আনাড়িয়া।

পরিবর্তনশীল এর ছবি
লিখেছেন পরিবর্তনশীল (তারিখ: বিষ্যুদ, ০৩/০৯/২০০৯ - ১১:২১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

নীলু আপা প্রায়ই বলতো দুপুর বেলা, মা যখন দুপুরের খাবার একটু খেয়ে নিয়ে, খবরের কাগজটা চোখের সামনে ধরতে না ধরতেই একটু চোখ বোজার আগে, আমাকে ডাকতো- আয়, ঘুমোবি- আর আমি দুপুরে ঘুম আসেনা বলে আমাদের ছোট্ট বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতাম, তখন দেখতাম নীলু আপাকে, সামনের বিল্ডিঙটার দালানে দাঁড়িয়ে। আমায় দেখতো কিছুক্ষণ, একসময় বলতো, "ছাদে আসবি?" আমি মুখ ভার করে বলতাম, "চাইলেই বুঝি আসা যাবে? মা বকবে না?" নীলু আপা হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলে, যেন এক্ষুণি, এই ভর দুপুর বেলাতেই হাতজোড়া আকাশে পৌঁছে দিতে হয়। বলতো, "কেন্? বকবে কেন? তুই কী এখনো ছোট আছিস? কই দেখি, দেখি তো! ঐ যে, তোর গোঁফ গজাতে শুরু করেছে।" এরপর হাসত নীলু আপা। হাসিরও এমনটি ধারা! যেন এই ভরদুপুরে হাসিটাও আকাশে মেলে দেবার জন্য।

আমার পড়ার ঘরে যে জানালা ছিলো, বৃষ্টি এলেই যে জানালার ফাঁক গলে জল এসে যত বইখাতা ভিজিয়ে নিয়ে যেতো- সে জানালার শিকে প্রতিটা ভোরে একটা পাখি এসে বসতো। ঘুম ঘুম চোখে স্কুলে যাওয়ার পোষাক পরতে পরতে দেখতাম। কেমন অবাক হয়ে দেখতো আমায়! বলতাম, "ও পাখি, তোমার নাম কী?" পাখি অবাক হতে হতে চোখের পলক ফেলতো, বৃষ্টিতে ভিজে কিংবা ভরা নদীতে স্নান করে একে সে পলক ফেলবার মুহুর্তে কয়েকফোটা জলও ঝরে পড়তো বুঝি। বলতো, "আমি দোয়েল!" স্কুল ব্যাগের ছোট্ট পকেটটাতে টিফিন বক্সটা ভরে নিতে নিতে হাসতাম আমি, "তোমার বাড়ি কোথায়? কোন গাঁয়ে?" দোয়েল পাখি জানালার শিকে, আয়েশ করে বসে শিস দেয় আর হাসে। "এ তো বড় কঠিন প্রশ্ন করে ফেললে ভাই! আমার বাড়ি যে কোন গাঁয়ে? উঁহু, দাঁড়াও একটু ভেবে দেখি।" আমি স্কুলে যাওয়ার কথা ভুলে যেয়ে পাখির পানে চোখ মেলে তাকাতাম, "কী আশ্চর্য! তুমি কাঁদছো কেন?" কখন যে তার শিস ধরে ধরে আসতো, ঠোঁট নীচু হয়ে কেঁপে কেঁপে উঠতো। বলতো, "জানো, সে গাঁয়ে আমার বন্ধুয়া থাকতো। মিষ্টি রোদ হলে, আমরা দুজনে গাছের ডালে বসে শিস দিতাম আর কবিতা পড়তাম- আমরা দুজন একই গাঁয়ে থাকি, এইতো মোদের একটিমাত্র সুখ, তাদের গাছে গায় যে দোয়েল পাখি, তাহার গানে নাচে আমার বুক।"

এখন মাঝে মধ্যে পুরনো বাসাটায় গেলে, ঠিক দুপুর বেলা, সামনের বিল্ডিঙের দিকে চেয়ে দেখি। একটা কিশোরী, ঠিক যেন নীলু আপার মতন। চেঁচিয়ে ডাকি, "এই মেয়ে, তুমি নীলু আপাকে চোনো?" মেয়ে চুলের বেনী দুলিয়ে জবাব দেয়, "না তো।"
দুপুর বেলা ছাদে দাঁড়ানো নীলু আপা, যার হাসি ডানা মেলতো মেঘে মেঘে, সেই দোয়েল পাখিটা রোজ ভোরে যে আমার পড়ার ঘরের জানালায় এসে বসতো, সব কবে এ পাড়ার পাট চুকিয়ে চলে চলে গ্যাছে। শুধু পড়ে আছে দুপুরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখা ছাদে, ভোরবেলা জানালার শিকে কয়েক ছত্র আনাড়িয়া।

আবার যদি জানালায় কোলে পেতাম পাখিটিরে,
বলে দিতেম তুমি ভাসিয়ে নিও, রোহিণী মায়ার সুরে।
তোমার পলক-ক্ষণে ঝরে যদি পড়ে, করে যদি টলোমল,
আমার আনাড়িয়া বুকে- এ কেমন করে? এ-ই কী অশ্রুজল?
গগন শিরীষের গায়ে গায়ে ঠেসে, মেঘে মেঘে ঘুড়ির মেলা,
না-ঘুমো দুপুরে, গ্যালো অকারণে রোদ,
মেঘপরী গ্যাছে, নিয়ে আনাড়িয়া সুখ,
না- জাগার দেশে, তুমি বয়ে গেলে ঠিকই-
আমার ছেলে মানুষীর বেলা।


মন্তব্য

সৈয়দ আখতারুজ্জামান এর ছবি

শান্ত সবুজ একটা বৃষ্টিভেজা লেখা।

শাহেনশাহ সিমন [অতিথি] এর ছবি

অদ্ভুত বিষাদমাখা এক লেখনী। শৈশব হারিয়ে যাওয়ার কষ্টটা নিংরে দিলো যেন।

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

'ছাদের পাঁচিল বলছে- আয় ,ছুটে আয় খালি পায়,
আকাশ বলছে গলা খুলে গা !!'

... কোথায় চলে গেলেন নীলু আপা আর কোথায় গেলো দোয়েল পাখি...
মন বিষণ্ণ হয় কেনো ??
---------------------------------------------------------------------------
- আমি ভালোবাসি মেঘ। যে মেঘেরা উড়ে যায় এই ওখানে- ওই সেখানে।সত্যি, কী বিস্ময়কর ওই মেঘদল !!!

দুষ্ট বালিকা এর ছবি

আজব ব্যাপার। লেখাটা পড়ে আমি ঠিক এই দুইটা লাইনই গুন গুন করে উঠলাম!

ভালো লেগেছে!

----------------------------------------------
আয়েশ করে আলসেমীতে ২৩ বছর পার, ভাল্লাগেনা আর!

**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।

মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

বালিকা আপার কী ভালো লাগলো বুঝলুম না যে, মন্তব্য (খাইছে) না লেখা ??
---------------------------------------------------------------------------
- আমি ভালোবাসি মেঘ। যে মেঘেরা উড়ে যায় এই ওখানে- ওই সেখানে।সত্যি, কী বিস্ময়কর ওই মেঘদল !!!

তুলিরেখা এর ছবি

বড় ভালো লাগে আপনার মায়াভরা লেখাগুলো।
-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

দ্রোহী এর ছবি

হুম....

মামুন হক এর ছবি

পড়লাম...

মৃত্তিকা এর ছবি

ভালো লাগলো খুব।

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

বড়ো একটা গল্পের আভাস পাওয়া গেল লেখায়। হতে পারতো। অথবা তুমি চাইলে এখনো হতে পারে।

যাই হোক, দারুণ লেখা।

এনকিদু এর ছবি

হুমমম ...
নীলু আপা
রেমেদিওস হয়ে গেছেন হয়ত ।


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...

মাহবুব লীলেন এর ছবি

তোমার পানি পড়া খাওয়া উচিত নিয়মিত
আর ঘুমানো উচিত মাজায় তাবিজ দিয়ে

জাহিদ হোসেন এর ছবি

বিষন্নতার হাত ধরে বসে থাকে একজন আমাদের সবার হৃদয়ে। এই লেখাটি পড়ে সেই জনেরও চোখ ছলছলিয়ে উঠলো। এত ছোট কেন লেখাটি? মনে হোল কয়েকটি স্ন্যাপশট মাত্র। কাহিনীর আভাস পাওয়া গেল, কিন্তু কাহিনীটিকে নয়।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

স্পর্শ এর ছবি

বরাবরের মতোই ভালো লেগেছে।


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

তিথীডোর এর ছবি

অদ্ভুত!!!!

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।