কখনো লেখা হয় নি। লিখে কি লাভ? লেখা হলে প্রকাশের তাড়া থাকে। মাথার মধ্যে একটা যন্ত্রণা কাজ করে। আমার লেখক বন্ধুদের দেখেছি লেখা প্রকাশের জন্য কী দৌড়ঝাপ। লেখা মেইল করছে। সম্পাদকের কাছে ঘোরাঘুরি করছে। প্রেসে ছুটোছুটি করছে। বাপের পকেট মারছে। দোকানে দোকানে ঘুরে বেড়াচ্ছে বিজ্ঞাপনের জন্য। ভয়ংকর দশা।
আমি একবার এক উঠতি সাহিত্য সম্পাদকের কাছে গেলাম। তিনি হাসি হাসি মুখে কথা বললেন। বললেন--সাহিত্য কী করে সাহিত্য হয়ে উঠছে। কবিতার ভেতরে কোথায় প্রাণটি লুকিয়ে থাকে। সেটি ধরতে হলে গুরু আছে কে কে ইত্যাদি ইত্যাদি। বুঝলাম, ষোলো আনাই মিছে। লেখা কাজটি খুব কঠিন। প্রকাশ আরও কঠিন। গোষ্ঠী বিনা মওকা মেলে না।
সুতরাং লেখালেখি বাদ। বাজারের ফর্দ লেখা ভাল।
গেল বছর--ফেসবুক নামে একটি ঘটনার দেখা পেলাম। দেখে সেখানে কয়েকটি কথা বলে বিপদে পড়লাম। লোকজন যে ভাষায় গালিগালাজ করল, তাতে আমার ঠাকুরদা পর্যন্ত মাটির নিচ থেকে বায়ুভূত নিরালম্ব হয়ে গেল।
কিন্তু একটা জিনিস বুঝে ফেললাম--ফেসবুকে বা অন্তর্জালে বিনা পয়সায়, বিনা তদ্বিরে যখন খুশি, যা ইচ্ছে লেখা যায়। কোনো গুরু ফুরু নাই। পুরো বাঘ-স্বাধীনতার লারে লাপ্পা। প্রচলিত কর্পোরেট শাসিত পত্রিকাওয়ালাদের দেওয়াল টলিয়ে দেওয়ার অবস্থা এসে গেছে। সুতরাং মনে হল লিখবই যখন--আত্মজীবনীই লিখব। মহৎ জীবন ছাড়া আত্মজীবনী হয় না।
হাতড়ে দেখি, ওমা--কোথায় মহৎ জীবনের কথা--একবারে পোকামাকড়ের জীর্ণ দশা।
আর তো কিছু নেই। সুতরাং তাই সই।
প্রথম গল্প
.....................
শোলার ফুল
.....................................................
কুলদা রায়
একবার আমাদের ভুলু হারিয়ে গেল। কে তাকে খুঁজবে? আমি বের হলাম। টলোমলো পায়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটছি। বটগাছের শেকড়-বাকড়-ঝুরির ফাঁকে ফাঁকে খুঁজে দেখছি। ডাকছি, ভুলু। ভুলু।
রাস্তা পেরিয়ে গোহাট। কোনো গরু নেই। কিছু খড়কুটো আছে। একপাশে মন্দির। মা-কালী জিব কেটে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে মুণ্ডুমালা। গলায় শোলার ফুল। পায়ের নিচে শিব ঠাকুর। ঘুমুচ্ছে। একটি শিয়াল স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফিস ফিস করে বলল, চুপ চুপ।
মাঠ পেরিয়ে নিচুপাড়ার খাল। জল ছল ছল করে না। কচুরিপানায় ভরা। চওড়া পাড়। একজন বুড়ো মিস্ত্রী ঠুক ঠুক করে নৌকা গড়ছে। বললেন, তুমি কোন বাড়ির খোকা?
আমি কোন বাড়ির খোকা? বললাম, ভুলুদের খোকা।
-কোন ভুলু?
- হারিয়ে যাওয়া ভুলু।
মাথার উপরে একটি শিল কড়াই গাছের ছায়া লম্বা হয়ে নৌকার গায়ে ঝুঁকে পড়েছে। বুড়ো মিস্ত্রী তার গামছাটি পেতে দিলেন। শান্ত হাওয়া এলো। আমাকে ঘুমের মধ্যে ধরে নিয়ে গেল।
তখনো সন্ধ্যে হয়নি। ঘুম ভাংলো। ছায়াটি খালের ঐ পাড়ে চলে গেছে। হাতুড়ি বাটাল বাক্সে ভরে বুড়ো মিস্ত্রী আমার গায়ের মাছি তাড়াচ্ছেন। হেসে বললেন, দ্যাখো, তোমাকে খুঁজতে এসেছে।
ভুলু আমার পায়ের কাছে ন্যাজ নাড়ছে। বুড়ো আমার মাথায় তার রোগা আঙ্গুলগুলো বারদুয়েক রেখে বললেন, কক্খোনো হারিয়ে যেও না খোকা।
কে হারাবে? কোনো মানুষ না থাকলেও ভুলু কুকুরটিতো আছে। আমাকে ঠিক খুঁজে বের করবে।
এ গল্পটি যখন আমার মেয়েদের কাছে করি, মেয়েরা হাসে। বলে, কী বোকা। কেউ হারায় নাকি! হুম, প্রশ্ন বটে।
যখন প্লেনে উঠেছি, তখনো আমার স্ত্রী কাঁদছেন।মেঘের অনেক উপরে চলে এসেছি। আমাদের শহরের আলোবিন্দুগুলো আর নেই। ছোট মেয়েটি বলল, আমরা কোথায় যাচ্ছি, বাবা?
জানি না।
বড়ো মেয়েটি বলল, হারিয়ে যাচ্ছি।
এই প্রথম সত্যি সত্যি হারিয়ে গেলাম। কোনো বটগাছ, গোহাট, জিব বের করা মা-কালী, ঘুম কাতুরে শিব ঠাকুর, ছোট মাঠ, খাল পাড়, শিল কড়াইয়ের ছায়া, বুড়া মিস্ত্রী, আধগড়া নৌকা, অথবা আমার ভুলু কুকুরটিও আজ জানে- যে যায়, সে আর ফেরে না।
মন্তব্য
সুন্দর। ভালো লাগলো।
হারিয়ে যাওয়া শব্দটি অনেকটা মৃত্যু কামনার বিলাষিতার মতো । যতক্ষন না এলেও চেয়ে চেয়ে হা পিত্যেস আর এলো তো বড় নির্মম ।
আপনাকে অভিনন্দন ।
লেখার শুরুর কথা গুলো খুব ঠিক । যাদের গোষ্ঠি নেই যাদের মাঝে লেখা ছাপানোর জনয় ছুটো ছুটির অভ্যেশ নেই তারা লেখক হতে পারে না কেবল ইজের খেড়ো খাতার পৃষ্ঠা পচানো ছাড়া । হা হা হা
আমি ঠিক করেছি, আপনার প্রতিটি লেখায় কোনো না কোনো মন্তব্য করব। মুগ্ধতা প্রকাশের ভাষা খুঁজে না পেলেও অন্তত এই মন্তব্যটির মতো কিছু একটা লিখে যাব।
মেয়েদের সাথে একমত- এই জমানায় কোনো মানুষ হারাতে পারে না। আসলে মনে হয়, মানুষ হারাতে চায় না; কিংবা নিজেকে হারাতে ভুলে গেছে।
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
শিক্ষাবিষয়ক সাইট ::: ফেসবুক
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
ঠিক তার উল্টো !
মানুষ তো আসলে একটা হারানো অস্তিত্বই ! সারাটি জীবন ধরে নিজেকেই খুঁজে মরছে শুধু ! শেষপর্যন্ত খুঁজে পায় কিনা, সেটা ভিন্ন অনুষঙ্গ।
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
করতলে কিছুই থাকে না। আঙুলের পাশ দিয়ে সবই ঝরে যায়। দাদা, কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসদেবের পুত্র শুককে আমার বারবার মনে পড়ছে। সর্বজ্ঞানী শুক। তিনি বুঝলেন--সবই অধরা। তাই ধরার জন্য ছুটলেন। বনের মধ্যে দিয়ে। মানুষের মধ্যে দিয়ে। পৃথিবীর মধ্যে দিয়ে। ততক্ষণে তার সব কোন বাসনা নেই। তিনি চলেছেন--অনন্তের দিকে। আর তার বাবা পিছন থেকে ডাকছেন, শুক। শুক।
শুকতো উত্তরও দিচ্ছেন না। ব্যাকুল বাবাকে এই উত্তর দেওয়াটাও যেন এক বাসনা হতে পারে। তিনি সব শূণ্য হয়ে এগুচ্ছেন--অসীম শূন্যের দিকে। কেবল গাছগুলো তার হয়ে উত্তর দিচ্ছে--অহম ভোঃ। বেদব্যাসের কাছে মনে হচ্ছে--গাছের উত্তর দেওয়াটাও তার নিজের কল্পনা মাত্র। কেউতো উত্তর দেওয়ার নেই।
আমার এই রকম মনে হয়।
অপার অধরা ছাড়া আর কিছু থাকে না, দাদা।
...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'
...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'
ভাগ্যিস ওই অধরাটা শেষপর্যন্ত বাকি থেকে যায়। নইলে ধরার বাকি আর কিছু না পেয়ে মানুষ তার স্থবিঢ় হয়ে পড়া অস্তিত্ব নিয়ে কী করতো ! কিছু কি করার থাকতো ?
ধরার প্রয়োজন নিয়ে ওই অধরা মাধুরিটা চিরকাল অধরাই থাক্ ।
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
ভালো লেগেছে।
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
গল্পের মতনই লেগেছে।
...........................
Every Picture Tells a Story
আপনার ছোট ছোট বর্ণণাগুলোর ধরন ভয়াবহ রকম সুন্দর!
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
আপনার ভাষা মৃত নয়। জ্যান্ত।
--------------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার
মুগ্ধ হলাম!
আপনি অপাত্রে শক্তিক্ষয় না করে গল্প লিখে যান। ফেসবুকে যাদের সাথে লড়েন, তারা ঐ মনোযোগের যোগ্য তো নয়।
অসম্ভব সুন্দর৷
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'
অসাধারণ।
আহ...একদম সত্যি।
++++++++++++++
ভাষা হোক উন্মুক্ত
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
অসহ্য রকমের সুন্দর। আপনার গল্প লেখারও দরকার নাই। কী খেলেন, কোথায় গেলেন, আগডুম বাগডুম যা মাথায় আসে লিখতে থাকেন, আর আমি পড়তে থাকি...
আপনার সব লেখায় একটা পূর্বকথন বা দোহাই জাতীয় একটা অংশ থাকে আর তারপর থাকে মূল লেখা। এই ফরম্যাটটা কি সব লেখাতেই জরুরী? লেখার পটভূমি ব্যাখ্যা দিতে কি লেখক সব সময়ই বাধ্য হবে?
আপনার লেখায় মন্তব্য করি কম, কারণ তাহলে আমার করা মন্তব্যরই পুনরাবৃত্তি হবে। শুধু চাইব আপনি নিয়মিত লিখে যান, পোস্ট করে যান।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
কিচ্ছু বলার নেই!
কিচ্ছু বলার নেই!
______________________________________
যুদ্ধ শেষ হয়নি, যুদ্ধ শেষ হয় না
______________________________________
যুদ্ধ শেষ হয়নি, যুদ্ধ শেষ হয় না
স্মৃতিবেদনার অসহ ছিন্নবীণার বেসুরো দ্রুতগা রঙে লেখাটা রাঙিয়ে দেওয়ায় এক মুহূর্তে একটা যেন বিশ্বদর্শন হলো।
সালাম দাদা।
_______________________________
খাঁ খাঁ দুপুরে, গোধূলিতে আর রাতে বুড়ি পৃথিবী
কেবলই বলছে : খা, খা, হারামজাদা, ছাই খা!
(ছাই: মণীন্দ্র গুপ্ত)
_______________________________
খাঁ খাঁ দুপুরে, গোধূলিতে আর রাতে বুড়ি পৃথিবী
কেবলই বলছে : খা, খা, হারামজাদা, ছাই খা!
(ছাই: মণীন্দ্র গুপ্ত)
অসাধারণ...!!
বেশ ভালো লাগলো পড়তে... বেশ...
----------------------------------------
জানতে হলে পথেই এসো,
গৃহী হয়ে কে কবে কী পেয়েছে বলো....
-----------------------------------------------------------------------------------------------------
" ছেলেবেলা থেকেই আমি নিজেকে শুধু নষ্ট হতে দিয়েছি, ভেসে যেতে দিয়েছি, উড়িয়ে-পুড়িয়ে দিতে চেয়েছি নিজেকে। দ্বিধা আর শঙ্কা, এই নিয়েই আমি এক বিতিকিচ্ছিরি
আগের কথাগুলো না লিখলেও হতো...
প্রিয় ব্লগার হয়ে উঠছেন...
-----------------------------------------------------------------------------------
...সময়ের ধাওয়া করা ফেরারীর হাত থিকা যেহেতু রক্ষা পামুনা, তাইলে চলো ধাওয়া কইরা উল্টা তারেই দৌড়ের উপরে রাখি...
**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।
মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।
কেমন করে যে লিখেন। অসম্ভব ভালো লাগলো। মুগ্ধতাটুকু জানিয়ে গেলাম, দেরীতে হলেও।
আরও বেশি বেশি গল্প চাই আপনার কাছ থেকে। প্লিজ লিখতে থাকুন। প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ।
---------------------------------
কুটুমবাড়ি
নতুন মন্তব্য করুন