রবীন্দ্রনাথের জমিদারগিরি—জমিদারের রবীন্দ্রগিরি : নবম পর্ব

কুলদা রায় এর ছবি
লিখেছেন কুলদা রায় [অতিথি] (তারিখ: শুক্র, ০২/১২/২০১১ - ১১:৫৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


কুলদা রায়
এমএমআর জালাল

ঠাকুরবাড়ির জমিদারি শুরু------------------
নীলমণি ঠাকুরের বড় ছেলে রামলোচন ঠাকুর প্রখর বিষয়বুদ্ধির অধিকারী ছিলেন। তিনি বিরাহিমপুর পরগণা কিনে জোড়াসাঁকো পরিবারের আনুষ্ঠানিক জমিদারগিরির সূচনা করেন। বিরাহিমপুর পরগণার সদর কাঁছারি ছিল শিলাইদহে। তিনি বিপুল বিষয়সম্পত্তি কিনে ঠাকুরপরিবারকে কোলকাতায় অভিজাত হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেন। এর আগে ঠাকুর পরিবারের পরিচয় ছিল-- পিরালী ব্রাহ্মণ এবং ব্যবসায়ী বাবু। তারা পাত্তা পাওয়ার মতো কেউ ছিলেন না। সমাজে অছ্যুত।

জমিদারি করার সঙ্গে সঙ্গে পারিবারিক কিছু সৌখিন আভিজাত্য গড়ে তোলেন রামলোচন ঠাকুর। বিকেলে তিনি হাওয়া খাওয়ার প্রচলন তিনি প্রচলন করেন। এছাড়া খেয়াল বা কালোয়াতি গান ও কবিয়াওয়ালাদের আসর জোঁড়াসাঁকোর বাড়িতে বসাতেন। সেসব অনুষ্ঠানে ইয়ারবন্ধুদের আমন্ত্রণ করা শুরু করেন। সেখানে বিস্তর খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা হত। বিভিন্ন জেলায় তিনি জমিদারি কেনেন। কোলকাতা শহরে দশটি বাড়ি কিনেছিলেন।

রামলোচন ঠাকুর আর তাই ভাই রামমণি ঠাকুর দুজনে দুবোনকে বিয়ে করেন। রামলোচনের স্ত্রী অলকা দেবীর শিবসুন্দরী নামে একটি মেয়ে হলেও শৈশবেই তার মৃত্যু হয়। তাঁর কোনো পুত্র সন্তান ছিল না। রামমণির স্ত্রী মেনকার গর্ভে দুটি ছেলে ও দুটি মেয়ে হয়েছিল। ছেলে দুটির নাম রাধানাথ (১৭৯০-১৮৩০) ও দ্বারকানাথ ঠাকুর (১৭৯৪-১৮৪৬)।. মেয়ে দুটির নাম জাহ্ণবী ও রাসবিলাসী। সবার ছোটো দ্বারকানাথ। দ্বারকানাথের বয়স এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই তার মা মেনকার মৃত্যু হয়। এরপর রামমণি ঠাকুর দুর্গামণি দেবীকে বিয়ে করেন। দুর্গামণির একটি ছেলে রমানাথ (১৮০০-১৮৭৭) এবং একটি মেয়ে দ্রবময়ীর জন্ম হয়।

ছোটো বোন মেনকার মৃত্যুর পরে দুধের শিশু দ্বারকানাথের লালন পালনের ভার তুলে নেন অলকা দেবী। তিনি তাকে স্তন্যপানও করান। সে সময় অলকাদেবীর পরামর্শে অপুত্রক রামলোচন দ্বারকানাথকে দত্তক নেন। এই দত্তক নেওয়াটা একই পরিবারের মধ্যে ঘটেছিল। দ্বারকানাথের বাবা-জ্যাঠা সহোদর দুভাই। মা-মাসি সহোদর দুবোন।

১৮০৭ সালে ডিসেম্বর মাসে রামলোচন উইল করে দ্বারকানাথকে তাঁর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী করে যান। উইলে লেখা হয়--
এখনও তুমি নাবালক একারণ এবং এই জমিদারি ওগায়রহ জে কিছু বিসয় তোমাকে দিলাম ইহার কর্ম্মকার্য্য জাবত আমি বর্ত্তমান থাকিব অর্থাৎ আমিই করিব আমার অবর্ত্তমানে জাবত তুমি বয়সপ্রাপ্ত না হও তাবৎ পরগণাদিগর এ সকল বিষয়রের কর্ম্মকার্য্য ও সহী দস্তখত বা বন্দবস্ত ও হুকুমহাকাম সকলি তোমার মাতা করিবেন তুমি প্রাপ্তবয়স হইলে জমিদারিদিগর আপন নামে হুজুর লেখাইয়া এবং আপন এক্তারে আনিয়া জমিদারির ও সংসারের কর্ম্মকার্য্য ও জমিদারির বন্দবস্ত ও খরচপত্র ওগায়রহ তোমার মাতার অনুমতি ও পরামর্শে তুমি করিবা এবং জাবৎ তোমার মাতা বর্ত্তমান থাকিবেন তাবৎ পরগণার মুনাফা ওগায়রহ জে কিছু আমদানির তহবিল তোমার নিকট জেমন আমি রাখিতাম তুমিও সেইরূপ রাখিবা।

রামলোচন ঠাকুর এইভাবে নিজের স্ত্রীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সঙ্গে সঙ্গে তার স্বাভাবিক কর্ত্রিত্বশক্তির প্রতি সম্মানও দেখিয়েছেন।

এই উইল করার কয়েকদিন পরেই রামলোচর ঠাকুর ১৮০৭ সালের ১২ ডিসেম্বর মারা যান। দ্বারকানাথের বয়স তখন তের। তিনচার বছর সম্পত্তি দেখাশুনা করেন তার মা অলকা দেবী ও দ্বারকানাথের আপন বড় ভাই রাধানাথ। এর পরে দ্বারকানাথ নিজেই সব নিজেই পরিচালনা করতে শুরু করেন। তখন তাঁর বয়স ১৬/১৭ বছর।

দ্বারকানাথ ঠাকুর—বাঙালি প্রিন্স বলিয়া ইংরেজরা আদর করিত-----------------------
বাল্যকালে প্রথামতো কিছুদিন দ্বারকানাথ পাঠশালায় পড়াশুনা করেন। পরে মৌলবীর কাছে ফার্সি ও আরবী ভাষা শেখেন। সে সময়ে মুগলদের অনুসরণে ফার্সি ভাষা রাজভাষা হিসাবে প্রচলিত ছিল। ইংরেজরা প্রথমদিকে এদেশের শিক্ষা নিয়ে ভাবিত ছিল না। তখন কিছু ইংরেজ ইংরেজি শেখার স্কুল খুলেছিলেন ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য। কিছু মিশনারীগণও কোম্পানীরকে পাশ কাটিয়ে স্কুল করেছিলেন। সে রকম একটি স্কুল খুলেছিলেন শেরবোর্ন সাহেব কোলকাতার চিৎপুরে। সেখানে দ্বারকানাথ ইংরেজি শেখেন। এছাড়াও পরে রামমোহন রায়ের বন্ধু উইলিয়াম অ্যাডাম, ডিজে গর্ডন, জেমস কলরড প্রমুখের কাছেও ইংরেজি ভাষার তালিম নেন। সেকালে ইংরেজি ভাষা শেখা ছাড়া বিত্তবৈভব অর্জন করা সম্ভব ছিল না। যারা ধনী হয়েছিলেন তারা সবাই-ইংরেজির শেখার গুণে ইংরেজদের সঙ্গে খাতির জমিয়ে ধনী হয়েছিলেন। দ্বারকানাথও এই ঘরাণার উন্নত সংস্করণ। ইংরেজদের দেওয়ান রাজা রামমোহন রায় তাঁর পাইওনিয়ার। তারা দুজনেই ধনীদের প্রতিনিধি। গরীবপ্রজাদের নয়।

রামলোচন ঠাকুরের জমিদারি ছিল উড়িষ্যার কটকে ও পূর্ববঙ্গের বিরাহিমপুর মহলে। বছরে এই দুটি মহল থেকে তাঁর আয় হত তিরিশ হাজার টাকা। দ্বারকানাথ ১৬/১৭ বছরে জমিদারির দায়িত্ব নিয়েই সন্তুষ্ঠ ছিলেন না। তিনি বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। প্রতিভাবলে উপার্জনের নানা শাখা-প্রশাখায় ছড়িয়ে দিয়ে কলাগাছ থেকে বটগাছ এবং বটগাছ থেকে তিনি প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর হয়েছিলেন। সেটা ইতিহাস। এই ইতিহাসের পেছনে কাজ করেছে তাঁর সহজে আয়ত্ত্বাধীন ইংরেজিভাষা আর বহুমুখী উদ্যোগ।

একটি দলিলে জানা যায়, কুষ্টিয়ার বিরাহিমপুরের প্রজারা ‘দুর্বত্ত বলিয়া প্রসিদ্ধ ছিল’।. এই জটিলতাপূর্ণ জমিদারি পরিচালনা করতে গিয়ে দ্বারকানাথ আটঘাট বেঁধে জমিদারি আইনকানুনগুলো ভালোভাবে শিখে নিয়েছিলেন। এই বিষয়ে তিনি এত কুশলতা অর্জন করেছিলেন যে অন্যান্য জমিদারগণ তাঁকে জমিদারির নানা সমস্যা নিরসনে ও আইনকানুন বিষয়ে পরামর্শক নিয়োগ করতেন। পরে সুপ্রীম কোর্টের ব্যারিস্টার ফার্গুসনের নিকট থেকে তিনি আইন বিষয়ে গভীর পাঠ গ্রহণ করেন। এভাবে স্বাধীন আইন পরামর্শক হিসাবে তাঁর উপার্জন বেশ ভালো ছিল।

রাজা রামমোহন রায়ের বন্ধু উইলিয়াম অ্যাডাম ও ডিজে গর্ডন বিখ্যাত সওদাগরী প্রতিষ্ঠান ম্যাকিনটস এন্ড কোম্পানীর অংশীদার ছিলেন। তাদের সহায়তায় দ্বারকানাথ ম্যাকনটস কোম্পানীর গোমস্তা পদে যোগ দিয়ে রেশম ও নীল কিনতে তাদের সাহায্য করেন। এই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তিনি নিজেও রেশম ও নীল ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হন।

১৮১৮ সালে চব্বিশপরগণার কালেক্টর অফিসে সেরেস্তাদার পড়ে তাঁর চাকরী হয়। এই চাকরীটি আগে রাজা রামমোহন রায়ের সুপারিশে তিনি পান। রামমোহন রায় নিজেও ইংরেজদের সেরেস্তাদার ছিলেন। দ্বারকানাথ আপন প্রতিভাবলে ১৮২২ সালে ২৪ পরগণা কালেক্টর ও নিমক মহলের অধ্যক্ষ প্লাইডেনের দেওয়ান নিযুক্ত হন। ১৮২৮ সালে শুল্ক ও আফিম বোর্ডের দেওয়ান পদে উন্নীত হন। ভালো আয় করা সত্ত্বেও তিনি ১৮৩৪ সালে কোম্পানীর চাকরী ছেড়ে দিয়ে নিজেই স্বাধীনভাবে ব্যবসা শুরু করেন।

১৮২৮ সালে ম্যাকিনটস কোম্পানীর ইংরেজ বন্ধুরা তাকে কোম্পানীর অংশীদার করে নেয়। এই কোম্পানীর কমার্শিয়াল ব্যাংকের ডিরেক্টর নিযুক্ত হন। পরের বছর ১৮২৯ সালে১৬ লাখ টাকা মূলধন নিয়ে তিনি ইউনিয়ন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। অন্যান্য ব্যবসা দেখার জন্য বাংকের কোষাধ্যক্ষ নিয়োগ করেন তার ছোটো ভাই রমানাথকে। ১৮৩০ সালে তিনি কালীগ্রাম ও ১৮৩৪ সালে সাহাজাদপুরের জমিদারী কেনেন।

এই সময় উইলিয়াম কার নামে এক ইংরেজ বন্ধুর সঙ্গে কার-ঠাকুর কোম্পানী প্রতিষ্ঠা করেন। এই কোম্পানীর সাহায্যে দ্বারকানাথ চীন থেকে রেশম আমদানী করেন। এছাড়া বহুবিধ ব্যবসাবানিজ্যের মধ্যে অন্যতম হল—ক্যালকাটা স্টিম টাগ অ্যাসোসিয়েশন, দ ফ্লোটিং ব্রিজ প্রজেক্ট, দ বেঙ্গল বন্ডেড ওয়্যারহাউজ অ্যাসোসিয়েশন, দ ক্যালকাটা ডকিং কোম্পানী, দ বেঙ্গল সল্ট কোম্পানী, দ স্টিম ফেরি ব্রিজ কোম্পানী, দ বেঙ্গল টি অ্যাসোসিয়েশন, দ বেক্ষল কোল কোম্পানী, এবং ইন্ডিয়া জেনারেল নেভিগেশন কোম্পানী। রেললাইন বানিয়ে রেল কোম্পানীরও পত্তন করার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। কিন্তু মৃত্যু তাঁকে থামিয়ে দেয়। কার এন্ড টেগর কোম্পানী বন্ধ হয়ে যায়। ইউনিয়ন ব্যাংকেরও পতন ঘটে।

১৮৩৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী একচেটিয়া ব্যবসার সুযোগ হারায়। তার কিছু সুবিধা ভোগ করেন দ্বারকানাথ। তার জমিদারি বিরাহিমপুরের কুমারখালি মৌজায় অবস্থিত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর রেশম কুঠিটি কিনে নেন। স্থাপন করেন রামনগরে চিনির কারখানা, রানীগঞ্জে খনি থেকে কয়লা তোলার বেঙ্গল কোল কোম্পানী। আসামের চা প্রথম আমদানি করেন। এ ছাড়া কার এন্ড টেগোর কোম্পানীর প্রধান ব্যবসা নীলের চাষ ছিল। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের নীলের কুঠি ছিল। এই নীল ব্যবসাটিই ছিল সর্বাপেক্ষা বিস্তৃত কারবার। তাদের অফিসকে লোকে নীলের বাজার বলে চিনত। এই ব্যবসা সঠিকভাবে পরিচালনা করার জন্য তিনি ইংরেজদের নিয়োগ দিতেন। স্থানীয় বাঙ্গালীরা ইংরেজদের ভয় পেত। ফলে তাদের ব্যবসা চলেছে ইস্ট ইস্টিয়া কোম্পানীর স্টাইলেই। কোনো কোনো ব্যবসা-বানিজ্য আইনসংগত বা ন্যায়সংগত ছিল বলে মনে করেননি গবেষকগণ। তাঁদের কিছু সন্দেহ ছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হয়তো এই কারণে দ্বারকানাথ সম্বন্ধীয় দলিলপত্রাদি পুড়িয়ে ফেলেন। তাই দ্বারকানাথের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগসমূহের সঠিক অনুসন্ধান করার সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন জীবনীকার ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

জমিদারদের শক্তিকে সংহত করতে এবং তাদের সমস্যা সম্পর্কে সরকারকে সচেতন করার জন্য ১৮৩৮ সালে জমিদার-সভা বা ল্যান্ড-হোল্ডার্স এসোসিয়েশন স্থাপন করা হয়। তিনি এর অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি প্রজাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য কিছু করেছেন কিনা তেমন কোনো তথ্য জানা যায় না।

ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর দ্বারকানাথ ঠাকুরের জীবনীতে লিখেছেন, অনেকগুলি ঘটনা তাঁহার উপার্জনের সহায় হইয়াছিল। প্রথমত তিনি নিজে পৈতৃক জমিদারির অধিকারী ছিলেন, তাহা হইতে বাৎসরিক আয় ন্যূনাধিক ষাট হাজার টাকা আয় হত। সে সময়ে তাহার খরচ পরিবার হিসাবে ধরিলে বাৎসরিক দুই-তিন হাজারের অধিক হইবে না। আমরা তৎস্থানে দশ হাজার ধরিলেও বৎসরে প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকা করিয়া সঞ্চিত হইবার অবসর ছিল। ১৮০৮ খ্রিস্টাব্দ হইতে দেখি যে প্রতি দশ বছরে তাহার পাঁচ লক্ষ টাকা জমিত।

দ্বারকানাথ তখনকার দিনে ভারতে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধনীই শুধু নয়—প্রভুত সমাজিক সম্মান ও প্রতিপত্তি লাভ করেন। নিজে ছিলেন বৈষ্ণব পরিবারের সন্তান। তিনি নিজে প্রথম প্রথম মদ্য-মাংস খেতেন না। নিরামিষ খেতেন।

রামমোহন রায়ের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পরে দ্বারকানাথের পারিবারিক ধর্মাচরণে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। তিনি নিরামিষ ছেড়ে মাংস-পিঁয়াজ-মদ খাওয়া শুরু করেন। ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন—শুনিয়াছি যে প্রথম প্রথম যখন দ্বারকানাথ ও রমানাথ রামমোহন রায়ের কথামত মাংসাহারে প্রবৃত্ত হইলেন, তখন উভয়েরই শরীর অসুস্থ হইয়া পড়িত এবং উভয়েই বমি করিয়া পরিত্রাণ পাইতেন। ক্রমে যখন অভ্যাস হইয়া পড়িল, তখন বাটির এক বহিঃপ্রান্তে মাংস রাঁধিবার বন্দোবস্ত হইল। রামমোহন রায় বড়ই মুসলমান প্রিয় ছিলেন। তাহারই অনুকরণে দ্বারকানাথও মুসলমান বাবুর্চি রাখিয়াছিলেন। ক্রমে দ্বারকানাথের সঙ্গে ইংরাজদেরও ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি হওয়াতে প্রকাশ্যেই তাহাদের সঙ্গে বসিয়া আহারাদি করিতেন। রামমোহন রায়ের অনুকরণে তিনিও অল্প পরিমাণে সেরি মদ্য পান করিতেন।

দ্বারকানাথে পত্নী দিগম্বরী দেবী খুবই ধর্মপরায়ণা ছিলেন। তিনি স্বামীর নিরামিষ বাদ দিয়ে মদ্য-মাংস খাওয়ার এই নবলদ্ধ আভ্যাসকে পছন্দ করেননি। তিনি অনেক চেষ্টা করেছিলেন তাঁকে এই পথ থেকে ফেরাতে। কিন্তু তাঁর স্বামী ফেরেননি দেখে, রীতিমত ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতদের ডেকে মতামত চেয়েছিলেন ম্লেচ্ছ সংসর্গে পানভোজনে মত্ত স্বামীর সঙ্গে বসবাস করা ধর্মসংগত হবে কিনা। স্বামীসেবা অবশ্য কর্তব্য বলে রায় দিলেও তাঁকে স্বামীর সংগে এক সঙ্গে থাকতে তারা নিষেধ করেন। ফলে দিগম্বরী দেবী স্বামীর দেখভাল করলেও সর্বপ্রকার সম্পর্ক ত্যাগ করেছিলেন। শোনা যায়, যতবার দ্বারকানাথের সঙ্গে তিনি কথা বলতে বাধ্য হতেন—ততবারই তাঁকে সাতঘড়া গঙ্গাজলে স্নান করতে হত।

স্ত্রীর আপত্তির ফলে দ্বারকানাথ বসতবাটির পরিবর্তে বেলগাছিয়ায় একটি বাগানবাড়ি কিনে বহুমূল্য আসবাবপত্রে সজ্জিত করে সেখানে তাঁর ভোজসভা ও নৃত্যগীত ইত্যাদির আয়োজন করতেন। এইসব আয়োজনে সে সমযে ইংরেজ সাহেবরা নিমন্ত্রণ পেলে কৃতার্থ বোধ করত।
সে সময়ের একটি সংবাদপত্রে কাগজে হেডলাইন প্রকাশিত হয়েছিল—

শ্রীযুত বা্বু দ্বারকানাথ ঠাকুরের উদ্যানে মহাভোজ ও তামাশা।–গত সোমবার রজনীতে শ্রীযুত বাবু দ্বারকানাথ ঠাকুর স্বীয় অত্যুত্তম উদ্যানে শ্রীলশ্রীযুত গবরনল জেনরল বাহাদুর ও অন্যান্য ন্যূনাধিক তিন শত সাহেব ও বিবি সাহেব লোককে মহাভোজন করাইয়া পরমসন্তোষক তামাসা দর্শাইলেন। বিশেষত: নৃত্যগীত, বাদ্য ও বহ্ণুৎসবজনক ও অত্যুৎকৃষ্ট বহুবিধ ভোজ্য সামগ্রী প্রস্তুত ছিল।...অনন্তর মহানাচ শুরু হইল।

কোলকাতায় সে সময় একটি গান জনপ্রিয় হয়েছিল—
বেলগাছিয়ার বাগানে হয়
ছুরি-কাটার ঝনঝনানি,
খানা খাওয়ার কত মজা
আমরা তার কি জানি?
জানে ঠাকুর কোম্পানি।।

একটা বর্ণনা পাওয়া যায় ফেনী পার্কসের বিবরণে, সময়টা ১৮২৩ সালে—দূর্গাপূজায় :
পূজা মণ্ডপের পাশের একটা ঘরে নানা রকমের উপাদেয় সব খাদ্যদ্রব্য প্রচুর পরিমাণে সাজানো ছিল। সবই বাবুর ইউরোপীয় অতিথিদের জন্য বিদেশী পরিবেশক ‘মেসার্স গান্টার অ্যান্ড হুপার’ সরবরাহ করেছিলেন। খাদ্যের সঙ্গে বরফ এবং ফরাসি মদ্যও ছিল প্রচুর। মণ্ডপের অন্য দিকে বড় একটা হল ঘরে সুন্দরী সব পশ্চিমা বাইজিদের নাচগান হচ্ছিল, এবং ইউরোপীয় ও এদেশী ভদ্রলোকেরা সোফায় হেলান দিয়ে চেয়ারে বসে সুরাসহযোগে সেই দৃশ্য উপভোগ করছিলেন। হান্টার সাহেব লিখেছেন—এইসব নাচ দেখে দূর থেকে এ দেশের গ্রামের লোকেরা অবাক হত। তাদের এখানে যোগদানের কোনো সুযোগ ছিল না। দূর থেকে দেখা যেত কিছু হিছু দৃশ্য আর শোনা যেত বাদ্য আর গানের সুর।

জানা যায় মেম পটানোতেও দ্বারকানাথ খুব ওস্তাদ ছিলেন। অর্থ ও প্রতিপত্তির জোরে পছন্দের যে কোনও লেডিকে তিনি কাছে টানতে সমর্থ। বিখ্যাত অভিনেত্রী ইসথার লিচ-এর সঙ্গে তাঁর গভীর বন্ধুত্বের কাহিনী সেকালে সবাই জানতেন। তিনি এবং তাঁর ষোড়শী কন্যাকে দ্বারকানাথ কেমন করে নিজের নাগালে রেখেছিলেন সেটাও ছিল সেকালের অন্যতম মুখরোচক কাহিনি। মিস হার্ব নামে এক লেডি দ্বারকানাথকে লিখেছেন,--‘বিয়ে হয়ে যাওয়ার আগে একবার তোমার সঙ্গে বসে খেতে চাই’।. চিঠির শেষ বাক্যে লেখা আছে-‘বিলিভ মি অলওয়েজ অ্যান্ড এভার টু বি ইওর সিনসিয়ার অ্যান্ড আই ডে সে নট ফারদার।...।. বিলেতে দ্বারকানাথ গেলে সেখানেও তিনি বিস্তর মেম সাহেবদের সঙ্গে খাতির জমিয়েছিলেন। তার অন্যতম বান্ধবী ছিলেন সুরসিকা ইংরেজ কবি এবং রূপসী ক্যারোলিন নর্টন। সবে স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়েছে তাঁর। শহরে তাঁর বিষয়ে নানা গুঞ্জন। দ্বারকানাথের জন্য তিনি আয়োজন করেছিলেন কবি ও সাহিত্যিকদের নিয়ে স্মরণীয় নৌ-পার্টির। সেই আসরে হাজির ছিলেন স্বয়ং চার্লস ডিকেন্স। ব্লেয়ার বি ক্লিং লিখছেন—দ্বারকানাথ এসব ব্যাপারে ঢাকাঢাকি পছন্দ করতেন না।সর্ববিষয়েই তিনি ইংরেজদের সঙ্গে ভারতিয়দের পার্টনারশিপ চাই। নারী বাদ যাবে কেন।

এসবই ছিল সাহেব ধরার কায়দা কৌশল। পয়সাকড়ি কামানোর নিত্যনতুন ফন্দি।

অষ্টম পর্বের লিংক


মন্তব্য

পল্লব এর ছবি

এই সিরিজটা অনেকদিন ধরেই খেয়াল করছি। মনে হয় না কেউ খুব একটা পড়ে। এরপরও কষ্ট করে লিখে যাচ্ছেন দেখে অবাকই লাগে।

কুলদা রায় এর ছবি

আপনি পড়েছেন দেখে ভালো লাগছে। ধন্যবাদ।

...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'

ধ্রুবনীল এর ছবি

পড়ছি।

এই পর্বের বিষয় এত বিস্তারিত জানা ছিল না। সামনের পর্বের জন্য আগ্রহে অপেক্ষা করছি, শুনেছি দবারকানাথের বিলাত ভ্রমন অনেক বৈচিত্রময় ছিল। বিশেষ করে যে পরিমান টাকা তিনি সেই সময় উড়িয়েছেন তা এখনও অকল্পনীয়।

ধন্যবাদ।

কুলদা রায় এর ছবি

ধন্যবাদ আপনাকেও।

...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'

আকামের আবদুল এর ছবি

@ পল্লব
ঐতিহাসিক বিষয়ে সবার আগ্রহ সমান আশা করা যায় না। আমি কিন্তু লেখাটা প্রথম থেকে খুব খেয়াল করেই পড়ে যাচ্ছি। শেষ দৌড়ে কিন্তু এ ধরণের লেখার মূল্য অনেক। ভাই কুলদা রায়, লিখে যান । জনপ্রিয়তার আপনার দরকার আছে মনে করি না।

কুলদা রায় এর ছবি

এই লেখাটা আসলে আমাদের একটা অনুসন্ধান। সাহিত্য নিয়ে কোনো কাজ নয়। আবার রবীন্দ্রজীবনী নিয়েও নয়। আমরা কাজ করছি রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিশাল কর্ম নিয়েও নানাবিধ বিরোধিতার শিকার হয়েছেন তাঁর জীবিতকালে এবং বর্তমানকালেও। পূভৃপাকিস্তান থেকে বতৃমান বাংলাদেশেও একটা বিরোধিতা করা হচ্ছে কিছু নেতিবাচক রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। এই বিরোধিতার স্বরূপটাই খুজে দেখার হচ্ছে এই সিরিজগুলোতে। পড়ছেন জেনে ভালো লাগছে। ধন্যবাদ।

...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'

পথিক পরাণ এর ছবি

ফেইস বুকে কোন এক বন্ধুর লিঙ্কে 'রবীন্দ্রনাথ কতৃক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বিরোধিতা' বিষয়ে একটা নোটে প্রথম আপনার পরিচয় পাই। লেখাটা খুব জুতসই এবং তথ্য নির্ভর ছিল।

রবীন্দ্রনাথের স্বরূপ সন্ধানী এই ধারাবাহিকটির দিকেও নজর রাখছি সমান উৎসাহে। খুবই তথ্যবহুল মূল্যবান লেখা।

-------------------------
পথেই আমার পথ হারিয়ে
চালচুলোহীন ছন্নছাড়া ঘুরছি ভীষণ...

মঈনুল এর ছবি

বেশ ভালো লাগলো এই পর্বটা।পড়ছি সিরিজটা।

Debanjan Ray এর ছবি

দ্বারকানাথ যে রামমোহন প্রভাবে আমিষাশী হয়েছিলেন এই তথ্য কোথা থেকে পেয়েছেন তা জানলে বড় বাধিত হবো। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ তথ্য।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।