[[ এমনিতে লেখার জন্য আমার হাত সবসময় নিশপিশ করে। আগের পর্বে সবার কাছ থেকে সাড়া পেয়ে দ্বিতীয় পর্ব লেখার আগ্রহ তাই আরো বেড়ে গেল]]
****দ্বিতীয় পর্ব****
সেদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছি- দেখি আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তায় এশা দাঁড়িয়ে আছে। আমার মনটা ভালো হয়ে গেল। ইদানীং একটা ব্যাপার লক্ষ্য করছি- আমার মা'কে যেমন ভালো লাগে- এশাকেও ঠিক তেমনি ভালো লাগে। আমি হেসে বললাম...
- কেমন আছ?
আমি একটা কথা বললে এশা সাধারণত ফড়ফড় করে দশটা কথা বলে। কিন্তু আজ আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তায়- এক ঝাঁক মরচে পড়া রোদের নীচে দাঁড়িয়ে- আমি দেখলাম এশা কেমন চুপটি করে আছে। আমি কী বলব বুঝতে পারি না। একসময় মন খারাপ করা পাখির মর এশা আস্তে আস্তে বলে...
- আজ বিকেলে চলে যাচ্ছি। তোমার সাথে দেখা করতে এলাম।
আমি অবাক হয়ে এশার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি। প্রথমবারের মত আমি বুঝতে পারি... আমার শ্যাম যদি হইত মাথার কেশ!... লাইনটার অর্থ। এশাই আবার কথা বলে...
- তোমার জন্য আমি বই পাঠাব। ঠিকানাটা লিখে দাও তো।
আমি কাঁপা কাঁপা হাতে- ইস্কুলের ব্যাগ থেকে খাতা বের করি। ঠিকানা লিখতে গিয়ে দেখি- অক্ষরগুলো কেমন ঝাপসা লাগে! আমার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হয়।
এশার দিকে কাগজ বাড়িয়ে দিলাম। এশা আলতো কণ্ঠে বলল...
- তোমার বাড়িতে যেতাম আন্টির সাথে দেখা করতে। কিন্তু টাইম নেই... জিনিসপত্র গোছাতে হবে।
- অসুবিধা নাই।
- আন্টিকে বলো... উনি খুব ভালো... আমার মা যেমন ভালো ছিলেন...তার চেয়েও ভালো।
আমি কিছু বলতে পারি না। শুধু তাকিয়ে দেখি... মেয়েটার সুন্দর চোখ দুটিতে... কয়েক ফোঁটা জল।
- তোমাদের আমি খুব মিস্ করব... মনু। আচ্ছা যাই... ভালো থেকো। আর শোন এরপরের বার দেখা হলে... আমাকে কিন্তু বাঁশি বাজিয়ে শোনাতে হবে।
এশা আর দাঁড়িয়ে থাকে না। আমি বাড়ির দিকে ছুটতে থাকি... এমন একটা সময় মায়ের কোল বাদে আমার কী যাওয়ার আর কোন জায়গা আছে?
এরপর অনেকদিন আমার মন খারাপ ছিল। এশা যে কয়েকটা বই দিয়েছিল... সেগুলো বারবার পড়ি। এশার চোখ দুটি বইয়ের প্রত্যেকটা শব্দ হয়ে- আমার দিকে চেয়ে থাকে। আমি এশার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি।
এদিকে আমার আব্বা কেমন বদলে গিয়েছে। আমাকে আর বকা দেয় না। মা'কে আর বকা দেয় না। কোন কাজকর্ম করতে যায় না। শুধু উঠোনে জায়নামাজ পেতে বসে থাকে। আর কিছুক্ষণ পরপর বলে...
- আমি আর বেশিদিন নাই... মনুর মা।
কবিরাজ চাচা বলে...
- দিন ফুরাইছে মিয়া...
মা পাগলের মত কাঁদতে থাকে- আমাকে বুকে জড়িয়ে।
একদিন সকালে আব্বা আমাকে বলল...
- মনু...ইশকুল আছে তোর আইজকা?
- হ।
- ইশকুলে যাওনের দরকার নাই... আইজ তোরে এক জায়গায় নিয়া যামু।
আব্বা আমার মাথায় হাত রাখে। কান্নায় আমার শরীর কেঁপে ওঠে। আমি অবাক চোখে আব্বার দিকে তাকিয়ে থাকি। শুধু বলি...
- আইচ্ছা।
দুপুরে আব্বা আর আমি বের হলাম। আব্বা শক্ত করে আমার হাত ধরে আছে... যেন মুহুর্তের জন্য হাত ছেড়ে দিলেই আমি হারিয়ে যাব... নৌকা করে আমরা ক্ষীরু নদী পাড় হলাম। নদীর ও পাড়ে হিন্দু পাড়া। আমি অবাক হই। আমার আব্বার কাছে হিন্দু এবং সকল হিন্দুয়ানী জিনিসপত্র- ঘৃণ্য। আব্বার এই পরিবর্তনে আমি খুশি হব নাকি বুঝতে পারলাম না।
আমরা হাঁটলাম। বুঝলাম আজ রাতে এখানে কোন অনুষ্ঠান আছে।
সন্ধ্যার পরে শুরু হল অনুষ্ঠান। গান হচ্ছে... মেলা হচ্ছে। গেরুয়া কাপড় পরা- লম্বা চুলের এক লোক গাওয়া শুরু করে...
''একি কাণ্ড ভবের মাঝারে
আমার কলিজার ভিতর দয়াল
ক্যান এমন দুঃখ করে?...
আমার গলায় দুঃখ আটকে থাকে... এশার কথা মনে পড়ে... মা'র কথা মনে পড়ে।
আব্বা আমার হাত ছাড়ে না... হঠাৎ কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে ওঠে...
- তোর মা'রে লগে আনা উচিত ছিল রে মনু... বেচারী সারাজীবন ঐ বাড়িতেই কাটাইয়া দিল...
আমি চুপ করে থাকি। আব্বার জন্য আমার মন কেমন করে! মেলা থেকে আব্বা আমাকে বাঁশি কিনে দেয়। আর বলে...
- মাইয়াটা বড় মধুর ছিল ... আমারে নিয়ে কী খারাপটাই না ভাবল...
রাত দুইটার দিকে আমারা নৌকায় ঊঠলাম। আব্বা আমাকে বলল...
- একটা গীত ধর্ না...মনু মিয়া।
আমি গেয়ে উঠি... আমার শ্যাম যদি হইত মাথার কেশ...
- বাঁশিটা তাড়াতাড়ি শিইখা ফ্যাল... তোর মা বড় খুশি হইব... মাইয়াটা বড় খুশি হইব...
আমি গান গাইতে থাকি... ভেজা কণ্ঠে... আব্বা পাগলের মত কেঁদে ওঠে...
- এর পরেরবার তোর মা'রে নিয়া আসুম।
আব্বা কখনো মা'কে গান দেখাতে নিয়ে যেতে পারে নি। এর কয়েকদিন পরের ঘটনা। আমি স্কুলে। বাংলা স্যার ক্লাসে সুন্দর সুন্দর সব কথা বলছেন... স্কুলের দপ্তরী ক্লাসের মাঝখানে আমাকে ডাক দিল... মনোয়ার।
- তাড়াতাড়ি বাড়ি যাও... মিয়া। তোমার বাপের শরীর বেশ খারাপ।
আমি বইখাতা ফেলে দৌড়াতে লাগলাম... বাড়ির সামনে এসে বুঝতে পারলাম... সব শেষ হয়ে গেছে... মা আমাকে ঝাঁপটে ধরল... আরো অনেক মানুষজন জড়ো হয়েছে... আমি আব্বার চোখের দিকে তাকালাম... ছুঁয়ে দেখলাম না। মসজিদের ইমাম সাহেব বলে উঠলেন...
- মনু মিয়া। কুরান শরীফ লইয়া আস। বাপের লাশের পাশে বইসা... পোলা কুরান পড়লে আল্লাহর আরশ কাঁইদা উঠে... আমরা দাফন কাফনের ব্যবস্থা করি...
রাশু... সালাম... আমার কাঁধে হাত রেখে বলে...
- কান্দিস না... মনু।
ছোটবেলার সেই দৃশ্যটা আমার এখনো মনে আছে... আমার মা পাগলের মত চিৎকার করছে...
- মনুর বাপরে তোমরা কই লইয়া যাও?... মনুর বাপরে তোমরা কই লইয়া যাও?...
সেইসব ভয়ংকর দিনগুলোতে এশার কথা আমার খুব মনে পড়ত।
আব্বার মৃত্যুর পরের দিন হাশেম মেম্বার আমাদের বাড়িতে এলেন। আমার মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন...
- কাঁইদা লাভ কী? জাহাংগীর ভালো মানুষ আছিল... সে ভালোই থাকব... এইবার তোমরা কীভাবে ভালো থাইকবা সেই চিন্তা কর...
মা মাথা নীচু করে থাকে। হাশেম মেম্বার বলে...
- জাহাঙ্গীরের কুলখানিতে একটা গরু দিব ভাবছি...
- আপনি ক্যান গরু দিতে যাইবেন?
হঠাৎ করে হাশেম মেম্বারটা বলল... আমি বিশ্বাস করতে পারলাম না...
- আমি তোমারে বিয়া করবার চাই... রাশেদা...
মা চেঁচিয়ে ওঠে...
- আপনি অখন বাইর হন... আমার বাড়ি থেইকা... অখন বাইর হন।
হাশেম মেম্বার উঠে দাঁড়ায়... বলে...
- বিবেচনা কইরা দেইখ... আমি আবার আসুম... বুঝলা?
মা আমার ঘুম ভাঙাল।
- মনু ওঠ্...
আমি ঘুম ঘুম চোখে মা'র দিকে তাকায়...
- কী হইছে মা?
- এখানে আর থাকন যাইব নারে বাপ... চল...হাশেম মেম্বার দলবল লইয়া আসতাসে...
- কে কইল তোমারে?
- কেউ কয় নাই... আমি জানি।
সামান্য কয়েকটা কাপড় চোপড় নিয়ে আমি আর মা বের হলাম। চাঁদের আলো আমাদের বাড়ির উঠোনে ঢেউ ছুটিয়েছে... মা আমার মাথায় হাত রেখে বলে...
- যাওয়ার আগে তোর বাপের কবর জিয়ারত করবি না একবার?
চাঁদের আলোয় আমার এবং আমার মায়ের চোখের জল চিকচিক করে ওঠে... আমি নিচু গলায় বলি...
- হ।
(চলবে...)
মন্তব্য
- সাবাশ গুরু।
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
গুরু সাবাশ দিলেন ক্যা
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
প্রথম পর্ব এক নিশ্বাসে পড়ছিলাম , মন্তব্য করতে পারিনাই । এই বার একসাথে ১০ দিলাম।
---------------------------
স্বপ্নকে ছুঁতে চাই সৃষ্টির উল্লাসে
-------------------------------
স্বপ্নকে ছুঁতে চাই সৃষ্টির উল্লাসে
একসাথেই নিলাম
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
আচ্ছা এশা চলে যাবার সময় কোন মোবাইল নাম্বার দিয়ে যায় নাই ?
---------------------------
স্বপ্নকে ছুঁতে চাই সৃষ্টির উল্লাসে
-------------------------------
স্বপ্নকে ছুঁতে চাই সৃষ্টির উল্লাসে
ধরে ন্যান... ... মোবাইল নাই... তাই বাইরের কেউ ওখানকার কাউকে মোবাইল নম্বর দিয়ে যোগাযোগ করতেবলে না... চিঠি লেখার ঠিকানা দিয়ে চিঠি লিখতে বলে।
কিংবা এশা'র মুহুর্তের জন্যও মনে হয় নি... এমন একটা গ্রামে একটা ছেলেকে মোবাইল নাম্বার দেয়া যেতে পারে...
হয়তবা দিয়েছিল... একদিন মনু এশাকে ফোন করবে
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
মনুরে কষ্ট দিয়েননা ভাই, এশা মেয়েটা বড়ই মায়াবতী। মোবাইল না থাকলেও সেই যুগে ল্যান্ড ফোন ঠিকই আসিল। আর তারচেয়ে বেশী প্রচলিত ছিলো বাংলাদেশের ডাক বিভাগ। মোবাইল আর কুরিয়ার আইসা ডাক বিভাগের ব্যবসা পটলে তুলছে।
---------------------------
স্বপ্নকে ছুঁতে চাই সৃষ্টির উল্লাসে
-------------------------------
স্বপ্নকে ছুঁতে চাই সৃষ্টির উল্লাসে
হা হা হা...
দেখা যাক কদ্দুর কী করা যায়?
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
আরোও ৫ আমার থেকে!
অসাধারণ গতিময়।
বড় গল্প আর উপন্যাসের মাঝামাঝি একটা ব্যাপার ঘটছে এখানে।
___________________________
বুড়োরা সবাই সমস্বরে বললো, "নবজন্ম", আমি চাইলাম "একটা রিওয়াইন্ড বাটন"
উৎসাহ পাচ্ছি
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
ভেরি গুড।চলুক এমন কিছু পর্ব।
-নিরিবিলি
হুম
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
আমিও বলি, সাবাশ গুরু। (বিপ্লব)
----------------------------------------------
আমাকে নিঃশব্দে অনুসরণ করে একটা নদী-
সাথে নিয়ে একটা পাহাড় আর একটা নিঃসঙ্গ মেঘ।
থ্যাংকু
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
ভাল হইতেছে... চলুক
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
আশা করি চলবে
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
চিত্রনাট্য বেচার মতলবে আছেন নাকি!!!
ভালো হচ্ছে....চলেললললললললললললললন পিছনে আছি জোকের মত
কল্পনা আক্তার
.................................................................
সব মানুষ নিজের জন্য বাঁচেনা
হ থাকেন...
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
কি বলবো! সবকিছু যে গলায় এসে আটকে যাচ্ছে!! খুব ন্যাচারাল। আপনার ফ্যান লিস্টে নামটা অ্যাড করে রাখলাম কিন্তু।
কী আর কমু!
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
ভালো লাগছে লেখাটা। চলুক।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
ধন্যবাদ
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
আমি তো আপনার ফ্যান হয়ে গেলাম রে ভাই!
পরের পর্বের অপেক্ষায় আছি।
একটা প্রশ্ন, আপনি কি গঠনমূলক সমালোচনা প্রত্যাশা করেন?
ওয়েবসাইট | ফেসবুক | ইমেইল
অবশ্যই...
কোন সমালোচনার কারণে আমার লেখায় যদি সামান্যটুকু উন্নতি হয় তবে সেই সমালোচনা আমি মাথা পেতে নেব এবং কীভাবে সেটা কাটিয়ে ওঠা যায়... সেই চেষ্টা করব...
আমি তো শেখার ধাপেই আছি।
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
দারুন দারুন...
---------------------------------
এসো খেলি নতুন এক খেলা
দু'দলের হেরে যাবার প্রতিযোগিতা...
তাই নাকি মনা??
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
প্রথম পর্ব পড়েই ভাল লেগেছিল। এবারেরটাও ভাল হয়েছে। আমার একটা পরামর্শ আছে। রিডার্স ডিসক্রেশন বলতে পারেন এটাকে:
— বিদ্যাকল্পদ্রুম
দেখা যাক!
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
হুম
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
অপেক্ষায় রাখলেন...
........................
সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
অপেক্ষায় থাকা উত্তম কর্ম
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
এইটা যদি গল্প হয় তাইলে নাটক কোনটা ?এইটা যদি নাটক হয় তাইলে গল্প কোনটা ?এইটা যদি গল্প আর নাটক দুইটাই হয় তাইলে চিত্রনাট্য কোনটা ? এইটা যদি সিনেমা হয় তাইলে নাটক কোনটা ?এইটা যদি নাটক হয় তাইলে ...........?
--------------------------------------------------------
দেয়ালে দেয়ালে মনের খেয়ালে/ লিখি কথা ।
আমি যে বেকার, পেয়েছি লেখার/ স্বাধীনতা ।।
মাথা ঘুরতাসে...
কিচ্ছু বুঝি নাই!!!
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
নতুন মন্তব্য করুন