সামরান হুদার জন্য ছুপান্যাস--- হে নাগর, তোমার মৃত্যুফুল : দ্বিতীয় পর্ব

কুলদা রায় এর ছবি
লিখেছেন কুলদা রায় [অতিথি] (তারিখ: সোম, ১৩/১২/২০১০ - ১১:৩১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

autoচেঙ্গিস খানের কাগু
---------------------
(সঙ-বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ : এই ছুপান্যাসের সগোল চরিত্রই বাস্তব। অজীবিত বা মৃত কোনো মালের লগে ইহার কোনো মিল নাই। কোনো অমিল পাওয়া গেলে তা লেখকের ভাব বলে ধরে নিতে হবে।)

মুন্সী গরীবুল্লাহর বাড়িটি ঝাটকাঠি। সিও অফিসের পোল পার হরে বাঁদিকে পাবলিক হেলথ। ডানদিকে বদ্যিপাড়া—রাস্তা এখানে সরু হয়ে ঢুকেছে। তিনটা বাঁকের পার হলেই বড় একটা বান্দরলাঠি গাছ। খুবই প্রবীণ। এ শহরে আর কোনো বান্দরলাঠি গাছ নাই। সত্যি সত্যি বান্দরও নাই। গাছটির পিছনে কাব্যকুঞ্জ। দরোজার উপরে কুঞ্জলতার লাল ফুল ফুটেছে। আহা কী বাহার ছুটেছে।

সমীরণ বিবি বহুদিন পরে কানে দুল পরেছে। নাকে নথ। বড় মেয়েটা এলাচ বাচছে। পাশে দারুচিনি।

বড় মেয়েটার মন খারাপ। কদিন ধরে রাতে স্বপ্ন দেখছে—একটা ময়না পাখি আমগাছে বসে আছে। নিরবে নিভৃতে। নড়ে না। চড়ে না। একবার পাখিটার দিকে তাকিয়ে বলেছে, ও পাখি, তোমার বাড়ি কোথায়?

পাখিটা মুখ তোলে না। চোখে জল। পাখিটার মনে খুব দুঃখ। কি দুঃখ-- ও পাখি?

মাকে বলতে চেয়েছে পাখিটার দুঃখের কথা আকারে প্রকারে বহুবার। ওর গো গো শব্দ শুনে সমীরণ দীর্ঘশ্বাস ছেড়েছে। এই মেয়েটার নাম বুলবুলি। ডাক নাম—বুলি। মা বলল, ও বুলি, এলাইচ খাইবাগো মা?

মাথা নাড়ে বুড়ি। খাবে না। কিন্তু একদানা এলাচ মুখে দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। বাইরে সামান্য আলো। তারপর উঠে বাইরে বেরিয়ে এল। উঠোনের একপাশে আম গাছটি। তার ডালের নাম ঝুমজুমি। ঝুমঝুমি বলল, ও বুলি। কারে চাও? ময়না পাখিরে?

বুলি হা করে চেয়ে আছে? মাথা নাড়তে ভুলে যায়।
--ময়না পাখি আইবে। চিন্তা নাই।
বুলবুলির কিন্তু চিন্তা হচ্ছে। পাখিটা ময়না—কোনো কথা কয় না। ও কেন ময়না রে ভাই আমডাল!

আমডাল ঝুমঝুমি হাসে একগাল। আমি কি জানি।

--কে জানে?
--পাখি জানে। আর তোমার মা জানে।
--মা জানে?
--জানে জানে। হ্যারে জিগাও।
--জিগামু কী? মায় তো রান্না করে আর কান্না করে।

ডাল চুপ হয়ে গেছে। কান্না শব্দটি তার পছন্দ নয়। পাতাগুলোও তাই। আর আকাশ থেকে এক টুকরো চন্দ্র টুক করে টুকরো আলো সরিয়ে ফেলে । আঁধার ঘনিয়ে আসে। রাত এলে পাখি আসে। বুলবুলি চেচিয়ে জানতে চায়, ও পাখি—তুমি কথা কও না ক্যান? ও পাখি—তুমি কথা কও না ক্যান?

বুলবুলির গো গো শব্দ শুনে টিয়া বেরিয়ে এল। দেখল, বুলিবু গভীর বেদনা নিয়ে তাকিয়ে আছে অন্ধকার আমগাছটার দিকে। কপালে ঘাম জমেছে। বড় বড় করে শ্বাস ফেলছে। চোখে মুখে ঘোর লেগেছে। টিয়া বুলবুলির হাত ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকোতে বলল, বুলি ব, বুলি বু।

আকাশে তখন মেঘের আড়াল থেকে চাঁদ ওরফে চন্দ্র বেরিয়ে এসেছে। আলো এসে পড়েছে উঠোনে। সমীরণ বিবি এক গ্লাস জল নিয়ে এল। বুলবুলির চোখে মুখে ছিটিয়ে দিল। বুলবুলি মায়ের দিকে একবার—আমডালের দিকে আরেকবার তাকাল। আমডাল ঝুমঝুমি মাথা ঝাঁকিয়ে বলছে, খাও। খেয়ে নাও গো মেয়ে।

বুলি লক্ষ্মী মেয়ের মতো ঢক ঢক করে জলটুকু খেয়ে নিল। ডালে পাখিটি নেই। স্বপ্নে আসবে। তখন ওকে জিজ্ঞেস করে করে নেবে। চোখে ক্লান্তি নেমেছে। উঠোনে মাদুরের উপরে গা বিছিয়ে শুয়ে পড়েছে। মাথাটা টিয়ার কোলে। টিয়া ধীরে ধীরে মাথায় আঙুল তুলবুলিয়ে দিচ্ছে। এ সময় একটি গান গাইতে ইচ্ছে করছে—

ময়না তোমায় ডাকি নিরজনে একা থাকি
মনে বড় বুনি হাহাকার।
ফিরিব তোমার সনে কথা কব মনে মনে
পানঘুচি হব পারাপার।।
পরাণে রাখিও আশ তুলে দেব নয়া কাঁশ
বাঁধিও বাঁধিও সখি চুলে।
চান্দনি পহর ওড়ে কে ডাকে আমারে ওরে
কাঁদিয়া মরিব সখি ভুলে।।

চরারচর শান্ত হয়েছে। বুলবুলি চোখ বুজেছে। তার শ্বাস খুব স্বাভাবিক। রান্নাঘরে খুন্তি নাড়ার শব্দ। সমীরণ বিবি খুন্তি দিয়ে ছবি আঁকছে, একটি বটগাছ—জালি পাতার ফাঁকে কে এক ফকির বাবা গাছুড়ের মত চার-হাতপায়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে। আর বলছে ফিসফিস করে, ও পাখি, তুমি কনে।তুমি কনে ও পাখি।ছবি আঁকছে—নীচের থেকে কে একজন লম্বা মানুষ ভয় ধরা গলায় বলছে, ওস্তাদ। তাড়াতাড়ি নাইম্যা আসেন। হ্যারা আইয়া পড়তেআছে। নাইমা আসেন গো ওস্তাদ।খুন্তি দিয়ে খাসির গোস্তের মধ্যে খেড়ে খেড়ে লেখে—এই গ্রামটির নাম টিংরাখালি। ওস্তাদের নাম সোনাই কবিরাজ। জড়িবুটি বেঁচে। আর রাতে রাতে কোনো এক ময়না পাখিরে খোঁজে। গুণ গূন করে গান করে—

বন বিবি বনে থাকো বাঘো মামা কেনো ডাকো
পাথারে পাথারে জমে জল।
প্রভাত মলিন হল দিনমণি ঢুলে গেল
কেমনে কাটিবে রাতি বল।। 

গরীবুল্লাহ দু মেয়ের পিছনে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। এই গানটি একদিন লিখেছিল। এখন লেখার সময় নাই। লিখতে হচ্ছে চেঙ্গিস খান আর বাদশা বাবুরনামা। দীর্ঘশ্বাস নেমে এল বুক থেকে। লাইনে লাইনে টাকা। মনে লাগে বড় দাগা।

টিয়া বলে, বাজান, টেংরাখালি যাইতে মঞ্চায়।
টেংরাখালি কোন বাড়ি?
কোবরেজবাড়ি। সোনাই কবিরাজ শুয়ে আছে। তার গান শোনার বড় সখ।

এইখানে গরীবুল্লাহ বড় বড় পা ফেলে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে। কয়েকটা শব্দ মাথার মধ্যে উসক করছে। বুড়বুড়ি ফেলছে। কিন্তু ধরা মুশকিল। ধরতে পারলে—মনটা চান্দিফটাস। আজ রাতে খাসির গোস্তে বড় আনন্দ হত।

মেজো মেয়েটা একটি বাটি রেখে গেছে। গোস্ত কষানো হলে দুটুকরো নেবে। মুড়ি দিয়ে খাবে।ছোট মেয়েটার নাম টুনি।সাদা কাগজে একটা বক পাখি খেড়েছে। জলের মধ্যে এক ঠ্যাঙে দাঁড়ানো। আরেকটি পা দেওয়া হয় নি। দিলে ভাল হত। দেবে কিনা বুঝতে পারছে না। দাঁত বের করে আছে একটা বক পাখির চেয়ে বড় সড় একটা মাছ।মাছ নয় কো দাদু—কুম্ভীর।কুমোইর। খান জাহানের কুমোইর। লেজে ঝালর দিয়েছে। ছবিটি বাবাকে দেখাবে বলে টুনি বারান্দার ঘরে দাঁড়িয়ে আছে। মুন্সি গরীবুল্লাহ খুব ব্যস্ত হয়ে ডিকশোনারী খুলে বসেছে। মনোযোগ দিয়ে খলিফা শব্দটির প্রকৃত অর্থ খুঁজছে। নাকের উপর চশমা। গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি।

এ সময় দরোজায় ঠুক ঠুক করে শব্দ হল। টুনি বক পাখিটার চোখ আরেকটু টেনে দিল। বলল, ও বাজান, দ্যাখোনা পঙ্খিটা খাড়চি। আরেকটা ঠ্যাঙ কি দেওন লাগবে? ও বাজান।

গরীবুল্লাহ টুনির কথা শুনতে পাচ্ছে না। কিন্তু দরোজার শব্দটি শুনেছে। দরোজার খুলে বাইরে এল। বাইরে থেকে টেনে বন্ধ করে দিল। বান্দরলাঠির গাছের নিচে কচিবাবু দাড়িয়ে। চওড়া গোফ। বলল, দেরী কইরেন না। বস অপেক্ষা করতেআছে।

গরীবুল্লাহ জানে বস অপেক্ষা করতে ভালবাসেন না। খিদা লাগছে। খাসির গোস্তের ঘ্রাণ নাকে আসছে। শুধু বলল, পাঞ্জাবীডা পইরা আসি?

কচিবাবু তার হাতটি ধরল। বলল, পায়জামার উপ্রে গেঞ্জি। মানাইছে ভাল। চলেন। টাইম চইলা যায়।

অদূরে প্রস্তুত গাড়ি। রাত্রি দ্বিপ্রহর। কাব্যকুঞ্জে খাসির গোস্ত গামলায় রাখা হচ্ছে। টিয়া মেয়েটা বলছে, অ আম্মা, আমার গোস্তের টুকরা দুটো দ্যাও। মুড়ি আনছি।

মুড়ি দিয়ে খাসির গোস্ত চাখতে মজা। কবি গরীবুল্লাহর এ গুনটি মেঝ মেয়েটি পেয়েছে। মেয়েটার নাম টিয়া।জব্বর তার হিয়া। ক্লাশ টেন। করে ফেনফেন।

আউয়াল সাব বসে আছেন দরবার কক্ষে। মুখে আলবোলা। দেওয়ালে ঝুলছে একটি হরিণের মাথা। শিং তেল চক চক করে। শিং-এর উপর টুপি ঝুলছে। টুপিটাকে লক্ষ করে আউয়াল সাবএকটি গুলি ছুড়লেন। নিখুত নিশানা। টুপির আগা ফুটো হয়ে গেল। এবং টুপ করে ফ্লোরে পড়ে গেল।

টুপিটা কচি বাবু কুড়িয়ে মুন্সী গরীবুল্লাহর হাতে দিল। টুপিটা তার। দামোদরের উত্তর পাড়ে জনতার ময়দানে পড়ে গিয়েছিল। নবরচিত কাব্যসম্ভার পাঠ করার কালে খেয়াল করতে পারে নাই। কবিরা একটু বেখেয়াল হয়।

আউয়াল সাব বললেন, মুন্সি টুপিটা পরো।

ফুটো টুপি পরতে সংকোচ লাগে। তবু পরতে হল। পাজামা-গেঞ্জি-টুপি। আউয়ালের সাবের পিস্তলে সাইলেন্সার লাগানো আছে। ছোট্ট করে একটা খেজুর গাছ আঁকা হাতলে। তার আগায় দুটো মাছ।মুশকিল হল খেজুর গাছের দেশে মাছ নাই। বালি আছে। ধু ধু বালি রাশি রাশি। চন্দুমুখী হাসি হাসি। আমরা দুটো জ্যান্ত খাসি।

এর মধ্যে বাড়ির ভিতর থেকে এক থালা খাসির কাবাব এসছে। সঙ্গে বড় সড়ো মোগলাই। মুন্সী গরীবুল্লাহ মুখ দিয়ে বুঝলেন এর স্বাদ অভাবনীয়। পেটে খিদে চনমন কর ওঠে। এ মসলা কোন দেশ থাকা আনা?

আউয়াল সাব আলবোলা টানতে টানতে বললেন, আফগানিস্তান চেনো?
--কী স্তান?
--আফগানিস্তান।
--কাবুলীওয়ালা। রহমত।
--গুড। সেই দেশ থেইকা মুহাম্মদ জহিরুদ্দিন বাবুর আইয়াছিলেন। হ্যার পূর্ব পুরুষ চেঙ্গিস খান।চেনো মুন্সী?
--চেঙ্গিস মান্নান।
--গাধা। চেঙ্গিস মান্নান হইবে ক্যান।হ্যারতো রাজারহাটের বাড়ি। কম্যুনিস্ট উকিল। আমার চেঙ্গিস অইল মোঙ্গল চেঙ্গিস।
--খট খট। খট খট। ঘোড়া ছোটে। ফট ফট। ফট ফট। দ্যাশ জোটে।
--ভেরি গুড। এইবার আসল চিনছ।।জহিরুদ্দিন বাবুরের পুত্র হুমায়ূন। তার পুত্র আকবর। আকবর দি গ্রেট। মূঘল ই আজম। পেয়ার কিয়া না ডরনা কিয়া। সম্রাট জাহাঙ্গীরের আব্বা হুজুর। তার পুত্র শাহজাহান। তাজমহল। সপ্তম আশ্চর্য। তার পুত্র বাদশাহ আলমগীর। আলেম বাদশাহ।
--তিনি ভ্রাতৃঘাতী আছিলেন।
--কে ভ্রাতৃঘাতী নয়? ক্ষমতা—বোঝলা মিয়া। ক্ষমতাই আসল। মাইট ইজ রাইট। রাইট ইজ মাইট। হ্যার কাছে আব্বাহুজুর—আম্মাহুজুর বৈলা কিছু নাই। সেই সম্রাট আলমগীর বড় ভাই দারাশুকোকে খুন করছিলেন। পণ্ডিত দারাশুকো। হিন্দুগো বই ট্রানশ্লেট করছিলেন। পণ্ডিতের ভাত নাই। শাহ সুজা পালায়া গিছিলে চাটগাঁ। পথে এইখানে থামছে।শিশুপুত্রের জ্বর।মীর জুমলা আইসা পড়ছেন লগে লগে। তাল্লাশ কইরা বাইর করার আগে শাহ সুজা পগার পার। শুধু বেগমসাহেবা চইলা আইছেলেন এইখানে বলেশ্বর পাড়ে। লগে দুধের শিশু। নাম ফিরুজ শাহ। পিছনে মীর জুমলা। বোঝলা। ফিরুজশাহর জ্বর। ওষুদ নাই—চিকিৎসা নাই। শিশুপোলা ফটাস। হ্যার কব্বর আছে কুনহানে—জানো?
--কুনহানে?
--টাইন স্কুলের সামনে। পাকা রাজপুত্র। শাহসুজা রহর ছাড়লেন কানতে কানতে। আর এই মাটিতে ঘুমাইয়া রইল ফিরোজশাহ। ভাণ্ডারিয়ার কচা ছাইড়া বাদশার নাও পড়ে সুগন্ধায়। পিছন থেকে লোকজন কইল— বাদশা হুজুর,আপনি চৈলা যাইতেআছেন। যান। চিন্তা নাই। পোলারে আমরা দেইখা রাখুম। হ্যারে আমগো পরানের মইদ্যে ভইরা রাখছি। বোঝলা কিছু?

শুনে হা হয়ে গেছে মুন্সী গরীবুল্লাহ । গেদু বাবুটির জন্য তার প্রাণ আইঢাই করতে লেগেছে।একটি কচি শিশু কণ্ঠ থেকে থেকে ডাকছে—আব্বু। আব্বু। শিশুহারা জননী চেয়ে আছে।আগে চলে স্বামী শাহ শুজা। পিছনে দেওরার সেনাপতি মীর জুমলা।হাতে কৃপান। কেন চেয়ে আছ মা। এটা নিয়ে একটি মহাকাব্য লেখা যেতে পারে। নাম—বাদশাজাদার কব্বর।তার জন্য নদী কান্দে ছলাৎ ছলাৎ।পাখি শিয়রে বসে কান্দে পলাৎ পলাৎ।সরোবরে কুমির কান্দে হলাৎ হলাৎ। আকাশে খানে জাহান বলে—এইসা ই ইনসান,আশু মাৎ। টলাৎ টলাৎ। এটা একটা ট্রাজেডি পালা। চেঙ্গিস মান্নানরে ধরতে হবে। তার নাটকের দল আছে—উদীচী।

--বোঝলা মুন্সী। সেই হৈতে এই শহরের নাম ফিরোজপুর। মাঝখানে দামোদর। ওপারে শিকারপুর। এপাশে মাছিমপুর মৌজা। লোকে কয় ফ-এর বদলে প। পিরোজপুর। অতিদূর।সামনে সমুন্দুর।

আওয়াল সাব আবার আলবোলা টানে হুকুর হুকুর। দশাসই চেহারা। পরণে পাজামা আর সান্ডো গেঞ্জি। পায়ের কাছে কোলাহপুরী চটি। সুন্দরবনের আগে বা পরে এ চটি তুমি দেখিতে না পাও হে ভাই ও বেরাদর।আপনেরে সালাম।

কচি বাবু বলল, মুন্সীজী, মোগো আওয়াল সাব হৈল সম্রাট ফিরোজ শাহের বংশধর। বোঝলা?

বোঝা কঠিন। ফিরোজশাহ মারা গেছে শিশুকালে।বাবা গেছে আরাকানে। আর মায়ের কী হৈল ইতিহাস নীরব।কী করে বোঝে এইসব গহীন কাহিনী। মুন্সীজীর মাথার ভিতরে বোবার মত কাঁদছে শিশু ছেলেটি। আকাশ বাতাস মথিত হয়ে উঠেছে। ডাকছে, আব্বু আব্বু। আমার ভয় করে। একা একা আমার ডর করে। মনে হল এক্ষুণি ছুটে যায় ওর কাছে। বুকে জড়িয়ে ধরে বলে, কাঁদে না, কাঁদে না খোকা। আমি আছি। আর আছে ষাইট গম্বুজ।

একটি ছেলে পাশের ঘর থেকে ঢুকল। চোখ লাল। মৃদু টলছে।ঘুম ঘুম চোখ। হাতে লাখনৌর পাঞ্জাবী। সিল্কের। গিলেকরা। আউয়াল সাবের ইঙ্গিতে মুন্সী পাঞ্জাবী নিল। পরে দেখল—কোনো সমস্যা নাই। খাপে খাপ। গায়ে দিব্যি ফিট করেছে। শেখ বাদশার বাপ এন্তাজআলী খলিফাও এরকম পারবে না। তাজ্জব হয়ে বলবে, ওস্তাদ কারিগর—মোরা কী হ্যাগো লগে পারুম। আর তখনি শিশুটির কান্না মৃদু হয়ে হচ্ছে। মিলিয়ে যাচ্ছে হাওয়ায়। কানে বাজছে আলবোলার গুড়ুক গুড়ুক। ঘর ভর্তি ধোয়া। গোলাপের বাস ছুটেছে।

আউয়াল সাব বলল, ছেলেটি রাজশাহী ইউনিভার্সিটি থিকা ইতিহাসে পড়ছে। বাড়ি ময়মনসিং—শামগঞ্জ। ফিরোজশাহের ইতিহাসটা হ্যায়ই লেখবে। এইটা ধৈরা তুমি লেখবা মহাকাব্য। সহি শাহ মোহাম্মদ আওয়াল নামা। এই তোমার কাজ। লাইনপ্রতি পাঁচ টাকা। বাদশা দেয় দুই ট্যাকা। খলিফার পোলা আর কতো দেবে! ওকে?

ছেলেটির চোখে ঘুম। সালাম দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

রাত্রি পোহায়ে গেল। পাড়েরহাট রোড থেকে ম্যালেরিয়া পুল পার হল। তারপর বসন্তের পুল। পূব আকাশে শুকতারা উঠেছে। পাতায় পাতায় জমেছে শিশির। নয়া শবনম। তার মধ্যে খান জাহানের তসবীর রোশনাই। টাউন স্কুলের সামনে খোলা মাঠ। মাঠের ওপারে রাস্তা। সোজা পানাপুকুর পার হয়ে ডিসি সাবের বাংলো—তার পরে গভট স্কুল। শহীদ মিনার। একটা চৌমাথা। এখানে একটি কৃষ্ণচূড়া গাছ। একটি রাস্তা গোডাউন হয়ে চলে গেছে বলেশ্বরে। ঘাটে খেয়া নামে। পাশে একটি স্মৃতিফলক। বীরের এ রক্তস্রোত—মাতার এ অশ্রু ধারা। জানি হে জানি তাও হয় নি হারা।

টাউন স্কুলের মাঠের সামনে ডোবা পুকুর। টগরে ভরা। মশা ভ্যান ভ্যান করে। একপাশে বাদশা ছায়া নিকেতন। সঙ্গীত ভবন। কোথাও কোনো কবরখানা নাই। কিন্তু ছোট্ট একটি শিশু একা একা কাঁদছে—আব্বু আব্বু। এত মিহি যে কান পেতে শুনতে হয়। সবাই শুনতে পায় না।

--------

লিংক--

১। সামরান হুদার জন্য ছুপান্যাস--- হে নাগর, তোমার মৃত্যুফুল : প্রথম পর্ব :


মন্তব্য

সাবিহ ওমর এর ছবি

সামরান হুদায় গেল কই? কমেন্টায় না ক্যান?

শ্যাজা এর ছবি
পাঠক [অতিথি] এর ছবি

এসব লেখা দেখে মাঝে মাঝে মনে হয় সচলায়তনে কোন মডারেটর নাই।

কুলদা রায় এর ছবি

ভাই, আপনাকে একটি সরল প্রশ্ন করি--এ লেখাটি দেখে মডারেটরকে খুঁজছেন কেন? লেখাটির সমস্যা কি?

লেখাটির কোনো আখ্যানগত, বর্ণনাগত বা ভাষাগত দূষণ ঘটেছে?
এটি একটি ছুপান্যাস যেখানে ১৯৭১ সালের একটি মর্মান্তিক সত্যি ঘটনাকে অবলম্বন করে লেখার চেষ্টা হচ্ছে। সঙ্গে একটি শহরের গড়ে উঠা, তার ভেতরের ছুপা রুস্তম এবং নানা কিংবদন্তি, স্বপ্ন, স্বপ্নভঙ্গ, মানুষের বেঁচে থাকা মরে যাওয়া নিয়ে বলা হচ্ছে। বর্তমান সময়কাল পর্যন্ত আখ্যান সম্প্রসারিত হচ্ছে। দেশের একজন সবচেয়ে বড় যুদ্ধাপরাধী এ ছুপান্যাসের চরিত্র।

গত পর্বেও লক্ষ্য করেছি, কোনো পাঠক এ লেখাটির শিরোনামকে লালকার্ড দেখাচ্ছেন। দেখাতে পারেন। পাঠক হলেন ভগবান। তার সামর্থ্য আছে যেমন ইচ্ছে তেমন গড়ার--তেমন পিঠার। এটা নিয়ে আমার কোনো কথা নেই। পাঠকের এই ভগবানত্বকে আমি সম্মান জানাই।

কিন্তু লালকার্ডের কারণটি কি? সেটা জানতে পারলে লেখক হিসাবে নিজেরও অবস্থান পরিষ্কার করা যেত। তাতে সে অবস্থানটি কেউ গ্রহণ করুক আর নাইবা করুক।

লেখা নানারকম হয়। আমি আমার মত করে লেখার চেষ্টা করছি। এই লেখার মধ্য দিয়ে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বা ব্যক্তিবর্গকে খর্ব করার বা চাঙ্গে তোলার কোনো কোসেস করছি না। আমি তো কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীভুক্ত নই। হওয়ার ইচ্ছেও নেই। সে পথে আমার চলাচল নেই। আমি কি আখ্যান নেব বা শিরোনাম দেব--সেটা আমার ইচ্ছে। এই ইচ্ছেকে সম্মান দেখানোও পাঠকের দায়িত্ব। আর যার নাম শিরোনামভুক্ত করেছি তাঁকে অহেতু গর্জন প্রদর্শন করার মানে কি? এবং মনে হল--এই ধরনের গর্জনের প্রতি কোনো কোনো মডারেটরের প্রচ্ছন্ন অনুমোদন আছে। থাকুক। এটা নিয়ে আমার চিন্তা নেই। তবে তাঁদের চিন্তিত হওয়ার দরকার আছে--খোলা দরোজার কালে নতুন পাঁচিল তোলার কোনো মানে হয় না।

ভবিষ্যতে এখানে নতুন লেখা করার আগে প্রশ্নটি ভেবে দেখতে হবে।
ধন্যবাদ।
...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'

...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

আর যার নাম শিরোনামভুক্ত করেছি তাঁকে অহেতু গর্জন প্রদর্শন করার মানে কি? এবং মনে হল--এই ধরনের গর্জনের প্রতি কোনো কোনো মডারেটরের প্রচ্ছন্ন অনুমোদন আছে। থাকুক। এটা নিয়ে আমার চিন্তা নেই। তবে তাঁদের চিন্তিত হওয়ার দরকার আছে--খোলা দরোজার কালে নতুন পাঁচিল তোলার কোনো মানে হয় না।

ভবিষ্যতে এখানে নতুন লেখা করার আগে প্রশ্নটি ভেবে দেখতে হবে।
ধন্যবাদ।

মন্তব্যটির এই অংশটুকুর জন্য আপত্তি জানালাম। এরকম হুমকি দিয়ে করা মন্তব্যটি পাঠক হিসেবে আমাকে অবাক করল।

কুলদা রায় এর ছবি

হুমকি কোথায় দেখলেন? এখানে উপলদ্ধির কথা বলছি।
...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'

...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

তাহলে আমার বোঝার ভুল হয়েছে। সেক্ষেত্রে আপত্তি তুলে নিচ্ছি।

কুলদা রায় এর ছবি

ধন্যবাদ।
আমরা যারা লেখালেখি করছি--তাদের ভাবনা একপথে চলবে সেটা ধারণা করা ঠিক নয়। তবে পথের দিশাটি কোথায় সেটা ভাবনায় আনা যেতে পারে। সেক্ষেত্রেই ঐক্যমত হওয়াটা খুব স্বাভাবিক। সে ঐক্যমত বোঝার সামর্থ্যটা থাকা দরকার।

এইখানে ভুল হয়ে যায় অনেকেরই।

আমি যতদিন ব্লগে লিখছি--(আসলেতো আমি ব্লগেরই লেখক। আমাকে সত্যিকারের লেখক বলে পাত্তা দেওয়ারও কিছু নাই। পেতেও অনাগ্রহী। আমার না আছে ধান্ধা--না আছে বাজি। ব্লগে লিখি একারণে যে লেখার স্বাধীনতাটি পেতে চাই। কোনো মামাবাজি আমার পছন্দ নয়। আমাদের দেশের ছাপাপত্রিকার এই আবদারটি আমাকে ভীত করে।)--ততদিন আমি নিজের মত করে লেখা করেছি। লেখা পোস্ট করেছি। অনেক কিছুই শিখেছি অনেকের লেখা পড়ে--মন্তব্য পড়ে। আমার মত নাদান পাঠক লেখার পথে হাঁটতে শিখছি। হাঁটতে শিখতে হলে তো মাঝে মাঝে ঘাইগুঁতো খেতে হয়--আছাড়ে অভ্যস্ত হতে হয়। একে স্বাগতম। দেখেছি--অনেক সখা (যারা এক পাতে ভাত খায় তাদের বলে সখা) আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। এটা আমার বাড়তি পাওয়া। আমি কৃতজ্ঞ।
আবার আমার কোনো কোনো বন্ধু চেয়েছেন--তাদেরকে যেন পাত্তা দেই। তাদের পাত্তা দিতে গিয়ে আমার পাততাড়ি ঘুঁচে গেলে তাদের কিছুই যায় আসে না। আমি তাদের সযত্নে পরিহার করেছি। সোজা বলে দিয়েছি--বেরাদর গাঞ্জে ফেরশতেতে আমার আস্থা নাই। বাই। এভাবে আমার চল্লিশ বছরের সখাও বখে গিয়েছেন। কী করা যাবে বলুন। আমি তো পথের দিশাটি নিয়ে চিন্তিত। উপায়টি নিয়ে নয়।

...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'

...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'

আদিত্য [অতিথি] এর ছবি

কুলদা,

আউয়াল সাব এখন সংসদ সদস্য, আর তার ছোট ভাই মালেক
পৌরসভার চেয়ারম্যান।
আপনার লেখাটা তেজকাঠির সোবাহান হাজির বাড়ি পর্যন্ত নিয়া যান তো খাইছে

কুলদা রায় এর ছবি

তেজকাঠিতে সোবাহানহাজীর কলেজের প্রিন্সিপাল কাজি ভাল। টোনা বাজারে থাকেন। আর সারাদিন মান অফিসে অফিসে ঘুইরা বেড়ান। আর নাম আছে উপাধ্যক্ষ আলমগীর সাবের। পোস্টারে তার এই পদবীটি যায়। তার বাবা সোবান হাজি শুরুতে আছিলেন নৌকার মাঝি। এখন কোটি কোটি টাকার কারবাড়ি। আলমগীরের জায়গায় ক্লাশ নেন এক ঠিকে শিক্ষক। তার কোনোকালে পারর্মানেন্ট টিচার হওয়ার সম্ভাবনা নাই।
সোবানহাজি যখন মরে গেলেন--তখন জানা গেল সোবানহাজি সাব বুইড়াকালে একটি বিয়ে করেছিলেন গোপনে। একটা গেদু পোলাপাইনও পয়দা হইছিল। এই দ্বিতীয় স্ত্রী আর কোনোদিন বিধবা হতে পারে নাই।
তেজদাসকাঠি খালের দক্ষিণপাড়ে সোবান হাজির বাড়ি। আলমবিড়ির কারখানা। আর উত্তর পাশে জামাতের মান্নান চাগিয়ে উঠছে। তেজদাসকাঠির মাঠে বেশ কিছু দিন ভুট্টা, সূর্যমুখী আর আখের চাষ করেছিলেন। জলে জোঁক আছে। আমি ও গ্রামে পকেটে চুন নিয়ে ঘুরতাম। এই লেখাটায় সোবান হাজিও আছেন।
আপনাকে ধন্যবাদ।
...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'

...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।