক্রের পুনরাবৃত্তি। এইরকম কোনো মেসেজ কি শহীদুল দিতে চান তার চতুর্থ মাত্রায়? এর উত্তর পাওয়ার সুযোগ আমাদের হাতে আর নেই। কারণ শহীদুল জহির মারা গেছেন। তিনি আর বেঁচে নেই।
ক্স
শহীদুল জহিরের লেখার সঙ্গে জাদুবাস্তবতা শব্দটি মেলানোর একটা চেষ্টা ইতিউতি দ্যাখা যাচ্ছে। শহীদুল জহিরের গল্পে নাকি জাদুবাস্তবতা আছে। গ্যাব্রিয়েল গার্সিায় মার্কেজের লেখা পড়ে নাকি তিনি এ বিষয়টি শিখেছেন। গ্যাব্রিয়েলের কাছ থেকেই নাকি তিনি জাদুবাস্তবতা বিষয়টি আত্মস্থ করেছেন। এমন কথাবার্তা শহীদুল জহিরের মৃত্যুর পরও শোনা গেছে।
গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজেরে অন্তত আড়াইটা বই আমার পড়ার সুযোগ হইছে, অনুবাদে। হ্যাঁ, গ্যাব্রিয়েলের চরিত্ররা অতীতে যাতায়াত করে। কিন্তু তারা কি অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎকে একাকার করে সময়শূন্যতায় ডুবে যায়? এবং ডুবে গিয়ে জীবনে বিপন্ন বোধ করে? তাদের জীবন কি অর্থহীন হয়ে ওঠে বিপন্নতার আঘাতে? গ্যাব্রিয়েলের পাঠকরা বিপন্ন হন তার লেখা পড়ে? শহীদুলকে যারা গ্যাব্রিয়েলের অনুগামী বা সহগামী মনে করেন তারা মানুষ কি না সন্দেহ হয়। তাদের অনুভূতি নিয়ে সন্দেহ হয়।
তবু চিন্তা হয়, শহীদুলের লেখা পড়ে আমার যে এখন বিপদ হচ্ছে এই জন্য শহীদুলকে দোষি বলা যায় কি না। তিনি তো বেঁচে নেই। শহীদুলের লেখা মানুষ পড়ছে- এতে কি শহীদুলের কিছু যাচ্ছে আসছে?
মাঝখানে বিপদে পড়ছি আমরা পাঠকেরা।
মন্তব্য
জীবনের বিপন্নতাকে সনাক্ত করা কিন্তু বিপন্নতাকে পেরিয়ে যাওয়ার আকুতিও হতে পারে। পারে না কি?
শহীদুল জহির নিয়ে কথা বলতে আমার আরো ক'দিন সময় লাগবে। একানে চিন্তার কিছু নোক্তা আপনার ঘায়ে ঝরে পড়ল:
জাদুবাস্তবতা: কল্পনাকে যুক্তিশৃঙ্ক্ষলা ছাপিয়ে চালনা করলেই ইদানিং হৈ হৈ হয়, ঐ যে যাদুবাস্তবতা যায়। আমি আপনার সঙ্গে একমত যে, এই বলাটা দায়সারা এবং এর মধ্যে মিল খোঁজার আরামটা বেশি, বিশিষ্টতা সনাক্ত করার মেহনত এই বলনেওয়ালারা করতে চান না। শহিদুল আধুনিক শিক্ষিত মনের কল্পনাসুষমার বাইরে জীবনকে দেখেছেন। তার চরিত্র বান্দরের দুধ খেয়ে বড় হয়, বা এক পতিতা মেয়ে যার জীবন বাঁচায় সে-ই আবার সেই মেয়ের নামে গ্রাম প্রতিষ্ঠা করে, এক কুয়োর মধ্যে বারবার আটকে পড়ে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার এক ট্র্যাজেডির যাতনা ইত্যাদি। কিন্তু এগুলো ঘটে না কি? না ঘটলেও বাস্তবতার সঙ্গে কন্ট্রাস্ট না করলে বাস্তবতার সীমা কীভাবে পরীক্ষা করা যাবে? গ্রেগর সামসাকে তেলাপোকা না বানাতে পারলে কাফকা কি বোঝাতে পারতেন যে, আধুনিক সময় আমাদের সবাইকেই আসলে তেলাপোকা বানিয়ে রেখেছে?
শহিদুল আমাদের অব্যাখ্যাত বাস্তবতাকে কাহিনীর মধ্যে বাঁধতে গিয়ে কুহকের আশ্রয় নেন, কিন্তু আমাদের মনের মধ্যে আমাদের ইতিহাসের মধ্যেও অনেক কুহক কি নেই? আমরা কি কুহকের টানে অনেকদূর চলে যাই না? শহীদুল আমাদের সময়ের জটিল সংবেদনকে তাঁর কল্পনা আর ভাষার আংটায় ধরতে চেয়েছেন এবং মুখের দিকে দেখি-তে বুঝতে পারি, সেটা তিনি ধরতে পেরেছেন। জীবনকে এভাবেও দেখা চলে, দেখা সম্ভব।
আর এমন মমতা দিয়ে ক্ষুদ্র-তুচ্ছ-বাতিল হয়ে ধাঁধায় আটকে পড়া চরিত্রগুলোকে কে এমন করে ভালবেসেছে?
থাক বড় হয়ে যাচ্ছে মন্তব্য। আপনার লেখাটায় অনুধাবনের গভীরতা ঈর্ষণীয়। এধরনের লেখা আরো চালান দাদা।
হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।
"আপনার লেখাটায় অনুধাবনের গভীরতা ঈর্ষণীয়" বলে আসলে খোচা দিলেন কি না বুঝতে পারতেছি না!
আমি কিন্তু শহীদুলের লেখা পড়ে এভাবেই আক্রান্ত হইছি।
==========================
পৃথিবীর তাবৎ গ্রাম আজ বসন্তের মতো ক্ষীণায়ু
আরে নাহ্, আমিও ভিন্ন ভিন্ন ভাবে আক্রান্ত হইছি নানান সময়। এখন সেই বোধগুলারে থিতু কইরা দেখতেছি, তলানিতে কী জমে, গাদ না গরদ।
লেখা যদি আক্রান্তই না করলো তাইলে আর লিখা কাম কী? আরাম পাইতে চাইলে কদুর তেল মাখাই শ্রেয় নয়?
হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।
প্রথমেই পলাশ দত্ত কে অনেক অনেক ধন্যবাদ । শহীদুল জহির সম্পর্কে কিছু জানতাম না । এই লেখা পড়ে ভয়ানক কৌতূহলী হয়ে গেলাম । তাঁর বই কোথায় পাব যদি জানাতেন । আপনার লেখা পড়ে হঠাত্ করে মনে পড়ে গেলো , পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকী সম্ভবত তার কোন একটি নাটক শহীদুল জহিরের গল্প অবলম্বনে বানিয়াছিলেন । তারিক আনাম ছিলেন সে নাটকে । একটি লোক বার বার ঘুরে ফিরে একটি জায়গাতেই এসে থামে । এমনই একটা থিম ছিল সে নাটকের ।
যাই হোক আপনার লেখার ভঙ্গি , লেখা , আবেগ , প্রকাশ সবকিছুই খুব টানল আমাকে । এরকম হলেই বোধহয় পাঠক রা পরাজিত হয় লেখকদের কাছে । আরো আরো লিখবেন ... এই আশা ...
---------------------------------------------------------
পৃথিবীর সব সীমান্ত আমায় বিরক্ত করে। আমার বিশ্রী লাগে যে, আমি কিছুই জানিনা...
---------------------------------------------------------------------------
কারও শেষ হয় নির্বাসনের জীবন । কারও হয় না । আমি কিন্তু পুষে রাখি দুঃসহ দেশহীনতা । মাঝে মাঝে শুধু কষ্টের কথা গুলো জড়ো করে কাউকে শোনাই, ভূমিকা ছাড়াই -- তসলিমা নাসরিন
আমার লেখা পড়ে আপনার শহীদুল পড়তে ইচ্ছা হইছে- এতে আমি খুবই আনন্দিত বোধ করতেছি।
হ্যা, একটা নাটক হয়েছে। ওই গল্পের নাম চতুর্থ মাত্রা। আপনি যেদেশে থাকেন
সেখানে শহীদুলের বই পাওয়া যাবে না।
আমার আরো দুয়েকটা লেখা সচলায়তনে আছে। সময় পেলে পড়ে দেখবেন।
==========================
পৃথিবীর তাবৎ গ্রাম আজ বসন্তের মতো ক্ষীণায়ু
কঠিন জায়গায় হাত দিলেন রে ভাই... ম্যাজিক রিয়ালিজম... মার্কেস আর শহীদুল জহির...
লক্ষীবাজারের শ্যামাপ্রসাদ চৌধুরী লেনের যুবক আবদুল মজিদের পায়ের স্যান্ডেল পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গতি বিধানে ব্যর্থ হয়ে ফট করে ছিঁড়ে যায়। আমার ভাবনাও...
নাহ্... ভাবনায় জট পাকায়ে দিছেন... শহীদুল জহির নিয়া একটা লেখার খায়েশ ছিলো আমারও... তার কাক মহল্লা চরিত্রের নাম... রিপিটেশন... আরো অনেক কিছু নিয়া... একটু সময় কইরা... অচিরেই লেইখা ফেলতে চেষ্টাইবো...
আপনার লেখাটা ভালো লাগলো...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
লেখা ভালো লাগছে শুনে আমারো ভালো লাগলো।
শহীদুলকে নিয়ে আরো লেখার ইচ্ছা আছে, বড়ো পরিসরে।
==========================
পৃথিবীর তাবৎ গ্রাম আজ বসন্তের মতো ক্ষীণায়ু
আমারো ভালো লাগলো আপনার লেখা। আর একই সাথে শহীদুল জহিরের লেখা পড়ার ইচ্ছা জাগলো। আজিজে পাবো না কি?
-------------------------------------
সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে !
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
পাবেন।
==========================
পৃথিবীর তাবৎ গ্রাম আজ বসন্তের মতো ক্ষীণায়ু
পলাশের লেখা ভাল লাগে। কবিতাগুলোতো বটেই, এই গদ্য পড়ার পরেও ভাল লাগা বেড়ে গেল আরো।
প্রবাসে বসে সবার লেখা পড়তে পারা ভীষণ মুশকিল। তারপরেও কিছু সুহৃদের কল্যাণে শহিদুল জহির পড়ার সুযোগ হয়েছে। সেই পাঠ অভিজ্ঞতা থেকে জানি, জহিরকে নিয়ে আপনার আবেগের জায়গাটা, এবং তার প্রকাশটা একদম পার্ফেক্ট। এরকমই ভাল লাগার আসলে, জহিরের লেখাগুলো।
একটা জায়গায় শুধু আপত্তি রয়ে গেল। শহীদুল জহিরের লেখার মাঝে যারা মার্কেজের ছায়া পায়, সেটা তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গী মনে করি। কেউ পায় কেউ পায় না। সেটা নিয়ে আপনার ক্ষোভ, এইটুকু পর্যন্ত ঠিক আছে, কিন্তু তারপরেই মার্কেজকে নিয়ে বলা কথাগুলো ভাল লাগলো না।
আপনি বলেছেন,
মজা হলো, আমার মতে, আপনার সবগুলা প্রশ্নের উত্তর হলো, "হ্যা"। গ্যাব্রিয়েলের কোন আড়াইটা বই পড়ার পরে আপনি এমনতরো বিষয়গুলা নিয়া সন্দিহান হয়ে পড়লেন, এটা খুব জানতে ইচ্ছা করছে। আপনি দয়া করে বইগুলোর নাম জানাবেন, আমি আবারও পড়ে দেখবো।
আপনার আরেকটা কথাও কোট করি।
এই কথাটা আবেগের ভারে তার ভেতরকার ছিঁটে ফোটা সমস্ত যৌক্তিকতা সাথে নিয়ে নুয়ে গেছে। অনুগামী আর সহগামীর মধ্যে তফাৎ আছে জানি। এবং লেখার চরিত্র-বৈশষ্ট হিসেবে আনলে, জহির মার্কেজের অনুগামী বা সহগামী কি না, এই নিয়ে একটা তর্ক-বিতর্ক হয়ে যেতেই পারে বলেই আমি মনে করি। এই মনে করাটা যদি আমার অনুভুতিহীনতার প্রমাণ হিসেবে সাব্যস্ত হয়, আপনার ভাষ্য অনুযায়ী, তবে আমি জহির বা মার্কেজ পড়ার চেয়েও বেশি বিপন্ন বোধ করবো।
আপনার অনুভুতির জন্যে অনেক শুভেচ্ছা।
-----------------------------------
... করি বাংলায় চিৎকার ...
-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ ।
প্রথমেই স্বাগতম পলাশ দত্তকে । কয়েকদিন থেকেই তার লেখা পড়ে পড়ে ভাবছি তাকে অনেক কিছু জানাবার ছিলো । জানাবার ছিলো যে আমার সময়ের ( 'শূন্য' নামের দশক-পাথরের ভার যে পলাশ দত্ত কি, সুমন সুপান্থ নামের অনেকের কাঁধেই বসেছে ভালো করেই , আর সোহেল হাসান গালিব সম্পাদিত ' শূন্যের কবিতা' নামের সংকলন সেটাকে পোক্ত করেছে আরো ! ) অন্যতম প্রিয় কবি-বন্ধুকে সচলে পেয়ে দারুন ভালো লাগছে ! বন্ধু হাসান মোরশেদ ক'দিন ধরেই বলছিলো পলাশ সচল হবে শীঘ্রই , তার বরাতেই জানলাম 'প্বথিবীর শেষ গ্রাম' র সংবাদ ও । পড়া হলো পলাশের কিছু চমত্কার কবিতা ও । অভিবাদন পলাশ ।
শহীদুল জহির আমদের অনেকেরই প্রিয় লেখক, সন্দেহ নেই । আর আমি নিজে মনে করি আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের পর আমাদের কথাসাহিত্যের সবচেয়ে উজ্জ্বল বাতিঘরের নামই শহীদুল জহির । কেবল তাঁর অকাল প্রয়াণের জন্যই নয়, কব্জির শক্তির গুনেই তাঁকে অস্বীকার করা,অনালোচিত রাখা আমাদের পক্ষে দুরহ ! ফারুক ওয়াসিফের আরো একটা লেখা / মন্তব্যে দেখেছি, তিনি বিষয়টা খেয়াল করে উল্লেখ করেছেন,- আমার নিজের অল্প-সল্প পাঠক্ষমতায় ও বুঝতে পেরছি যে , শহীদুল জহির তাঁর সমস্ত দুর্বলতা ( সব লেখকেরই কম বেশী থাকা স্বাভাবিক ) সমেত ও তার নিজের সর্বোচ্চ উত্তরণ ঘটিয়েছেন তাঁর শেষ উপন্যাস ' মুখের দিকে দেখি' তে ।
জাদু-বাস্তবতা ( যা কি না আমরা মার্কেজের সমার্থক বলেই ধরে নিয়েছি ) বা ল্যাতিন কথাসাহিত্যিকদের , এমন কি আমাদের সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ র প্রভাব তাঁর নিজের লেখায় থাকলে থাকতে ও পারে বলে শহীদুল জহির নিজেই বলেছেন বার কয়েক । ( ছোটকাগজ কথা য় কামরুজ্জামান জাহাঙীরের সঙে সাক্ষাত্ কারে , এস রনি র সঙে আর এক আলাপচারিতায়, যা প্রথম আলোয় ছাপা হয়েছিলো )
নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে করি, দেশে থেকেও অনেকের পক্ষে যা একটু কঠিন-ই ছিলো; এই পরবাস ও কেন জানি, কেমন করে জানি প্রতিবন্ধক হতে পারে নি; - মৃত্যুর আগে পর্যন্ত একটা ভালো যোগাযোগ ছিলো এই কৃতিমান লেখকের সঙে । ব্যাক্তিগত অনেক ফোনালাপে উঠেছিলো বিষয়টা, শহীদুল জহির কে কখনোই অস্বীকার করতে শুনিনি ! বরং একবার এ ও বলেছেন তাঁর জাদুকরী ভাষার সিনট্যাক্সটা তিনি পেয়েছেন মার্কেজ থেকেই !
( এই নিয়ে একটা লেখা প্রায় শেষ করে এনেছি, লোক সম্পাদক অনিকেত শামীমের হুংকারে । )
তবে ফারুক ওয়াসিফের মতো আমিও জানি , শহীদুল জহিরকে নিয়ে লেখার সময় এখন-ই নয় ।
তো, পলাশ , আপনি যখন লিখেন
শহীদুলকে যারা গ্যাব্রিয়েলের অনুগামী বা সহগামী মনে করেন তারা মানুষ কি না সন্দেহ হয়। তাদের অনুভূতি নিয়ে সন্দেহ হয়।
তখন আপনাকে ই বরং আবেগের ভেলায় ভাসমান মনে হয় বেশি !!
ভালো থাকুন । আপনার এই লেখাটার জন্য ধন্যবাদ । আর শহীদুল জহির আমাদের এমন এক লেখক, তাঁকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলতেই পারে, বিরতিহীন ।
---------------------------------------------------------
আমার কোন ঘর নেই !
আছে শুধু ঘরের দিকে যাওয়া
---------------------------------------------------------
তুমি এসো অন্যদিন,অন্য লোক লিখবে সব
আমি তো সংসারবদ্ধ, আমি তো জীবিকাবদ্ধ শব !
শহীদুল জহিরকে মার্কেজের অনুগামী কিংবা সহগামী মানতে পলাশ দত্তের আপত্তি । আপত্তি আমারো এইরকম ট্যাগিংয়ে ।
মোটা দাগে বললে- ঐ সব যাদু বাস্তবতা তো আমাদের প্রাচীন রুপকথাগুলো খুঁজলেই ও পাওয়া যায়?
তাহলে কি মার্কেজ ঐ সবের অনুগামী কিংবা সহগামী?
এইসব বালখিল্য ।
পলাশকে অনুরোধ করবো নিচের গল্পটা পড়ার জন্য সময় করে । আমাদের এক সহ-সচল আনোয়ার সাদাত শিমুলের লেখা । বেচারা লেখককে একই হ্যাপা সামলাতে হয়েছে- ''শহীদুল জহিরের অনুগামী কিংবা সহগামী"
নীলুফার যখন মারা গেলো
এইক্ষেত্রে পলাশ দত্তের বিবেচনা জানতে আগ্রহী আমি ।
-------------------------------------
বালক জেনেছে কতোটা পথ গেলে ফেরার পথ নেই,
-ছিলো না কোন কালে;
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
অসাধারণ সমালোচনা।
অভিনন্দন পলাশ দত্তকে।
সচলে সমালোচকের বন্ধ্যাত্ব ঘুচছে তাহলে!
যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!
আমার মনে হয়, এ বিতর্কে একটা মাঝামাঝি জায়গা আছে।
শহীদুল জহীর ওয়ালিউল্লাহ ও ইলিয়াস দিয়ে যেমন প্রভাবিত হয়েছেন তেমনি মার্কেজ দিয়েও ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছেন। তাঁর সে রাতে পূর্ণিমা ছিল-তে মার্কেজের ক্রনিকল অব এ ডেথ ফরটোল্ড এর বয়ানকৌশল ব্যবহৃত হয়েছে। বা সাধারণভাবেও সেই প্রভাব টের পাওয়া যায়।
কিন্তু তিনি ধীরে ধীরে জগতকে একটা কুহক বা চক্র ভাবা থেকে সরে এসেছেন। মুখের দিকে দেখি-তে বৃহত সময় নিয়ে ডিল করতে গিয়ে তাঁকে মার্কেজিয় অনিশ্চয়তা ব্যবহার করেও জীবনের একটা গতি দেখাতে হয়েছে। চরিত্রগুলো এবং উপন্যাসের প্রবাহ শেষপর্যন্ত জগতের কুহকের থেকে বেশি শক্তিশালী হয়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়।
প্রথম দিকে তিনি বোধহয় চরিত্র-ঘটনা-আবহ নিয়ে একটা খেলায় মেতেছিলেন। বালক যেমন তার খেলনার জিনিষগুলোকে নানাভাবে নাড়াচাড়া করতে করতে একসময় জোরালোভাবে ধরতে শেখে, তেমনি তিনিও দিনে দিনে জীবনকে ধরবার একটা আংটা পেয়েছিলেন। এবং এটা একেবারেই তাঁর উদ্ভাবন। মার্কেজ ছিল তাঁর লঞ্চিং প্যাড। কিন্তু সেখানেই তিনি আটকে থাকেন নাই।
তাঁর শেষ গ্রন্থভুক্ত গল্প ডলু নদীর হাওয়া এবং ঘুড়ি পত্রিকায় প্রকাশিত শেষ গল্প দ্য মিরাকল অব লাইফ পড়লে এই যাত্রাটা বোজা যায়। ডলু নদীর হাওয়ায় গল্প পাত্রপাত্রী, ঘটনা, সময় এবং পাঠক সমেত একটা ধাঁধার মধ্যে ঢুকে পড়ে। এই ধাঁধার মধ্যেই চরিত্রগুলোর মুক্তি তেমনি মুক্তি পাঠকেরও। এভাবেই অসম্পর্ণ অভস্থায় তাদের একটা ঐ ধাঁধাঁর মধ্যে ফেলে লেখক সটকে পড়েন। মনের মধ্যে তখনও গল্পটা প্রবাহিত হয়। কিন্তু একটা সময় মনে হয় ধাঁধাঁ নয় বরং ধাঁধাঁ ও কুহকের খাঁচা ভেঙ্গে বেরুতে চাওয়া মানুষেরাই বেশি শক্তিমান। গল্পের ফর্মের আবজাব ভেঙ্গে কন্টেন্ট এভাবে সামনে চলে আসে।
দ্য মিরাকল অব লাইফ-এ কোনো কৌশল বা ভনিতা ছাড়াই লেখক বলতে শুরু করেন। আড়াই পৃষ্ঠার গল্পটা যেন আড়াই পৃষ্ঠার কথা বলে। সরল-সিধা চোখে লেখকের দেখা লেখক যত সরলভাবেই বলুন, তাতে মানুষের প্রতি, পরি নামে ঐ বস্তিবালিকা বা তাদের জীবনের প্রতি লেখকের স্লেষ এত প্রত্যক্ষ যে, তাঁকে আর গল্প বলিয়ে মনে হয় না। মনে হয় রূপকার। এবং হ্যাঁ আমাদের সময়ের জট-রস আর দুর্গতির মধ্যে মানুষের মানুষ থাকার ইতিহাস সেটা। মার্কেজ বরং অনেক ক্লাসিক মেজাজে কথা বলেন আর শহিদুল বলেন, চেখভের মতো।
এখন এই যাত্রার কোনটুকু দেখে আমি বলতে পারি যে, শহিদুল মার্কেজিয় জাদুবাস্তবতার লেখক। গাছের গোড়া দেখব কিন্তু তার প্রসারিত শাখা-প্রশাখা কোন আকাশে শীর্ষ তুলল, তা না দেখলে তো সামগ্রিক দেখা হয় না। জাদুবাস্তবতা বা এই নামে যা বলা হয়, সেটা ছিল তার খোলস, পরিণত লেখকের আর খোলসের দরকার হয় না। শহিদুল তাই খোলস ছেড়ে আসলে যাত্রা করেছিলেন। সেখানেই তাঁর ইতি। সেখানেই তিনি আমাদের বিদায় জানাবার সুযোগ না দিয়েই চলে গেলেন।
হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।
আমি আসলে শহীদুলের গল্প নিয়ে কথা বলতেছিলাম।
==========================
পৃথিবীর তাবৎ গ্রাম আজ বসন্তের মতো ক্ষীণায়ু
নতুন মন্তব্য করুন