আত্মজা ও একটি করবী গাছের গল্প

কুলদা রায় এর ছবি
লিখেছেন কুলদা রায় [অতিথি] (তারিখ: সোম, ২১/১১/২০১১ - ৩:৩০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


১.

আমার সবচেয়ে প্রিয় গল্পটির নাম আত্মজা ও একটি করবী গাছ। প্রিয় গল্পকার হাসান আজিজুল হক। এই রকম গল্প একদিনে লেখা যায় না। একা লেখা যায় না। বংশপরম্পরায় লিখতে হয়। একটি জনপদের সবাই মিলেই লেখেন।

এই গল্পটি যখন আমার মুদিদোকানী বাবা কাজের ফাঁকে ফাঁকে পড়তেন--স্পষ্টভাবে দেখতে পেতাম, বাবার শ্বাস ঘন হয়ে পড়ছে। নাকের ডগা লাল হয়ে উঠেছে। পড়া শেষ হলে দপদপিয়ে মুদিখানা থেকে বেরিয়ে পড়েছেন। কোন কথা বলতে পারছেন না। পারলে রাস্তাটিকে ধরে আকাশের ওপারে ছুড়ে মারতেন।

সে সময় আমাদের পাড়ায় কয়েকটা করবী ফুলের গাছ ছিল। ফুলগুলো লাল হত না—হলুদ হয়ে ফুটত। ফুলটির নাম যে করবী এটা কেউ জানত না। সবাই বলত কলকি ফুল। এই কলকি ফুল তুলতে নেই।

একদিন আমার মেজোদিদি একটি কলকি ফুলের গাছ এনে আমাদের মন্দিরের সামনে লাগিয়েছিল। গাছটি তুলে ফেলেছিল আমার মা। রেগেমেগে বলেছিল, সংসারে কি অ্যালফ্যাল ‌আনতি চাও নাকিরে মাইয়া?

এরপর গাছটি বহুদিন পড়েছিল নিমতলার পাশে। সেখান থেকে বেলতলার নিচে। শুকিয়ে ঠ্যানঠ্যানে হয়ে পড়েছিল। তারপর পুকুরপাড়ে ছুড়ে ফেলেছিল।

এই পুকুরপাড়ে আমাদের পাড়ার জেঠীকাকীরা প্রতিদিন সকালে থালাবাসন মাজতেন। মাজতে মাজতে তাদের মাজা ধরে আসত। জল দিয়ে চোখ থেকে জল মুছে দিতেন। মুখে জল নিয়ে কুলকুচা করে উঠে পড়তেন। মাঝে মাঝে সেই কুলকুচা এসে পড়ত পাড়ের দিকে। আর সেই থেকেই আমাদের কলকি গাছটি নড়ে চড়ে উঠেছিল। আমাদের অবাক করে দিয়ে তার শুকনো ডালে পাতা এসেছিল। শেকড় জেগেছিল।

আমার সেজো বোনটি সেই মরতে মরতে বেঁচে যাওয়া কলকি গাছটি মন্দিরের পাশটিতে আবার লাগিয়ে দিয়েছিল। মা যখন গাছটিকে তুলে ফেলবে বলে ডাল ধরেছে, সেই সময়ে উঠোনে ঢুকছেন কুসুমদিয়ার ফকির। তিনি ডেকে বলছেন, গাছটির নাম করবীগাছ। সেই থেকে আমাদের কলকি ফুল করবী হয়ে আমাদের উঠোনে ফুটেছিল।

২.

সে সময়কালে হাসান আজিজুল হকের বুড়োটির মত বেশ কয়েকজন বুড়ো খুব ভোরে হাঁটতে বের হতেন রাস্তা দিয়ে। এর মধ্যে একজন ছিলেন কাশেম রেজা। চোখের ডাক্তার। তিনিই আমাদের জলের তলা থেকে ভেসে ওঠা খুদে শহরের কবিকাকা। তিনি পূজোর সময়ে দুর্গামণ্ডপে কবিতা পড়তেন। শহীদ মিনারে একুশে ফেব্রুয়ারির দিনে কাগজে কবিতা লিখে বিলি করতেন। তাঁর মুখ ছিল প্রাচীন ঋষিদের মত সৌম্য। আর শিশিরের মত মায়াময়। তিনি একদিন ভোরবেলা সবাইকে ডেকে তুললেন। বললেন, এই করবী গাছটি নিয়ে আমি একটি কবিতা লিখব। তোমাদের শুনিয়ে যাব।

তিনি কবিতা শোনাবেন এই আশায় আমরা তাঁর ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতাম। পাশে কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়। ছবি তুলে কেউ বেরিয়েছে ছবিঘর থেকে। তার চুলে তখনো টেরিকাটা। মকলু ভাই হৈ হৈ করে যাত্রাদলের কথা বলছেন। পথচারিরা আমাদের পাশ হেঁটে যেত। কেউ কেউ গান গাইত, অনেক সাধের ময়না আমার। ময়নাটি বাঁধন কেটে যেত। তারা কল্পনা সিনেমা হলে রাজ্জাক কবরীর ময়নামতি সিনেমাটি দেখে যাবে।

কবির ঘরটি ছিল কালিবাড়ির পুকুরের উপরে। মাচা থেকে মাছ ধরা যেত। আমাদের বন্ধু পল্টু পুকুর থেকে জল তুলে ঠিক পুকুরের উপরে দাঁড়িয়ে গোসল সারত। বলত, জানিস, পৃথিবীতে কেউ জলের উপরে হাঁটতে পারে না। আমরা পারি। কবি কাশেম রেজা আর তার ছেলে কবি রেজা পল্টু প্রতিরোজ জলের উপরে হেঁটে বেড়াত। আমরা দেখতে পেতাম—কবি তার টেবিলে ঝুঁকে কবিতা লিখছেন। চোখের উপর থেকে চশমাটি নাকের উপরে ঝুকে এসেছে। কাঁচাপাকা চুল। আর বাদশাহী দাড়ি। আমরা অপেক্ষা করতাম এই কবি বুড়ো হওয়ার আগে করবী গাছটি নিয়ে কবিতাটি লেখা শেষ করবেন। আমরা শুনতে পাব। পল্টু তখন বলেছিল, কষ্ট কবিতা থেকে জন্ম নেয়। কী কষ্ট জানিনা। তাহলে কি করবী কোনো কষ্টের নাম?

৩.

পান্নু স্যারের বাসার সামনেই বাজার বসে। শুক্রবারে আর মঙ্গলবারে দূরের হাটুরেরা এসে কবির হোটেলে ভাত খেয়ে যায়। খেতে খেতে লাউগাছের গল্প করে। রায়েন্দাধানের পুড়ে যাওয়ার জন্য হাহাকার শোনায়। মাঝিগাতির বিলে শালুকধরার খবরাদি জানিয়ে যায়। রাধুনে মহিলাটি এসে বলে—বাবা, আপনেও চাইট্টা খাইয়া লন। এ সময়ই পান্নু স্যার তার দ্বিতীয় বিবির জন্য ম্যাকবেথ পড়ছেন। আর বাজার ধীরে ধীরে ভেঙে যেতে থাকে।

কবি আমাদের উঠোনে ভোর ফোটার আগেই ঘুরে যেতেন। তখন তার ঘরে মোজো মেয়েটির ছেলেমেয়েরা এসে পড়েছে। কেউ কেউ বারান্দায় ঘুমোয়। কেউ কেউ রোগীদেখার ঘরে। কোকো আপা মন খারাপ করে ইস্কুলে পড়াতে যান। সেকো আপার সঙ্গে দেখা হয় না। রেখা আপা একদিন বিপ্লব হবে বলে ছুটে বেড়ান এপাড়া থেকে ওপাড়ায়। আর শোনা যায় কচি আপা কবিতা লিখছেন। ঢাকায় কবিতা ছাপা হচ্ছে। করবী ফুলকে নিয়ে কেউ কবিতা লেখেনি। আমরা জানি আমাদের শহরের সত্যিকারের কবি কাশেম রেজাই লিখবেন কবিতাটি। আমরা শুনব। শুনলে আমাদের মন ভালো হয়ে যাবে। এইহেতু আমাদের উঠোনে একটি গাছেই কখনো রক্তের মতো লাল ফুল ফুটত। কখনো শ্বেত পাথরের মত সাদা ফুল। কখনো আমার মায়ের মতো কালো কালো ফুল। আবার বাটা হলুদের মত হলুদ হলুদ। কবিতা এই লাল, সাদা, কালো আর হলুদের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসবে। চারিদিকে ফেটে পড়বে।

৪.

এইভাবে আমাদের কবি একদিন বুড়ো হতে হতে তার লেখার টেবিল হারিয়ে ফেললেন। সেখানে বসেছে ক্যারামবোর্ড। আর কবিতার খাতার বদলে মাসুদ রানা। অমিতাভ বচ্চন—আখেরি রাস্তা। ইয়াহ-ঢিসুম ঢুসুম।

কবি আমাদের বটতলায় আসেন। হাতে ময়ূরমুখী লাঠি। মাথায় সাদা টুপি। তার চোখের মধ্যে অনেকগুলো কাক কা কা করে ওড়ে। পাখা ঝটপটায়। মা দুটো মুড়ি খেতে দেয়। একখণ্ড নলেন গুড়। কাসার গ্লাসে জল। কবির হাতে জলের গ্লাস। তিনি বলেন, কবিতা লেখা হয়েছে।

তিনি ঢকঢক করে জল খেলেন। তারপর পড়লেন 'একটি বাবা, তার মেয়ে আর একটি একটি করবী গাছের' কবিতা। বাবা বারান্দার ঘরে বসে থাকে। তার ঘরে গ্রামের ছেলেরা আসে। দুটো একটা টাকা দেয়। ভেতর ঘরে তার মেয়েটির শাড়ির খসখসানি কানে আসে। বুড়ো খুক খুক করে কাশে। আর বাইরে সেই করবী গাছ বেড়ে ওঠে। বুড়ো শোনায় করবী ফলের মধ্যে মারাত্মক বিষ থাকে।

আমরা কবির কণ্ঠে শুনি সেই বিষের গল্পটি। আর কিছু নয়। এই বিষময় করবী গাছটি আমাদের মন্দিরে বেড়ে ওঠে। বাতাসে তারা চিকন চাকন পাতাগুলো দোলে। মা রান্না ঘর থেকে গরম ভাতের ফ্যান গাছটির গায়ে ফেলতে ফেলতে থেমে যায়। এ সময়ই কবি জলের গ্লাসটি আবার ঠোঁটে চেপে ধরেন। তার আবার জল পিপাসা জেগেছে। কিন্তু গ্লাসটি শূণ্য। আমাদের উঠোনে করবী ফুল ফেটে পড়েছে।

.নিউ ইয়র্ক. ২০ নভেম্বর. ২০১১.

৫.

সংযোজন :

যেভাবে লেখা হলো আত্মজা ও একটি করবী গাছ

হাসান আজিজুল হক

------------------------------------------------

প্রথম কথা হচ্ছে, যিনি লেখক তিনি যদি একটা লেখা লিখতে শুরু করেন, যে মুহূর্তে শুরু করেছিলেন তার আগে কী ভেবেছিলেন বা আগে কদিন ভেবেছিলেন, এটা ঠিক কেউ বলতে পারবে না। এ গল্প লেখা হয়েছে ১৯৬৭ সালে। আমার মনে হয়, গল্পে যে সময়টা, তাতে তীব্র শীতকালের উল্লেখ আছে যেহেতু, সেহেতু গল্পটা লেখা হয়েছিল শীতকালেই। মাথার ওপর চাঁদ দেখা যাচ্ছে_এ রকম লেখাও আছে সেখানে। অথচ গল্পটা লিখতে শুরু করেছিলাম কিন্তু উজ্জ্বল রোদের এক সকালবেলায়।

আমি একটা নিঝুম রাতের অনুপুঙ্খ বিবরণ দিচ্ছি যেখানে শব্দ নেই, পাখির আওয়াজ নেই এরূপ। এক উজ্জ্বল সূর্যালোকিত সকালবেলায়। আমি তখন থাকতাম ফুলতলা নামের একটা জায়গায়। খুলনা শহর থেকে ১৪ মাইল দূরে এবং আমি যে কলেজে চাকরি করতাম, ব্রজলাল কলেজ ওখান থেকে ৯ মাইল দূরে। আমি যাতায়াত করতাম বাসে। আসতামও বাসে। গরিব মাস্টার, বিরাট পরিবার টানতে হতো। কী করে লেখা হয়েছে, এটা সোজাসুজি করে বলা যায় কিছু কাগজের ওপরে কলম দিয়ে। অবশ্য একটা বই বেরিয়েছে তখন। পাঠকরা তা ভালো করেই নিয়েছে, গ্রহণ করেছে বলে মনে হয়। তবুও '৬৭ সালে দৌলতপুর ব্রজলাল কলেজ, যেখানে অধ্যাপনা করি, তখন খুব সাধারণ অবস্থার মধ্যে ছিলাম। আমি তখন গল্পটা নিয়ে ভাবার সুনির্দিষ্ট কোনো জায়গা বলতে পারব না কিংবা গল্পও বলতে পারব না।

তখন বেশ কিছু মানুষ পশ্চিমবঙ্গ থেকে তারা যে বিতারিত হয়ে এসেছে, তা নয়, যেভাবেই হোক না কেন তারা পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে ফুলতলাতে বসবাস শুরু করেছে। এরা একটা বিশেষ দুরবস্থার মধ্যে ছিল। আর যেভাবেই হোক স্থানীয় মানুষদের তাদের গ্রহণ করার ব্যাপারটা কোনো দেশেই থাকে না। একটা মানুষ নিজেই একটা এলাকার নানা সমস্যায় জর্জরিত হচ্ছে, তাদের এসো এসো বলে গ্রহণ করা হয় না। বাস্তবে সেটা ঘটে না। তো এমন একটা পরিবারের পারিবারিক ঘটনার একটা টুকরো কানে এসেছিল। সে বাড়িতে মেয়েটার কাছে লোক আসত। মামা কাকা জানে শোনে কিন্তু কিছু পয়সা কড়ি দেয় বলে তারা কেউ কিছু বলে না। জেনেও না জানার ভান করে। এ কথাটুকু একটা পরিবার সম্বন্ধে এসেছিল। মাথায় এটা ঘুরতে থাকে যে, কিছু একটা লিখে ফেললে হয়। এ পর্যন্তই।

তারপর গল্প লিখতে শুরু করার সপ্তাহখানেক আগেই গল্পটা একটু চেপে ধরল আমাকে। তখন আমি নানাভাবে গল্পটা লিখতে শুরু করেছিলাম। আমার মনে আছে, একবার শুরু করলাম যে একটি স্থানীয় বাজারের ছোট্ট চায়ের দোকানে বসে কয়েকটি ছেলে খুব আড্ডা দিচ্ছে। তো আড্ডা মারতে মারতে রসালো গল্প করছিল তারা। তখন একটি মেয়ের প্রশ্ন তুলছে। যারা যারা সেখানে যায়, তারা খুব মজা পাচ্ছে। এভাবে তা দু-এক লাইন লিখেছিলাম। দেখা গেল, এত অপছন্দ হলো যে গল্পের ভাষা গড়ন পুরনো হতে হতে নষ্ট হয়ে যাওয়া একটা জায়গায় চলে গেছে। সেটা ছিঁড়ে ফেলে দিলাম। ওই দিনের কথা থেকে, আচ্ছা দেখি, গল্পটা লেখার চেষ্টা শুরু করি।

খুব যে সুনির্দিষ্টভাবে গল্পটা লেখা শুরু করেছিলাম, তা কিন্তু নয়। শীতের দিনে যে বাড়িটা আমরা পেয়েছিলাম বিনিময়সূত্রে, সেখানে বসে লিখেছিলাম। তো লেখা শুরু করার আগে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'বুড়ো আঙুল' পড়ছিলাম। তার প্রথম বাক্য ছিল 'হৃদয় নামের ছেলেটির নামই হৃদয়।' হৃদয় থেকে আমার মনে হলো, আমি তাহলে নিদয় শব্দটি ব্যবহার করব। সেই জন্য আমি লিখলাম 'এখন নিদয় শীতকাল।' কলার পাতা অল্প বাতাসে একবার বুক দেখায় একবার পিঠ দেখায়। এভাবে গল্পটা শুরু হলো এবং তারপর দেখা গেল আসতে থাকল কী রকম করে যে, একটা ছবির পর একটা ছবি। আরেকটা কথা, ফুলতলা খুব রূপবতী জায়গা। এত ফুল, এত সুন্দর লতাপাতায় ঘেরা জঙ্গল, ঠিক যেমনটি আমি ব্যবহার করেছি 'আত্মজা এবং একটি করবী গাছ'-এ। এটা যে খুব কল্পনা করে লিখেছি, সে রকম নয়। আমার ঠিক যেমনটা মনে হয়েছে, তেমনই লিখেছি।


মন্তব্য

ব্যাঙের ছাতা এর ছবি

গল্পটি পড়া হয়নি কিন্তু আপনার লেখাটি চমৎকার। সুপাঠ্য এবং হৃদগ্রাহী। চলুক

কুলদা রায় এর ছবি

পড়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'

মাহবুব ময়ূখ রিশাদ এর ছবি

''আমি একটা করবী গাছ লাগাই বুঝলে? ফুলের জন্য নয়, বিচির জন্য। চমৎকার ভিষ হয় ফুলের বিচিতে''

খুব সম্ভবত এভাবেই শেষ হয় গল্পটি, অনেকদিন আগের পড়া।

চমৎকার একটি গল্প।

------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

চমৎকার লেগেছে আপনার লেখাটি। বিষণ্ণতা ও বিপণ্ণতায় মাখামাখি।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।