বই-দাদু : ধীরেন্দ্রনাথ সরকার

কুলদা রায় এর ছবি
লিখেছেন কুলদা রায় [অতিথি] (তারিখ: মঙ্গল, ১৭/০৮/২০১০ - ১০:১৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

তিনি এসেছিলেন ঝড়ের পরে। সাতাত্তরের এপ্রিলে। মাত্র তিন মিনিটে একটি শহর লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল। আমাদের টিউকলটি একটি নারিকেল গাছে স্প্রিংএর মতো পেঁচিয়ে গিয়েছিল। টিনের ঘরগুলো কাগজের মতো হাওয়ায় উড়েছিল। আর অনেকের মতো আমাদের হারুনকাকুকে পাওয়া গিয়েছিল নদীর অন্যপাড়ে। সকালে তিনি গাছপালা-ঘরবাড়ি উজিয়ে এলেন। আমরা দুভাই, মেঝ বোনটি আর বাবা—নিঃসহায়ের মত বসে আছি। মা গেছে মামাবাড়ি। তার কোনো সংবাদ তখনো পাইনি। তিনি এলেন আর বাবা উঠে দাঁড়াল।

তিনি হাত ধরে নিয়ে গেলেন সারা শহরে। ঘুরে ঘুরে দেখালেন—প্রবল ঝড়ের পরে মানুষ জেগে ওঠেছে। আবার দাঁড়িয়ে যাচ্ছে মানুষের ঘরবাড়ি আর ঠিকানা। তার কাছে আঁক কষি। এর ফাঁকে ফাঁকে পড়ে শোনাতে হয় মহাভারত আর তিনি শোনান রবীন্দ্রনাথ স্মরণ থেকে। তিনি বলেন আর লিখি বড় বড় কাগজে শাপলার অপার গুণের কথা। মোড়ে মোড়ে দেওয়ালে দুজনে আঠা দিয়ে লাগিয়ে দেই। মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শহরের হাটে হাটে বলতে হয় শুষণি শাকের কথা। মাঝে মাঝে শেলফ থেকে বের করে আনেন একটি ছোট ডাইরি। লিখেছেন তার ছোট ছেলে।এই ছেলেটি রবীন্দ্রনাথ হবেন এই শুধু আশা। তার একটি কবিতার বই বেরিয়েছে— যুগশিখা। তিনি রবীন্দ্রনাথ হলে আমাদের মন খুশি হবে।

আমার নিজের দাদু বছর দুয়েক আগে নাই হয়ে গিয়েছেন। তাই এই দাদুটির সঙ্গে আমার দিন কাটে। বিকেলে গরুটি নিয়ে বের হন নদীর পাড়ে। শুভ্র চুল—ওড়ে শ্মশ্রুদল।এক হাতে চোখের সামনে খোলা বই। পড়ছেন। আর অন্য হাতে গাভিটির দড়ি—নিরবে ঘাস খাচ্ছে। প্রতিদিন লোকজন দেখছেন—ধুতি পাঞ্জাবী পরা ধীরেণ মাস্টার ক্রমশ দেবপ্রতিম। দূর থেকে তাকে সালাম জানিয়ে যাচ্ছেন নিরবে। কে একজন বুড়ি অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছেন--ঈশ্বর মানুষের বেশে হেঁটে বেড়ান। এখানকার হাওয়া মধুময়। এই হাওয়ায় আমি ঘুমিয়ে পড়ি। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার আগে আমরা দুজনে মিলে বাড়ি ফিরি।

মাঝে মাঝে তিনি বলছেন আর একটি খাতায় লিখছি বাংলা বাগধারার ইতিবৃত্তটি। সহজ সরল গদ্য। বলেন, যা বলতে চাও তা সহজ করে বল হে। পড়ে প্রাণ টানে। খাতাটি ভরে গেলে তিনি উপরে বড় বড় করে লিখলেন—মণিকোষ। বের হল বাংলা একাডেমী থেকে।

যেদিন স্কুল থেকে অবসরে গেলেন—তারপর থেকে তিনি বলছেন আর আমি লিখছি চিঠি। মাজেদ—তোমাদের কাছে কখনো গুরু দক্ষিণা চাইনি। কিন্তু কিছু বই চাই। প্রাপক মাজেদ অথবা আলী নূর। কোন এক মোসাব্বির পাঠিয়ে দিচ্ছেন ডাকে কিছু টাকা। আমরা দুজনে মিলে বুক লিস্টি বানাতে লেগে যাই। আর চিঠি লিখি মুক্তধারায়, বাংলা একাডেমীতে—জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনীতে। কাউকে লিখি—ভিক্টর হুগোর অমনিবাস আমাদের দরকার। একদিন লিখতে দেওয়া হল একটি সাইনবোর্ড –সুভদ্রা স্মৃতি গ্রন্থাগার।

একদিন সাতপাড়ের আগে নৌকা চলে গেল আরও ভিতরের গ্রামে। টুঠামান্দ্রা-- অজ পাড়াগাঁ। একটি স্কুলঘরের পাশে একটি টিনের ঘর উঠেছে। ভেতরে কয়েকটি ঝকঝকে আলমারী। কাঁচের ভিতরে হাসছে আমাদের দুজনের বুক লিস্ট থেকে উঠে আসা বইগুলি। এই তাঁর জীবনের স্বপ্ন পূরণ।

সুভদ্রা তাঁর মা। এককালে তার মা ছিলেন এই গ্রামে। তাকে শাপলা রেঁধে খাইয়েছিলেন কতবার আর তালের পিঠে। তার জন্য এই বুড়ো ছেলেটি চাকরীর সব টাকা আর দক্ষিণা খরচ করে মায়ের গ্রামে গড়েছেন গ্রন্থাগার। সেদিন তৃপ্তি ভরে আমাকে ধরে হেসে উঠেছিলেন। কিরে—ভাল লাগছে না!

ভাল না লেগে পারে! এই ভাল লাগা নিয়ে আজো বেড়ে উঠি।

আহা, এই বই-দাদুর নির্মল হাসিটি মাঝে মাঝে দেখা যায় ঈশ্বরের মুখে।


মন্তব্য

হিমু এর ছবি
কুলদা রায় এর ছবি

দাদু নেই। গ্রন্থাগারটি আছে অইগ্রামে।
গ্রামটিতে আমি ওঁর সঙ্গে চড়কমেলায় গেছি।
তার ছোট ছেলে পরিমল সরকার ডাক্তার। শিশুদের নিয়ে গান লেখেন, সুর করেন আর তাদের নিয়ে অনুষ্ঠান করেন প্রতিবছর লাইব্রেরীর সামনে।
বাবার ডুপ্লিকেট।
...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'

...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাল লাগল
রাজীব মিত্র
ইমেইলঃ

হাসিব এর ছবি

কীভাবে লিখতে হয় সেটা শিখছি আপনার লেখা পড়ে পড়ে। লিখতে থাকুন।

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

খুব দুঃখজনক হচ্ছে আমি গ্রাম বুঝি না। অনেক কিছু ধারণা করে নিতে হচ্ছে। দুঃখই লাগে ...
___________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

ভালো লাগল।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

কুলদা রায় এর ছবি

https://mail.google.com/mail/?ui=2&ik=06feab365f&view=att&th=12a8142ee96c14d6&attid=0.1&disp=thd&zw
বই-দাদু ধীরেন্দ্রনাথ সরকার।
...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'

...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'

সুরঞ্জনা এর ছবি

আপনার লেখা বড়ই হৃদয়গ্রাহী।
বইপাগল দাদুর জন্যে রইল ভালবাসা।
............................................................................................
স্বপ্ন আমার জোনাকি
দীপ্ত প্রাণের মণিকা,
স্তব্ধ আঁধার নিশীথে
উড়িছে আলোর কণিকা।।

............................................................................................
এক পথে যারা চলিবে তাহারা
সকলেরে নিক্‌ চিনে।

কুলদা রায় এর ছবি

auto

দাদু নেই। তবে আপনাদের ভালবাসা পাচ্ছেন নিশ্চয়ই। ওনার ছেলে ডাঃ পরিমল সরকার জানালেন--গ্রন্থাগারটি আছে ঠিকঠাক মত। দাদু একটা ফান্ড দিয়েছিলেন--গ্রন্থাগার পরিচালনার জন্য। সেটা গায়েব হয়ে যায় নি। আরও বেড়েছে।
দূর দূর গ্রামের মানুষজন বই ধার নেন। পড়েন।
একবার আমার বন্ধুরা একটা অনুষ্ঠানে তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তিনি ঠিকই সেই বই এবং গরু হাতে হাজির। কেননা অনুষ্ঠানটি হয়েছিল বিকেলে--নদীর পাড়ে। তাঁকে একটি সম্মাননাপত্র দেয়া হয়েছিল।
...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'

...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'

শান্ত [অতিথি] এর ছবি

নমস্য এই ব্যাক্তিকে আমার অন্তরস্থল থেকে শ্রদ্ধা

তিথীডোর এর ছবি

বইদাদুর জন্য শ্রদ্ধা!

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

কুলদা রায় এর ছবি

ধন্যবাদ।
...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'

...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'

মাহবুব লীলেন এর ছবি

ভাল্লাগছে এরকম একটা কাহিনী শুনে

বইখাতা এর ছবি

বই-দাদুর কথা জেনে ভাল লাগলো।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।