কুলদা রায়
এমএমআর জালাল
বাকী রাখা খাজনা
মোটে ভাল কাজ না।।
( --হীরক রাজার দেশ/ সত্যজিৎ রায়)
খাজনা আদারের কাছারি------------------------------
মুগল বাদশা জমির মালিক। তার কাছ থেকে কৃষক বা রায়তরা জমির সাময়িক মালিকানা নিয়ে চাষবাস করত। এর মধ্যে এই প্রজা বা রায়তদের কাছ থেকে জমির খাজনা আদায়ের জন্য মুগল বাদশা মধ্যবর্তী লোক হিসাবে জমিদার নিয়োগ দিতেন। জমিদার জমির মালিক ছিলেন না। খাজনা আদায়কারী মাত্র। জমিদাররা খাজনা আদায়ের কাজটি ভালমতো করতে পারলে বাদশার তরফ থেকে খিলাত বা উপাধী জুটত। এই খিলাত দিয়ে ক্ষুদে জমিদারী থেকে বড়ো জমিদারি পেতে সুবিধা হত। চোর থেকে ডাকাত হতে কাজে লাগত। তবে কিভাবে—কোন প্রক্রিয়ায় সেই খাজনা আদায় করা হত—সেটা নির্মম কী ভয়ঙ্কর ছিল, তা বিবেচনা করার কোনো দরকার ছিল না বাদশার। এই তনখা পাওয়াটাই ছিল শাহীর জন্য আল্লার নেয়ামত।
তাহলে খাজনা—দেখি তোমার সাজনা------------------------------
জমিদাররা তিন ধরনের খাজনা আদায় করে বাদশার খালসা বা কোষাগারে জমা দিত।
এক. খাজনা মানে মাল :
আবাদি ফসলী জমি ও অফসলী জমি যেমন, ফলজ-বনজ গাছপালা, বনজঙ্গল, জলাভূমি ও পুকুর থেকে যে খাজনা আদায় করা হত, তার নাম ছিল মাল। (এখান থেকেই টাকা পয়সাকে মাল বলা হয়। বলা হয়—মাল-কড়ি কেমন কামাচ্ছেন ভাই?)
দুই. সেইর খাজনা :
নদীপথে যেসব নৌযান চলাচল করত, যেসব হাঁট-বাজার বসত গ্রামে গঞ্জে তাদের কাছ থেকে সেইর খাজনাটি আদায় করা হত। এছাড়া যারা বিভিন্ন ধরনের কাজকারবার করত—সেইসব পেশাজীবী বা কর্মজীবীদের কাছ থেকে আদায় করা হত বেশ মোটা অঙ্কের খাজনা। এটার নামও ছিল সেইর খাজনা।
তিন. বাজে জমা খাজনা :
বিভিন্ন ধরনের জরিমানা, প্রতারণা ও বিয়েশাদি থেকে এই ধরনের জরিমানা আদায় করা হত।
খাজনা কি করে ধার্য হত------------------------------
এই খাজনা আদায়ের জন্য জমিজিরেতের সঠিক জরিপ ছিল না। একটি সংক্ষিপ্ত হিসাব থেকে খাজনা ধার্য করা হত। একে বলা হত আসনাসাক। জমিদারের কাজ ছিল বাদশাহী থেকে ধার্যকৃতএই খাজনা আদায় করে দেওয়া।
ধার্যকৃত খাজনার টাকা বিভাজন করে জমিদাররা প্রজাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতেন। তবে মুগল আমলে জমিদাররা প্রজারাদের বেশি খেপিয়ে তুলত না। বেশী ঝামেলা সৃষ্টি হলেই বাদশা জমিদার পাল্টে দিতেন। ফলে জমিদারী টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই প্রজাদের অনুগত রাখার দরকার হত। জমিদাররা প্রজাদের খুশি রাখতে তাদের কিছু দাবীদাওয়া মেনে নিতেন। তাদের দেখভালের কিছু কাজ করতেন।
সকলপ্রকার জমিদারদের পুলিশ, বিচার ও সৈন্যসামন্তর দায়দায়িত্বও বহন করতে হত। জমিদারদের খাজনা আদায়ের জন্য পাইক বরকন্দাজ থাকত। এরা খাজনা আদায়ের কাজে সহযোগিতা করত। আবার স্থানীয় চুরি ডাকাতি দস্যুদের উৎপাত থামানোর কাজ করত। বড় জমিদারদের আওতায় থানা ছিল। সেখানে নিয়মিত পুলিশ থাকত। থানা অধিনে একাধিক চৌকি বা পাহারাস্থল ছিল। এদের কর্মীদের নাম ছিল চৌকিদার। থানার প্রধান ছিল ফৌজদার। ফৌজদাররা বাদশার লোক হলেও তারা জমিদারদের অধিনেই কাজ করত। এসবই ছিল খাজনা আদায়ের নানাবাহিনী।
মুগলদের নিয়মিত সেনাবাহিনী ছিল না। যুদ্ধের জন্য, বিদ্রোহদমনের সময়, বা পররাজ্য দখলের কাজে বাদশাহীতে সৈন্যসামন্ত, ঘোড়া-হাতি এগুলোর যোগান দিতে হত জমিদারদের। এই উপলক্ষ্যে প্রজাদের ঘাড়ে বাড়তি কিছু খাজনা চাপিয়ে দেওয়া হত।
জমিদাররা ছোটোখাটো বিচারআচারও করতেন। তাদের ছিল জমিদারী আদালত। এই আদালতে যেসব বিচার সম্ভব হত না—তা পাঠিয়ে দেওয়া হত থানাদার বা কাজির কাছে। সাধারণত রায়ত বা প্রজাদের পক্ষে রায় যাওয়াটা ছিল দৈবদুর্ঘটনা। বাদশার স্বার্থ-জমিদারের স্বার্থরক্ষা করে যেটুকু বিচার করা সম্ভব—সেখানে তা-ই করা হত।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর আমল : ------------------------------
পাঁচশালা বন্দোবস্ত—------------------------------
সে সময়ে কোম্পানী বেশ খারাপ অবস্থায় পড়ে যায়। তাদের আর্থিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। এই সমস্যা মোকাবেলায় কোম্পানী তরফ থেকে ১৭৭২ সালে নিলামের মাধ্যমে জমিদারিগুলো পাঁচবছরের মেয়াদে ইজারা দেওয়া হয়। এই পাঁচসালা বন্দোবস্ত স্থির করার দায়িত্ব দেওয়া হয় গভর্নর ও কাউন্সিলের চার সদস্যের নেতৃত্বে এক সার্কিট কমিটিকে। এই কমিটির আরও দায়িত্ব ছিল ইজারাদারদের কাছ (চাষীদের) থেকে রাজস্ব আদায় করা। দেশীয় জেলা কর্মকর্তা তথা ফৌজদার, কানুনগো আর আমলাদের জায়গায় স্থলাভিষিক্ত হলো ব্রিটিশ কালেক্টর বা রাজস্ব আদায়কর্তা। কানুনগোদের কাছে প্রজাদের জমিজিরতের—খাজনাপাতির হিসেবপত্র-দলিলদস্তাবেজ থাকত। তাদের বাতিল করার ফলে নতুন করে যে যে কোনো হারে খাজনা বসাতে কোনো অসুবিধে থাকল না।
ইউরোপীয় প্রতিনিধিদের দ্বারা রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা করা হয়। এরা ‘জেলা কালেক্টর’ হিসেবে অভিহিত হন। জেলা কালেক্টর জমিদারদের কাজনা আদায়েরকাজ তত্ত্বাবধান করত। কমিটি অব সার্কিট বন্দোবস্তের কাজ ১৭৭২ সালের মধ্যে শেষ করে।
নতুন ইজারাদার বা জমিদাররা চড়া হারে খাজনা আদায় করতে মনোযোগী হয়। যারা চড়া দামে নিলামে এইসব ইজারা নিয়েছিলেন, তারা যে-পরিমাণ রাজস্ব আদায় করবেন বলে আশা করেছিলেন, অনেক ক্ষেত্রেই তা করতে পারেননি। ইজারাদাররা কোম্পানীকে নির্দিষ্ট অঙ্কের খাজনা আদায় করে দিতে পারেনি। তাদের জমিদারি নিলামে দেওয়া হয়। ব্যক্তিগত স্থাবর অস্থাবর সকল সহায় সম্পত্তিও কেড়ে নেয়। এরপরও এই পুরনো জমিদারদের কয়েদখানায় ঢোকানো হয়। নির্মমভাবে অত্যাচার করা হয়।
পুরনো জমিদারদের কাছ থেকে নিলামে জমি কিনে নতুন জমিদার হয়ে বসে নবাবের চাকুরেরা, ব্যবসায়ীরা, সুদখোর মহাজনেরা-- জমিদারদের দুর্নীতিবাজ নায়েব ধরনের আমলারা। ফলে তারা খাজনা আদায়ের বেলায় পুরনো জমিদারদের রেকর্ড ভেঙে ফেলে। প্রজাদের দুর্দশা আরও বেড়ে যায়। লোকজন জায়গা জমি পালাতে থাকে। সে সময়ে লোকসংখ্যার তুলনায় অনাবাদি জমির পরিমাণ বেড়ে বেড়ে যায়। বকেয়া খাজনার পরিমাণ বেড়ে যায়। আর তারাও কোম্পানীকে লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে রাজস্ব দিতে না পারলে তাদের ভাগ্যেও পুরনো জমিদারদের মতো সব হারিয়ে কয়েদখানায় যেতে হত।
এই সমস্যা নিরসনকল্প কোম্পানী দশশালা বন্দোবস্ত করে।
দশশালা বন্দোবস্ত------------------------------
জমি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে উত্তরাধিকারভিত্তিক জমিদারদের একটা সামাজিক স্বার্থ জড়িত ছিল যা অস্থায়ী ইজারাদারদের বেলায় ছিল না। তাই ধরে নেওয়া হয় যে, জমিদারদের তাদের পুরানো মর্যাদা ফিরিয়ে দিলে ও তালুকের সম্পদ অনুযায়ী রাজস্ব ধার্য করা হলে একদিকে যেমন রাজস্ব আদায় সহজতর হবে অপরদিকে তা কৃষককুলকেও ইজারাদারের অত্যাচার থেকে রেহাই দেবে। কিন্তু পাঁচসালা বন্দোবস্তের শর্তাবলীর কারণে এক্ষেত্রে সরকারের হাত বাঁধা ছিল। ১৭৮৯-১৭৯০ সালে লর্ড কর্নওয়ালিন জমিদারদের সঙ্গে দশশালা বন্দোবস্ত করেন। এর ফলে জমিদার ও তালুকদাররাই জমির প্রকৃত মালিক বলে বিবেচিত হন। তারা সরকারের কোনো অনুমতি ছাড়াই তাঁদের জমি দান বা বিক্রি করতে সক্ষম বা বন্ধক দিতে পারবেন। এমন কি উত্তরাধিকারদের মধ্যে বণ্টন করতে পারবেন। আর কোম্পানীকে ধার্যকৃত রাজস্ব দিতে না পারলে তাদের জমিদাইর নিলামে দেওয়া হত। কিন্তু পাঁচশালা বন্দোবস্তের মত তাদেরকে কয়েদ করা হত না।
রাজস্ব শাসনের দক্ষতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে গোটা দেশকে অনেকগুলি জেলায় বিভক্ত করা হয়। জেলা কালেক্টরকে জেলার সর্বেসর্বা প্রশাসকে পরিণত করা হয়। কালেক্টরকে সকল নির্বাহী ও বিচারবিভাগীয় ক্ষমতা প্রদান করা হয়। কেন্দ্রায়ন ও হস্তক্ষেপের প্রতীক রাজস্ব কমিটিকে বিলুপ্ত করে স্থাপন করা হয় রাজস্ব বোর্ড, যার দায়িত্ব হলো রাজস্ব-সংক্রান্ত বিষয়াবলির সাধারণ বা সার্বিক নিয়ন্ত্রণ। জমিদারগণকে তাদের জমির ন্যায্য রাজস্ব নির্ধারণের জন্য এই কালেক্টরের মুখাপেক্ষী হতে হয়। রাজস্ব বোর্ডও রাষ্ট্রের রাজস্বের জন্য কালেক্টরের ওপর নির্ভরশীল হয়। ১৭৮৬ সনের সংস্কার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রকৃত প্রশাসনিক বুনিয়াদ রচনা করে। সরকার তখন থেকে আগেকার যেকোন সময়ের চেয়ে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাস ও দৃঢতার সঙ্গে জমিদারদের সঙ্গে বোঝাপড়ার জন্য প্রস্তুত হয়।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত------------------------------
দশশালা বন্দোবস্তের সাফল্যের কারণে ১৭৯৩ সালে একে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হিসাবে ঘোষণা করা হয়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে কোম্পানীকে ধার্যকৃত রাজস্ব প্রদানের পরেও বেশ মোটা অঙ্কের অর্থ জমিদারদের হাতে রয়ে যেত। তারা প্রজাদের দফায় দফায় খাজনা বাড়িয়ে দিত। তারা পরিত্যাক্ত সম্পত্তি, অনাবাদি জমি নতুন করে বন্দোবস্ত দিত প্রজাদের কাছে। নতুন খাজনা ধার্য করত। এভাবে তাদের আদায়কৃত অর্থের পরিমাণ বেড়ে যায়। এটা কোম্পানী এবং জমিদারদের জন্য একটি সুবিধাজনক বন্দোবস্তে পরিণত হয়। আর প্রজারা নতুন শোষণের জাতাকলে পড়ে।
কেন এই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত------------------------------
এ সময় কোম্পানীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আবস্থা খুবই খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তাদের দরকার ছিল বিপুল অর্থ। তারা চেয়েছিল ভারতে তাদের ব্যবসাবানিজ্য বিনা মুলধনেই করবে। তারা প্রজাদের কাছ থেকে অর্থ লুটপাট করে সেই অর্থ দিয়েই ভারতে ব্যবসাবানিজ্য চালাবে। সোজা কথায় বিনা পূঁজিতে মুনাফা কামানোর ধান্ধা। কিন্তু তাদের নিয়োগকৃত নাইবে নাজিম রেজাখানের দু:শাসন, দুর্ভিক্ষ, কোম্পানী লোকজনের উশঙ্খল আচরণ কোম্পানীর শেয়ার হোল্ডারদের কিছুটা হতাশ করেছিল। যত তাড়াতাড়ি পারা যায় বিপুল অর্থ কামাইয়ের ইচ্ছে ছিল তাদের। দুর্ভিক্ষের কারণে বাংলায় তখন এত জনসংখ্যা ছিল না। এই অল্প মানুষকে সহজে সুলভে শোষণ করে খাজনা আদায়ে জন্যই কোম্পানী জমিদারী প্রথায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করেছিল।
ইংরেজরা কুটির শিল্প, হস্ত শিল্পকে শেষ করে দিয়েছিল। তখন কেবল আয় বলতে জমির খাজনাই ছিল প্রধান। জমিদার পাল্টাতো কিন্তু শোষিত প্রজারা পাল্টাতো না। বাবার বকেয়া খাজনা ছেলের কাঁধে বর্তাতো। ছেলের বকেয়া তার ছেলের কাধেঁ পড়ত। এভাবে বংশপরম্পরায় বকেয়া খাজনা প্রদানের দায় বহন করে যেত।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত মানে চিরস্থায়ী প্রজাশোষণ--------------------------------
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হওয়ার ফলে প্রজাদের অবস্থা আরও কাহিল হয়ে গেল। যো লোকটি জমি চাষ করছে, এতকাল জেনে এসেছে জমিটি তার—তার ইচ্ছেমত ফসল চাষ করছে, ছেলেপেলেদের জমি হস্তান্তর করতে পারছে, প্রয়োজনে বিক্রি করতে পারছে, জমি বন্দক দিয়ে ঋণ নিতে পারছে—এসবই এক খোঁচায় বন্ধ হয়ে গেল চিরস্থাযী বন্দোবস্তের কারণে। সবকিছু্রই মালিক হয়ে গেল জমিদার। জমিদার খাজনা আদায় ছাড়া আর কোনো বিনিয়োগই করছে না ফসলী জমিতে—না শ্রম, না পূঁজি—বিনা মূলধনেই কৃষককের ফসলের সিংহভাগই তারা নিয়ে যাচ্ছে। চাষী কোনো গাছপালা লাগাতে পারে না। কোনো গাছপালা কাটারও ক্ষমতা তার নেই। যেখানে সে থাকে, সেখানে যেনতেন প্রকারে ঘর বেঁধে থাকবে—কোনো পাকা ঘর তুলতে চাষীরা পারবে না। জমাজুতোও পরতে পারবে না। মেয়ের বিয়েতে খাজনা দিতে হবে। বাপমা মারা গেলে তার শ্রাদ্ধশান্তিতে খাজনা ছাড়া করা যাবে না। চাষীর ছেলে হলেও জমিদারকে খাজনা দাও। এমনকি কোনো ঊৎসব-পার্বনও খাজনা ছাড়া প্রজারা করতে পারবে না। রায়ত বা প্রজারা এক ধরনের শেকলেবন্দী শ্রমিক জীবনের অধিকারী হল পাঁচশালা বন্দোবস্তের মাধ্যমে।
এই শেকল আরও শক্ত হয়ে যেত মহাজনদের ফাঁদে পড়লে। সাধারণত দেশে তখন বন্যা-খরা-দুর্ভিক্ষ-মহামারী লেগেই থাকত। আর এই মেয়ের বিয়ে, বাপের শ্রাদ্ধ আর ছেলের জন্মের কারণে খাজনা দেওয়ার উপায় থাকত না। ফলে চাষীরা মহাজনদের কাছ থেকে চক্রবৃদ্ধি হার সুদে ঋণ নিতে হত। এই ঋণ কখনো ফেরত দেওয়া কখনো ফুরাতো না। বাপের ঋণ শুধতে হত ছেলেকে। ছেলের ঋণ নাতিকে। এইভাবে মহাজানের ঋণের শেকড় বংশপরম্পরায় বহন করতে হত। আবার চাষী যদি অক্ষরজ্ঞানহীন মুর্খ কিসিমের হত, তাহলে কায়দা করে একই ঋণের টাকা পয়সা দুই-তিনবারও আদায় করা হত।
এই মহাজনদের বড় বড় ব্যবসাপাতিও ছিল। তারা ফসল ওঠার সময়ে জমি থেকেই তাদের ঋণের টাকা আদায় করত। সেই সময়ে ফসলের বাজার মূল্য কম থাকত। ফলে মহাজনরা কম টাকায় বেশি ফসল পেয়ে যেত। চাষীরা আরও বেশি ঠকত। কখনো এই সুদের কারবারীরা হত বড় কৃষক। তাদের বলা হত জোতদার। তারা সব সময়ই হা করে থাকত ক্ষুদে কৃষকের জমিজিরতের গিলে খাওয়ার জন্য।
জমিদাররা খালসা বা রাজ কোষাগারে আদায়কৃত খাজনার ধার্যকৃত অংশ জমা দেওয়ার পরেও তাদের হাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ সম্পদ থেকে যেত। এই অর্থ সম্পদ দিয়ে তারা এক ধরনের আয়েসী জীবন যাপন শুরু করে। তারা তাদের জমিদারিকে ছোটো ছোটো অংশ ভাগ করে পত্তনিদার বা তালুকদারদের কাছে ইজারা দিতেন। এই পত্তনীদাররা বা তালুকদাররা আসলে জমিদারের আমলা। জমিদাররা তাদের উপর জমিদারির ভার দিয়ে কোলকাতায় বসবাস করত। তালুকদাররা তখন প্রজাদের লুটে পুটে খেত। আদায় করত ইচ্ছেমত খাজনা। দখল করত সহায় সম্পত্তি। প্রজারা এর প্রতিকার কারও কাছে পেত না। আসল জমিদারের কাছে প্রজারা পৌঁছুতেই পারত না। আর যদি কেউ আদালতে যেত—তাহলে সেখানে উকিল নামের কুমীরের খপ্পরে পড়ত। এই জমিদারীকাল ছিল প্রজাদের জন্য দোজখ।
লেখাসূত্র----------------------------------
১. রবি ঠাকুর, রাহাজানি এবং রবীন্দ্র পূজারীবৃন্দ: ফরিদ আহমদ ও অভিজিৎ রায়
২. রবীন্দ্রনাথের জমিদারগিরি—জমিদারের রবীন্দ্রগিরি : প্রথম পর্ব
গ্রন্থসূত্র--------------------------------
১. রবিজীবনী--প্রশান্তকুমার পাল . ২.রবিজীবনকথা--প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় . ৩. রবীন্দ্রনাথের আত্মীয়স্বজন -- সমীর সেনগুপ্ত . ৪. ছিন্নপত্র : রবীন্দ্রনাথ . ৫. হাজার বছরের বাঙাল সংস্কৃতি গোলাম মুরশিদ . ৬. জমিদার রবীন্দ্রনাথ : শিলাইদহ পর্ব : অমিতাভ চৌধু রী. ৭. রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ . ৮. স্মৃতিসম্পুট, রবীন্দ্রস্মৃতি; পুরাতনী--ইন্দিরা দেবী : .৯.এইখানে গান নিয়ে আলোচনা চলিতেছে: কুলদা রায় . ১০. শাহজাদা দারাশুকো : শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় . ১. বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ : কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী
কুলদা রায় ও এমএমআর জালাল লিখিত রবীন্দ্রবিরোধিতার স্বরূপ সিরিজের লিংক--------------------------------
১. বাংলায় বিজ্ঞানচর্চা ও রবীন্দ্রনাথ : 'গ্রহগণ জীবের আবাসভূমি' থেকে 'বিশ্বপরিচয়'---
প্রথম পর্ব : লিংক
দ্বিতীয় পর্ব: লিংক
তৃতীয় পর্ব
২. আমি কোথায় পাব তারে থেকে আমার সোনার বাংলা :
৩. রবীন্দ্রবিরোধিতার স্বরূপ : পাকিস্তান পর্ব :
৪. রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেন নাই : প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
৫. রবীন্দ্রনাথের জমিদারগিরি—জমিদারের রবীন্দ্রগিরি : প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
মন্তব্য
থানার প্রধান ফৌজদার, আবার দেশীয় জেলা কর্মকর্তা তথা ফৌজদার- ঝামেলা হয়ে গেলনা !
মাঝখানে ’তালুকদার’ কোথা থেকে এলো?
তালুকদার আর ফৌজদার দুধরনের পদ।
ফৌজদার--
...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'
নতুন মন্তব্য করুন