একঃ অপরাধ
ক্লাস এইট। ২০০০ সাল।
আমরা সবাই ক্লাসরুমে উত্তেজনা নিয়ে বসে আছি। উত্তেজনার কারণ এখন ফজলে আলী খান স্যারের কৃষি শিক্ষা ক্লাস। ক্যাডেট কলেজের একটা নিয়ম হচ্ছে- যে স্যারের ক্লাস হবে তাঁর নামের ইংরেজী আদ্যক্ষর ব্ল্যাক বোর্ডের একটা বিশেষ জায়গায় লিখে দিতে হয়। সে হিসেবে ফজলে আলী খান স্যারের নাম যা হওয়ার কথা আমরা সেটা না লিখে এই উচ্চারণের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ অন্য একটা শব্দ লিখে রেখেছি।
স্যার আসলেন। ছোট খাটো মানুষটার মুখভর্তি বিশাল গোঁফ। কপালে প্রায় গোল কালো একটা দাগ। ক্লাসে ঢুকেই স্যার ব্ল্যাক বোর্ডের দিকে তাকালেন এবং চেঁচামেচি শুরু করলেন। আমরা সবাই হা হা করে হেসে দিলাম। আমাদের হাসি দেখে এবং শুনে স্যারের চেঁচামেচি আরো বেড়ে গেল।
এটা ছিল ক্লাস এইটে কৃষি শিক্ষা ক্লাসের নিয়মিত দৃশ্য। সবচেয়ে অদ্ভূত ব্যপার হলো- ফজলে আলী খান স্যার কখনোই চেঁচামেচি'র বেশি কিছু করতেন না। কিছুক্ষণ পর সবকিছু ভুলে গিয়ে স্যার হাসতেন। সন্তান কোন দুষ্টুমি করলে পিতার মুখে মমতার যে হাসি দেখা দেয়- সেই হাসি।
স্যার ক্লাস সেভেন এইটে কৃষিশিক্ষা পড়ালেও মূলতঃ কেমিস্ট্রি ল্যাবের টীচার ছিলেন। ক্লাস নাইনে আমাদের কেমিস্ট্রি ল্যাব নিতেন ফজলে আলী খান স্যার। কয়েকদিন পর দেখা গেল- কেমিস্ট্রি ল্যাবের কোন টেস্টটিউবেই পটাসিয়াম সালফেট কিংবা সোডিয়াম ক্লোরাইড নেই। কারণ এর আগেই আমরা যাবতীয় টেস্টটিউবে পানি কিংবা পানির মত মানব নিঃসৃত একটা বস্তু দিয়ে ভরিয়ে রেখেছি। প্রত্যেক ল্যাব ক্লাসে দেখা যেত স্যার শুকনো মুখে কোন একটা এক্সপেরিমেন্ট করার চেষ্টা করছেন আর রাগে গজগজ করছেন। স্যারের পাশে দাঁড়িয়ে আমরা লাল নীল কেমিক্যাল কিছু একটা কৌশলে স্যারের শার্টের পকেটে কিংবা শার্টের ওপর এঁকে দিচ্ছি।
এর ফলস্বরূপ মাঝে মধ্যে সাদা শার্টে অগোছালো কোন রঙ নিয়ে স্যারকে দেখা যেত। অন্য কোন স্যার ''খান সাহেব কী হইছে?'' জিজ্ঞেস করলে স্যার হেসে বলতেন... আর বইলেন না ভাই। একটা এক্সপেরিমেণ্ট করার সময় গায়ে ছিঁটা এসে পড়ছে...
এভাবে প্রায় দুই বছর অতীত হয়ে গেল। কালের বিবর্তনে আমাদের মেট্রিক পরীক্ষার আগমন হল এবং কেমিস্ট্রি ল্যাবের প্রত্যেকটা টেস্টটিউব কেমিক্যাল কম্পাউন্ডহীন হয়ে পড়ল।
দুইঃ শিরোনামহীন
এপ্রিল ২০০৩।
সেদিন ছিল এসএসসি সামাজিক বিজ্ঞান পরীক্ষা। পরীক্ষা তেমন একটা ভালো হয় নি। আমাদের পরীক্ষার সেণ্টার পড়েছে কাট্টলী নুরুল হক বিদ্যালয়ে। বিরস মুখে পরীক্ষার হল থেকে বের হয়ে দেখলাম আমাদের ক্লাস টীচার আবু বকর স্যার দাঁড়িয়ে আছেন। আবু বকর স্যার আমাদের দেখে
চিৎকার করে উঠলেন...ছেলেরা সবাই বাসে উঠে পড়। এক্ষুণি কলেজে ফিরতে হবে।
আমরা কিছুটা বিরক্ত হলাম। পরীক্ষার পর দশ মিনিটের জন্য আমরা বাবা-মা'র সাথে দেখা করার সুযোগ পাই। স্যার আবার চিৎকার করে উঠলেন... তাড়াতাড়ি...তাড়াতাড়ি ... খান সাহেব মারা গিয়েছেন। দুইটায় কলেজের প্যারেড গ্রাউণ্ডে জানাযা হবে...
সাথে সাথে আমি চিৎকার করে উঠলাম...
- খান সাহেব মানে? কোন খান সাহেব?
- ফজলে আলী খান সাহেব।
আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।
- ফজলে আলী খান স্যার মারা গেছেন মানে? কীভাবে সম্ভব?
- স্ট্রোক করেছেন।
মুহুর্তের মধ্যে পরীক্ষা খারাপ হওয়া নিয়ে টেনশন উধাও হয়ে গেল। আমি পুরোপুরি চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। মোরশেদ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল...তানবীন চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
আমরা কোন কথা বলার শক্তি খুঁজে পেলাম না। চুপচাপ কলেজ বাসে উঠলাম। একে অপরের দিকে তাকিয়ে আমরা দেখলাম... সবার চোখে মুখে কষ্টের সাথে কী একটা অপরাধবোধ!
স্যারের জানাযা হল - কলেজের প্যারেড গ্রাউণ্ডে। সেই গোঁফ আর কালো দাগ মাখানো মুখটা কেমন যেন হয়ে গেল। হঠাৎ করে আমার চোখ দিয়ে ঝম ঝম করে পানি পড়তে শুরু করল। আমি একটু আড়ালে চলে গেলাম। ক্যাডেট কলেজে কোন স্যারের জন্য চোখে পানি আনাটা লজ্জার বিষয়। আমি ভেজা চোখ নিয়ে দেখলাম- আমার আড়াল করার কিছু নেই।
স্যারের ছেলে আমাদের সাথেই পরীক্ষা দিচ্ছিল। ছেলেটার নাম আমার জানা নেই। দেখলাম সে তার বাবার লাশ থেকে অনেক দূরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি তার কাঁধে হাত রাখলাম...
ছেলেটা আমার দিকে তাকিয়ে কাঁদল...
পরে শুনেছিলাম স্যার মারা যাওয়ার আগে আমাদের সবাইকে ক্ষমা করে দিয়েছেন।
তিনঃ ...............
ক্যাডেট কলেজে প্রতি টার্মে একবার প্যারেণ্টস ডে হয়। ঐ দিন আমরা বাবা-মা'র সাথে চার ঘণ্টার জন্য দেখা করতে পারতাম।
ক্লাস সেভেনে প্যারেণ্টস ডে ছিল একটা স্বপ্নের ব্যপার। এরকম একটা স্বপ্নময় প্যারেণ্টস ডে শেষ হওয়ার পরে আমি ক্লাস রুমের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলাম। হঠাৎ গোফওয়ালা একটা লোক আমার মাথায় হাত রাখলেন। কোমল একটা কণ্ঠে বললেন...
- কী? নাম কী তোমার?
আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম...
- মহিব। স্যার।
- মহিব, কাঁদছ কেন? বাবা-মা'র জন্য খারাপ লাগছে?
আমি কোন কথা না বলে আরো জোরে কেঁদে উঠলাম। সেই স্যার বললেন...
- বোকা ছেলে তো! আমরা আছি না! আচ্ছা বল তো আমার নাম কী?
আমি মাথা নাড়লাম। তখনো সব স্যারকে চিনে উঠতে পারে নি। স্যার বললেন...
- আমি ফজলে আলী খান। ক্লাস এইটে তোমাদের কৃষি শিক্ষা নিব। এরপর কেমিস্ট্রি ল্যাব করাব। ক্যাডেটরা আমাকে ফাজলামি করে কী বলে জানো? বলো তো দেখি?
আমি একটু চিন্তা করে ফিক করে হেসে উঠলাম। স্যারও হেসে দিলেন।
**********
এই মানুষটার কাছে আমার ক্ষমা চাওয়ার যোগ্যতা নেই। শুধু তাঁর ব্যপারটা এলেই মানুষ হিসেবে আমার নিজের অস্তিত্ব স্বীকার করে নিতে লজ্জা হয়। নিজেকে মানুষ বলে দাবী করতে দ্বিধা হয়!
মন্তব্য
কতটা ভাল ছিলেন তিনি, লেখাটা পড়েই বুঝে গেলাম। সামনা সামনি দেখলে না জানি কত ভাল লাগত। মৃত্যুর পরের খবর জানি না, কিন্তু জীবনে তিনি সফল এ কারণেই।
— বিদ্যাকল্পদ্রুম
কেন খারাপ লাগছে জানি না।তবে আপনার স্যার যে নরম মনের মানুষ ছিলেন এটা বুঝতে পারছি।
-নিরিবিলি
ভালো লাগা মানুষগুলো বুকের গভীরে থেকেই যায়, কোন না কোন ভাবে।
...........................
সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
স্যারের জন্য শ্রদ্ধা।
ওয়েবসাইট | ফেসবুক | ইমেইল
মাহবুব স্যারকে খুব করে মনে পড়ছে এই লেখাটি পড়ে।
ফজলে আলী খান স্যারের জন্য শ্রদ্ধাঞ্জলী। চমৎকার লেখার জন্য মুহিবকে ধন্যবাদ।
কি মাঝি? ডরাইলা?
উপলব্ধি শেষ পর্যন্ত আমাদের মানুষ বানিয়ে দেয়। জানি না সবার হয় কিনা।
খুব ভালো লাগল পরিবর্তনশীল।
মানুষকে একদিন মরে যেতে হবে...ভাবতেই পারি না একদিন আমার বাবা কিংবা আমার মাও এভাবে চলে যাবেন...এই যে তাদের এতো কষ্ট দেই...ক্ষমা চাওয়ার সুযোগটাও হয়তো পাবোনা...উফফ!!!
কেন মরতে হয়...
---------------------------------
জ্ঞানীরা ভাবলেন খুব নাস্তানাবুদ করে ছাড়া গেছে...আআআহ...কি আরাম। বিশাল মাঠের একটি তৃণের সাথে লড়াই করে জিতে গেলেন।
ছোট্ট তৃণের জন্য অপরিসীম ঘৃণা।
কিছু কিছু শিক্ষক থাকেন, যাঁরা শিক্ষকেরও চেয়েও বেশি কিছু। আপনার লেখা পড়ে মনে হলো, ফজলে আলী খান ছিলেন সেই রকম একজন।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
আমি একগামী পুরুষ। একমাত্র নারীদের ভালোবাসি
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
মর্মপলোব্ধি মর্মান্তিক ... ভালোবাসা নিরন্তর ...
- নিশাচর (asifmt@yahoo.com)
সব কিছু নিয়ে এতো ভালো লেখার ক্ষমতা আপনার!
পড়েই মিলে গেল আমার ২/১ টা স্মৃতির সাথে। কিন্তু হলে কি হবে, এভাবে লিখতে তো পারবো না!
অনেক ভালো লাগলো।
___________________________
বুড়োরা সবাই সমস্বরে বললো, "নবজন্ম", আমি চাইলাম "একটা রিওয়াইন্ড বাটন"
ভালো মানুষগুলো কেন এত তাড়াতাড়ি পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়?
চমৎকার লিখেছ মুহিব।
সম্ভবতঃ সেপ্টেম্বরের ১ম রোববার আন্তর্জাতিক শিক্ষক দিবস পালিত হয়।
দৈনিক পত্রিকার পাঠক পাতা শিক্ষক সবিশেষ সংখ্যা বের করতো। যাযাদি'ও মনে হয় করেছিলো কয়েকবার। ভাবছি - সামনে কোনো সময় সচলের সবাই নিজেদের শিক্ষক নিয়ে লিখলে কেমন হয়?
_
পরিবর্তনশীলকে লেখার জন্য শুভেচ্ছা।
খুব ভালো হয়েছে।
চমৎকার আইডিয়া।
করতে পারলে খুব ভালো হয়।
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
-
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
পড়ার জন্য এবং মন্তব্যের জন্য সবাইকে অনেক ধন্যাবাদ। ভালো থাকবেন।
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
--------------------------------------------------------
যা কিছু স্বান্ত্বনা লিখে নিন নিজের জন্য-------
খুব ভাল লাগল আপনার লেখাটি।।
.....................................................................................
সময়ের কাছে এসে সাক্ষ্য দিয়ে চ'লে যেতে হয়
কী কাজ করেছি আর কী কথা ভেবেছি..........
.....................................................................................
সময়ের কাছে এসে সাক্ষ্য দিয়ে চ'লে যেতে হয়
কী কাজ করেছি আর কী কথা ভেবেছি..........
লেখাটা পড়ে মন খারাপ হয়ে গেল...
রিজভী
------------------------------
কেউ যাহা জানে নাই- কোনো এক বাণী-
আমি বহে আনি;
পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
ক্যামেলিয়া আপুকেও ধন্যবাদ।
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
কার কাছে যেন শুনেছিলাম স্যার নাকি ওইদিন সকালে ক্যাডেটদেরকে পরীক্ষার সেন্টারে নিয়ে যাওয়ার বাস আসতে দেরী হওয়াতে প্রচন্ড টেনশন করছিলেন। আর তারপরই নাকি স্ট্রোক হয়। অসম্ভব সরল মনের মানুষ ছিলেন আর ক্যাডেটরাই ছিলেন উনার সব। আল্লাহ উনাকে জান্নাতবাসী করুন।
নতুন মন্তব্য করুন