সত্যি ছাতির গপ্প

কুলদা রায় এর ছবি
লিখেছেন কুলদা রায় [অতিথি] (তারিখ: রবি, ০৩/০৭/২০১১ - ২:৩০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সত্যি সত্যি আমাদেরও একটা ছাতি ছিল। ছাতিটা দিয়েছিল আমাদের বাবা। বাবা পেয়েছিল তার বাবার কাছ থেকে। তার বাবা পেয়েছিল তার বাবার কাছ থেকে। ইতিহাসটা এইরকম। ছাতিময়।

আমার ঠাকুরদার বাবাকে দেখিনি। সেই বুড়ো খুনখুনের একটি ছবি দেখেছিলাম। তার স্ত্রী মারা যাচ্ছেন। অথবা ইতিমধ্যেই মারা গেছেন। মুখে ঝলমলে রোদ পড়েছে। আর সাদাসিদে নাড়ুগোপাল স্বামীধরটি পাশে বসে আছেন। গলাটা উঁচিয়ে রেখেছেন। ছবির পোজ। বগলে একটি ছাতি। এই ছবিটা সেকালে আমাদের এলাকায় খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। দেখে লোকে ধন্য ধন্য করত। অই সময় অন্য কেউ ছবি তোলার হিম্মত রাখত না। আমার ঠাকুরদার বাবা একবার করেছিল।

আমি ঠাকুরদাকে শুধিয়েছিলাম, ঠাকুরদাগো, তুমি সে সুমায় কোথায় ছিলা?
--বেজার মুখে বইসাছিলাম। মায়ে মরতেছে। বাপে বিধবা হইতেছে। হ্যারতো আর ছাতির দরকার নাই। বাপের ছাতিটা কুন সুমায় আমার বগলে আইবে—হেইডা ভাইবা আমার পরাণ কালাপানি। চাইয়া দেখো, ছবির মধ্যে ভিড়। পাড়া পরতিবেশির ঢল নাইমাছিল। কেউ আইছে পাগড়ি বাইনধে। কেউ আইছে—লম্বা লাঠি নিয়া। কেউবা আবার পুরনো চাদর পিন্দা। কেউ কেউ আবার নাতিপুতি নিয়াও আইছিল। আর বউঝিরা মুখে আঁচল দিয়ে দাঁড়াইছিল। কিন্তু ছবিতে কোনো ছাতি দেখতি পারতিছ?—না। দেখতি পারতিছ না। । কেবল আমার বাপার বগলের ছাতিডা ছাড়া। অই এখানা ছাতি আছে এ জগতে –জানিবা নিশ্চয়ই।

এই ছাতিটা আমার ঠাকুরদা বগলে সত্যি সত্যি উঠেছিল। তার আগে তিন ভাই শান্তিপূর্ণ ভাগাভাগিতে ছিলেন। নো বৈষম্য। সকালে জমিতে যাওয়ার সময় বড় ঠাকুরদা। দুপুরে রাজমিস্ত্রীগিরিতে যাওয়ার কালে মেঝ ঠাকুরদা। আর আমার ঠাকুরদা পরিবারের ছোট পোলা বলে রাতের বেলা ছাতি বগলে পেত। এ নিয়ে তাদরে মধ্য কোনো খেদ ছিল না। কখনো এজন্য রাজপথে মিছিল টিছিল হয়নি। আর হরতাল ততদিন জন্মই লাভ করেনি। এই ছাতি ভাগাভাগি নিয়ে শুধু আমার তিন ঠাকুরদারই নয়—তাদের সাত সাতটি বউয়ের গর্ব ছিল। এই গর্বে তাদের মাটিতে পা পড়ত না। গোবরে লেপে পুছে মাটিতে পা দিত। আর গান গাইত—
আমার নেতাই বাড়ি যাবে তুমার তাতে কি।
তার বগলে ছাতি আছে চাইয়া দেখছনি।।
মরি হায়রে হায়
সুকখে পরান যায়
ছাতির লগে লাঠি আছে
মোগো কী হৈবে উপায়।।

ইতিহাস বলে, দেশে তখনো বন্দুকের চল ছিল না। ওটা ছিল গোরাদের হাতে। নাম গাদা বন্দুক। গুলি ছোড়ার দরকার হত না। শুধু পজিশন নিলেই হত। দেখেই আসামী ঠুসে যেত। এইসব মাহাত্ম্য কথা আমাদের গাঁওগেরামের কাঁথায় পটে লেখা আছে—খাড়া আছে। সংশয়ে পরীক্ষা প্রার্থনীয়।

শুক্লপক্ষে এই ছাতির মাথায় চান এসে ভর করত। ফিকফিক করে আলো ছড়াত। আর ঢালাগোনে তারা এসে খিক খিক করত। আমার ঠাকুরদা অমাবশ্যাকালে কৃষ্ণযাত্রা সেরে বাড়ি ফিরত ভাবেরঘোরে, তখন বাঁশঝাড়ে খুব জোনাকি পোকা চিকচিক করত। ঠাকুরদারকে পোকামাকড়েরা চিনত বলে তারা বগলের ছাতিটার গায়ে এসে বসে পড়ত, আর তিরিতির বাতি দিয়ে তাকে পথ দেখাত। এই হেতু আমার ঠাকুরমাদ্বয় নিশ্চিয়ে ভেরেণ্ডা তেলের বাতি নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়ত। তাদের কোনো উদ্বেগ ছিল না। তারা একজন সতী—আরেকজন সাধ্বী বলে খ্যাত ছিল। তাদের কীর্তিমান স্বামীধন ছিলেন ছত্রপতি। কারো করত না ক্ষতি। জানিবেন নিশ্চয়ই। তাদের পায়ে গড় হই।

আমার বাবা সেই ছাতিটা হাতে নিয়ে বেরুত বটে, কিন্তু কখনো খোলার অবকাশই পায় নাই্। ছাতি খোলার আগেই ঝপ করে বৃষ্টি নেমে পড়ত। অথবা ঠা ঠা নেমে পড়ত রোদ্দুর। বৃষ্টিতে যখন ভিজেই গেছে অথবা গণগণে রোদ্দুরে যখন চান্দি ফটাশ হয়েই গেছে তখন আর ছাতি খুলে আর লাভ নাই। তার চেয়ে বগলে ছাতি নিয়ে হাঁটাই ভাল। আমার বাবাঠাকুর তার বাবাঠাকুরের মত রোদ-বৃষ্টি বড় মিষ্টি করে ভালবাসত। শীতও তাদের অপছন্দের নয়। আমাদের কোনো জেঠা অথবা কাকা নেই বলে বাবার মনে সদা সর্বদা ভয় ভয় ছিল। ছাতি থাকলে সে ভয় অভয় হত। বাবা বলত, এইডা ছাতি নয়রে বাপা—মূর্তিমান আপন ভাই। ইহার তুল্য কিছুই নাই। তবে বাবা যাওয়ার আগে আমাদের হাতে কোনো জমিজিরতের দলিলদস্তাবেজ দিতে পারেনি। এসব বালাই তার ছিল না। আমাদের চার ভাইকে কাছে ডেকে শুধু গুপ্ত মন্ত্রের মত বলে গিয়েছিল, এ ছাতিডা আমার বাপেও খোলে নাই। তার বাপেও খোলে নাই। তোমরাও খুলিবা না। খুলিবা না। খুলিবা না। অতি নিশ্চয়ই জানিবা-- ছাতি হৈল বগলের শোভা। মাথার নয়কো বাপা।

আমরা কখনো ছাতি খুলি নাই। বগলে নিয়েই চলেছি। এক সঙ্গে চার ভাই। এই শোভাময় রূপে আমরা চারভাই রাস্তা দিয়ে দিব্যি এক সঙ্গে যেতাম। ছাতির হাতলটি ছিল বাঁকা। ওটা দাদার বগলে। মাঝেটা তুলো তুলো। ওটা কুলো—কুলোর বগলে। আর ল্যাঞ্জাটা তৃতীয় ভ্রাতার বগলে। তৃতীয় ভ্রাতা ছোট ভাইকে ডেকে বলত, তোর তো ছাতি ছোঁয়ার জায়গাই নাই। তুই আমার ছায়াডা ধইরা হাট।
আমরা চার ভাই এইরূপে ছাতিধারী হয়ে বাড়ি থেকে বের হতাম। আমাদের মৃন্ময়ী মা চিন্ময়ী হয়ে গভীর উদ্বেগে চালের বাতা ধরে দাঁড়িয়ে থাকত। বলত, তুরা হাঁটতি পারতিছিস তো বাপাসগোল?

আমরা তখন টলে পড়তে পড়তে হাঁটছি। হাঁটতে হাঁটতে পড়ছি। তারপর এক সময় হাঁটতে হাঁতে হাঁটছি। খুব ধীরে ধীরে। পা টিপে টিপে। সাবধানে। আমাদেরতো হাঁটতে হবে। না হেঁটে আমাদের উপায় নেই। আমাদের বগলে তখন ছাতি। ছাতি বলেই হাঁটতে পরতাম। আর হাঁটতে হাঁটতে মায়ের দিয়ে তাকিয়ে একটু হাসতাম। সে হাসিটা ছিল খুব করুণ—পুরণো শঙ্খের মতন ম্লান। আমাদের ছোটো ভাইটি ছাতি ধরার জায়গা পায়নি বলে সেই একমাত্র ঠিকঠাক হাঁটতে পারত। ঠিক হাঁটা নয়—চার হাত পায়ে দৌঁড়াত। একবার দৌঁড়ে দৌঁড়ে আমাদের সামনে যত। আরেকবার দৌঁড়ে দৌঁড়ে পিছনে আসত। মুখে বলত, হট হট। হট হট বলে, রাস্তা ক্লিয়ার করত। তার হট হট ধ্বনি শুনে পথচারীরা দাঁড়িয়ে যেত। একটু সরে গিয়ে পথ করে দিত। বলত, হচ্ছে বাপা। হচ্ছে। ভীত হইও না। হৈলে পরাণ পাখি উড়িয়া যাইবে। উড়িয়া যাইত কোথায়? কেউ তা বলেনি। আর জানালায় জানালায় কোনো বাড়ির বউঝিরা এ সময় উঁকি ঝুঁকি দিত। আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ত। কেউ কেউ সহানুভূতি দিত। কেউ কেউ মুখ বেঁকিয়ে হাসত। খোঁড়া যাবে পাহাড় ডিঙ্গোতে। একবার একটা গীতও কানে এসেছিল, কে একটি মেয়ে গাইছে—
ছাতা ধরো হে দেওরা
এছান ছুন্দর খোপা আমার ভিগ গিলাই না।

আর কেউ না বুঝলেও আমাদের মা বুঝত, তার ছেলেরা নিরাপদ। হাঁটতে শিখছে। তারপর ঘরে ফিরে তুলসী তলার দিকে ফিরে গড় করে বলত, দুগ্গা দুগ্গা। মা সবার জন্য দুগ্গা চাল চড়াতে বসত। তার হাঁটুরে ছেলেরা চরাকরা ফরবে। চারটি খেয়ে গভীর নিদ্রা যাবে। নিদ্রাকালে ভয় থাকে না। এর চেয়ে সুখের কী আছে এ ধরাধামে? আমরা ঘুমাতাম। আমাদের পাশে ছাতিটিও ঘুমাত। আর আমাদের মা শিয়রে জেগে বসে জেগে থাকত। মাঝে মাঝে আঁচল দিয়ে বাতাস করত। বিড় বিড় করে ছাতিটিকে বলত, কিরে, কষ্ট হয় নাই তো? ছাতিটি শুনে পাশ ফিরত। আর একটু একটু করে আলো ছড়াত। সে আলোয় আমাদের আলোহীন ঘরের আন্ধার কেটে যেত। সে আলোর রোশনাই দেখে পরদিন কেউ কেউ ছাতির কাছে মানত করতে আসত। কেউ কলাটা, কেউ মূলাটা, কেউ কেউ আঁকাড়া এক সের চাল নিয়ে আসত। এইভাবে আমাদের ছাতিটার একটা নামও হয়েছিল এলাকায়—ছাতিবাবা। ছাতিবাবার মুসকিল আসান। তার তরে নৌকা ভাসান। ।

সে সময়ে আমাদের শহরে বিস্তর লোকের নানাবিধ ছাতি ছিল। কারোটা লাল। কারোটা নীল। কারোটা সাদা। কারো কারে হাতে হলুদ ছাতাও দেখা যেত। কোনো কোনো ছাতার গায়ে চানতারা খাড়া ছিল। সাদা কালিতে লেখা ছিল, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান। বৃষ্টি বাদল না নামলেও এরা মাঝে মাঝে ফট করে ছাতা মেলে ধরত। এদের ছাতা ধরা দেখলে আমাদের কানু পাগলা চেচিয়ে বলত, তুমাগো বৃষ্টি কনে নামছে গো কাগু?
তারা কেউ কেউ বলত, মস্কো। মস্কো।
--ইডা কনে গো বাপা। ইডা কি কসকো সাবান?
কানু পাগলা বলেই তাকে সহজে অগ্রাহ্য করা হত। এরপরও বিরক্ত করলে কেউ কেউ বলতেন, পেটি বুর্জোয়াসুলভ বালখিল্যপনা ছাড়ো। দ্যাখো, লেলিন ভেঙেছে রুশে জনস্রোত। অন্যায়ের প্রথম প্রতিবাদ—কমরেড লেনিন।
--তাতে আমাগো কি বাপ?

আরেকদল যখন ছাতা মেলত, তারা হুপ হুপ করে ফাল পাড়ত। তাদের চক্ষু ছিল লাল। আর চুলে জটাজাল। তাদেরকে কেউ প্রশ্ন করার সাহসই পেত না। একবার কানু পাগলাও কিছু বলতে গিয়ে থাপ্পড় খেয়েছিল। তারা কিছু কিছু ইস্তাহার সরকারী মহাফেজ খানায় পাঠাত। বলত, কমরেড, বৃষ্টি নামে আপনার যাহা বুঝিতেছেন-- ইহা বৃষ্টি নহে। বৃষ্টি বলিয়া কেহ ভুল করিবেন না। ভুল করিলে সংশোধনবাদি হইবেন। সংশোধনবাদিরা বিপ্লবের শত্রু। এদের শাস্তি দুম। দুম। ওয়াও। ফুঁ দিয়ে নলের আগার ধোঁয়া ওড়ানোর একটা ভঙ্গি তারা করতেন। তারপর তারা কেউ কেউ বলতেন বলে শোনা যায়—ইহা রেইন। গ্রামের রেইন দিয়ে বুর্জোয়াদের ঘাটি শহরগুলোকে ঘেরাও করা হইতেছে। আমার চিয়ারম্যান, মাও সে—তুং---তুং---তুং।

এই দুদলের ছাতাছাতি আমাদের ছোটো শহরেও বেশ রগড় তুলেছিল। শহরে কানু পাগল ছাড়াও আরও কিছু পেশাদারি পাগল ছিল। নেশাধারী ছাগল ছিল। তারা এই ছাতাবাজি দেখে হাততালি দিত। বলত, বাহারে বাহা। বাহারে বাহা। ইহাকে কি বলে?
--ইহাকে বিপ্লব বলে। এই বিপ্লবের মা মইরা গেছে। বাবা উধাও। নানী বুড়ি কান্দে। কেন্দে কেন্দে কয়, হায় হায় হায়, আমার অভাগা নাতি বিপ্লবের কী হৈব রে। বিপ্লব কি শ্যাষে পথে বইসবে?

এইসবের মধ্যেও আমাদের শহরেরে জোরো জোরো বৃষ্টি নামত। বন্যা হত। ফসল পানিতে ফেসে যেত। লোকে শালুক কুড়াত। ঢ্রাপের কই মুখে দিত।
আকাশ ভেঙে সূর্য নামত। খরা হত। মাঠ ঘাট জ্বলে যেত। লোকে হাহাকার করত—অন্ন দাও। অন্ন দাওগো। এর মধ্যেই আবার চানমারি হত। চানমারির গোড়ায় টার্গেট বসিয়ে পুলিশ মামারা ঠাসঠুস করে গুলি করা শিখত। তাদের রোগাপটকা পাছা নড়ে যেত বলে বড় বড় পুলিশ তাদের পাছায় পাড়া দিয়ে ব্যালান্স রাখত। বলত, গুলি কর। গুলি কর। তারা গুলি করত—ঠাস। গুলি করা ছাড়া এ জীবনের আর কোনো উদ্দেশ্য নাই।

কেউ কেউ গলা ছেড়ে গানও গাইত—জিনা এহি। মরণা এহি। আর গব্বর সিং তেড়ে ফুড়ে বলত, আরে ও শাম্বা। আমাদের শাম্বা জসিম তখন ছাতির খোজে উর্ধশ্বাসে ছুটত। আর শোনা যেত, হেমামালিনী নয়, আমাদের শাবানা বিবি প্লাসটিকের টুকরোর উপর নাচতে নাচতে গাইছে—
চাতি লাঠি বন্দুক।
তার মইদ্যে সন্দুক।।

এই সন্দুক শব্দটা নিয়ে বেশ সন্দেহ জেগেছিল। পরে আঞ্চলিক অভিধান ঘেটে জানা গিয়েছিল, সন্দেহ শব্দ থেকে সন্দুক শব্দটা ধার করা হয়েছে। কারণ ছাতি, লাঠি আর বন্দুক শব্দত্রয় এক ধরনের মারনাস্ত্র বিশেষ। উহাদের কার্যোদ্দেশ্য এই মারণ প্রকার। তাই এই ছাতি লাঠি বন্দুককে এক কাতারে বসাইলে এক ধরনের নিকট অন্বয়ই প্রকাশ পায়। আর পরের লাইনে সন্দেহ শব্দটার বসাইলে অর্থগত মিল ঠিক থাকে বটে তবে মাত্রাগত মিলটা থাকে না। কিন্তু সন্দেহ শব্দের বদলে সন্দুক করিয়া দিলে মাত্রা গণনার দিক হইতে ছন্দগত মিলনও রক্ষিত থাকে। আর প্রান্তে মিলের প্রশ্নে কোনো অসঙ্গতি দেখা দেয় না। প্রান্তে অসঙ্গতি দেখা দিলে রাষ্ট্রবিপ্লব উদ্ভুত হইতে পারে। সুতরাং মহামহিম পণ্ডতগণে এই মর্মে ঘোষণা করিতেছেন যে, এখানে নিজগুণে রাষ্ট্রবিপ্লবের ছাতিটি বহন করিবার দায় নেওয়া নেতৃবৃন্দের ফাটাফাটি বন্ধ করিবার অভিপ্রায়ে ত্রিকালদর্শী কবি সন্দেহ শব্দটাকে একটু কাটিয়া ছাটিয়া সন্দুক করিয়া দিয়েছেন। ইহাতে জাতি একটা ভয়াবহ রাষ্ট্র-সংকট হইতে রেহাই পাইয়াছে। বলেন, সোভহান আল্লা। তিনি মহান।

এইভাবে দেখা গেল, ছাতাছাতি করতে করতে মস্কোওয়ালাদের মাথায় বৃষ্টি থেমে গেছে। তাদের ছাতির লাঠিটা ফিনিস। আর তার আগে আমাদের চিয়ারম্যান মাও সেতুংও পরলোকে বিপ্লবের দায়িত্ব পেয়ে চলে যাওয়ায় সেই জাটাধারি ছাতাওয়ালারাও নেতিয়ে পড়েছেন। তাদের মাথায় ছাতিটা ঠন করে বাড়ি মরেছে। তাদের এখন পাগলা পাগলা অবস্থা। সেই সব ছাতা অব্যবহারে জীর্ণ হযে পোকা কর্তৃক কাটিত হল। ইঁদুর কতৃক ঘাটিত হল। উই কর্তৃক মাটিত হল। ভেঙে পচে শেষ। উহাদের আর খুঁজে পাওয়া যায় না। গায়েব। এই দুঃখে কেউ কেউ ভিতর বাহির করে। ঝিমায়। কেউ কেউ গাঞ্জা টাঞ্জা টানে। কেউ কেউ বাউল গাহে, আমি একদিনও না দেখিলাম তারে, বাড়ির কাছে আরশি নগর। বলেন, হক মাওলা।

লোকে বলে, অ বাবারা, তুমাগো ছাতিগুলান গেল কই?
--হেইডা ছাতাঅলারা জানে।
--ছাতাওয়ালা কারা?
--হেইডাও তারাই জানে।
--তুমরা কি জানো তাইলে?
--আল্লাহু। আল্লাহু।
--তাইলে, তুমাগো দরকার কি কাগু?
--আল্লাহু। আল্লাহু। আল্লাহু।
--তাইলে আমরা কি করি?
--তোমরা কি-ও করবা না। বোজলা। চুউপ। এখন খোলা আকাশ। মিঠা বাতাস। আকাশটাই ছাতি। ছাতি নয়—ছাতামাতা।

এই ভয়ংকর সমাজবদলের সময়েও কিন্তু আমাদের চার ভাইয়ের ছাতিটা কিছুদিন ঠিকই ছিল। বগল দাবা করে আমরা ঠিকই চলতে ফিরতে পারছিলাম। দুষ্টু লোকে বলল, কওতো দেহি, তোমাগো এইডা কি?
--ছা—তি।
--ছাতি হৈলে রোদ বৃষ্টিতে খেলো না কেন?

এ এক কঠিন প্রশ্ন। উত্তরে পাহাড়।

অন্য কোনো সন্দেহ করার লোক ছিল না বলে লোকে আমাদের চারভাইকে সন্দেহ করা শুরু করল। আড়ে ঠারে আমাদের দিকে চাইতে লাগল। এড়িয়ে যেতে লাড়ল। ছাতিবাবার কাছে মানতও বন্ধ হয়ে গেল। কলাটা, মুলাটা, আকাড়া চালটা আসাটা নট। এই সন্দেহ দেখে আমাদের ভয় ভয় করতে লাগল। আমাদের চলা থেমে গেল। ঘরবন্দী হয়ে যেতে হল। মা হায় হায় করতে করতে রক্তশূণ্য হয়ে গেল। ফ্যাঁকাসে বিষণ্ন গলায় শুধাল, এখন তুরা কি করবি রে বাপ?

আমরা সব ভাই জেষ্ঠ্য দাদার দিকে তাকিয়ে আছি। দাদা আমাদের বড় ভাই। সত্যনিষ্ঠ যুধিষ্ঠির। মায়ের ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে আছে। শুয়ে থাকা অবস্থায়ই দাদা বলল, তাইলে আমরা ছাতাডা খুলি?
মা দাদার কথা শুনে কেঁদে ফেলল। মিনতি করে বলল, খুলিস না। খুলিস না। তরা খুলিস না।
--না খুইলা আমগো উপায় কি মা?
--উপায় দিয়া কি করুমরে বাপ! তগো বাপ ঠাকুরদারা কেউ কোনোদিন এই ছাতা খোলে নাই।

কিন্তু দাদা অনড়। সন্দেহ নিয়ে মরাও ঠিক নয়। মার ধারাবাহিক ঘ্যান ঘ্যানানির মধ্যে দাদা বগল থেকে ছাতিটা বের করল। বাম হাত দিয়ে ছাতির বাটটি ধরল। ডান হাত দিয়ে ছাতিটি সত্যি সত্যি মেলতে গেল। মেললও বটে। দেখা গেল—ছাতিটি ধুতরো ফুলের মত মেলেছে। তার লাঠিটি আছে। লাঠিটির চারিদিকে বুকের পাঁজরার মতো লোহার শিকগুলো চোখা চোখা হয়ে ছড়িয়ে আছে। কিন্তু ছাতির কাপড়টি নাই। কাপড়টি গুড়ো গুড়ো হয়ে ঝরে পড়ে গেছে—ছাই হয়ে গেছে। সে ছাই উড়াইয়া দেখরে ভাই। পাইলেও পাইতে পার—রতন?—উহু্, নো রতন। কোনো রতন মিলিবে না। মিলিবে না। মিলিবে না। বিনা যতনে রতন কিবা মেলে ভাই?

আজ আমাদের কোনো ছাতি নাই। খোলা আকাশ আছে। এই খোলা আকাশের নিচে আমরা চার ভাই ছাতি ছাড়াই হাঁটতে পারছি বলে হাঁটতে থাকি।


মন্তব্য

হাসিব এর ছবি

ঢ্যাপের কই (নাকি ঢ্যাপের খই?) বস্তুটা কী জিনিস? পরিচিত শব্দ কিন্তু ভুলে গেছি কী ছিলো ওটা।

মাহবুব লীলেন এর ছবি


ছাতি ছাড়াই হাঁটতে হয়

০২

ভেতরে কিছু একটা কামড়াচ্ছিল
সকাল বেলা লেখাটা পড়ে মনে হয় সেই কামড়ানিটা কমে গেলো

কুলদা রায় এর ছবি

ঢ্যাপের খই। শাপলা বা নাইল থেকে সাবু দানার মত এই খই তৈরী হয়। খুব হালকা। নিঃশ্বাসে উড়ে যায়।
রাম-রাবনের যুদ্ধের সময় পবনপুত্র হনুমান এক চণ্ডাল রাজার বাড়িতে এই খই খেতে গিয়ে খুব নাজেহাল হয়েছিল।

...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

দারুণ লেখা... দারুণ

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।