চোখ বন্ধ করলে শৈশবের একটা দৃশ্য আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আমি বাড়ির উঠোনে ছুটছি আর আব্বু আমাকে তাড়া করছেন। এই সময় আমার কান্নার সাথে একটা কথা উচ্চারিত হতো-- আমি শহরে যাবো না।
ছুটতে ছুটতে বাড়ির উঠোন পাড়ি দিতেই আমার ভয় করত। আর সেই আমাকেই উঠোন অতিক্রমে ভয় করা বয়সে শহরে চলে যেতে হতো- পড়াশোনা করার জন্য- মানুষ হওয়ার জন্য।
আমি চলে এলাম আমার বড় চাচার বাসায়। আমার তিন ভাই বোন রয়ে গেল গ্রামের বাড়িতে। এক বিছানায় মা'কে ভাগাভাগি করে ঘুমানো আমরা চারজন। আমিই শুধু আলাদা হয়ে গেলাম।
বড় চাচাকে আমি ডাকতাম 'আব্বুজী'। এখন আমি বুঝতে পারি আমার আপাত ক্ষুদ্র জীবনে আমি যে কয়টা জিনিস হারিয়েছি- তার একটা হলো- কাউকে 'আব্বুজী' ডাকার সেই অসাধারণ অনুভূতিটা। আব্বুজী'র আদরের কারণে শহরে আসার কয়েকদিন পরেই গ্রামের স্মৃতি আমি ভুলে যেতাম। প্রত্যেক ছুটি শেষেই এটা হতো। যা আমার জীবনের একটা অংশ হয়ে গেছে ধীরে ধীরে।
চার পাঁচ বছর বয়সে গ্রাম ছেড়ে শহরে আসার পর পরপর কয়েকটা ঘটনা ঘটে গেল। আমার স্কুল জীবন শুরু হলো- আমাদের বাড়ির সেই বিছানাটায়- যেটাতে আমরা চার ভাই বোন আর মা ঘুমোতাম তার একটা অংশ খালি হয়ে গেল আর আমার দাদী যাকে আমি দাদু ডাকতাম খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে আমাকে নিয়ে একটা পুঁথি লিখে ফেললেন।
কেজি ওয়ানের সেই দিনগুলো মনে করতে খুব ইচ্ছে হয়। কিন্তু আবছা আবছা কয়েকটা টুকরো বাদে আর কিছুই আমার মস্তিষ্কে কেন যেন ধরা দিতে চায় না। মানুষের স্মৃতি শক্তি খুব ভালো হলে একটা সমস্যা হয়ে যেত। সে শুধু তার শৈশবের কথা মনে করতে চাইত। স্মৃতি শক্তির এই দুর্বলতা এজন্য বোধহয় একেবারে খারাপ না।
সেইসব দিনের যে গুটিকয়েক ছবি আমি এখনো দেখতে পাই- তার মধ্যে একটা হলো-
বিরাটাকায় মানুষ আমার আব্বুজীর বুড়ো আঙুল ধরে আমি সিডিএ কলোনিতে হাঁটছি। আশপাশ থেকে কেউ কেউ বলে উঠছে...
- বারী সাহেব। এই ফুটফুটে ছেলেটা কে?
আব্বুজী একগাল হেসে নিতেন। আমাকে কোলে নিয়ে হেসে বলতেন...
- ক্যান ভাই? এটা তো আমার ছেলে... আপনারা আগে দেখেন নাই?
বাসায় ছিল আমার বড় চাচী। আমার তিন জ্যাঠাতো ভাই- বড় ভাইয়া- দাদা ভাইয়া আর ছোট ভাইয়া। রাতে আমার শোওয়ার জায়গা হতো কখনো দাদা ভাইয়ার সংগে - কখনো বা ছোট ভাইয়ার সাথে। প্রথম দিকে বোধহয় কিছুটা কষ্ট হতো। তখন তো আর ইচ্ছে করলেই ছোট্ট পা দুটো মমতামাখা একটা শরীরে তুলে দেওয়া যায় না।
আমার দিন কাটতে লাগল। স্কুল ছিল কলোনির ভেতরেই। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে কিছু একটা খেয়ে স্কুলের দিকে দৌড় দেওয়া- সেই দৌড় দেওয়ার দৃশ্যটা অবশ্য এখন আর ধরা দিতে চায় না। শুধু একদিনের কথা বেশ মনে আছে- আমি পরীক্ষায় চতুর্থ হলাম আর আমার আব্বুজী আমাকে কাঁধে নিয়ে পুরো সিডিএ কলোনি চক্কর দিচ্ছেন আর পাগলের মত চিৎকার করছেন... আমার ছেলে ফোর্থ হইছে... আমার ছেলে ফোর্থ হইছে।
আব্বু শহরেই ব্যবসা করতেন। মাঝে মধ্যে ছুটির দিনে আমাকে দেখতে আসতেন। প্রত্যেকটা ছুটির দিনে আমাকে দেখা যেত- সকাল থেকে বাসার সামনের উঠোনের এক পাশে বসে আসি আর গেটের বাইরে পায়ের শব্দ শুনে ছুটে যাচ্ছি।
আব্বু কখনো চিপস নিয়ে আসতেন- কখনো আইসক্রীম নিয়ে আসতেন। এসব খাদ্যদ্রব্যের সংখ্যা মনের মতো না হলে আমি বলতাম...
- ভাইয়াদের জন্য আনেন নাই?
আমার একথা শুনে আব্বু লজ্জা পেতেন। দোকান থেকে ভাইয়াদের জন্য চিপস নিয়ে আসতেন।
এভাবেই - বড়দের ভাষায় একঘেঁয়ে ভাবেই হয়ত কেটে যেতো আমার দিনগুলি। আব্বুজী'র বুড়ো আঙুল ধরে নামায পড়তে যাওয়া- কলোনিতে বিকেলের রোদ মাখা - সন্ধ্যায় ঘরের এক কোণায় বসে হোমওয়ার্ক করা- এবং রাতের বেলা মায়ের জন্য - ওদের জন্য চোখে মাঝে মধ্যে জল নেমে আসা।
এরই মধ্যে যেন বৃষ্টি হতো অনেকদিনের পরে। মা আসতেন - সাথে হয়ত আমার পিচ্চি বোনটা। মা আসলে আমার স্কুলে ভালো লাগত না। শুধু চুপচাপ মায়ের পাশে বসে থাকতে ইচ্ছে হতো। ছোট বোনটার ভাঙা ভাঙা ভাষায় কথা শুনে হাসতে ইচ্ছে হতো।
মা যখন আসতেন- মাঝে মধ্যে খাবার সময় আমরা টিভি দেখতে বসতাম। মা আমাকে খাইয়ে দিতেন। আমি খাওয়া ভুলে গিয়ে মাকে প্রশ্ন করতাম...
- মা, দাদু কেমন আছে? আমাকে নিয়ে নাকি দাদু একটা ছড়া লিখছে?
মা আমার সাথে ছেলেমানুষের মত গল্প করতেন। চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলতেন...
- তোর তো এই কয়দিনে মাথায় অনেক উঁকুন হইছে!
ছোটবোনটা হামাগুড়ি দিয়ে টিভির কাছে যেত। টিভির ভেতরে এত ছোট জায়গায় মানুষগুলোকে দেখে অবাক হতো। ফুলের পাঁপড়ির মতো আঙুল দিয়ে ছুঁতে চাইত বোধহয়।
আমিও আমার মায়ের দিকে তাকাতাম। মাকে জড়িয়ে ধরে আমার কাঁদতে ইচ্ছে হতো খুব। কিন্তু টিভি সেটের মানুষগুলোর মতো আমি মাকেও ছুঁতে পারতাম না। কেঁদে বলতে পারতাম না...
মা- আমার বাড়ি যেতে ইচ্ছে করে- দাদুর মুখে পুঁথি শুনতে ইচ্ছে করে...
(অসমাপ্ত)
মন্তব্য
পড়লাম। লেখাটি কিন্তু ...
(অসমাপ্ত)
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
শেষ বিচারের আসরে উকিল নিয়োগের ব্যবস্থা না থাকলে ক্যাম্নে কী!
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
শেষের আশা করি। পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
এক ধরনের ভালোলাগা মিশ্রিত কষ্ট ছুঁয়ে গেলো।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
আজকে কেমন জানি লাগছে! জুবায়ের ভাই আর নেই এটা বিশ্বাসই হতে চায় না। পৃথিবীতে কষ্ট ছাড়া আর কিছুই বোধহয় নেই।
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
সুন্দর
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
ধন্যবাদ।
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
শেষ হওয়ার দরকার নেই, লিখতেই থাকুন -
শেষ!
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
মহিব,
তুমি আসলেই চমৎকার লেখ...চমৎকার...
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
http://biprodhar.com
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
ব্যাক্তিগত ব্লগ | আমার ছবিঘর
অনেক ধন্যবাদ বিপ্রদা।
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
অ্যাই মিয়া, আপনে তো বুড্ডা হইয়া গ্যাছেন গা, স্মৃতিকথা লিখবার লাগচেন।
ভালো হইছে। চালাইয়া যান।
জানি না কেন লিখছি। বুড়াই হয়ে গেছি মনে হয়।
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
ভাই মহিব, খুব সহজে একটা সত্যি কথা বলতে গেলে বলব, তোমার লেখা পড়লে বড়ই হিংসা হয়! পড়লে মনে হয় এইসব লেখা লিখে ফেলা কোন ব্যাপারই না, চাইলে আমিও লিখে ফেলতে পারব! কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। আমি তো পারিই না, জানি কোনদিন পারবও না, কিন্তু অন্য আরো অনেকেই পারে না, কারণ কাজটা মোটেও সহজসাধ্য নয়। খুব সহজ সহজ কিছু কথা দিয়ে যে এমন দারুনভাবে সাজাও তোমার লেখাগুলো, তা এককথায় অসাধারণ! ঠিক ভেতরে গিয়ে নাড়া দেয়। আরো ভাল লিখ, এই প্রত্যাশাই করি।
__________________________________
বিষন্নতা ছোঁয় আমায় মাঝে মাঝেই, কখনো কি ছোঁয় না তোমায়?
কিছুই বলার পাচ্ছি না। শুধু অসংখ্য ধন্যাবাদ।
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
পড়লাম।
ভালই লিখেছ।
তবে মন খারাপ করে দেয়া লেখা আরকি !
--------------------------------------------------------
মন খারাপ করে দেয়ার জন্য ক্ষমা চাই।
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
পাচ তারা ।
তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে
*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়
থ্যাংকু।
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
নতুন মন্তব্য করুন