হাতি মেরা সাথী
(সঙ-বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ : এই ছুপান্যাসের সগোল চরিত্রই বাস্তব। অজীবিত বা মৃত কোনো মালের লগে ইহার কোনো মিল নাই। কোনো অমিল পাওয়া গেলে তা লেখকের ভাব বলে ধরে নিতে হবে।)
শেখ বাদশাকে নিয়ে একটি গল্প লেখা দরকার। কারণ শেখ বাদশার মুখে গোঁফ। মোটা মাথা। এককালে ঝাকড়া চুল ছিল। চোখ দুটি বড়ো। যখন হাসে তখন বোঝা যায় শেখ বাদশা চলছে। যখন রাগে তখন ধারণা করা যায় শেখ বাদশা বলছে। যখন নিঃশব্দ হয় তখন বোঝা যায় ঘটনা আছে। কী ঘটনা? সেটা জানে শহরের একমাত্র নিকিবাই গহরজান। ও লালমেরী পট্টি, রাখিও বালা।
সূর্য যখন বত্তি হয়ে মধ্য গগণে ঝুলে পড়তে চাইছে তখন দামোদরের খালে গহরজান হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে হাই তুলছে। তার সামনের দুটো দাঁতের একটি সোনা দিয়ে বাঁধানো, আরেকটি আপাতত রূপা। সে সময়ে এইচ কে জুয়েলার্সের কৃষ্ণবাবুর দোকানে বিস্কিটের আমদানী কম ছিল। বর্ডার কড়াকড়ি। ফলে একটি দাঁত রূপা দিয়ে বাঁধানো ছাড়া উপায় ছিল না। কৃষ্ণবাবু মানী লোক। দানী ভাল। তিনি আশ্বস্ত করে বলেছেন—চিন্তা কইরো না গহরজান। একটা দাঁত রূপা দিয়াই বান্দো এখন। খবর পাঠাইছি মোহনলালজীকে। চালান আইলেই রূপা পাল্টাইয়া সোনা। সোনা নিয়া তুমার ভাবনা কী। তুমি নিয়ে তো সোনা।
--নো সোনা।
--সোনাকে সোনা না কি রূপা কইতে অইবে?
সোনার বদলে ইহাকে বলিও স্বর্ণ
তাহাতে তোমরা পাইবে ঝাঁঝালো পর্ণ।।
এই লোকটির নাম মুনশী গরীবুল্লাহ। বাসা শিকারপুর মৌজার ঝাটকাঠি। কিঞ্চিৎ শুষ্কং কাষ্ঠং। আঁখির কোনে ভাব আছে। গাছির মনে ডাব আছে। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি আছে। লোকটি শহরের বিশিষ্ট কবি। তার কবিতা শুনে কৃষ্ণবাবু সহসা হেসে উঠল। শুধু শেখ বাদশা গম্ভীর হয়ে জানতে চাইল—হ্যায় তো বোজলাম মামু। কিন্তু এই পর্ণ জিনিসডা কী?
পণ্ডিত রসময় কুমার গলা খাটো করে বললেন, বুলু।
--বু-লু?
--বুলু বুলু।
--বুউ-লুউ। বুঝজি।
বলেই শেখ বাদশা কবির কাঁধে বড় একটা থাবড়া মেড়ে নাবড়া করে হেসে উঠল। কবি মুনশী গরীবুল্লাহর গুরবো দেহ নড়ে চড়ে গেল। তিনি কাঁধটা বেকিয়ে একবার শুধু বলে উঠলেন, আহ। পর্ণ শব্দটির আরেকটি অর্থ আছে। সেটা মনে আসছে না।সপ্তপর্ণ কি? একবার বলার চেষ্টা করল, হেইয়া বুলু নয়গো। গহরজান এর মধ্যে হারমোনিয়ামে প্যা প্যা তুলে গেয়ে উঠেছে—
সোনার বদলে ইহাকে বলিও স্বর্ণ।
তাহাতে তোমরা পাইবে ঝাঁঝালো পর্ণ।।
আর সবাই হৈ হৈ করে ধুয়ো তুলল। সাধনার পোলে যে পাহারাদারটি দাঁড়িয়ে ছিল—এই মধ্যরাতে এইসব মাইফেল কানে যেতেই জোরে গগণ বিদারী হায়দারী হাঁক পাড়ল—কেয়া বাত। কেয়াবাত। একটা রোয়াতোলা ঘেয়ো কুকুরও বেড়ে সমজদারী জবাব দিল—ঘেউউউউ। রাত্রি দ্বিপ্রহরে রাস্তা সাধারণ সুনসান তেরে কেটে ধিন তা—আমি তুমি হীন তা। ঘেউউউউ। কৃষ্ণচূড়া অবধি হাওয়া উড়ে যায় হেএএএএ।
সোরাবুদ্দিন শিকারপুর রোড থেকে সখানাথ মউরীর বাড়ির সামনে এসে জিব কাটল। তার পা থেমে গেছে। কানে গোজা তুলা। তুলায় শাহী আতর। শরীরে মৃদু কম্পন। দোতলার জানালা থেকে মন্টুবাবু চেচিয়ে ডাকল, কেডা যায়। সোরাব কাগু নিকি?
সোহরাব মিয়া উপরের দিকে তাকাল না। চক্ষু বড় বড় করে দেখতে পায়—হাঁটু জলে নেমে হাটু মাজন করছে হওহরজান। বসন আলুথালু। কোনো এক সমুন্দুরের ঢেউ লেগেছে গায়ে। বিড় বিড় করে, নাওজোবিল্লাহ মিন জ্বালেক।
মন্টুবাবু জানালা থেকে হাক পাড়ে, কাগু। আইসা পড়েন।
--আইসা কাম নাই। দিনডা মাডি হৈল।
সোহরাবুদ্দিন মন্টুবাবুর দোতলায় উঠে এলো। জানালায় একটি কৃষ্ণ তুলসীর টব। তার ফাঁক দিয়ে দেখা যায়—জলের মধ্যে এবার বসন ছেড়েছে গওহরজান। কুল কুর করে জোয়ারের স্রোত আসছে। আর একপাল শুয়োর লাফিয়ে দাপিয়ে উঠছে।
সোহরাবুদ্দিন সেদিকে গভীর দৃষ্টিতে চোখ রেখে বলে, আইয়ামে জাহলিয়াত আইয়া পড়ছে।
মন্টুবাবু সিগারেটের ধোঁয়া হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে বলল, কলিকাল। ঘোর কলিকাল।
ধোঁয়া ঠিক জানালা দিয়ে উড়ে যাচ্ছে জলে ভাসা বসনের দিকে।
গওহারজান চোলির বন্ধন খুলে ফেলে ছাদের দিকে তাকাল। দুটো মানুষ ছাদের আলসের দিকে ঝুঁকে গভীর আগ্রহ নিয়ে চেয়ে আছে। চিলে কোঠার কোনে একটা দাঁড় কাক তারস্বরে চোচ্ছে—কা কা কা।
গহওরজান সেদিকে জলে ভেজা চোলিটা ছুড়ে দিয়ে বলল, যারে কাউয়া যা। আইয়ামে জাহিলিয়াতে যা। কলিকালে যা।
পুরো মাছের বাজার স্তদ্ধ। বাজার জমে গেছে। ডান হাতে মাছের রক্ত নিয়ে দাঁড়িয়েছিল ছোট মানিক।বাম হাতে চায়ের কাপ। ধুঁয়া উড়ছে। চেঁচিয়ে বলছে, ও দিদি ধরমু নিকি হালা কাউয়া দুইডারে?
শুনে গওহারজান হাসে। বলল, লারে লাপ্পা লারে লাপ্পা। ছোড় দে ইয়ার। একটু উঁচু হয়ে হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপটা নিল। মন্টু বাবু বলল, দেবী অমৃতো লৈয়া উঠতেআছে।
-কোন দেবী?
--সমুদ্র মন্থনের দেবী।
--বুতপরোস্তি। নাওজোবিল্লাহ।
গোসলে নাইমা কইন্যা চায়ে দিল ফুঁ।
চাইয়া আছেলে কাউয়া তরে মারি থু।।
সোরাবুদ্দিন বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। চশমার কাঁচ ভাল করে মুছে নিল। তোতলাতে তোতরাতে বলল, দ্যাখছ মন্টুবাবু। দ্যাখছ? কশবির আকামডা দ্যাখছ? নাম্বারওয়ান ছ্যাদাড়। মানির মান রাহে না। হ্যায় কি মুনে করছে—দ্যাশে বিচার আচার নাই?
মন্টুবাবুর ভাব এসেছে। চোখটা একটু ছোট হয়ে হয়েচে। সোরাবুদ্দিনের ঘাড়ে হাত দিয়ে বলল, যাবা নিকি?
--কুনহানে আবার?
--মুক্তাকেশী। রাইবিনোদিনীরি আসর।
--মাল কেমন?
--জব্বর।
এ সময় ঠাস করে একটি গুলির শব্দ হল। ইলেকট্রিক তারে বসা কয়েকটি কাক নড়ে চড়ে বসল। কাশেম মিয়া রুটির দোকান থেকে একটি দশাসই চেয়ার দামোদরের পাড়ে রাখল। হাতলে দুটো সিংহের মুখ। একটি চোখ ট্যারা। আরেকটির কান সামান্য ব্যাঁকা। বেশ কিছু লোকজন চেয়ারের সামনে হাঁটু মুড়ে বসে পড়েছে। এরা চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল।রাজার হাটের পোলের কাছে ঠুন ঠুন ঘণ্টা বাজছে। হাতি এসে পড়েছে। দি এলিফেন্ট। মাহুতের মাথায় শোলার মুকুট। মুকুটের মাথায় বাতাসে দুলছে ময়ুর।লেজটা ভাঙা।
কথিত আছে এই হাতি দি দি লক্ষণ দাসের ট্রেড মার্ক হাতি। পা দিয়ে ফুটবলে লাথি ছুড়তে পারে। শেষবার যখন দি দি লক্ষণদাস সার্কাস পার্টি খেলা শেষে গৌরনদীতে ফিরে যাচ্ছিল, তখন হাতিটা রুক্মিনীবালাসহ রয়ে গেছে। পৃথিবীতে দিদি লক্ষ্মণদাস সার্কাস নাই। রুক্মিণীবালা কোথায়—সে সংবাদ কোনো পত্রিকায় ওঠে নাই। সেই থেকে হাতিটার নাম রুক্মিনীবালা বলে প্রচলিত।
রুক্মিনীবালা নীচু হল। শেখ বাদশা মুখের কাছে হাত রেখে লম্বা একটা হাই তুলে নেমে এল। কাশেম মোল্লা চিক্কুর পেড়ে ঘোষণা করল, শেখ বাদশার আগমণ। লোকজন সমস্বরে বলে উঠল, শুভেচ্ছা স্বাগতম। শেখ বাদশার চরিত্র। লোকজন জবাব দিল,ফুলের মত পোবিত্র।
জনতার ময়দান
শেখ বাদশা অবদান।
মাছিমপুরের চান্দু খাঁর রাম ছাগলটি কদিন ধরে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। হবি মণ্ডলের উঠোনের দিকে তাকে সর্বশেষ দেখা গেছে। হবি মণ্ডল বলেছে, ওটা তার। এই নিয়ে মাছিমপুরে খুব উত্তেজনা বিরাজ করছে। বাতেন কমিশনার চান্দু খাঁ আর হবি মণ্ডলকে নিয়ে এসেছে। জনতার ময়দানে সালিশ ছাড়া আর কোনো উপায় নাই।
চান্দু খাঁর কিছু হাঁপানি আছে। সকালে হাঁপের টান উঠেছিল। এখন নাই। লাফ দিয়ে ময়দানে পড়ল।হুজুর না বাদশা –কী বলে সম্বোধন করবে বুঝে উঠতে পারছে না। বাদশা তার চোখের সামনে বেড়ে উঠেছে। বাল্যকালে প্যান্ট লতরপতর করে কোমরে থাকত না।মাঝে মাঝে নীচে পড়ে যেত। এই জন্য বাদশার নাম ছিল ল্যাংটা বাদশা। এখন সেই কোমরের বেড় পাওয়া যায় না।খোদা কখন কী করে বোঝা মুশকিল। তিনি বড়ই রহস্যময়। চান্দু খাঁকে তো তো করতে দেখে হবি মণ্ডল কানে কানে বলল, হুজুরই কও। হুজুরই কও।
হবি মণ্ডলের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল, বাদশা হুজুর, আমার আলোমতিরে আইনা দ্যাও। এই হবি মণ্ডল দখল লইছে।
হবি মণ্ডল বিড়ি টানছিল। বিড়িটা চান্দু মণ্ডলের হাতে গুঁজে দিল। চান্দু মণ্ডল বিড়ি খায় না—তামুক খায়। হবি মণ্ডল জানে। এখন তামুক পাবে কই এখানে। মাথা কাত করে ইশারা করল, এখন বিড়িই টানো। পরে তামুক হইবেআনে।চান্দু খাঁ ফুস ফুস করে বিড়ি টানতে শুরু করল। আর হবি মণ্ডল দাপিয়ে উঠল। এককালে নামকরা হাডুডু প্লেয়ার ছিল। তার ডুগ দেওয়া দেখে বাঘেহরিণে চমকে যেত। দাপিয়ে ওঠার সময় হাঁটুর উপরে লুঙ্গিটা তুলল। ডুগ ডুগ করে একটা টান দিয়েই বলে উঠল, চান্দু চাচা, মিছা কইও না। এইডা আমার ছাগল। পাঁচ পাড়ার হাট থিকা আমার নানাজান কিন্যা আনছিল। নগত তিনশ ট্যাকা।
--রাখ তোর নানাজান। হ্যায় তো শিয়াল পুষত। ছাগল পাইবে কুনহানে। আর তোর বাপে কুড়হা।
--ধানাই পানাই কইও না চান্দু চাচা। আমার নানাজানে জমিদার আছেলে।
--জমিদার নয়রে খাডাস। হ্যায় আছিল জমিদারগো লাইঠাল।আর আমার দাদাজানে হ্যাগো ছাগোলদার। হ্যাগো রামছাগল গুলান সব আমগো বাথানে আছেলে।
--আমাগো তাইলে জমিদারগো ঘোড়া।
-- ঘোড়া পাইলি কুনহানে। তোরা হইলে রাম পাডা।
কথাটার মধ্যে সত্যি আছে। জমিদাররা জমিহারা হওয়ার পরে হবি মণ্ডলের দাদাজন তাদের পাঠাগুলো নিয়ে কারবার শুরু করেছিল। টাকায় একবার পাল খাওয়ানো। দুর দুরান্ত থেকে লোকজন আসত ছাগী নিয়ে। এইজন্য মণ্ডলরা পাঠা মণ্ডল নামে অভিহিত।এখন অন্য ব্যবসা। পাঠাগিরী ছেলেপিলেদের অপছন্দ। বাড়ির সামনে একটা সাইনবোর্ড ফিট করা হয়েছে—ইহা পাঠাবাড়ি নয়। মাছিমপুরের বিখ্যাত মণ্ডলবাড়ি। কেহ পাঠাবাড়ি বলিয়া ভ্রম করিবেন না। সুন্দর লেখা। মুসাবিদা করেছেন পণ্ডিত রসময়কুমার।
চান্দু খাঁর রামপাঠা শুনে ঘাপিয়ে পড়ল হবি মণ্ডল, রে রে রে। এদিক ওদিক বসেছিল খাঁবাড়ি আর মণ্ডলবাড়ির লোকজন। তারাও সদর্পে আসরে নেমে পড়ল। মাঝখানে পুলিশ। শেখ বাদশা চেয়ার থেকে উঠে পড়ল। হাত উচু করে বলল, খামুশ।
দুই তরফ যে যে অবস্থায় ছিল সে অবস্থায় দাঁড়িয়ে গেল।
চান্দু খাঁ আর হবি মণ্ডলের কাঁধে হাত রেখে দুজনকে বসিয়ে দির। আর সবাই দেখা দেখি বসে গেল। শেখ বাদশা বাতেন কমিশনারের দিকে চেয়ে বলল, রাম ছাগলডা কই?
ছাগলটা কাশেম মিযার বেড়ার লগে বাঁধা আছে। পুরনো পাউরুটি চিবুচ্ছে। চিবুতে চিবুতে আসরে এল। দশাসই চেহারা। চোখ জুড়িয়ে যায়। মন্সী গরীবুল্লাহকে খুব কাছ থেকে দেখতে হচ্ছে। ছাগলের সঙ্গে পাগল শব্দটার একটা মিল আসছে। এর চেয়ে জুতসই শব্দ আপাতত তার মাথায় নাই।
হেলিয়া দুলিয়া চলে রামেরও ছাগল।
তাহাতে হাসিয়া ওঠে দুইটা পাগল।।
আহ্লাদে রামছাগলটি গরীবুল্লাহর গা ঘেষে বসেছে। বসো বেটা। মনে মনে করো অবধান। মুন্সী গরীবুল্লাহ ভনে ছাগলেরও গান।।
বদশা শেখ চান্দু খাকে প্রশ্ন করল—ও মিয়া, এইডা পাইছিলা কুনহানে?
--মোর উনির বাড়ি থিকা।
--উনি কেডা?
--বিবিসাব।সাং সাপলেজা। উপজেলা: মঠবাড়িয়া। আকন বাড়ির অতি বিখ্যাত ছাগল। মরহুম শ্বশুর হুজুর আব্দুস ছালাম আকন। হ্যার ছাগলের নাম আলোমতি। আলোমতি বিবাহের যৌতুক?
--তুমি মিয়া যৌতুক লইছিলা?
-- তুমার বাপেও লইছিল। হারে জিগাও।খাঁবাড়ির পোলা বুইল্যা মুই লইছিলাম রাম ছাগল। আর তুমার বাপে খলিফাবাড়ির পোলা বইল্যা লইছিল—সেলাই কলের প্যাডেল। এহনো তুমার বাপে বারান্দায় খডোর খডোর কইরা সেলাই মেশিন চালায়।
বাদশা শেখ হবি মণ্ডলকে জিজ্ঞেস কলল, ও মিয়া, তুমি রাম ছাগলডারে পাইছিলা কুনহানে?
--কাডাল গাছে।
--কি কাডাল?
--খাজা কাডাল।
--কাডালগাছে রামছাগল! কস কিরে হারামজাদা?
--হ হুজুর। একডা খাজা কাডালগাছ লাগাইছিলাম। হেই ছাগলডায় খাইয়া শ্যাষ করছে। গাছডা নাই। ছাগলডা আছে।খোদার দান। মোগো দোষ কি?
কঠিন সমস্যা। এটা নিয়ে মারমার কাট কাট কেস হতে পারে। উকিল রেডি। গেলেই গপ। হ্যাগো বিশ্বাস কি!
জনতার আদালতে হইবে ইনসাফ।
শেখ বাদশা আছে জাইন্য পৌরসভার বাপ।।
বাতেন কমিশনার কানে কানে ফিস ফিস করল। কাশেমও ঘটা করে অন্য কানে ঘোত ঘোত করল। দামোদরের জলে গওহারজান ততক্ষণে চল থেকে ফিতা খুলছে। আঁখি রেখেছে কিঞ্চিত বাঁকা করে। সেদিকে তাকিয়ে শেখ বাদশা বলে উঠল, মানিক! ছোট মানিক আরেকহাতে বেলের সরবত নিয়ে ওপারে দাঁড়িয়ে ছিল। গওহর জানের হাতে দিল। বলল, বস, আইতে আছি। সব রেডি।
মানিক দশাসই কিরিস এনেছে। জনতার ময়দানে রাম ছাগল আলোমতি দুভাগ হচ্ছে। দুপক্ষই ভাগ পাবে। দুপক্ষই খুব খুশি। বিচার ন্যায্য হয়েছে। কেউ ঠকে নাই।
কবি গরীবল্লাহ কিছুটা বিমর্ষ চিত্তে দাঁড়িয়ে আছে। তার কষ্ট হচ্ছে।চোখের সামনে রক্তপাত তার সয় না। প্রাণ কাঁদে। এ সময় আড়ালে গিয়ে আলম বিড়ি টানতে পারলে আরাম হত। কিন্তু যাওয়ার অনুমতি নাই। আজ তার মহাকাব্য পাঠ করতে হবে। জনতার ময়দান : শেখ বাদশার অবদান। প্রতিদিনই তাকে লিখতে হচ্ছে। আজও লিখেছে। পকেটে হাত দিয়ে দেখল—নেই। পকেটশুদ্ধ আজকে সুবেহ সাদেকে লেখা মহাকাব্যে দ্বিতীয় সর্গ গায়েব। ছাগলে খেয়ে ফেলেছে। কবি মানুষ। বেখেয়ালে জিন্দগানি বরবাদ।
শেখ বাদশা চেয়ারে বসে বলল, মুন্সী, পড়ো দেহি, আইজ কি ল্যাখছো?
গরীবুল্লাহ ঘেমে উঠেছে। কী বলবে? তবে কি বলার আগে ছোট মানিক ছাগলের মুখের ভিতর থেকে বের করে দিল মহাকাব্য জনতার ময়দানের প্রথম সর্গ। লালায় ভিজে গেছে। আফশোস নিয়ে মরেছে রামছাগলটি। হতভাগা শেষ খাদ্যটি গেলা শেষ করতে পারে নাই। গরীবুল্লাহর মুকে হাসি। চোখে জল। অতিশয় ভক্তি ভরে মহাকাব্যখানি পাঠ করা আরম্ভ করল :
শুন সবে ভক্তি ভরে করি নিবেদন।
শেখ বাদশার কথা করিব বর্ণন।।
শেখ বাদশা শরীফ—সে তো শেখ নয়।
তুরান শহর থিকা আগমন হয়।।
তারা ছিল খলিফা এবং জমিদার।
জরুগরু বাঁধা ছিল এক ঘাটে তার।
দাসী বান্দি আগে পিছে হাজারে হাজার।
বনে পাখি জলে মাছ মাফেল গাঁজার।।
শেখ বাদশা নামটি যে সবে জানে আজ।
তার জন্ম মিছা জাইন্য নাই কোনোই লাজ।।
--ও তার মাথায় পড়বে বাজ।।
শেষের লাইনটা বলার সময় মুন্সী গরীবুল্লাহর মুখটা গভীরতর লাল হয়ে উঠল। গলাটাও ফুলে উঠেছে। মাথার উপর থেকে টুপিটা পড়ে গেছে টুপ করে। উপস্থিত জনতা সমস্বরে তার সঙ্গে কোরাস ধরল—ও তার মাথা পড়বে বাজ।
রুক্মিনী ঠুন ঠুন করে ঘণ্টা বাজাল। শেখ বাদশা খুশি। নাসিম সাব ছবি তুলে নিয়ে নিয়েছে।আজ রাতেই দৈনিক ইত্তেফাকে জনতার ময়দানের খবরটি ছবিসহ প্রেরিত হবে। ছোট মানিক কলা পাতায় গোস্ত দুভাগ করে রাখছিল। এক ভাগ চান্দু খাঁর। আরেক ভাগ হবি মণ্ডলের। সমান সমান। কোন অন্যায্য কাম নাই। চান্দু খাঁ আর হবি মণ্ডল—দুগ্রুপই আরাম পেয়েছে। ন্যায্য বিচার। এর নাম শেখ বাদশার জনতার আদালত।
ততক্ষণে গওহরজান দামোদর থেকে উঠে গেচে। মেছো বাজারের মধ্য দিয়ে হেলে দুলে চলে গেছে। আর রেখে গেছে পায়ের জলছাপ। শেখ বাদশা ওপার থেকে বুলন্দ আওয়াজ দিল, মুন্সী গরীবুল্লাহ বাড়ি কিছু গোস্ত পাঠাও। হ্যায় ভাল ল্যাখসে। আর আইজ মাইফেল।
সুতরাং ছোট মানিক কলাপাতটি দুটিই এক করে ফেলল। গোস্তগুলো এক লগে বেঁধে ছেদে সোজা ম্যালেরিয়া পুলে বাদশামঞ্জিলে পাঠিয়ে দিল। চান্দু খাঁ আর হবি মণ্ডলের হাতে রাম ছাগলটির দড়িগাছার দু টুকরো। দুজনে আলম বিড়ি টানতে টানতে রওনা দিয়েছে। আগামীকাল তারা দুজনেই কাউখালি হাটে যাবে। রাতে মাইফেল। মাইফেল ছাড়া মানুষের মুক্তি নাই।
...........................................................................................
(ধারাবহিকভাবে চলবে বলে ভরসা করা হচ্ছে। সঙ্গে থাকেন বাকী পর্বগুলোর জন্য। এই ছুপান্যাসে ব্যবহৃত পদ্যঘরের কারিগর কবি জয়তী ব্যান্যার্জী)
মন্তব্য
শিরোনাম উত্তরাধুনিক মনে হৈছে। কারণ সামরান হুদাকে আমি চিনি না।
--
লেখা হিসেবে মারাত্মক। চালিয়ে যান।
কী যে কন দাদা।
আমি আসলে পূর্বআধুনিকপন্থী মানুষ। উত্তরাধুনিকতাকে ফালতু কচকচানি মনে হয়। পূর্বে আমাদের যে বয়ানপদ্ধতি ছিল তা অতি খাসা। সেটা নিয়ে ভাবনা দরকার।
আমি হইছি ধেড়ে কার্তিক মার্কা লোক। দল নাই। বল নাই। চল নাই। মাঝে মাঝে কই--রে রে রে।
এইমাত্র। অক্ষম আর কী করতে পারেগো দাদা!
...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'
...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'
সামরান হুদা কি আপনার পরিচিত? উপরন্তু সঙ্গের ছবিটাও সম্ভবতঃ সামরান হুদার। যদি পরিচিত না হন তাহলে এরকম শিরোনামে গল্প লেখাটা আপত্তিকর।
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
সামরান হুদা আমার লেখক বন্ধু। মাঝে মাঝে বাতচিৎ হয়। তিনি আমাকে অনুরোধ করেছিলেন একটা লেখা করতে। এই লেখাটির শিরোনামটিতে তাঁর অনুমোদন আছে বলে মনে হয়েছে। আমি মাঝে মাঝে আমার বন্ধুদের নামে লেখার শিরোনাম দেই। শিরোনামের যে কোনো মানে থাকতে হবে এটা কখনো ভেবে দেখি নি।
ছবিটি সামরান হুদার নয়। কার সেটা জানি না। নেটে পেয়েছি। এরকম ছবি, গান, সাহিত্য নেটে পেলে আমি কাজে লাগাই। কারণ বুদ্ধিবৃত্তিক সত্বে আমার কোনো বিশ্বাস নাই। সব কিছু সবার। এমত আমার বিশ্বাস।
আপনাকে ধন্যবাদ।
...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'
...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'
শিরোনামটা কেমন যেন মাথার মধ্যে একটা বিরক্তি সৃষ্টি করেছে। সেই বিরক্তি নিয়ে পড়তে বসায় দুই প্যারার বেশি এগোনো গেল না। লেখক মনে হয় এটাই চেয়েছেন। দেখি পরে আরেকবার পড়ার 'ট্রাই' দেব।
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
শিরোনাম নিয়ে আপনার শিরঃপীড়া হয়েছে জেনে দুঃখ হচ্ছে। কিন্তু কেন? এর কারণটি কি? কারণ উদ্ঘাটন করা গেলে নিদান বের করা যায়। আশা করছি একটু খোলাসা করে জানাবেন।
আমি মাঝে মাঝে ছাতামাতা লিখি। এগুলো সাহিত্য নয় বলেই আমার ধারণা। সাহিত্যের কোনো ব্যাকরণ আমার জানা নাই। জানার চেষ্টাও করি নি। করার সময়ও নাই।
ছুপা রুস্তম বলে একটি শব্দ প্রচলিত আছে। এই ছুপা রুস্তমদের নিয়ে যখন লিখি তখন এই লেখাগুলোকে ছুপান্যাস নাম দেই। গন্ধগোকুল নামে আরও একটি লেখায় ছুপান্যাস শব্দটি ব্যবহার করেছি। এই শব্দটিই কি আপনার পীড়ার কারণ? নাকি অন্য কোনো শব্দ? জানান।
অবাক লাগছে জেনে যে, পৃথিবীতে এমন লেখকও আছেন যারা পাঠকসমক্ষে লেখা দিচ্ছেন--কিন্তু পাঠককে পড়াতে অনিচ্ছুক। আপনার আবিষ্কার মহৎ সন্দেহ নাই।
তবে পুরো ছুপান্যাসটিতেই এই শিরোনামটি ব্যবহার করব বলেই ঠিক করেছি। আমি দুঃখিত।
ধন্যবাদ মন্তব্য প্রকাশের জন্য।
...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'
...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'
আপনি মনে হয় ব্লগোস্ফিয়ারে নতুন। তাই জানেন না। অনেক ব্লগে অনেক লেখকই আছেন যারা 'পাঠকের সংখ্যার' চেয়ে পোস্টে 'হিট সংখ্যা' বেশি চায়। এই পোস্টের শিরোনাম তাদের সেসব পোস্টের সমতুল
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
আপনার এরকম কেন মনে হল? আমি কি সে রকম কোন ভনিতা করেছি? হিট দিয়ে আমি কী করব? কোন কাজে লাগবে আমার?
একটু ব্যাখ্যা করুন--কিভাবে এই পোস্টের শিরোনামটি হিটসংখ্যাকামীর সমতুল্য হল।
আমি অনিন্দ্য রহমানকে নিয়ে একটি শিরোনাম করেছিলাম। আরও কয়েকজনকে নিয়ে করেছি। যদি আপনার নামে করি--সেটাও কি হিটসংখ্যাকামী হবে?
একজন লেখক কি লিখবেন বা কি করবেন সেটা তার নিজের ব্যাপার। পাঠকেরও তাই। সেটা নিয়ে আমার মাথা ব্যথা নাই।
রবি ঠাকুরের লাইনটি মনে পড়ছে--আমারই চেতনায় পান্না হল সবুজ।
আপনার বানী বুঝতে আমার অসুবিধা হয় নি।
...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'
...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'
উৎসর্গ শিরোনামের অংশ করার দরকার দেখি না। এতে বিষয়বস্তুর গুরুত্ব কমে, কারণ শিরোনাম লেখার বিষয়বস্তু সম্পর্কে ইঙ্গিত দেয়। উৎসর্গ বরং লেখার শুরুতে আলাদা করে দেয়া যায়, যদি দিতেই হয়। ... আসলে, পোস্টের শিরোনামের মধ্যে অকারণে অতিরিক্ত ইনফরমেশন দিলে, এবং তা যদি পরিচিত কারও নামই হয়, তাইলে, পড়ার সময় মনোযোগে ছেদ পড়তে পারে। এই ধরণের শিরোনাম অনেক সময় পাঠকের চিন্তাকে বিভক্ত করে। ফলে লেখার সাথে সুবিচার হয় না। ... লক্ষণ দাসের সার্কাসের দল নিয়া অনেকদিনের আগ্রহ ছিল। ঐটা নিয়া বিস্তার করবেন আশা রাখি।
অট: এর আগে আমার নাম দিয়ে কুলদা দা শিরোনাম করসেন। কিংবা সহলেখক মহাস্থবির জাতক একাধিক সচলের নাম ব্যবহার করে শিরোনাম করসেন। তারা সেইটা ভালো মনেই করসেন বলে বিশ্বাস করি। সচলের অন্য আরো কেউও এইভাবে করে থাকবেন। কিন্তু কখনো কখনো সেইসব নামকরণ তিক্ততারও জন্ম দিসে, এই কথাও সত্য। সুতরাং, সহসচলের নাম শিরোনামে ব্যবহার করা নিয়া কোনো পলিসি আছে কি না, সেটাও জেনে নেয়া যায়, এই সুযোগে।
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
শিরোনামটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে। লেখাটা একবার পড়ে বুঝিনি। মনে হচ্ছে কয়েকবার পড়তে হবে বুঝতে হলে।
আপনার সম্পর্কে আমার দুটি সাম্প্রতিক মূল্যায়ন।
১. আজকাল আপনার লেখালেখি উত্তরাধূনিক পথে হাঁটছে। আমার মতো সাধারন পাঠকের মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।
২. কেন যেন মনে হয় আপনি নিজের লেখার প্রতি সুবিচার করছেন না।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
এ ভ্রমণ, কেবলই একটা ভ্রমণ- এ ভ্রমণের কোন গন্তব্য নেই,
এ ভ্রমণ মানে কোথাও যাওয়া নয়।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
কুলদা,
আপনি পিরোজপুরে অনেক বৎসর ছিলেন মনে হলো।
পিরোজপুরের কোথায় থাকতেন?
লেখা অনেক ভালেো হয়েছে, চালিয়ে যান।
আদিত্য
আমি বরিশাল অঞ্চলে ছিলাম ১৫ বছর। পিরোজপুরের প্রতিটি গ্রাম চিনি। লোকগুলোকেও চিনতাম।
এই ছুপান্যাসটি পুরাটাই পিরোজপুরের। ১৯৭১ থেকে আমার অবস্থানকাল পর্যন্ত এটা রচিত। আপনি যদি পিরোজপুরের হয়ে থাকেন--তাহলে চিনবেন সবকিছু।
ধন্যবাদ।
...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'
...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'
নতুন মন্তব্য করুন