সাইকো

পরিবর্তনশীল এর ছবি
লিখেছেন পরিবর্তনশীল (তারিখ: রবি, ১০/০২/২০০৮ - ৮:৪২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আশির গোড়ার দিকের কথা। আমার মত একা মানুষ সারা বাংলাদেশে ছিল না। একটা বাড়ির সিঁড়িঘরে ত্রিশ টাকা ভাড়া দিয়ে থাকতাম। একটা সামান্য কোম্পানিতে টাইপিস্টের কাজ করতাম। তিন বছর আগেই বাবা-মাকে হারিয়েছিলাম। ভাই বোন ছিল না। তেমন একটা বন্ধু বান্ধবও না। যা বেতন পেতাম তা দিয়েই চলত। মাসে একবার ভালো-মন্দ খেতাম আর প্রতি দুই সপ্তাহ পর সিনেমা হলে যেতাম। একেবারে খারাপ না। এরই মধ্যে একদিন একটা পত্র পেলাম। প্রথমে একটু অবাক হয়েছিলাম। পুরো বাংলাদেশে আমাকে পত্র লেখার কেউ আছে বলে মনে পড়ছিলনা। আমেনা নামে আমার দূর সম্পর্কের এক খালা লিখেছেন,
'' বাবা। দোয়া নিও। দিনকাল কেমন যাইতেছে? গতকাল এক পরিচিতের
নিকট তোমার সম্পর্কে জানিতে পারিলাম। মন অত্যাধিক খারাপ হইল।
তোমার মা নিশ্চয় আমার গল্প করেছেন। তোমার জন্য কিছু একটা করবার
ইচ্ছা হইল। আশা করিব পত্রপাঠ আমার এখানে চলে আসিবে। খালার কাছে
ভালোই থাকিবে- এ আশ্বাস দিতে পারি...।''
আমেনা নামে কোন খালার নাম মনে করতে পারছিলাম না। তবুও একদিন আমার যাবতীয় সম্বল একটা ব্যাগে ভরে সিলেটের ট্রেনে উঠে পড়লাম।

খালা এবং তাঁর বাড়ি বেশ লাগল। খালার কেউ নেই। বিশাল বাড়ি। একটু এগোলেই 'সুরমা' নদীর ঢেউ চোখে পড়ে। খালার আদর আপ্যায়ন দেখে চোখে জল আসে- এমন অবস্থা। নারীদের মমতা'র কোন বিকল্প এখনো বোধহয় পৃথিবীতে আসে নি। ঘুরলাম-ফিরলাম-খেলাম। একেবারে খানদানি দিনকাল চলছিল।
এরই মধ্যে আবিস্কার করলাম খালার ছবি আঁকার বেশ একতা বাতিক আছে।
একদিন বিকেলে একটু হাঁটতে বের হলাম। দেখি খালা বাগানে বসে একটি আমড়া গাছের ছবি আঁকছেন। আর নিজে নিজেই কাকে উদ্দেশ্য করে চেঁচাচ্ছেন। আমি খালার কাছে গেলাম।
- কি হয়েছে? খালা।
- আর বলো না। গাছটা বাতাসে এমন নড়াচড়া করছে। শান্তিমত ছবিটাও আঁকতে পারছি না।
- হুঁ। বাতাসকে তো আর কন্ট্রোল করা যাবে না।
- সেটাই। আচ্ছা, বাজারের দিকে যাবে?
- কেন খালা? কিছু আনতে হবে।
- দেখ তো। মোটামুটি বড় সাইজের প্লাস্টিকের গাছ পাওয়া যায় কিনা।
- জ্বী আচ্ছা।
খালার জন্য দুই ফুটের মত লম্বা একটা প্লাস্টিকের মরিচ গাছ আনলাম। রাতে দেখলাম খালা গাছটিকে সামনে রেখে মনোযোগের সাথে আঁকছেন। আমার কেন জানি খুব বিরক্ত লাগল।

খালার ছবি আঁকা রোগ বাড়তেই লাগল। একদিন দেখি বাজার থেকে আনা কাঁচা মাছের ছবি আঁকার চেষ্টা করছেন।

এরই মধ্যে একটা মেয়ের সঙ্গে আমার কিছুটা ভাব হল। থিয়েটারে নাটক দেখতে গিয়েছি। পাশ থেকে একটা মেয়ে বলল।
- ভাইয়া। আমেনা খালার বাড়িতে থাকেন না?
আমি বেশ অবাক হলাম। একটা মেয়েকে আমার সাথে নিজে থেকে কথা বলতে দেখে। আমি বললাম।
- হ্যাঁ।
- উনি খুব ভালো মানুষ।
- হ্যাঁ।
- আপনি কি প্রায় নাটক দেখতে আসেন?
- মাঝে মধ্যে।
- আমিও।

আরেকদিন থিয়েটারে গেলাম। দেখি মেয়েটা আমাকে দেখে মাথা নীচু করে ফেলল। মুচকি মুচকি হাসতে লাগল। থিয়েটার থেকে ফেরার সময় আমার হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিল। বাড়িতে এসে কাগজটা খুললাম। গুটি গুটি অক্ষরে লেখা।
''আপনাকে আমার অনেক ভালো লাগে। এখন থেকে আপনাকে তুমি করে বলব। ঠিক আছে? তোমাকে আমার খুব ভালো লাগে।''

খালা কোত্থেকে একটা কুকুরের বাচ্চা নিয়ে আসলেন। প্রাণীদের প্রতি খালার এত মমতা আগে বুঝতে পারিনি। কুকুরটার জন্য এটা কিনেন- ওটা কিনেন। মানুষ নিজের বাচ্চার জন্যে এত কিছু কিনে না। নিজে কুকুরটাকে খাইয়ে দেন। কুকুরটার জন্য কাপড় বোনেন। আমাকে বলেন।
- বাচ্চাটা খুব আদুরে না? -বাচ্চাটাকে একটু ঘুরিয়ে নিয়ে আস। কিংবা - দেখলেই মায়া লাগে। এই জাতীয় কথা।
সেদিন সকালে বাড়ির পিছনে গিয়েছি। দেখি কুকুরের বাচ্চাটা মরে পড়ে আছে। আমার বুকটা কেঁপে উঠল। খালা জানতে পারলে খুব কষ্ট পাবেন।
খবরটা শুনে খালা পাগলের মত কাঁদতে লাগলেন। আমি কি করব বুঝতে পারছিলাম না। খালা কিছুটা শান্ত হওয়ার পর বললাম।
- খালা। পিছনের উঠোনে কবর দিয়ে দিই?
খালা কেঁদে উঠলেন।
- না , না।
দেখলাম খালা একটা প্লাস্টিকের কেসে কুকুরটাকে শুইয়ে রাখলেন। একদিন দেখলাম- মরা কুকরের বাচ্চাটা উপরে দড়ি থেকে ঝুলানো। খালা মনোযোগ দিয়ে ছবি আঁকার চেষ্টা করছেন। দৃশ্যটা আমার ভয়ানক লাগল।

কয়েকদিন পর আমি আর খালা নাস্তা করছিলাম। কথা প্রসঙ্গে খালা বললেন।
- রিনুর সঙ্গে তোমার খুব ভাব।
আমি লজ্জা পেলাম। একে অন্যের বাড়িতে থাকি- তার ওপর আবার প্রেম করছি। খালাই বলল।
- মেয়েটা বেশ ভালো। তোমার সঙ্গে খুব মানাবে।
খালার কথা শুনে আমার চোখে পানি এসে গেল। মা বেঁচে থাকলে নিশ্চয় এমন করে কথা বলতেন।
- বেশিদিন তো আর বাঁচবনা। ছেলের বউ দেখে যেতে ইচ্ছে করছে। তুমিই তো আমার ছেলে। আমি ঠিক করেছি- রিনুকে তোমার বউ করে আমার সবকিছু তোমাকে দিয়ে দিব। এরপর তুমি রাখতে চাইলে- থাকব।
আমি কি বলব বুঝতে পারছিলাম না। মানুষ এত মায়া-ময়ী হয়!

সেদিন রাতে বিছানায় শুয়ে আছি। হঠাৎ একটা কথা মনে হওয়াতে আমার বুক কেঁপে উঠল। খালা নিজেই কুকুরের বাচ্চাটাকে মেরেছেন- ছবি আঁকার জন্য। কুকুরটাকে কেন এত যত্ন করেছিলেন- বুঝতে পারলাম। বুঝতে পারলাম- আমাকে কেন এত আদর-যত্ন করেন।
খালা আমার ছবি আঁকবেন। প্রাণ আছে এমন কোন বস্তু তো আর স্থির থাকতে পারেনা- ভালো করে ছবি আঁকা যায়না- তাই আমাকে প্রাণহীন করবেন।
আমি দরদর করে ঘামতে লাগলাম। হঠাৎ আমার ঘরের দরজা খোলার আওয়াজ শুনলাম। খালা আসছেন- আমাকে খুন করার জন্য।

আমার এই ঘটনা পরবর্তীতে অনেককে বলেছি। কেউ বিশ্বাস করেনা। এমনকি আমার স্ত্রী, যে আমার সব কথা বিশ্বাস করে- সেও না। শুধু 'মিয়াও' বিশ্বাস করে । মিয়াও হলো আমার মেয়ে অপ্সরা। ওকে আদর করে আমি 'মিয়াও' বলে ডাকি। আমি যতবার গল্পটা বলি মিয়াও আমার বুকে মাথা লুকিয়ে বলে।
- আব্বু। আমি কখনো ছবি আঁকব না।

[[ গল্পটি আলফ্রেড হিচকক সম্পাদিত ''The stories they would'nt let me do on tv'' গ্রন্থের ''The perfectionist'' থেকে অনুপ্রাণিত]]


মন্তব্য

ধুসর গোধূলি এর ছবি
কনফুসিয়াস এর ছবি

ভাল লাগলো। শেষের দিকে আরেকটু জমানো যেত মনে হয়। আরো খানিকটা সাসপেন্স। চালিয়ে যান।
*
একটা ব্যপার চোখে পড়লো, তাই বলছি। -
'না' একটা আলাদা শব্দ। তাই অন্য শব্দের মতন এটাও আলাদা বসে। যেমন- ছিলনা নয়, হবে ছিল না। আবার বলিনা নয়, হবে বলি না।
*
লিখতে থাকুন।

-----------------------------------
যা দেখি তা-ই বলি...

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

পরিবর্তনশীল এর ছবি

ভুল হয়ে গেছে।
---------------------------------
-মহিব
ভাবসাব দেখে মনে হইল "উনি একজন মানুষ"

কনফুসিয়াস এর ছবি

হাসি
আমার কথাগুলো পন্ডিতি শোনালো নাকি? দুঃখিত।
সাধারণ পাঠকের মতামত হিসেবে ধরে নিতে পারেন।

-----------------------------------
যা দেখি তা-ই বলি...

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

পরিবর্তনশীল এর ছবি

কি বলেন! কেউ যদি ভুল ধরিয়ে না দেয়
তাহলে তো ভুল ভুলই থেকে যাবে।
শুধরানোর সুযোগ পাবো না।
---------------------------------
-মহিব
ভাবসাব দেখে মনে হইল "উনি একজন মানুষ"

ফারুক হাসান এর ছবি

দারুণ!!!
----------------------------------------------
আমাকে নিঃশব্দে অনুসরণ করে একটা নদী-
সাথে নিয়ে একটা পাহাড় আর একটা নিঃসঙ্গ মেঘ।

অয়ন এর ছবি

ভালো লাগলো।

অতিথি লেখক এর ছবি

গল্পটি চরম লাগল। একটি বৈশিষ্ট্যের কারণে ক্লাসিক্যাল সাইকো কাহিনীর স্বাদ পেলাম: সাইকোরা স্বাভাবিক অবস্থায় সাধারণ মানুষের চেয়ে অসাধারণ থাকে। কুকুর মারা যাওয়ায় খালা কাঁদে, যদিও হত্যাকারী সে নিজেই। কিন্তু হত্যার সময় তার সাইকো সত্তা বেরিয়ে এসেছিল।

মুহাম্মদ২০১৭

রায়হান আবীর এর ছবি

ঝটিল লাইগলো।

Man can do what he wants, But he can't want what he wants

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

একটি দৃষ্টি আকর্ষণ :

একটা সামান্য কোম্পানিতে টাইপ রাইটারের কাজ করতাম।

টাইপ রাইটারের কাজ করতাম? নাকি টাইপিস্টের?

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

নজমুল আলবাব এর ছবি
কিংকর্তব্যবিমূঢ় এর ছবি

ভালৈছে ...
................................................................................

সৌরভ এর ছবি

হুমম। ভালো লাগলো।
দারুণ চেষ্টা। চলুক।

আমি গল্প লিখতে পারি না। কিন্তু, আমি শুধু প্রশংসা করবো না। আমি গল্প পাঠক হিসেবে কড়া। হাসি

কয়েকটা পয়েন্ট।
এই যেমন থিয়েটার দেখার কথা, রিনুর কথা কেমন যেন হঠাৎ এসে হাজির হয়েছে গল্পের মাঝে। আর রিনুর চরিত্র হঠাৎ শেষ হয়ে গেছে। আশির দশকে সুরমা নদীর তীরে কোন শহরের পটভূমিতে থিয়েটার দেখার সুযোগ কোথাও ছিলো কি? আর সেই সময়ে কোন মেয়ে একা থিয়েটার দেখতে যাওয়াটাও অসঙ্গতিপূর্ণ।
খালা নিজেই কুকুরের বাচ্চাটাকে মেরে ফেলেছেন - এই ব্যাপারটা বুঝে ফেলাও নাটকীয় মনে হয়।

অমীমাংসিত রহস্যের থেকে হালকা অসঙ্গতি গুলোই কেমন যেন প্রশ্নবোধক চিহ্ন রেখে যায় গল্প শেষ হয়ে যাওয়ার পরে।

হিচককের মূল গল্প পড়া হয়নি। তাই, মাস্টারি ধরনের মন্তব্য ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ থাকলো।



আমি ও আমার স্বপ্নেরা লুকোচুরি খেলি


আবার লিখবো হয়তো কোন দিন

রেনেট এর ছবি

আপনার পুরানো লেখা পড়া শুরু করলাম। ভালৈ লাগলো।
---------------------------------------------------------------------------
No one can save me
The damage is done

---------------------------------------------------------------------------
একা একা লাগে

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

এইটা মিস করছিলাম ক্যান? চিন্তিত

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।