এটি আল মাহমুদের সঙ্গে বাংলা কবিতা নিয়ে একটা আলাপ। আলাপটি দৈনিক সমকালের সাহিত্য সাময়িকী কালের খেয়ার চলতি সংখ্যায় ছাপা এই শিরোনামে। আলাপটা আমার সঙ্গেই হইছে। এই কারণে এটা সচলায়তনে দিলাম।
=================================
আপনার উড়ালকাব্য বইটায় আপনি বলছেন পৃথিবীতে ঈগল থাকবে না ইতিহাস থাকবে। তো আগামী পৃথিবীর ইতিহাস তো হবে প্রযুক্তিতে আত্মবিস্মৃত মানুষের ইতিহাস। সেই ইতিহাসে কবিতাকে কতোখানি জায়গা দেবে মানুষ?
আল মাহমুদ : মানুষের শ্রেষ্ঠ কাজ হলো কবিতার সৃষ্টি। অর্থাৎ স্বপ্ন সৃষ্টি। মানুষ এই পৃথিবীতে কঠোর-কিঠন বাস্তবতার মধ্যে বাস করতে পারে না। তারা কিছুটা বাস্তবে কিছুটা স্বপ্নে বাস করে। এই যে স্বপ্ন সৃষ্টি করতে পারে মানুষ এটার নামই হলো কবিতা। মানুষ যে স্বপ্ন সৃষ্টি করে স্বপ্নের মধ্যে চলাফেরা করে এটা সম্ভব হয়েছে কবিতার জন্যে।
নতুন ধরনের কবিতা লিখতে না পারলে কোনো কবি কবিতার ইতিহাসে জায়গা পান না। আপনি যখন লেখা শুরু করলেন তখন এই চ্যালেঞ্জটা কিভাবে মোকাবেল করলেন?
আল মাহমুদ : আমি যখনই কবিতা লিখেছি তখনই নতুন কথা বলতে চেয়েছি। কবিতার আঙ্গিক বদলে দিয়েছি। কথা নতুন হলে আপনাতেই আঙ্গিক বদলে যায়। বক্তব্য থাকতে হবে। বক্তব্য থাকলে আঙ্গিক বক্তব্যের সাথে বদলে যায়।
আপনার ‘লোক লোকান্তর’ বেরুলো ১৯৬৩তে। ‘কালের কলস’ বেরুলো ১৯৬৬তে। এই দুই বইয়েল জন্য আপনি বাংলা একাডেমী পুরস্কার পেলেন। পাঠক আপনাকে চেনে ‘সোনালি কাবিন’-এর জন্য। ওই বইয়ের প্রথম কবিতাটা ‘প্রকৃতি’- “কতোদূর এগোলো মানুষ!/আমি আজো ঘোর লাগা বর্ষণের মাঝে/উবু হয়ে বসে আছি।” এটা কি আসলে গ্রামের কথা?
আল মাহমুদ : হ্যাঁ এটা তত্কালীন আমার যে পরিবেশ ছিলো গ্রামের কথা।
সোনালি কাবিন বেরুলো ১৯৭৩-এ। কবিতাটা তারও কিছু আগে লেখা। প্রায় ৩৬ বছর পার হয়ে গেছে। এখন কি আপনার মনে হয় যে বাংলাদেশে/পৃথিবীতে গ্রাম থাকবে আদৌ?
আল মাহমুদ : দেখো আমরা হলাম এশিয়ান মানুষ। আমাদের তো চতুর্দিকে গ্রামই। যেটাকে তোমরা বলো যে urbanity, আমার কি সত্যি সত্যি খুব urban? আমরা তো অতোটা urban না। আমরা তো গ্রাম প্রকৃতি আধা শহর আধা গ্রাম- এর মধ্যে বাস করি। তোমার প্রশ্নটা কী?
আমার প্রশ্নটা হচ্ছে আধা শহরের ধাক্কায় তো আধা গ্রাম নাই হয়ে যাচ্ছে। ইওরোপীয় শহরের চরিত্র বাদ দিন। বাংলাদেশের শহরের যে চরিত্র ঢাকা শহরের যে চরিত্র চিটাগাংয়ের যে চরিত্র এই শহরের চরিত্র কি গ্রামের দিকে চলে যাচ্ছে না? গ্রাম কি শহরের চরিত্র ধারণ করতেছে না আস্তে আস্তে? এভাবে পুরো বাংলাদেশটাই কি শহরের আধা শহরের চরিত্র নিয়ে নেবে নাকি আস্তে আস্তে?
আল মাহমুদ : আমারও তাই মনে হয় যে,
নিরঙ্কুশ গ্রাম বলতে যেটা বুঝতাম সেই গ্রাম কি থাকবে? নাকি এই আধা শহুরে চরিত্রের গ্রাম হবে?
আল মাহমুদ : এটা তো এই মুহূর্তে বলতে পারছি না..
কবি তো দ্রষ্টা। আপনার তো অন্তর্দৃষ্টি আছে...
আল মাহমুদ : আমার মনে হয় যে হ্যাঁ, নানান আধুনিক সুবিধাপ্রাপ্ত একটা গ্রাম থাকবে।
আচ্ছা মাহমুদ ভাই বাংলা কবিতায় আপনার কাব্যভাষাটা তো নতুন?
আল মাহমুদ : তখন ছিলো নতুন।
হ্যাঁ। ৩০-এর দশকের কবিদের হাত দিয়ে যে-ভাষাটা তৈরি হলো বাংলাতে, সেই ভাষার মধ্যেই পরবর্তি সময়ে আপনারা পরে আরো কেউ কেউ সেই ভাষার কাঠামোর মধ্যেই নতুন নতুন কিছু জুড়ে দিয়ে নিজস্ব একটা করে ভাষা তৈরি করছেন। কিন্তু ৩০-এর পর এখন ২০০৯ সাল, এই এতো বছরেও ভাষার কাঠামোতে কোনো পবির্তন ঘটে নাই।
আল মাহমুদ : কথাটা ঠিক সর্বাংশে সত্য নয়। কিছু পরিবর্তন হয়েছে। জীবনানন্দ দাশের যে-ভাষা সেই ভাষার একেবারেই নিকটবর্তী কবি হলাম আমার ৫০ দশকের কবিরা। তো জীবনানন্দ দাশের ভাষা কি অবিমিশ্র থেকেছে? আমার মনে হয় যে ভাষা অনেকটা নদীর স্রোতের মতো। বদলে যাচ্ছে কিন্তু ধরা পড়ে না সহজে।
না, ধরেন যে রবীন্দ্রনাথের পর ৩০-এ ভাষাটা যেভাবে বদলালো একবারে, যেভাবে চোখে পড়ে
আল মাহমুদ : ৩০-এর কবিদের প্রকৃতপক্ষে কোনো দেশ ছিলো না। তারা ইউরোপীয় সাহিত্য পড়েছেন। সবগুলো লোকই ইংরেজি ভাষার অত্যন্ত ভালো ছাত্র ছিলেন। যখন তারা মনে করলেন যে একজন কবির তো দেশ না হলে চলে না, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। তো কোথায় ফিরবে? বুদ্ধদেব বসু দেশে ফিরতে চাইলেণ, কিন্তু দেশ কই? তার তো কোনো দেশ ছিলো না। তিনি মহাভারতে ফিরলেন। এইরকমই বিষ্ণু দে : আমার খুঁজেছি হরেক বইয়েতে আপন দেশ/ দেশের মানুষ ঘুরিয়েছে শুধু ডাইনে বাঁয়ে/এখন আমি হয়রান হয়ে খুঁজছি শেষ/ফিরবো ফিরবো আমি বলো সে কোন গাঁয়ে। এদের সবারই ফেরার চেষ্টা ছিলো। কিন্তু ফিরতে গিয়ে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু আমার ৫০ দশকের কবিরা আমি শামসুর রাহমান বা আমাতের প্রথমেই দরকরা ছিলো একটা দেশ। আমার দেশের ভেতরেই ছিলাম। একটা দেশ আমাদের ছিলো সেটার নাম বাংলাদেশ।
ঠিক আছে। কিন্তু ৩০-এর কবিরা যে ভাষাটা আপনাদের দিছেন সেটা না দিলে কি আপনারা যতো সহজে শুরু করতে পারছেন সেটা পারতেন?
আল মাহমুদ : ঠিক আছে। তারা যে ভাষাটা দিয়েছিলেন, ৩০-এর কবিরা, আমার সে ভাষায় কাঠামোটা রেখেছি; কিন্তু আমরা অনেক আঞ্চলিক-গ্রাম্য শব্দ মিশিয়ে একটা ভাষা তৈরি করেছি।
কবিতাকে কি আপনি শিল্প মানেন? কবিতা কি একটা শিল্প?
আল মাহমুদ : কবিতা হলো স্বপ্ন। স্বপ্নটা যখন কাব্যে রূপ নেয়, ভাষায়- তখন কিন্তু এটাকে শিল্পই বলা উচিত। অতিশয় অনুভূতিপ্রবণ সূক্ষ্ম শিল্প।
শিল্প বললে কিছু আবার পরিকল্পিত ব্যাপার আসে না? মানে যে ইচ্ছাকৃতভাবে মানুষের আবেগকে স্পর্শ করার জন্য জাগ্রত করার জন্য আলোড়িত করার জন্য কবির ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু শব্দ সাজিয়ে লেখাÑ এই অর্থ কি আমার শিল্প বলবো এটাকে?
আল মাহমুদ : না। ভাষার অর্থে। ভাষাকে যদি শিল্প বলা হয় তাহলে এটা বলা যায়। কারণ কবিতা কী? ভাষা ছাড়া কিছু না।
আমার যারা এখন লেখালেখি করি তারা তো লেখালেখি শুরু করছি আপনার ৫০ বছর পরে। এই কারণে আপনার সাথে একটু ভাবনা বিনিময়। আমাদের সময়ে প্রায় সবাই কবিতা লেখেন হচ্ছে যে ধরেন কোনো একটা কোনো একটা ঘটান দেখলো অথবা কোনো একটা দৃশ্য দেখে আলোড়িত হলো যে কোনো একটা অনুভূতি নিয়ে তার কেমন লাগলো সেইটা লেখে। আমার প্রশ্নটা হচ্ছে কবি কি কোনো দৃশ্য দেখে তার কেমন লাগলো সেইটা লিখবেন, নাকি কী দেখলেন সেইটা লিখবেন?
আল মাহমুদ : কবির কাজ হলো অন্যকে স্বপ্ন দেখানো। অন্যকে স্বপ্ন দেখাতে হলে ভাষার যে-উপাদানগুলো প্রয়োজন এটা কবিকে আয়ত্ব করতে হবে নিজে। কেউ সাহায্য করতে পারে না। তো আমার ধারণা যে বাংলা কবিতা আধুনিক বাংলা কবিতা এখন এমন একটা অবস্থায় এসে পৌঁছেছে যে এখান থেকে তার একটা মোড় ফেরা উচিত। কোথাও চলে যাওয়া উচিত। কিন্তু মোড়টা ফিরছে না। যদি মোড় ফেরে তাহলে একটা ওলোটপালোট হয়ে যাবে।
এই যে মোড়টা যে ফেরা উচিত বলে মনে হচ্ছে আপনার এটা কেন মনে হচ্ছে?
আল মাহমুদ : এটার কারণ হলো প্রত্যেক ভাষারই একটা গতি আছে, একটা পিরিয়ড আছে। আধুনিক কবিতারও একটা পিরিয়ড আছে। আমার বলি আধুনিক কবিতা। আধুনিক কবিতা কতোকাল আধুনিক থাকে? একশ বছর? আমার এখনো তো আধুনিক কবিতাই বলি। এই যে একশ বছর পরেও কবিতা এখন যেটা লেখা হচ্ছে এটা আধুনিক? এটার অন্য নাম হওয়া উচিত।
অন্য নাম হতে হলে তো লেখাটাও অন্যরকম হওয়া উচিত, নাকি?
আল মাহমুদ : সেটাই তো। অন্য নাম যখন হবে তখন লেখাটাও অন্যরকম হবে।
বাংলা কবিতায় আপনারাও লিখছেন, আমরাও লিখি- আমরা সবাই উত্তম পুরুষে কবিতা লিখি। সব আমি দিয়ে লেখা হয় কেন আমাদের কবিতা?
আল মাহমুদ : এই প্রশ্নের জবাবটা তো আমাকে না করে নিজকে করাই উচিত। কারণ আমি, এটা ঠিক কথা যে আমি-আমি, এখন আমি না থাকলে কী হয়? আমি না থাকলে দেশ আছে জনগণ আছে।
কিন্তু কবিতা হয়ে ওঠার প্রথম শর্ত যেটা যে আমার অনুভূতিটাকেই সর্বজনীন করে তুলতে হবে লেখার মধ্যে, শুদু আমি দিয়ে লিখলে আমার অভিজ্ঞতাকে সর্বজনীন করে তোলার ক্ষেত্রে কি একটু সমস্যা হয় না? এটা কি আমাদের একটা টেকনিক্যাল প্রবলেম হয়ে যাচ্ছে না কবিতার?
আল মাহমুদ : আমার মনে হয় যে... একটা যুগ ছিলো যখন... বাংলা কবিতা চর্যার দল থেকে উঠে এসছিলো। আগে তো কবিতা গান করা হতো। এবং এটা যারা করেছিলেন তাদের মধ্যে নিশ্চয়ই সুধীন্দ্রনাথ দত্ত একজন। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত মধ্যবিত্ত সমাজকে নিয়েই কাজ করেছেন। উনি মধ্যবিত্ত সমাজকে ভাবতেন উটপাখি- উড়তে পারে না, কিন্তু সে পাখি। আবার পশুদের সাথেও মিশতে পারে না। কারণ সে ভাবে যে তার পাখা আছে। এই যে দোদুল্যমান মধ্যবিত্ত সমাজ, এই যে বেদনা এটা আধুনিক কবিতায় উচ্চকিত হয়েছে বাংলা ভাষায়। সেখান থেকে আর অগ্রসর হতে পারেনি। আমার ধারনা এখনকার যুগের যে কবিরা- আমি অবশ্য জানি না, অতো খোঁজখবর রাখতে পারি না তো, চোখেও দেখি না- হয়তো তারা ভালোই লিখছে। কিন্তু কী? একটা কিছু দাঁড়াবে তো? সেটা আমি তো দেখি না। হয়তো আছে তোমাদের মধ্যে, কিন্তু... আমার কথা হলো আধুনিক কবিতা কতোদিন আধুনিক? এই হিসাবটা করতে হবে।
একটা সময় ছিলো যখন কবিতাকে আধুনিক কবিতা বলা হতো। এখন তো আর কবিতাকে আধুনিক কবিতা বলা উচিত না। অন্য কোনো নাম দেয়া উচিত। চিন্তার বদল না হলে আঙ্গিক বদলায় না। এমন কিছু বিষয় আসতে হবে যাতে আঙ্গিকটা ফেটে যাবে। এটা তো ঘটছে না। ঘটবে না এটা বলছি না। হয়তো এই সময়ের মধ্যেই এমন বহু কবি আসতে পারেন যারা ভাষার খোলনলচে পাল্টে দেবেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত দেখছি না।
কিন্তু আপনার বক্তব্য হচ্ছে বদলানোর সময় হইছে?
আল মাহমুদ : হ্যাঁ, পুরোপুরি।
এই বদল কি সচেতনভাবে করা সম্ভব?
আল মাহমুদ : সচেতনভাবে করা সম্ভব। সচেতনভাবেই তো করতে হবে। কিন্তু কবিতা তো হতে হবে। এমন একটা কিছু হতে হবে যেটা দারুণ একটা প্রভাব বিস্তার করে মানুষের ওপরে।
কবিতায় কল্পনা জিনিসটা কী বলেন একটু।
আল মাহমুদ : কবিতায় তুমি কী কী চাও? কবিতায় কল্পনা চাও না। কী চাও।
বাস্তব জগতকে দেখে সেখান থেকে তাড়িত হয়ে যে কল্পনার সৃষ্টি সেটা একটা। আর একটা হচ্ছে যে শুধুই কল্পনার জগত তৈরি করে লেখা।
আল মাহমুদ : শোনো কল্পনাটা সবসময়, আমার ধারণা আর কি, বস্তুনির্ভর। তুমি কল্পনা করছো কিন্তু অন্তঃসার কিছু নাই- এটা তো কল্পনা হয় না। কল্পনাকে অবশ্যই একটা বাস্তবতার ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।
মন্তব্য
কবি'র অনেক ধ্যান-ধারণার সাথে আমার তীব্র দ্বিমত আছে। কবিতাও বুঝি কম। তবে এই সাক্ষাৎকারটি ভালো লাগলো। চিন্তার ধরন, লেখার কারণ, ইত্যাদি সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়ায় গেলো।
খুব ভাল লাগল।
আধুনিক কবিতাকে অন্যকিছু বলা মনে হয় যুক্তিসঙ্গত হবে না। আবার সব কবিতাকেও আধুনিক বলা যাবে না। ভাবের জগতে আধুনিকতার ছোঁয়া থাকতে হবে তো। হাজার বছর পরেও কেউ আধুনিক কবিতা লিখতে পারে বলে আমি মনে করি। এখন যারা লিখছেন তাদের সবার কবিতা হয়ত আধুনিক না - তাহলে হয় অতিআধুনিক (ultra-modern), না হয় উত্তরাধুনিক; নাম তো আছে। আর অন্যকোন নামের কথাও কবি প্রস্তাব করেননি। আল মাহমুদ অনেক শক্তিমান কবি এ কথা মানি। যতদূর জানি ওনার বয়স হয়েছে অনেক, এবং চিন্তার জগতেও ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে তাঁর।
___________________
সহজ কথা যায়না বলা সহজে
আল মাহমুদ একজন অসাধারণ কবি। আমি তারুণ্যে পদার্পণ করার পর তাকে এতটা গভীরভাবে পড়ছি এখন...
খুব ভালো লাগলো পড়ে। কবি হিসেবে আল মাহমুদ সত্যিই অনেক বড় মাপের।
পলাশ ভাইকে ধন্যবাদ এই সুন্দর কবির সাথে সুন্দর একটা সাক্ষাৎকার আমাদের সাথে শেয়ার করার জন্য।
বাংলা কবিতাকে আল মাহমুদ 'সোনালি কাবিন'-এ যা দিয়েছেন তা অতুলনীয়। এবং বাংলা কবিতায় মাহমুদের দান ওই বইয়েই শেষ। এই ঐতিহাসিক সত্যগুলিও আমাদের মনে রাখা উচিত। বিশেষ করে আমাদের মতো তরুণ কবিতা লিখিয়েদের।
==========================
পৃথিবীর তাবৎ গ্রাম আজ বসন্তের মতো ক্ষীণায়ু
==========================
পৃথিবীর তাবৎ গ্রাম আজ বসন্তের মতো ক্ষীণায়ু
পলাশ ভাইয়া,
বুঝলাম না......
শেষ কেন?? আমি তো 'কবিতাসমগ্র' পড়ছি এখন। ক'দিন আগে শুরু করেছি...শুধু ক্রমাগত মোহিত হয়ে চলেছি...... অসাধারণ সেই ভাষাশৈলী আর চিত্রকল্পগুলোও খুব ব্যতিক্রমধর্মী। যদিও আমি হয়ত কবিতা অনেক আগে থেকে ভালোবাসলেও তেমন ভালো বুঝিনা...... কিন্তু আমার কাছে তো অনন্যসাধারণ মনে হয়েছে কবি আল মাহমুদকে। অন্তত নজরুল, জসীমউদ্দীন পরবর্তী কাউকে আমার এতটা শক্তিশালী আর হৃদয়স্পর্শী মনে হয়নি (আগেই বলেছি, আমি আপনাদের তুলনায় কবিতা নিয়ে খুব বেশি জানিনা, শুধু কবিতা ভালোবাসি...)।
এখনও তো উনার কবিতা অনেক চমৎকার!
আমার প্রতিউত্তর করার জন্য পলাশ ভাইয়াকে ধন্যবাদ...
আল মাহমুদ অতুলনীয় কবি। ভালো লাগলো সাক্ষাতকার।
কিছু বিষয় আলোচনাতে এসেছে যা আরো বিস্তারিত হলে পাঠক হিসেবে কবির ভাবনার সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ হতোঃ
কবিতায় ভাব/আবেগ এবং ব্যকারণের আন্তঃসম্পর্ক; কবিতার আদৌ সার্বজনীন হওয়ার চেষ্টা করা জরুরী কিনা; অথবা কবিতার আদৌ কোন লক্ষ্য থাকা উচিত কিনা ইত্যাদি।
ধন্যবাদ একটা দরকারী সাক্ষাতকার প্রকাশের জন্য।
সঠিক মানুষগুলো কেন যেনো বেঠিক পথগুলো খুঁজে খুঁজে বেছে নেয়- আল মাহমুদ পড়লে প্রতিবার আমার এই কথাগুলো মনে হয়!
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
::: http://www.bdeduarticle.com
::: http://www.facebook.com/profile.php?id=614262553/
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
কালের খেয়াতেই পড়েছি । এখানে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ ।
আল মাহমুদ আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান কবি । কবিতার শব্দ ব্যবহারের স্বতঃবেদ্য স্বাভাবিকতা এবং বিশ্বাসের অনুকুলতা নির্মানে তিনি নিঃশংসয়ে আধুনিক বাংলা ভাষায় একজন অগ্রগামী কবি । প্রখ্যাত সমালোচক অধ্যাপক শিবনারায়ণ রায় বলেন -"সমকালীন যে দুজন বাঙালী কবির দুর্দান্ত মৌলিকতা এবং বহমানতা আমাকে বারবার আকৃষ্ট করেছে তাদের মধ্যে একজন হলেন বাংলাদেশের আল মাহমুদ , অন্যজন পশ্চিমবঙ্গের শক্তি চট্রোপাধ্যায় । " অধ্যাপক ডঃ রাজীব হুমায়ুনের মতে , তিনি চল্লিশ দশক পরবর্তী কবিদের মধ্যে অন্যতম মৌলিক কবি , নতুন কবি । রাজীব হুমায়ুন 'তাঁর মৌলিকত্ব এবং নতুনত্ব ' দেখেছেন আল মাহমুদের 'গাঁয়ে ফেরার পিপাসায়' এবং 'অনিবার্য শব্দ, উপমা , চিত্রকল্পে সে পিপাসার প্রকাশে ' । পঞ্চাশ দশকের প্রধান কবি আল মাহমুদ গ্রামে ফিরলেন এবং গ্রামের মেঠো পথ বেয়ে চলতে গিয়ে রচনা করলেন -
এখন কোথায় যাওয়া যায় ?
শহীদ এখন টেলিভিশনে । শামসুর রাহমান
সম্পাদকীয় হয়ে গেলেন । হাসানের বঙ্গজননীর নীলাম্বরী বোনা
আমার দ্বারা হবে না । জাফর ভাই ঘোড়ার গায়ে হাত বোলান ।
অতএব কবির কোথাও যাওয়া হলো না , কেননা :
আমার সমস্ত গন্তব্যে একটি তালা ঝুলছে । (আমার সমস্ত গন্তব্যে )
বিধায় , আল মাহমুদ লোকজ অভিমুখে যাত্রা করে লোকায়ত বাংলার চিরায়ত শব্দ সুষমাকে আধুনিক বাক্য বন্ধনে উপস্থাপন করলেন । তার নির্মিত পটভুমির কেন্দ্রবিন্দু মানবতা ই আত্মবিশ্বাস । জসীম উদ্দিন এবং জীবনানন্দ উভয়ের থেকে তিনি সম্পুর্ন ভিন্ন প্রকৃতির কবি । কারো প্রতিধবনি নয় , নির্মীয়মাণ স্বকীয়তাই তাকে আধুনিক জগতে বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী করেছে । ক্রমশ হয়ে উঠেছেন আস্থাশীল এক কাপ্তান । আল মাহমুদই আমাদের বিপুল জনসমষ্টির জীবনধারার অভিজ্ঞতাকে কবিতায় ব্যবহার করেছেন :
"আমার বিষয় তাই , যা গরীব চাষীর বিষয়
চাষীর বিষয় বৃষ্টি ফলবান মাটি আর
কালচে সবুজে ভরা খানা খন্দহীন
সীমাহীন মাঠ ।
চাষীর বিষয় নারী ।
উঠৌনে ধানের কাছে নুয়ে থাকা ।
পুর্নস্তনী ঘর্মাক্ত যুবতী । " (কবির বিষয় )
স্পন্দমান আবগের ভুগোল , দেশজ চেতনা ,লেককাহিনী ও ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর সৌন্দর্যে আপ্লুত আল মাহমুদ একজন মিথলজিক্যাল রোমান্টিক কবি । যেমন তিনি তার শ্রেষ্ট কর্ম 'সোনালী কাবিন ' এ মাতৃভুমির ইতিহাস খনন করে তুলে এনেছেন ঐশ্বর্যময় ও বীর্যবান অনিষঙ্গসমুহ । তিনি এখানে শক্তিমত্তার সাথে রোমান্টিসজম প্রবেশ করিয়েছেন যা 'সোনালী কাবিন ' সনেট গুচ্ছকে করেছে মহিমান্নিত ।
"সোনার দিনার নেই , দেন মোহর চেয়ো না হরিনী
যদি নাও , দিতে পারি কাবিনহীন হাত দুটি
আত্মবিক্রয়ের স্বর্ন কোনকালে সঞ্চয় করিনি
আহত বিক্ষত করে চারদিকে চতুর ভ্রুকুটি ;
ছলনা জানিনা বলে আর কোন ব্যবসা শিখিনি । "
'সোনালী কাবিন'সনেটগুচ্ছ কবি উপমা -রুপকের চর্চার কুশলতার যে নিদর্শন রেখেছেন , আমাদের কবিতার ক্ষেত্রে তা নতুন এবং আন্তরিক সততায় উজ্জ্বল । গ্রামের মাটি থেকে বিচিত্র আকুল আগ্রহকে কবি উন্মোচন করেছেন , নদীর চরের প্রতি কৃষানীর পতির অধিকার প্রতিষ্ঠার রূপকল্পে প্রমানিত হয়েছে নারীর প্রতি পুরুষের আকাঙখার ক্ষুধার্ত নদীর উপমায় নর-নারীর কামনার চিত্র ফুটে উঠেছে । এইতো আমাদের আল মাহমুদ এবং তার গ্রামীন প্রান্তরের উপঢৌকন যেখানে যৌনতার আন্তরিক অভিব্যক্তি ঘটেছে -
"ক্ষুধার্ত নদীর মতো তীব্র দুটি জলের আওয়াজ
তুলে মিশে যাই চলো অকর্ষিত উপত্যকায় । "
বাংলাদেশের কবিতার মেজাজ ও মন বুঝতে হলে আমাদের আল মাহমুদের কবিতার দরজায় নক করতেই হবে ।
" কবিতা কি ?
কবিতা তো শৈশবের স্মর্তি
কবিতা চরের পাখী , কুড়ানো হাসের ডিম , গন্ধভরা ঘাস
স্নান মুখ বউটির দড়িছেড়া হারানো বাছুর
কবিতাতো মক্তব্যের মেয়ে চুলখোলা আয়েশা আক্তার ।"
( কবিতা এমন )
কবিতা সহ সাহিত্যের কোন শাখায় নর-নারীর মিলনকে অস্বীকার করা যায় না । হুইটম্যানের কবিতায় ভাবের এক বে আব্রু প্রকাশ দেখে আমরা তাই আতঙ্কিত হলেও খুব্ধ হইনা :
It is I , you women , I make my way
I am stern acrid , undissuble , but I have you
I do not hurt you any more than is necessary for you
I pour the stuff to starts sons and daughters fit for these states
I press with slow rude muscle
I brace myself effectually. I listen to no entreaties
I dare not with draw till deposit what has so long accumulated within me.
তখন আমরা মু্গ্ধ হই এই ভেবে যে , মানব মনের একটি অদৃশ্য ও আদিমতম কামনার জোয়ারকে কবি বিন্দুমাত্র বাঁধা না দিয়ে তার প্রবাহমানতাকে আরো স্বচ্ছন্দ দিয়েছেন । আল মাহমুদ 'সোনালী কাবিন' কাব্যে শব্দ প্রতীক ও উপমার মাধ্যমে আদিমতাকে অপুর্ব চিত্রায়ন পুর্বক আদি ও অন্ত পর্যন্ত চিরন্তন রোমান্টিক ধারাকে প্রজ্জ্বল করেছেন :
" তারপর তুলতে চাও কামের প্রসঙ্গ যদি নারী
খেতের আড়ালে এসে নগ্ন করো যৌবন জরদ
শস্যের সপক্ষে থেকে যতটুকু অনুরাগ পারি
তারো বেশী ঢেলে দেবো আন্তরিক রতির দরদ । "( সনেট ১০ )
আল মাহমুদ যে মৌলিক ও নতুন কবি তা আগেই বলা হয়েছে । একজন কবির বড়ত্ব তার কাব্যভাষা, চিত্রকল্প এবং ছন্দের নতুনত্বে । আল মাহমুদের বড়ত্ব তার নিজস্ব বাকরীতি প্রবর্তনে এবং অদ্ভুত সুন্দর চিত্রকল্প নির্মানে । সৌন্দর্য বিভায় উদ্ভাসিত তার কবি হূদয় সর্বদা সুন্দরের পুজারী । তিনি তার কাব্যে বহু বিচিত্র বিষয়ের চিত্রকল্প নির্মান করেছেন ।
আল মাহমুদের কাব্য যাত্রা সচল থাকুক ।
নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)
নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)
কবিতার বাঁক ফেরানোর কাজ চালিয়ে যাচ্ছে তরুণ কবিরা। কবিতা এখন আর আধুনিক ও উত্তর আধুনিক ধারায় নেই, সরে এসেছে অনেকটা দৃষ্টান্তবাদী ধারায়। আধুনিক ও উত্তর আধুনিকতার অযৌক্তিকতা ও অন্ধকারমুখিতার ঘোর বিরোধী বর্তমানের এই ধারা।
নতুন মন্তব্য করুন