মিনিয়রহাটের ভেতরের দিকে নতুন বাড়িটা আমার খুব পছন্দ হল।
এক ভদ্রলোক দুবাই চলে যাচ্ছেন। তার কাছ থেকে অনেকটা জলের দামেই পেয়ে গেলাম। বেশ চুপচাপ জায়গা। আজকালকার দিনে যে জিনিসটা সবচে দুর্লভ এবং আমার কাছে সবচে লোভনীয়। ভোরবেলা এক কাপ চা সামনে রেখে খাতায় একা একা লেখালেখি- সামনে জংলা ভরা পুকুর আর পেছনের দিকে পুরনো একটা কবরস্থান।
কবরস্থানটা পরিত্যক্ত বলে লোকজন তেমন একটা আসে না। ভালোই হয়েছে। খাটিয়া করে লাশ কাঁধে কিছু মানুষের মিছিল আমার কাছে সবসময় ভয়ংকর একটা দৃশ্য।
সারাদিন খাতা কলম নিয়ে বসে থাকি। বিকেলের দিকে একটু হাঁটাহাঁটি করি। সপ্তাহে দুইদিন বাজারে গিয়ে জিনিসপত্তর কিনে নিয়ে আসি। কয়েক কেজি চাল... কাঁচা মাংস... কয়েক প্যাকেট বেনসন সিগারেট... এই।
এক সন্ধ্যায় হাতে সিগারেট নিয়ে বারান্দায় বসে আছি। বেশ শীত পড়ছে। শাল গায়ে হাতে সিগারেট নিয়ে নিজেকে খুব পুরনো একজন মানুষ মনে হচ্ছিল। শৈশবের কিছু স্মৃতি মনের মাঝে উঁকি দেয়। সেই পুরনো গ্রামটায় আমার বাবা... শীতের দিনে চাদর জড়িয়ে... হাতে বিড়ি নিয়ে বসে আছেন। মা আমাকে দুই টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলছেন। তোর বাবার চোখের সামনে এই বিড়ির প্যাকেট পুকুরে ফেলে দিবি...
এমন সময় দরজায় টোকা শুনতে পেলাম। কিছুটা আনন্দ হল। আনমনেই হয়তবা কোন মানুষের সংগ কামনা করছিলাম। দরজা খুলেই বেশ অবাক হলাম আমি। ছেঁড়া একটা হাফপ্যান্ট পরে দশ বারো বছরের একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখেই ছেলেটা ফড়ফড় করে কথা বলে ফেলল...
- স্যার। আপ্নের কাছে একটা জামা হবে? আমার মায়ের খুব ঠাণ্ডা লাগতাসে।
ছেলেটা এবং তার কথা বলার ধরণ দেখে মায়ায় আমার বুকের একপাশে ব্যথা করে উঠল। এতটুকু একটা ছেলে শীতের দিনে খালি গায়ে ঘুরছে। তার মায়ের জন্য জামা খুঁজছে! এক মুহুর্ত আমি কথা বলতে পারলাম না...
- ভেতরে এসো তুমি।
- না। স্যার। আমার তাড়াতাড়ি বাড়ি যাইতে হইব। আমার মা'র শীত করতাসে।
- তোমার বাড়ি কোথায়?
- ঐদিকে।
ছেলেটা কবরস্থানের দিকে হাত বাড়িয়ে দেখাল। শীতে খুব জলদিই আঁধার নেমে আসে। প্রায় কিছুই দেখা যায় না। কবরস্থানের ঐপাশে কোন লোকালয়ের কথা আমি মনে করতে পারলাম না।
আমার যাবতীয় শীতের পোশাক একটা ব্যাগে নিয়ে- ছেলেটার গায়ে আমার একটা শার্ট চাপিয়ে দিয়ে বললাম...
- চল। তোমার মাকে দেখে আসি। যাওয়ার আগে বাজার থেকে কিছু খাবার দাবার কিনে নিলে কেমন হয়?
ছেলেটা আমার দিকে এক পলক তাকাল। আমি হাসলাম একটু...
- কী আশ্চর্য! তোমার নামটাই জিজ্ঞেস করা হয় নি। নাম কী তোমার?
- অন্তু।
- অন্তু, চল, রওনা দেয়া যাক।
- আপ্নে হাচাই যাইবেন?
- কেন? আমি গেলে কোন সমস্যা আছে?
বাজার থেকে কিছু ফলমূল কিনলাম। অন্তুর বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছিল- শহরের খুব কাছে কী সত্যিকারের একটি গ্রাম! মাথার উপরে পসরা সাজিয়ে বসা চাঁদটাকেও মনে হচ্ছিল বাবার বুড়ো আঙ্গুল ধরে দেখতে থাকা সেই চাঁদটার সহোদরা। হঠাৎ করে ঘোর কেটে যেতে দেখলাম অন্তু আমাকে কবরস্থানের সামনে এসে দাঁড় করিয়েছে।
- কোন দিকে তোমার বাসা?
অন্তু কবরস্থানের মাঝামাঝি ইশারা করল।
- ঐখানে?
অন্তুর নিষ্পাপ চোখে আমি কোন ভনিতা দেখলাম না। আমাকে সিদ্ধান্ত নিতেই হল- কবরস্থানের উপর দিয়ে হেঁটে ওপাশে যাওয়া যায়। ওপাশে অন্তুদের বাসা। আমি হাঁটতে শুরু করলাম...
- চল।
কবরস্থানের ঠিক শেষ প্রান্তে এসে অন্তু থামল। আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম কিছু একটার জন্য। কী... সেটা বলতে পারব না। অন্তু বলে উঠল...
- হারিকেন জ্বালায় দিয়া গেসিলাম? কেডা নিভায়া দিসে? আমার মায় ভয় পাইব না?
পকেটের ভেতর থেকে লাইটার বের করে আমি হারিকেন জ্বালিয়ে দিলাম। অন্তু কবরে নেমে পড়ল। আমার হাত থেকে চাদর নিয়ে কবরের এক কোণে সযত্নে পড়ে থাকা কিছু হাড় ঢেকে দিল। চাদরে মোড়ানো সেই হাড়গুলো কোলে নিয়ে চুমু খেতে লাগল। ছোট শিশুকে মানুষ যেভাবে আদর করে ঠিক সেভাবে বলল...
- মা। আমি আইসা পড়ছি... মা। তোমার লাইগা কাপড় আনতে গেসিলাম। দেখ... স্যার তোমার লাইগা খানা আনছে...
আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম। দৃশ্যটা সহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই। আমি যে মাটিতে পা দিয়ে আছি... ঠিক সেই মাটিরই কোন অংশে আমার মায়ের অস্তিত্ব মিশে আছে...
এরপর অন্তুকে জোর করে আমি আমার কাছে নিয়ে এসেছিলাম। অন্তুর মা মা কান্না শুনে... একটা পুরনো কংকাল কিনে আনলাম। কিন্তু কয়েকদিন পর পরই অন্তু সেই কবরে ছুটে যায়। আমি অন্তুকে ফিরিয়ে আনতে পারি না। আমাকে দেখলে অন্তু বলে... আমি যে মা কিনে দিয়েছি সেটা মিথ্যে... নইলে ওটা থেকে বাসন্তী ফুলের ঘ্রাণ আসে না কেন?
মন্তব্য
ভাল, মনছোঁয়া লেখা লিখেছেন আপনি।
চমতকার রূপকের ব্যাবহার!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
অনেক ধন্যবাদ তীরুদা।
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
খুব সুন্দর। পুরনো বাড়ি এবং আশপাশের পরিবেশের বর্ণনাটুকু সবচেয়ে ভাল লেগেছে। শেষ লাইনটাও খুব ভাল লেগেছে।
— বিদ্যাকল্পদ্রুম
তাই নাকি বিজ্ঞানপু্রুষ?
--------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
আরেকটা মাস্টারপিস...দারুন লাগলো গল্পটা।
---------------------------------
জ্ঞানীরা ভাবলেন খুব নাস্তানাবুদ করে ছাড়া গেছে...আআআহ...কি আরাম। বিশাল মাঠের একটি তৃণের সাথে লড়াই করে জিতে গেলেন।
ছোট্ট তৃণের জন্য অপরিসীম ঘৃণা।
হে হে
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
চমত্কার!
আচ্ছা, সত্যি করে বলুন তো, আপনার মাথায় কি গিজগিজ করে কাহিনী?
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
আমি তুষ্ট আত্মপ্রেমেই। এর সুবিধে হলো, প্রতিদ্বন্দ্বী কেউ নেই
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
আগে বলুন... আপনার মাথায় ছন্দ কী গিজগিজ করে নাকি?
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
আমরা আপনার আর একটা সুন্দর গল্প পড়লাম।অনেক দিন পর মনে হইল লিখলেন।
-নিরিবিলি
উড়া উড়া কী যেন শুনলাম। পুরা ঘটনা খুইলা কন তো।,
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
ঘটনা কিছুই না...৯ নম্বর বিপদ সংকেত ছিল। এখন ঠিক আছে।
-নিরিবিলি
একরাশ মুগ্ধতা।
-----------------------------------------------------
We cannot change the cards we are dealt, just how we play the hand.
---------------------------------------------------------------------------
একা একা লাগে
অনেক ধন্যবাদ
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
জল এসে যায় চোখে ...
অসাধারণ!
....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !
....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !
''জননীর কবর'' এর রচয়িতার কাছ থেকে প্রশংসা পেয়ে খুব ভালো লাগল।
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
ভালো গল্প...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
থ্যাংকু।
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
দশ বারো বছরের ছেলের কাছে এই জাতীয় আবেগ আর পুরো ব্যাপারটাই কেমন যেন প্রত্যাশিত নয়। তারপরেও অনেক কিছু ঘটে, যা আমরা চিন্তাও করতে পারিনা। যাই হোক,আপনার গল্প লেখার স্টাইল টা আমার ভালো লেগেছে। আপনি ভালো লিখেন...বলাটাই বাহুল্য হয়ত...
---------------------------------------------------------
পৃথিবীর সব সীমান্ত আমায় বিরক্ত করে। আমার বিশ্রী লাগে যে, আমি কিছুই জানিনা...
---------------------------------------------------------------------------
কারও শেষ হয় নির্বাসনের জীবন । কারও হয় না । আমি কিন্তু পুষে রাখি দুঃসহ দেশহীনতা । মাঝে মাঝে শুধু কষ্টের কথা গুলো জড়ো করে কাউকে শোনাই, ভূমিকা ছাড়াই -- তসলিমা নাসরিন
ঠিক এই মন্তব্যই আমি কারো কাছ থেকে আশা করছিলাম।
চিটাগাং-এ আমরা আগে যে বাসায় থাকতাম,ঐ বিল্ডিং-এ একটা পিচ্চি ছেলে থাকত। সারাদিন দুষ্টুমি- আর কিছুক্ষণ পরপর মা-বাবা'র হাতে পিটুনি খাচ্ছে। কোন কারণে একদিন তার মা মারা গেলেন। এরপর থেকে পিচ্চিটাকে আমরা কখনো দাঁত বের করে হাসতে দেখি নি। যতদিন ঐ বাসায় ছিলাম।
কে জানে এখন হয়ত হাসে।
সেই ঘটনাটা মাথায় রেখে গল্পটা লিখেছি।
মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
আসলেই অসাধারণ লিখেছেন
--------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে
------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে
অনেক ধন্যবাদ মুমু আপা।
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
ভাল লেগেছে
খারাপও লেগেছে
---------------------------
থাকে শুধু অন্ধকার,মুখোমুখি বসিবার...
---------------------------------
বাঁইচ্যা আছি
কী করা যায়?
তুই এখন লেখস না ক্যান?
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
খুব ভালো লেগেছে...
ভিন্ন স্বাদের গল্প...বালিকাদের বেড়াজাল থেকে ধীরে ধীরে বেড়িয়ে আসছেন মনে হয়...
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
বিপ্রতীপ ব্লগ | ফেসবুক | আমাদের প্রযুক্তি
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
ব্যাক্তিগত ব্লগ | আমার ছবিঘর
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
অনেকদিন পর আপনার লেখা পড়লাম।
ক্যামনে লেখেন রে ভাই এইসব !
প্রশংসার জন্য শব্দ সংকটে ভুগতে হয়...
...........................
সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
প্রশংসার শব্দরা আসতে চায় না... কারণ তারা অপাত্রে পড়তে চাই না...
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
লেখাটা প্রায় চোখ এড়িয়ে গিয়েছিলো।
একটু অবিশ্বস্য হলেও, গল্প হিসাবে চমৎকার!
আপনার সাবলীলভাবে গল্প বলার স্টাইলটা খুব ভালো।
অনেক ধন্যবাদ।
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
খুব ভাল লাগল।
পরীক্ষা শেষ? কেমন হলো?
নাহ!
মাত্র তিনটা সাবজেক্ট হইছে... আরো তিনটা বাকী?
ভালো হচ্ছে না
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
নতুন মন্তব্য করুন