জীবনে প্রথমবার বই কিনেছিলাম ঊনিশশো নব্বইয়ের ডিসেম্বরে -বড় আপার বার্ষিক পরীক্ষা শেষে। 'বর্ণ পরিচয়' নামের সে বইয়ের প্রথম বাক্যটায় আঙুল রেখে বড় আপা বলতো- "বল্। অ-তে অজগর। অজগরটি আসছে তেড়ে।" আমি বড় আপার আঙুল রাখা ছবিটায় তাকাতাম- দেখতাম, বিদঘুটে একটা সাপ অ-এর দিকে ছুটে যাচ্ছে। মনে হতো, সেই বিদঘুটে অজগর অ-এর গায়ে এক্ষুণি আঘাত করবে। অ-এর জন্য আমার মন কেমন করে উঠলে বড় আপাকে বলতাম, "আপা, এই সাপটা কি অ-কে খেয়ে ফেলবে?" বড় আপা হাসতো। বলতো, "অক্ষর কি কেউ খেতে পারে, বোকা ছেলে?
এক একদিন যখন ছোট চাচার বুড়ো আঙুল ধরে নদীর ধারে বেড়াতে যাই, আমি বলি- "চাচা, জানো নদী কী দিয়ে হয়?" ছোট চাচা না জানার ভান করতো। বলতো," কী দিয়ে?" আমি বলতাম, "এটাও জানো না। নদী হয় ন-তে।" ছোট চাচা হেসে বলতো, "তুই সব জানিস? বলতো এ- তে কী হয়?" আমি ভেবে বলতাম, "এ-তে এরোপ্লেন। এরোপ্লেনটা যাচ্ছে ওড়ে। এ তে.... এ তে...."
এরপর বছর কয়েক পরে একদিন জানতে পারলাম, এ- তে একুশ। একুশে ফেব্রুয়ারি!
দুইঃ
সেবার আমাদের স্কুলে একুশে ফেব্রুয়ারিতে একটা দেয়াল পত্রিকা প্রকাশিত হলো। মূলত সেই দেয়াল পত্রিকার জন্য লেখা তৈরি করতে গিয়ে আমি মনেপ্রাণে একুশকে প্রথমবারের মতন অনুভব করেছিলাম। বাবা যেদিন বুঝিয়ে বললেন, বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতে কী হয়েছিল, সেদিন খুব শীত পড়ছিল- মনে আছে। বাবার কাছ থেকে একুশের গল্প শুনতে শুনতে অনেক রাত হয়ে আসে- মা আমাকে ঘুমোনের জন্য ডাকতে এলে আমার মনে হলো- মা আমাকে যে ভাষায় ঘুমাবার জন্য রোজ ডাকে সে ভাষার জন্য কিছু মানুষ নিজেদের প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছিল!
সে শীতের রাতে বাইরে কুয়াশার তুচ্ছ আবরণ ভেঙে চাঁদটা উঁকি দিচ্ছিল। বিছানায় শুয়ে আমি অনেক রাত পর্যন্ত জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিলাম। যে চ- তে চাঁদ- যে ক- তে কুয়াশা যে শ- তে শীত যে ব- তে বাবা যে ম- তে মা- যে অক্ষরগুলো- যে বর্ণমালা আমার হৃদয়েরও খুব কাছে বাস করে তাঁদের সম্মান তাঁদের অধিকার রক্ষার জন্য অসামান্য কিছু মানুষ নিজেদের রক্ত বিসর্জন দিয়েছিল!
সে রাতে বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার হঠাৎ মনে হয়েছিল- জানালার শিকগুলোর পেছনে ঐ চাঁদটা রক্ত বর্ণ ধারণ করেছে- যেন একটা শহীদ মিনার আমার চোখের সামনে গড়ে উঠলো মাথা উঁচু করে। কুয়াশা ভেদ করে আমি যেন দেখতে পাই ভার্সিটিতে পড়ুয়া আমার দাদাভাইয়ের বয়েসী কয়েকজন মানুষ হাত মুঠো করে স্লোগান দিচ্ছে "রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই!" আর হায়েনার মতন ভযংকর কিছু লোক তাঁদের দিকে বন্দুক তাক করে আছে। কিন্তু স্লোগান দিতে দিতে এগিয়ে চলা মানুষগুলোর চোখে মুখে কোন ভয়ের চিহ্ন নেই। কী অদ্ভূত সাহস তাদের চোখে! আমার বর্ণমালার জন্য কী ভয়ানক ভালোবাসা তাদের কণ্ঠে!
তিনঃ
ভাষা আন্দোলনের আজ ষাট বছর পেরিয়ে যাচ্ছে, সময়ের হিসেবে খুব একটা দীর্ঘ কি? জানি না। তবে অনেক বদলে গেছে সবকিছু।
যে অনুষ্ঠানের শুরু হয় "আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি দিয়ে" সে অনুষ্ঠানের অলংকরণের জন্য আমরা এখন ভিনদেশী কিছু প্রাণী ভাড়া করে নিয়ে আসি- হায়েনাদের সেই কুৎসিত ভাষার মতনই অপর এক ভাষায় চিৎকার করবে বলে। হায়েনাদের সেই কুৎসিত ভাষার সহোদরা এক ভাষায় আমাদের তরুণ তরুণীরা পরস্পরকে প্রেমের বার্তা পাঠায়। স্কুলের সামনে আড্ডা দেবার সময় আমাদের নারীরা পরস্পরকে বলে, "ভাবী। আপনার মেয়েটা কী সুইট করে হিন্দী বলে।" যে ভাবীদের এ কথা বলা হলো তাদের মুখে গর্বের হাসি ফুটে ওঠে "হুঁ। ঠিক তাই। আমিও তো মাঝে মধ্যে ওর সাথে হিন্দীতে আটকে যাই।" আমাদের বেতার টেলিভিশনে রবীন্দ্রসংগীত হয়ে যায় "ট্যাগোর সং" কথোপকথনের মাঝখানে দুই একটা ইংরেজি বাক্য জুড়ে দিয়ে আমরা তৃপ্তির হাসি দিই- "দেখেছ? আমিও কম ফ্যালনা নই!"
আমি এখন মাঝে মধ্যে কুয়াশায় জানালার পিঠে চাঁদ নিয়ে বানানো আমার কৈশোরের সেই শহীদ মিনারের কাছে যাই। দেখি বায়ান্নর সে শহীদেরা- যারা হাসিমুখে মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছিল বাংলাকে ভালোবেসে, তাঁদের মুখরেখায় আজ কী গভীর এক কষ্ট খেলা করে। আমার লজ্জা হয় খুব। বলি, "রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার- আমাদের ক্ষমা করে দিন। আপনাদের পবিত্র রক্তে ভেজা যে বাংলা ভাষা- তার মর্যাদা আমরা রাখতে পারছি না। "
শীতের রাতে জানালার বাইরে কুয়াশার দিকে তাকিয়ে আমি রফিক সালাম বরকত জব্বার শফিউলদের বেদনাহত মুখ দেখতে পাই। আমার মনে হয়- বোকা ছেলেটা খুব একটা ভুল বলেনি সেদিন তার বড় আপাকে- বর্ণ পরিচয় বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠার দিকে তাকিয়ে।
এক বিদঘুটে ভিনদেশি অজগর আমার দুঃখিনী বর্ণমালার দিকে ক্রমশ তেড়ে আসছে।
মন্তব্য
আপনার লেখা সবসময়ই অসাধারণ।
ঠিক।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
ধন্যবাদ।
ঠিক
চমৎকার
হৃদয় ছুয়ে গেল লেখাটা, অসাধারণ।
ধন্যবাদ।
চমৎকার এই লেখাটার জন্য স্যালুট বস।
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
ওয়ালাইকুমুস সালাম।
অসাধারণ একটা লেখা!
থ্যাংকু।
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
ধন্যবাদ।
প্রথম পাতায় দেন নাই নাকি লেখাটা? আরেকটু হইলেই মিস করতাম। লেখা নিয়া আর কি কমু? কেন যে এত ভালো লেখেন!! এত প্রশংসা করতে ভাল্লাগে না
লেখাটা অন্য একটা ব্লগে (সিসিবিতে) দিসি গতকাল। তাই এখানে নিজের ব্লগে রাখলাম।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
আমারও একই প্রশ্ন, প্রথম পাতায় আসেনাই নাকি লেখাটা?? অসাধারণ লাগল!
ধন্যবাদ।
আপনার লেখা পড়তে গেলে বুকের ভেতর কেমন যেন হু হু করা একটা অনুভূতি হয়!
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
অসাধারণ।
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
ধন্যবাদ।
কিছু বলার মত ভাষা খুজে পাচ্ছিনা।
ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য।
আমটি পেড়ে খাওয়ার বদলে ভাষাকে কচকচিয়ে খাচ্ছে সবাই...
অসাধারন!!!
_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না
হুম।
অস্বাধারন হয়েছে লেখা।
ধন্যবাদ।
আপনার লেখাটা আমার হৃদয় ছুঁয়ে গেছে, সত্যিই চমত্কার লিখেছেন.
অসাধারণ লেখা।
অজগরটা এখন আরো ভয়ানক হয়েছে। তেড়ে আসার পর্ব পার। সে এসে গেছে। গিলেছে অনেক কিছুই। গেলা চলছে।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
বাংলা ভাষার আজকাল কী অবস্থা বিশেষ করে বেসরকারী অফিসগুলো (দেখলেন তো, অফিস বলে দিলাম!)। বাংলা মাধ্যমের শিক্ষা সনদের জন্য মানুষ সেখানে ব্রাত্য, বাংলায় কথা বলার জন্য ব্রাত্য এই বাংলাদেশেই! নিজে দেখছি, সেই অভিজ্ঞতারই মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। কিচ্ছু বলার নেই...
দেবদ্যুতি
নতুন মন্তব্য করুন