কবিয়াল বিজয় সরকারের জন্ম নড়াইলে। তিনি দক্ষিণবঙ্গে প্রবাদতুল্য কবিয়াল। মতুয়া সম্প্রদায় তাঁর গান গেয়ে পথ চলে। মতুয়া সম্প্রদায় হল নমশুদ্রদের একটি সহজিয়া মত। লাল নিশান নিয়ে তারা বারুনীতে যায়। পদব্রজে ওড়াকান্দিতে। বানী শুধু হরিব্বোল। মতুয়াদের গুরু হরি ঠাকুর। তাকে নিয়ে রাইরসরাজ কবি হরিলীলামৃত রচনা করেছেন বহুবছর আগে। এটা নমশুদ্রদের একটি ইতিহাস। ছোট বেলায় আমিও এই মতুয়াদের সঙ্গী হয়েছি।
বিজয় সরকারের আটটি গান পেলাম।
১.
পোষা পাখী উড়ে যাবে সজনী একদিন ভাবি নাই মনে
সে আমারে ভুলবে কেমনে সজনী একদিন ভাবি নাই মনে
খেলতো পাখী সোনালী খাঁচায়
কতো কি বলিতো আমায়
বসে রূপালী আড়ায়
স্ফটিকের বাতি ভরে খাবার দিতাম থরে থরে
নিঠুর পাখী আমার খেলতো আনমনে
জংলি পাখী করলো সর্বনাশ
শুধু করি হাই হুতাস
কোথায় করবো তারে তালাশ
বনের পাখী বনে গেল
দিল আমার বুকে শেল
নিঠুর পাখী আমার গেল কোন বনে
আমি পাখীর মায়া ভুলবো কেমনে
পাখীর মায়ায় পড়ে কতো লোক
তারা পেল আমার মত শোক
তাদের জল ভরা দুই চোখ
অসীম গহীন বনের পাখী
(তারে) আপন বলে কেন ডাকি
পাগল বিজয় কান্দে পাখীর সন্ধানে
পাগল বিজয় কান্দে বসে বিজনে
২.
দরদীয়া রে কোন দেশে যাবো
তোর লাগিয়া রে
আমার জীবনে মরনে সুখ নাই
ঐ মুখ না দেখিয়া রে
ঝিল্লিমুখর ঘর-বাড়ি সব রজনী নিঝুম
একা একা বসে আছি চোখে নাইরে ঘুম
কাঁদে আমার সাথে বনের কুসুম
রজনী জাগিয়া রে
আধ ফালি এক চাঁদের হাসি
শেফালী বনে
———————- ?
আছি প্রতীক্ষায় এই শূণ্য ভুবনে
মিলন
তটিনী চলেছে ঢেয়ে
সে কার তল্লাসিয়া রে
৩.
তুমি জানো নারে প্রিয়
তুমি মোর জীবনের সাধনা
তোমায় প্রথম যেদিন দেখেছি
মনে আপন মেনেছি
তুমি বন্ধু আমার বেদন বুঝো না
ফাল্গুন দোল পূর্ণিমায়
মৃদু মৃদু বায়ু বয়
ফুলবনে পুলকের আল্পনা
মাধুয়া মাধুবী রাতে বঁধুয়া তোমারি সাথে
করেছিনু যামিনী যাপনা
(তুমি) আমায় ফেলে চলে গেলে
কি আগুন মোর বুকে জ্বেলে
একদিনও দেখতে তুমি এলে না
যদি পেতাম দুঃখিনীর কুটিরে
দেখাইতাম অন্তর চিঁড়ে
বুকের ব্যথা মুখে বলা চলে না
কাষ্ঠ-নলে দাবানল
পুড়ে যায় বন জঙ্গল
মন পোড়া পিরিত বন্ধু তাহা নয়
কত বিরহীনির তুমি অন্তর তলে
বিনা কাষ্ঠে আগুন জ্বলে
জলে গেলে জ্বলে দ্বিগুণ
নিভে না– না নিভে না
খুঁজিলাম জনম জনম
ক্ষিতি অপ তেজ মরুৎ ব্যোম
কোনখানে পাইনে তোমার ঠিকানা
পাগল বিজয় বলে চিত্ত চোর
ফিরবে কি জীবনে মোর
মনে রইলে ব্যথা ভরা বাসনা
৪.
কোন দেশেতে যাব গুরু
যাব আমি তোমার সন্ধানে
জনম আমার গেল বিফলে
আমায় মানবকুঞ্জে কনে বা পাঠালে
বহুজনম করিয়ে এমন তবুও হলনা স্মরণ
শুধু মায়ারই কারণ
আমার এ জনম বিফলে গেল
কৃষ্ণ সেবায় না লাগিল
আমার এ দুঃখ কি যাবে মরিলে
ভাই-বন্ধু-পুত্র পরিজন
তারা ভাবে না কখন
আমি ভাবি সর্বক্ষণ
যাবে ভাবিলে হয় চির শান্তি
জীবনে কেটে যায়রে মোহশান্তি
তারে পুজলেম না দুই নয়নের জলে
সাধু গুরুর চরণ ধৌত জল
শুনি সর্ব তীর্থের ফল
কবে করিব সম্বল
শুধু এ করিও দান বন্ধু
নয়নে আসে যেন জল একবিন্দু
সে জলে দেব আমি
সাধু গুরুর চরণ যুগলে
আমার বৃথা এই জনমে
পাগল বিজয় বলে মন ইন্দ্রিয়রে
তুই রইলি মোহ অন্ধকারে
সাধু গুরুর কৃপা হলে
কত প্রেম ফল ফলে
৫.
এই পৃথিবী যেমন আছে তেমনি ঠিক রবে
সুন্দর এই পৃথিবী ছেড়ে একদিন চলে যেতে হবে
যখন নগদ তলব তাকিত পত্র নেবে আসবে যবে
মোহ ঘুমে যে দিন আমার মুদিরে দুই চোখ
পাড়াপড়শী প্রতিবেশী পাবে কিছু শোক
তখন আমি যে এই পৃথিবীর লোক ভুলে যাবে সবে
যতো বড় হউকনা কেন রাজা জমিদার
পাকা বাড়ি জুড়ি গাড়ি ট্রানজিস্টার
তখন থাকবে না কোন অধিকার বিষয় ও বৈভবে
চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা আকাশ বাতাস জল
যেমন আছে তেমনি ঠিক রইবে অবিকল
মাত্র আমি আর থাকবোনা কেবল জনপূর্ণ ভবে
শব্দ স্পর্শ রূপ রস গন্ধ বন্ধ হলো যেন
এই পৃথিবীর অস্বস্তি বোধ থাকবেনা আর হেন
পাগল বিজয় বলে সেই দিন যেন এসে পড়ে কবে
৬.
আমি জানিতে চাই দয়াল তোমার
আসল নামটি কি
আমরা বহুনামে ধরাধামে
কত রকমে ডাকি
কেউ তোমায় বলে ভগবান
আর গড কেউ করে আহ্বান
কেউ খোদা কেউ জিহুদা
কেউ কয় পাপীয়ান
গাইলাম জনম ভরে মুখস্থ গান
মুখ বুলা টিয়াপাখী
সর্বশাস্ত্রে শুনিতে যে পাই
দয়াল তোমার নাকি মাতাপিতা নাই
তবে তোমার নামকরন কে করলে সাঁই
বসে ভাবি তাই
তুমি নামি কি অনামি সে সাঁই
আমরা তার বুঝি বা কি
কেহ পিতা কেহ পুত্র কয়
আবার বন্ধু বলে কেউ দেয় পরিচয়
তুমি সকলেরই সকল আবার
কারো কেহ নয়
তোমার দেওয়া আসল পরিচয়
কে জানে তা কি না কি
বিজয় বলে মনের কথা কই
আমি খাঁটি ভাবের পাগল নই
আমার গোল বেঁধেছে মনের মাঝে
তাতেই পাগল হই
আমার বুকে যা আই মুখে তা কই
কাঁটা কান চুলে ঢাকি
৭.
আমার দুই নয়নে বহে ধারা গো
আমি মুছব কত অঞ্চলে
প্রাণজ্বলে সে আর আসিবে গো
কলংকিনি না মরিলে
নিশিতে সাজাইলাম রে বন্ধু
ফুলের বাসর ঘর
দেখতে অতি মহোহর বন্ধু
আমার ফুলের মালা হইলো বাসী
মালা দিব কার গলে
প্রাণ জ্বলে
আসবে বলে প্রাণের বন্ধু (আমার)
রইলাম চেয়ে
আমার বন্ধু বিনোদিয়া বন্ধুরে
আমার বন্ধু বিনে সোনার যৌবন
মরিব সই অকালে
প্রাণ জ্বলে
আমি বন্ধুর তালাশে যাব
প্রতি ঘরে ঘরে
বন্ধু রইল কার বাসরে
বন্ধুরে
পাগল ফকির ভানু কেন্দে বলে
আর কি পাব তাহারে
৮.
একটা চিঠি লিখি তোমার কাছে ব্যাথার কাজলে
আশা করি পরান বন্ধু আছো কুশলে
আগে নিও ভালোবাসা অবলার না বলা ভাষা
আমার যত গোপন আশা ভিজাইয়া দেই নয়ন জলে
প্রথম যেদিন এসে তুমি মিলাইলে হাত
ফুটিল মনের বনে প্রেম পারিজাত
সেই বাসরে শুণ্যহিয়া আমি থাকি তবু পথ চাহিয়া
কান্দে আমার মন পাপিয়া গুঞ্জরিয়া বুকের তলে
যে বকুলের তলায় বসে শুনেছিলাম বাঁশী
সেই বকুলের মুকুলেতে গন্ধে অলি হাসে
ছিঁড়ে গেছে গাঁথা মালা বুকে জ্বলে দারুন জ্বালা
কুলবধু হইলা একলা কান্দি বসে নিরালে
ভুলে যাওয়া পথটি ধরে ভুল করে এসে
পার যদি দেখে যেও দিনের শেষে
(আমি) কেমন আছি পরের ঘরে দেখে যেও নয়ন ভরে
বনবিহঙ্গী থাকে যেমন বাঁধা শিকলে
কি যে লিখি কি বা বাকি পাইনা খুঁজিয়া
অভাগিনীর মনের বেদন (তুমি) লও বুঝিয়া
চিঠি লিখি করি ইতি নিও আমার প্রেম পিরীতি
(অধম) রসিক বলে শেষ মিনতি চরণ কমলে
পোষাপাখি একদিন উড়ে যাবে গানটি শুনুন--
http://www.youtube.com/watch?v=tgS5HO5tFTo&feature=related
মন্তব্য
পাগল বিজয় বলে চিত্ত চোর, আসবে কি জীবনে মোর?
সেই কথা তুমি বন্ধু জানো না... তুমি জানো না...
তুমি জানো না রে দয়াল... তুমি মোর জীবনের সাধনা...
আহ্ বিজয় সরকার...
আমার বাবা একটু মা'রেফত লাইনের লোক ছিলো। আমাদের বাড়িতে প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে একটা জলসা হতো। আমি তখন খুব ছোট। আমি ডানোর কৌটায় তাল দিতাম... তখন থেকে বিজয় সরকার আমার মনে।
বিজয় সরকার নিয়ে অনেক কিংবদন্তী শুনতাম ছেলেবেলায়... তার কবর বিষয়ক কাহিনী একসময় খুব আশ্চর্য লাগতো। তখনো বিজয় সরকারের কোনো রকর্ড আমি পাইনি। কিন্তু তার গান গাইতাম!
তার অনেক বছর পরে কোলকাতায় গিয়ে এইচএমভির রেকর্ডে বিজয় সরকারের ১০টা গান পাই। সেটাও প্রায় এক যুগ আগের কথা।
বিজয় সরকারের যে কয়টা গান আমি এখন পর্যন্ত শুনেছি... গুরু...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
তিন নাম্বার গানটা, তুমি জানো না গো প্রিয় ... এটা অনেকদিন আগে শুনেছিলাম। আছে আপনার কাছে?
এই গানটা একটা ঢাকাই সিনেমা ব্যবহার করা হয়েছিল। সিনেমার নাম সম্ভবতঃ "রসের বাইদানী"। এবং গানটা সম্ভবতঃ এন্ড্রু কিশোর গেয়েছিলেন।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
আমি অবশ্য শুনেছিলাম একজন চারণগায়কের মুখে।
বানী চক্রবর্তী এবং তাপসী চৌধুরীর গাওয়া ভার্শনটা পাবেন এখানে।
এই পোস্টে প্রকাশিত গানগুলি ইন্টারনেটে পাওয়া যায়। এই পোস্টটি তাই কোন অর্থেই মৌলিক নয়। কিভাবে মডারেশন পার হল সেটা নিয়ে চিন্তিত হলাম।
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
"তুমি জানো নারে প্রিয়
তুমি মোর জীবনের সাধনা"
৮০’র দশকে কোন এক ব্যান্ড গানটা বাজিয়েছিল, নামটা এখন মনে করতে পারছিনা।
...........................
Every Picture Tells a Story
মনে হয় ব্যান্ডটা ছিল চাইম। খালেদ গানটা গেয়েছিল...পুরো নিশ্চিত নই।
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
একদম ঠিক, মনে পড়লো।
আসলে বুড়া হইছি, অনেক কিছুই ভুলে যাই।
...........................
Every Picture Tells a Story
ব্যান্ডটার নাম চাইম। খুবই জনপ্রিয় ছিলো একসময়।
রাতঃস্মরণীয়
অনেক কবি গান শুনেছি। আমাদের শহরের কলেজ মাঠে হত। অনেক বড়ো মাঠ। বঙ্গবন্ধু এমাঠে ভাসণ দিতেন। আর কবিগানের আসরে গ্রাম ভেঙে আসত। মাঠ পেরিয়ে রাস্তা, নদীর পাড়ে লোকে বসে পড়ত। দুই কবি লড়াই করছেন। একজন ভক্ত আরেকজন ভগবান। ভক্তের ছেলে অকালে মরে গেছে। ভগবানকে বলছে--আমি তোর এত সেবা করলাম। কিন্তু আমার ছেলেটাকে নিয়ে গেলি কোন অপরাধে? আমার ছেলে ফিরিয়ে দে...
দোহাররা সঙ্গে সঙ্গে গেয়ে ধরত-- আমার ছেলে ফিরিয়ে দে।
থৈ থৈ মানুষ ভক্তের সঙ্গে ভগবানের সঙ্গে কাঁদতে কাঁদতে আবেদন জানাচ্ছে--আমার ছেলে ফিরিয়ে দে।
এখনো এই বিদেশ বিভূঁইয়ে যখন একা থাকি--তখনো কখনো কানের মধ্যে শুনতে পাই অই গানটি। কবি তখন ধরেছেন আরেকটি বিচ্ছেদি গান--আমার পোষা পাখি উড়ে যাবে একদিন ভাবি নাইতো মনে।
মনে হয় এক ছুট লাগাই। এই ছাতামাতার বিদেশের নিকুচি করি। দেশে ফিরে যাই। হায় গান। যাও গান।
...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'
...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'
দাদা, রাইরসরাজ কবি ‘হরিলীলামৃত’ রচনা করেছেন বহু বছর আগে? এরকম ভুল তথ্য না দিলেও বিজয় সরকারের গানগুলি উপভোগ করতে একটুও অসুবিধা হতো না। হলিলীলামৃত গ্রন্থের রচয়িতার নাম বদলে দিলেন? বলিহারি, দাদা, বলিহারি!!!!!
বিজয়ের গানগুলোর মধ্যে আমার সবথেকে পছন্দের গানটা হচ্ছে-
নক্সী কাঁথার মাঠেরে-
সাজুর ব্যাথায় আজও বাজে রূপাই মিয়ার বাশের বাঁশি
তাদের ভেঙ্গে গেছে আশার বাসা
তবু যায়নি ভালো বাসাবাসি।।
খুলনায় বিজয় সরকারের অনেক শিষ্য আছেন। তাদের মধ্যে একজন জাফর ভাই। মাঝে মাঝেই তার গুরুর গান শোনাতেন। বিজয়ের নিজের কণ্ঠে গাওয়া ১০টা গানের স্পুল ক্যাসেট শুনেছিলাম একবার অনেক বছর আগে আমাদের পাড়ার তবলার দোকানদারের কাছে। অসাধারণ দরদী কণ্ঠ। অনেক খুজেঁও পরে আর ওই ক্যাসেট বা কোনও এলপি পাইনি। শুনেছি খুলনা রেডিওতে তার কিছু গানের রেকর্ড আছে।
পোষা পাখি উড়ে যাবে সজনী গানটার ব্যাকগ্রাউন্ড এখানে লিখলে ভালো হতো।
রাতঃস্মরণীয়
আরও একটা চমৎকার গানের উল্লেখ এখানে নেই। কি সাপে দংশিলো-
[i]আগে যদি জানতাম গো আমি
বিষের এতো তাপ
ঘপ বান্ধিতাম হাওয়াই দ্বীপে
যেই দেশে নাই সাপ।।
অসাধানণ বাণী এবং কাব্যিকতা।
রাতঃস্মরণীয়
নতুন মন্তব্য করুন