হারিয়ে যাওয়া কবিতা (১৯৯৮-২০০৫)

পলাশ দত্ত এর ছবি
লিখেছেন পলাশ দত্ত (তারিখ: রবি, ১২/১০/২০০৮ - ৪:৫৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মৃত্যুর সঙ্গে মশকরা মশকরা বিচ্ছেদের সঙ্গে
মশকরা
সাহস লাগে অদ্ভুত
মৃত্যু আর বিচ্ছেদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে খেলতে

কে জিতবে? মরণ না বিচ্ছেদ?
তোমাদের দু’জনের মুখে তাকাই
আর মনে-মনে ভাবি

তোমাদের কাকে নেবো, ফাঁকি দেবো কাকে

বেকুবের মতো অগ্রপশ্চাৎহীন সাহস
আমার আছে
তাই মশকরা করতেছি অনিচ্ছা-স্বাভাবিক

দেখি কে জেতে

মরণ
বিচ্ছে;
মশকরা

যেই জিতুক
আমি হারের জন্য প্রস্তুত আছি

২.
তোমাকে মায়ের মতো ছবিতে দেখতে
তুমি কুৎসিৎ রোগে মাথা ঘুরে-ঘুরে
প’ড়ে যাও অনেকবার রাস্তায়
তুমি কি আমার মা?

কথায়-কথায় এখন হেসে ওঠো যে-তুমি তুমি কে
তোমাকে পুরনো মায়ের মতো চেনা লাগে না
শিশুতোষ কার্টুন তুমি দেখতে না আগে
যতো মনোযোগে এখন
দেয়ালের গায়ে-গায়ে তুমি কার্টুনের স্টিকার
অযথা হেসে হেসে ওঠো
কথায়-কথায়

মাগো, তোমাকে দেখতে এখনো
আমার মায়ের মতো
সুস্থ সুস্থ
মায়ের পূর্ণ স্বাভাবিক তোমাকে

৩.
তোকে ইস্কুলে-ইস্কুলে বেড়াইতে নিয়ে গেছি
ঘরের ছনের ছাদ ফুটা হয়ে পানি
পড়তেছিলো, তুই ইস্কুল থেকে এলে
ডিম-আলু সিদ্ধ খেতে দিই তোকে
তুই তখন পেটে-

একটা ছেলে হোক একটা ছেলে হোক

তোর বাবার যে-চরিত্র ছেলে হ তুই
বয়সকালে তাহলে ভরসা পাবো রে

ছেলে হবে ছেলে হবে
বয়সকালে মুছে দেবে পানি
৪.
আমি তোমাকে একদিন ছোটো ছিলাম ব’লে
পাইলট হতে চাইছিলাম তোমাকে দ্রুত নিয়ে যাবো
তোমার মেয়ে আর আমার বোনের বাড়ি
বোন তখন স্বাভাবিক শ্বশুরের ঘরে থাকবে ব’লে

আমি সেই ছোটোবেলা থেকে মাগো
উড়ে-উড়ে তোমার কাছ থেকে দূরে
ঠিকঠিক চ’লে যেতে পারি

তবু তুমি আমাকে তোমার ভাববে একমাত্র
একটিমাত্র ছেলে
ভরসায় ভরসায় যে থাকো বড়ো
কী হবে সে যেদিন পালিয়ে গেলে?

ছেলেকে তুমি স্কুলে-স্কুলে দিলে
ছেলে বড়ো হয়ে যায়
ছেলে জাগতিক নিয়মে তোমাকে মহাজগতকে
আয় আয় আয়
স্বাধীনতা আছে রে বড়ো
দূরে গিয়ে মরলে, আয় আয়

৫.
ছেলেকে তুমি হাতের বালা ছেলেকে তুমি গলার চেইন
ছেলেকে তুমি বাড়িভাড়া ছেলেক তুমি জমানো প্রাইজবন্ড
ছেলেকে তুমি পূজার শাড়ির নগদ ছেলেকে তুমি তাবৎ সামর্থ্য
তুমি তাকে সব ঢেলে বলী দিলে বিদ্যার কোলে

বিদ্যা বিদ্যা বিদ্যা

বিদ্যা লাগে বড়ো
জগতে কী আর আছে গাড়ি
জগতে কী আর আছে ঘোড়া

মাগো তুমি জানো বিদ্যাসাগরÑ
জানো গাড়িঘোড়া চড়ে সে পুত্রকন্যা
লেখাপড়া করে তারা যারা

মাগো তুমি বিদ্যার ফাঁকে
ছেলেকে তোমার বিচ্ছেদে দিলে

ওইখানে মহাজীবন মাগো
প্রিয় বন্ধুতার ছদ্মবেশে ঘোরেফেরে

৬.
জল আমার পর ছিলো না
আমি ডুবেছি পাহাড়
পদমূলে পলাশ, হাহ্
ভাসতে-ভাসতে জল ফেলে
পাহাড়ে পলাশবনে
কেনো গেছিলাম তোমার
কাছে? তুমি মাটিতে
মিশেমিশে, ঘাসে শুয়ে
আলোয় উড়ে তোমাকে
দেখি পূর্ণ চরাচর

কেনো জলকে ভুলে হে
পলাশ আমি গেছিলাম
তোমার অন্যমনস্ক
সবুজের কাঁটাতারে
৭.
ক্যকটাস ফুটছিলো আকাশ আর মাটি দোঁহে মেলে না ব’লে। আমি শহর ছেড়ে পালাইছিলাম মুক্তি আর নতুন তার প্রযুক্তির কৌতূহলে। ওইখানে
নিয়ত লংমার্চ করতেছিলো দূরের মেঘবন- আমার তা জানা ছিলো না। জানতাম না।
পা মাটিতে সরাসরি লাগলে নিজেকে মানুষ মনে হয়। জানতাম না পৃথিবীতে বাপ-মা ভোলানোর ক্ষমতা রাখে মাটি। জানতাম আমি মাটির বানানো মাটিতেই ফিরে যাবো। জানতাম না মাটি সরাসরি পায়ে লাগলে নিজেকে মনে হয় স্বয়ম্ভু।
সামান্য মাটির পরশে আমি স্মৃতিশক্তিহীন, সামান্য মাটিতে আমি ভুলে যাই
আমার উত্তরাধিকার, ভুলে যাই মা শহরে তাবৎ দুনিয়া বেচে তার। ভুলে যাই ভরসা আমি। মনে হয় শুধু মনে হয় মানুষ পৃথিবীতে বাঁচে। পৃথিবীতে মানুষ জীবনে একবারই বাঁচে। মাটি আমায় কানেকানে আকাশের তারা দেখিয়ে দেয়। শুধু সেই সত্য বলেÑ পৃথিবীতে মানুষ জীবনে একবারই বাঁচে।

৮.
দেখি মাটি আর তুমি
দেখি আকাশ আর মাটির
মাঝখানে তোমার বাতাস
হয়ে যাওয়া- আমাকে
ঘিরে ধরো। হা-শ্বাসে
না-শ্বাসে পূর্ণ হই

শরীর আমার মাটি চায়
চায় আকাশভরা সূর্য
আর তারা মাটির গড়া
মানুষ, আমি জলবাষ্পে
তোমার প্রতীক্ষা করি
প্রার্থনা করি বৃষ্টি
ছুঁয়ে ঘুরি তোমার পা

তুমি পৃথিবীর প্রথম
আমি স্বর্গহারা ইভ্
মাটিতে শিকড় গেড়ে
আজ গাছের চারা- তুমি
মাটি চিনে সূর্যের দিক
যেতে-যেতে ঝরো রোদ

৯.
রোদ আজ ঘরে এসে পড়েছে। টবে ফুটে গেছে সব অনন্য চারা। টবে বাঁধা
ব’লে চারা তুমি ম’রে খ’সে যেতে চাও। মা যেতে চায় ছেলেকে খুঁজতে
বিদ্যাবাগানে। যদিও সে-বাগান ধ’সে গেছে বহুবহু আগে সে-বাগানে মানুষ
গেড়েছে বসতি। কিন্তু তবু মা। ছেলেকে খোঁজে, বলে আছে ওর বন্ধুর পাশেÑ
বেকার, কপর্দকহীন আলোর তলায় ব’সে-ব’সে নাকি দুই বন্ধু গল্পে মশগুল।
খুঁজতে যেতে চায়। মা ছেলেকে খুঁজতে ঘর ছেড়ে চ’লে যেতে চায়।

টবে বাঁধা বলেই গাছ। তবু গাছ আজ আর চেনে না সূর্য। আলোতে নাই তার
কণামাত্র পরিত্রাণ। সে তো ফুটছিলো জলে। ভুলে পাহাড়-কৌতূহলে
ছুঁইছিলো মাটি। এই মাটি আসলে ভুল যে কিনা টবেও নির্বিকার, বুকে ফোটাতে
চায় ফুল। এই মাটি স্বেচ্ছাচারী। এই মাটি দুই নাম্বার। এই মাটি স্বার্থপর। টবেই যদি ফোটা তবে পৃথিবীতে আর অভাবব কই? এবার নিজের মতো ফুটবে পুনশ্চ মাটিতে সূর্যের আলোয় সে নিজস্ব এক ভুল ফুল। এক বিচ্ছেদে শীর্ণ স্বর্ণলতা। ফুটতে
চায় একাএকা চৌকষ পৃথিবীর বুকে। মাটিতে সবকিছিুর স্মৃতি থেকে যায়? থাকুক যেই পা একদিন সরাসরি ছুঁইছিলো মাটি প্রায়শ্চিত্ত তো তার সুনিশ্চিত।

কিন্তু একজীবনে দুইবার স্বয়ম্ভু হতে পারে কে? পৃথিবীর কক্ষপথে ঘুরতে ঘুরতে
তাকে খেলেই যেতে হবে

১০.
মৃত্যুর সঙ্গে মশকরা মশকরা বিচ্ছেদের সঙ্গে
মশকরা
সাহস লাগে অদ্ভুত
মৃত্যু আর বিচ্ছেদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে খেলতে

কে জিতবে? মরণ না বিচ্ছেদ?
তোমাদের দু’জনের মুখে তাকাই
আর মনে-মনে ভাবি

তোমাদের কাকে নেবো, ফাঁকি দেবো কাকে

বেকুবের মতো অগ্রপশ্চাৎহীন সাহস
আমার আছে
তাই মশকরা করতেছি অনিচ্ছা-স্বাভাবিক

দেখি কে জেতে

মরণ
বিচ্ছে;
মশকরা

যেই জিতুক
আমি হারের জন্য প্রস্তুত আছি॥


মন্তব্য

নজমুল আলবাব এর ছবি

আরে এইগুলা পাইলি কই???

আমি অনেকদিন রাখছিলাম। পরে কোন ফাঁকে পড়ছিল খেয়াল নাই।

তোর কাছে আছে দেখে ভাল লাগছে।

ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল

আহমেদুর রশীদ এর ছবি

পুরা এক জগ পলাশ দত্ত।
গ্লাসে ঢেলে ঢেলে পড়লাম।
কয়েক গ্লাস অমৃত মনে হলো।

---------------------------------------------------------

আমরা যারা শিখিনি চাষবাস,ফসলের গীত
গুলালিতে পাখি হত্যা

---------------------------------------------------------

ঘাস তুমি ঘাসের মতো থাকো মাটি ছুঁয়ে
যে দেখার সে নতজানু হয়ে ছুঁবে তোমার আঙুল
অবরুদ্ধ মাঠ থেকে তুমি লাফিয়ে নেমোনা প্লিজ পাথরের পথে
________________________________________
http://ahmedurrashid.

মুজিব মেহদী এর ছবি

মৃত্যুর সঙ্গে মশকরা শুরুতে শেষে দুইবার করলেন ও করালেন যে!
একজীবনে দুইবার স্বয়ম্ভু হতে পারে কে?
সে কি মৃত্যু?
................................................................
তোমার হাতে রয়েছি যেটুকু আমি, আমার পকেটে আমি আছি যতটা, একদিন মনে হবে এটুকুই আমি, বাকি কিছু আমি নই আমার করুণ ছায়া

... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ...
কচুরিপানার নিচে জেগে থাকে ক্রন্দনশীলা সব নদী

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

প্রথমে ভাবলাম ব্লগে এতগুলা কবিতা একসাথে! পড়বো? অল্প অল্প কইরা দিলেই পারতেন।
এই ভাবতে ভাবতে কখন জানি দেখি পড়া শেষ... ভালো লাগলো।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

রানা মেহের এর ছবি

আপনার 'মা'কবিতাগুলো
খুব ভালো হয় পলাশ দা
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

শেখ জলিল এর ছবি

একগুচ্ছ পলাশীয় কবিতা পড়ানোর জন্য কবিকে ধন্যবাদ।
দশ নম্বরটা বেশি ভালো লাগলো।

যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!

পলাশ দত্ত এর ছবি

এতো ভালো-ভালো মন্তব্যের উত্তরে বলার মতো কিছু কুজে পাচ্ছি না।

==========================
পৃথিবীর তাবৎ গ্রাম আজ বসন্তের মতো ক্ষীণায়ু

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।