গন্ধগোকুল : একটি রগরগে ছুপান্যাস : দ্বিতীয় পর্ব

কুলদা রায় এর ছবি
লিখেছেন কুলদা রায় [অতিথি] (তারিখ: শনি, ০৭/০৮/২০১০ - ৬:৩৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

auto


প্রথম পর্ব : গন্ধগোকুল

দ্বিতীয় পর্ব.
………..
জালাল সাবের মাথাটা পুরা আউলা। বাঁহাত দিয়ে পাঞ্জাবীটা টেনে সামনে আনার চেষ্টা করছে। ধবধবে পাঞ্জাবী। কোরা মারা। ফজলু ঘুরংকলটা ছেড়ে দিয়ে বলল, হালাগো আশফাশ নাই। একদম ইজ্জতের উপ্রে হামলা।

জালাল সাব ঘাড়টা ঘুরিয়ে খুব বেশি দেখতে পেল না। আবছা ছোপ ছোপ দাগ লেগেছে। গাটা রি রি করে উঠেছে। তখন বেশ বড় একটা ঢেউ উঠেছে। এ সময় লঞ্চের মুখ ঘুরিয়ে দিতে হয়। ঢেউ কেটে যায়। ফজলু ঘুরংকলটা ছেড়ে দেওয়ায় ঢেউয়ের দোলা ঝাপটে পড়ল। জালাল সাব একটু টাল খেয়ে পড়ল। বলল, ফজলু, ঘুরংকলটা ধর। লঞ্চডা সৈর কর।

--রাখেন আপনের লঞ্চ। আগে ইজ্জত কা সওয়াল। বলে ফজলু ফাল দিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। যাত্রী কেবিনে ঢুকে চিৎকার করে উঠল, কেডায় করছে?

ফজলু দাঁত কিড়িয়ে মিড়িয়ে দাঁড়িয়েছে। হাত দুটো খড় খড় করে ঝুলছে। রোজি সামাদ পুটলিতে ভরে ফেলেছে পান শুপারি। কোলের কাছে রেখে সাদা তামাক মুখে দিয়েছে। চুন এলে পান খাবে। শবনম কি করে এতক্ষণ?

দেবনাথদের নতুন বউটির কপাল থেকে ঘোমটা নেমে গেছে। কানপাশা ঝকমক করছে। গলায় সীতাহার। পেছন থেকে দুটি মেয়ে অবাক হয়ে দেখছে। ফিস ফিস করে বলছে, গা ভরা গয়না। লক্ষ্মী পিতিমে রে। ছোট দেবনাথ নড়ে চড়ে বসেছে। তার ঝিম ঝিমানি এসেছে। ছোট্ট একটু হাসি তার গোফের নিচে ছলকে উঠেছে। লঞ্চটা দুলছে বলে বউটির কাঁধে মাথাটা সামান্য হেলে পড়েছে। বুকে সোনার বোতাম।

কেউ কোন কথা বলছে না বলে ফজলুর তুরবুরি বেড়ে গেছে। নিচের ঠোঁটটা তিরতির করে কাঁপছে। ডান পাটি উঁচু করে থপাস করে ফেলতে ফেলতে বলল, কেডায়, কেডায় করছে, কও। কইতে অইবে।
--গান্ধিবাবু জানে।

শালুক চান চক্ষু খুলে মুখটাকে দেখতে পেল। ফজলুর মুখ। কুঁচকে গেছে। ধীরে ধীরে বসে পড়েছে। এ সময় লঞ্চটি আবার ঝাঁকি খেয়ে থেমে গেল। শালুক চান পাশ ফিরে আবার চক্ষু মুদে ফেলেছে। রোজি সামাদ চোখটা শক্ত করে বলল, অ ফজলু, ডুবায় মাইরতে চাস নিকি? তর কেবিনে যা।

পায়ের নিচ থেকে ভাঙা কাঁচের টুকরো টেনে বের করতে হল। খয়েরের ছোট শিশি। লঞ্চ বিকট শব্দে ভড় ভড় করছে একটানা। ফজলু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দৌঁড়ে গেল সাড়েং কেবিনে। ফ্লোর জুড়ে টস টসে রক্ত। জালাল সাব ঘুরংকল ধরে আছে। একবার ডাইনে একবার ঘোরায়। আরেকবার বাঁয়ে ঘোরায়। আর মাঝে মাঝে টিং টিং দড়ি টানে। লঞ্চ তখন ভটং ভট। কপালে ঘাম জমেছে। লঞ্চ এক পা নড়ে না-- চড়ে না। আউ খাউ করে একটি জায়গায় থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফজলু চেঁচিয়ে উঠল, খাইছে রে।

ভটংভট থেমে গেছে। হাচা মোল্লা নিচ থেকে ছুটে এসেছে। হাতে পায়ে তেল মাখামাখি। চুল উজঝুড়।ফজলু ঝাড়ি দিল, বেপার কি?
--বেপারতো কেরাসিন।
--তাইলে আইলি যে? নাইমা যা।

ফজলু পা বাড়াতে গিয়ে থমকে গেল। রক্ত ঝরছে। টস টসে। হাচা মোল্লা শিউরে উঠল। বলল, খাড়ান ওস্তাদ। বলে এক টুকরো কালিঝুলি মাখানো ত্যানা এনে বেঁধে দিল। বাঁধতে বাঁধতে বলল, এহন কি করমু?

ফজলু কষে থাপ্পড় লাগাল গালে। গর গর করতে করতে বলল, কি করতে অইবে—তা জানস না হালার পো হালা। অ খাডাশডা, এদ্দিন ধইরা বাল জানলি!

গাল জ্বলে উঠেছে। গালে হাত দিয়ে হাচা মোল্লা নেমে গেল। সোজা লঞ্চের পিছনে চলে এল। নিচু হয়ে দেখতে পেল—পাঙ্খায় জাল জড়িয়ে গেছে। মহা হ্যাতর প্যাতর অবস্থা। ছাড়ানোর উপায় নেই। মালকাছা মেরে পানিতে নেমে গেল। জাল ছাড়ানো কঠিন। মিরধা দৌড়ে গেল ফজলুর কাছে। ফজলু বসে আছে পা তুলে। ত্যানা ভিজে উঠেছে। জালাল সাব বলল, দেরি হইতেআছে ক্যান?
মিরধা কিছু বলতে গেল। ফজলু থামিয়ে দিল। খিঁচিয়ে উঠল, যা, ক অরে।

ছোট দেবনাথ সারেং রুমের জানালার কাছে উঠে এসেছে। বিরক্ত মুখ। বলল, কী অইছে রে জালাল।
জালাল সাব চমকে তাকাল। জামার পিছনে লাল লাল ছোপ। ঘাড় ঘুরিয়ে আবার দেখার চেষ্টা করল। দেখে টেনে টুনে আড়াল করার চেষ্টা করল। মুখটা ঘুরিয়ে বলল, হালা ফজলুরে. নদীতে ইলিশের উসক কেমুন অইতেআছে এই গোনে?
ফজলু সেদিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, দাদায় আপনে বসেন গিয়া। কিছু অয় নাই। খামোখা কাউতলি করেন ক্যান?

এ সময় দুটো ট্রলার নৌকাকে তীরের দিক থেকে ছুটে আসতে দেখা গেল। কজন লোক কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একজন লঞ্চটির দিকে ইঙ্গিত করছে। নদীতে রৌদ্র তেতে উঠেছে। ফজলু টিং টিং দড়ির দিকে তাকাচ্ছে।
মিরধা একটি চকচকে দা হাচা মোল্লার দিকে এগিয়ে দিল। জলের দিকে তাকিয়ে বলল, দেরি করিস না। ফডাফড নামায় দে।
হাচা মোল্লা নামানোর আগের ইঞ্জিন রুমের দিকে দৌঁড়ে এল। মালকোছা থেকে ফুট ফুট করে জল পড়ছে। শাবানা বেগম আধো অন্ধকারে বসেছিল। তার সোন রং হাত ছুঁয়ে ফিস ফিস করে একটি বাক্স দেখিয়ে দিল। তারপর ছুটে গিয়ে ঝপাৎ করে লাফিয়ে পড়ল লঞ্চের পিছনে।

পাঙ্খায় জাল আতর ফাতর। একটু ডুবে গিয়ে দা দিয়ে পোচাতে শুরু করেছে। একটি ইলিশ জালে আটকে আছে। তখনো ফুলকা নাড়ছে। ইলিশটিকে ধরে উপরে ছুড়ে মারল মিরধার দিকে। চেঁচিয়ে বলল, আইস ছাড়াও ওস্তাদ। সর্ষে বাডা আইনা রাখছি। রাধুমআনে। ভুস করে ডুবে গেল। হাচা মোল্লা কায়দা করে বসল পাঙ্খায়।

ট্রলারের শব্দ ঘনিয়ে আসছে। এ সময় জালাল সাব সিগারেট ধরিয়ে নিয়েছে। কী একটা গান তার মাথার ভেতর গুণগুণিয়ে উঠেছে। ফজলু টিংটিং দড়িটা ধরে রেখেছে। তার চোখ ট্রলার দুটোর দিকে। জালাল সাব বলে উঠল, বাইদ্যার মাইয়া জোচছোনাডা লাগাতো দেহি।
--অহনতো চলবে না ছার।
-সমস্যা কি?
--লঞ্চ স্টার্ট নাই।
--তাইলে স্টার্ট দে। স্টার্ট দেরে ব্যাডা।
--কিন্তু!
--কোনো কিন্তু নাই। কইছি। স্টার্ট দিবি। ফাইনাল।

ফজলু টিংটিং দড়ি এক টান দিতে গিয়ে থেমে গেল। জালাল সাব মাথা নেড়ে হা করে দিল। ফজলু টিংটিং দড়ি ধরে টান দিতে লাগল। ধীরে ধীরে নয়। জোরে জোরে। মিরধা দৌড়ে এল। জালাল সাবের ভাব এসে গেছে। মিরধার হাতে বেদের মেয়ে জোৎস্নার সিডিটা ধরিয়ে দিয়ে বলল, যা ব্যাডা। ফিট কর।

ফজলু খোঁড়াতে খোঁড়াতে নিচে চলে গেল। মুখটা কঠিন। লঞ্চটা ফট ফট করে উঠল। ধোঁয়ায় ভরে গের ইঞ্জিন ঘর। কালো। জানালা গলিয়ে নদীর উপরে উড়ে গেল। শাবানা বেগম মুখে কাপড় গুজে উঠে দাঁড়িয়েছে। শরীরটা থরথর করে কেঁপে উঠছে। টিভিতে তখন অঞ্জু ঘোষ নেচে উঠেছে—
বেদের মেয়ে জোৎস্না আমায় কথা দিয়েছে।
আসি আসি বলে জোৎস্না ফাঁকি দিয়েছে।।

এ গান যেখানে সত্য অনন্ত গোধুলী লগ্নে ট্রলার দুটো ভিড়ল লঞ্চটার গায়ে। ফস ফস করে লোকগুলো উঠে গেল। চিৎকার করে ওদের কে একজন চেঁচিয়ে উঠল, কোন হালারপো হালা মোগো জাল কাডছেরে?
--গান্ধিবাবু জানে।
--গান্ধিবাবু কী জানে?
--হ্যায়ও গান্ধিবাবু জানে।

শালুক চান গভীর ঘুমের থেকে চক্ষু ফাঁকা করে আবছা দেখতে পেল—চোখ লকলক করে। আর দা চকচক করে। আর পরাণ ধ্বক ধ্বক করে। গুম্ফধারী কেবিনের দরোজায় ধা করে লাথি ছুড়ল। হা করে খুলে গেল দরোজাটা। চোখের পলকে ঢুকে ছাদে ঢাক করে বাড়ি দিয়েছে। যারা বেদের মেয়ে জোৎস্নার গানে বিহ্বল হয়েছিল—তারা মনে করল—এই দাধারী গুম্ফমানুষগুলো টিভির ভিতর থেকে লাফিয়ে পড়েছে। ওরা ভিতরে ঢুকে লণ্ডভণ্ড করে দিল। অন্যরকম মজা। মেয়ে দুটো ফিক ফিক করে হাসছিল, আর দেবনাথদের ছোট বউটির সঙ্গে চোখাচুখি করছিল—তারা দুজনে বিস্মিত হয়ে দেখল, কালো বোরকা জড়ানো তাদের মায়ের গলা থেকে গো গো শব্দ হচ্ছে। দুটো দৃঢ় হাত ওদের গলার দিকে এগিয়ে আসছে। গো গো করার সময় পেল না। ছোট দেবনাথ কী একটা বলতে চেয়েছিল।তার আগে একটা হাতের সঙ্গে তার কানের লতিটি ছিড়ে এল। গিলে করা পাঞ্জাবিটির উপর টপটপ করে লাল রক্ত ঝরতে লেগেছে। নতুন বউ হড়বড় করে বমি করতে করতে দেখতে পেল, ছোট দেবনাথকে ওরা বাইরে নিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তারপর ঝপ করে শব্দ হল। কিন্তু কেউ শুনতে পেল না। তখন জ্যোৎস্না কোমর দুলিয়ে দুলিয়ে গাইছে –
বেদের মেয়ে জোৎস্না আমায় কথা দিয়েছে।
আসি আসি বলে জোৎস্না ফাঁকি দিয়েছে।।

জালাল সাব আরেকটি সিগারেট ধরিয়ে ফেলেছে। গানটি শুনতে শুনতে গোল গোল রিং বানাতে শুরু করেছে। রিংগুলো হাওয়ায় দোলে। উপরে ওঠে। ধীরে ধীর বাইরে চলে যায়। ধোঁয়া দিয়ে এরকম রিংয়ের যাদু মেহেন্দিগঞ্জে কেউ কোনদিন বানাতে পারে নি। এ ব্যাপারে জালাল সাব ফাস্টো কেলাস। এই কথা ভাবতে ভাবতে মিরধা আকুল হয়ে বুঝতে পারল—আজ তার রাড়ী বাড়ি যাওয়া দরকার। মাথার ভিতরে একটি কাটামুণ্ড সাপ ফোঁস ফোঁস করছে। উহা সাপ নয়—সর্প।
--এই সর্পের কথা আর কেডা জানে?
--গান্ধিবাবু জানে।
সর্প দেখিয়া পরাণ উড়িয়া যায় গো গান্ধিবাবু। মইরাম বিবির ধোঁয়াগিরি সাফ বিনা তারণ নাইকা।


মন্তব্য

মুস্তাফিজ এর ছবি

এক টানে পড়লাম

...........................
Every Picture Tells a Story

হাসিব এর ছবি

এইটার নাম ছুপান্যাস কেন?

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

ditto

----------------------------------------------------------------

অভ্র আমার ওংকার

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

একবারে পড়ুম পুরাডা
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।