কুলদা রায়
এমএমআর জালাল
আসমানদারীর নির্মাণপর্ব
গিরীন্দ্রনাথ ঠাকুর : সৌখিন মেজাজের বাবু-------------------
দেবেন্দ্রনাথের চতুর্থ ভাই গিরীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮২০-১৮৫৪) বিষয়বুদ্ধিসম্পন্ন ছিলেন। আবার আসমানদারীর পক্ষেও কাজ করেছেন। দাদার সঙ্গে তিনিও ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেন। সৌখিন যাত্রাদলের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। বাবুবিলাস নামে একটি নাটকও লিখেছেন। ব্রাহ্ম হলেও তার পরিবারে দোল-দুর্গোৎসব অব্যাহত রেখেছেন। এ উপলক্ষ্যে বাড়িতে আয়োজন করতেন যাত্রা প্রভৃতি লৌকিক বিনোদনের ব্যবস্থা। বেশ বাবু চেহারা ছিল তার চরিত্রে। রবীন্দ্রনাথ এই পালাগানের স্মৃতি চারণ করেছেন আমার ছেলেবেলা গ্রন্থে। গিরীন্দ্রনাথের নাতি অবনীন্দ্রনাথ লিখেছেন—
দাদামশায়ের সখ ছিল বোটে করে বেড়ানো। পিনিস তৈরি হয়ে এল—পিনিস কি জিনিস জান, বজরা আর পানসি, পিনিস হচ্চে বজরা আর পানসির বড়ো ভাই—ভিতরে সব সিল্কের গদি, সিল্কের পর্দা, চারদিকে আরামের চূড়ান্ত।
ফি রবিবারে শুনেছি—দাদামশায় ইয়ারবক্সি নিয়ে বের হতেন--সঙ্গে থাকত খাতা পেন্সিল, ছবি আঁকার সখ ছিল, দু-একজোড়া তাসও থাকত বন্ধুবান্ধবদের খেলার জন্য। পিনিসের উপরে থাকত একটা দামামা।। দাদামশায়ের পিনিস চলতে শুরু হলেও সেই দামামা দকড় দকড় করে পিটতে থাকত। তার উপরে হাতি মার্কা নিশেন উড়ছে পতপত করে। এই তার সখ, দামামা পিটিয়ে চলতেন পিনিসে।..তার সঙ্গে প্রায়ই থাকতেন কবি ঈশ্বর গুপ্ত। অনেক ফরমাইশী কবিতাই ঈশ্বর গুপ্ত লিখেছেন সে সময়ে।...দাদামশায়ের যাত্রা করবার সখ, গান বাঁধবার সখ—নানা শাখা নিয়ে তিনি থাকতেন। তিনি বেশ একটা সৌখিনতা তৈরি করেছিলেন ঠাকুরবাড়িতে।
গণেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪১-১৮৬৯) : নাট্যশালা স্থাপন-----------------
গিরীন্দ্রনাথের ছেলে গণেন্দ্রনাথের ব্যবসায়ী বুদ্ধ ছিল ক্ষুরধার। দেবেন্দ্রনাথ তার উপরে ব্যবসাসংক্রান্ত কাজে নির্ভর করতেন। তাছাড়া শিল্প-সাহিত্য—ইতিহাসচর্চা-নাট্যাভিনয় ইত্যাদি ব্যাপারেও তাঁর বিপুল আগ্রহ ছিল। ১৮৬৬ সালে ঠাকুরবাড়ির অভিনয়ের জন্য রামনারায়ণ তর্করত্ন নবনাটক প্রকাশ করেন। সেটা ঠাকুরবাড়ির ছেলেরা মঞ্চস্থও করেন। ১৮৬৭ সালের ৬ জানুয়ারি দেবেন্দ্রনাথ একটি চিঠি লেখেন গুণেন্দ্রনাথকে। তখন দেবেন্দ্রনাথ জমিদারি কাজে কালিগ্রামে অবস্থান করছেন। তিনি লিখেছেন—
তোমাদের নাট্যশালার দ্বার উন্মুক্ত হইয়াছে—সমবেত বাদ্য দ্বারা অনেকের হৃদয় নৃত্য করিয়াছে—কবিত্বরসের আস্বাদনে অনেকে পরিতৃপ্তি লাভ করিতেছে। নির্দোষ আমোদ আমাদের দেশের যে একটি অভাব, তাহা এই প্রকারে ক্রমে ক্রমে দূরীভূত হইবে। পূর্বে আমাদের সহৃদয় মধ্যম ভায়ার উপরে ইহার জন্য আমার অনুরোধ ছিল। তুমি তাহা সম্পন্ন করিয়াছ। কিন্তু আমি তোমাকে স্নহপূর্বক সাবধান করিতেছি যে, এ প্রকার আমোদ যেন দোষে পরিণত না হয়।
দেশের মানুষের মধ্যে জাতীয় ভাবের উদ্বোধন ঘটানোর উদ্দেশ্যে আয়োজিত চৈত্র মেলা বা হিন্দুমেলার প্রধান উদ্যোক্তাদের মধ্য দ্বিজেন্দ্রনাথের সঙ্গে তিনি অন্যতম সংগঠক ছিলেন। এই হিন্দুমেলায় তখনকার কৃষি-শিল্প-সংস্কৃতির একটি প্রদর্শনী ছিল। সেখানে গ্রাম থেকে কৃষিপণ্য-হস্তশিল্পজাত সামগ্রী প্রদর্শন করা হত। এই হিন্দুমেলায় মুসলমান গায়কগণও পালাগান করতে আসতেন। কোনো অর্থেই এই চৈত্রমেলা বা হিন্দুমেলা হিন্দুত্ববাদের জিনিস ছিল না।
ঠাকুরবাড়ির সাংগীতিক ঐতিহ্যের সঙ্গেও গুণেন্দ্রনাথের যোগ ছিল। হিন্দি গান ভেঙ্গে ব্রহ্মসঙ্গীত রচনায় তিনিও প্রভুত উৎসাহ দেখিয়েছিলেন। সে সময়ে ঠাকুরবাড়িতে বড়ো বড়ো ওস্তাদরা এসে গান শোনাতেন। নামকরা যাত্রাওয়ালারা এসে অভিনয় করতেন। মেয়েরাও দেখার সুযোগ পেতেন। কালিদাসের বিক্রমোর্বশী নাটকটি গুণেন্দ্রনাথ অনুবাদ করেন। ১৮৮৬ সালে এই নাটকটি প্রকাশিত হয়।
বড়োবাবু দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪০-১৯২৬) : অনেকের মধ্যে একা একজন-------------------------
দ্বিজেন্দ্রনাথের অল্প বয়সের ঝোঁক ছিল কাব্য রচনা ও ছবি আঁকায়। ১৮৬০ সালে কুড়ি বছর বয়সে তিনি কালিদাসের মেঘদূতের পদ্যোনুবাদ করেন। এরপরই দর্শনের ত্ত্ত্বানুসন্ধানে তিনি মনোযোগী হয়ে পড়েন। তার স্মৃতি কথা থেকে সে সময়ে ঠাকুরবাড়ির একটি চেহারা পাওয়া যায়—
পূজার সময়ে আমাদের বাড়িতে যে উৎসব দেখিয়াছি, সে রকম উৎসব পরে আর কখনো দেখি নাই। বোধ হয় আমাদের প্রতিমা দেশের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর হইত। পূজার অনেক আগে হইতেই আমাদের বাড়িতে দর্জি বসিয়া যাইত, জহুরীর আগমণ হইত। দর্জী ও জহুরী মিলিয়া বাড়ির সকলের পোষাক-পরিচ্ছদ অলঙ্কারাদি প্রস্তুত আরম্ভ করিত। গৃহ-প্রাঙ্গণে যে যাত্রা প্রভৃতির আযোজন হইত, তাহাতে যোগদান করিবার অধিকার আপামর সাধারণ সকলের ছিল। দরজা বন্ধ করিয়া পাহারা রাখিয়া, কাহাকেও প্রবেশ করিতে না দেওয়া অত্যন্ত গর্হিত বলিয়া বিবেচিত হইত। ধনী গৃহস্থের বাড়ির পূজার আয়োজনে কেবল মাত্র সেই পরিবারের নিমন্ত্রিত নির্দিষ্ট সংখ্যক আত্মীয় বন্ধু বান্ধবের জন্য করা হইত না। প্রত্যেক গৃহস্থের পূজার উৎসব একটা বৃহৎ সামাজিক উৎসব ছিল। সমাজের ছোট-বড় সকলেই অবাধে সে উৎসবে মাতিয়া উঠিত। আমার পিতৃদেব ব্রাহ্মধর্মানুরাগ বশতঃ পূজার সময় বাড়ি থাকিতেন না। তিনি কিন্তু আগে হইতেই বিদেশ পর্যটনে বাহির হইতেন।
তাঁর সময়েই ঠাকুরবাড়িতে নাটক রচনা, অভিনয় ও আনন্দমুখর সঙ্গীত ধ্বনিত পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ তখন বেশ ছোটো। দূর থেকে এসবই দেখতে পেতেন।
সমীর সেনগুপ্ত লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথের শিশুকালে তাদের বাড়িতে তিনটি ধারা দেখা যায়। প্রধান ধারাটি হল জনপ্রিয়, সঙ্গীত-নাটক-প্রমুখ কোলাহল মুখরিত যৌথ আনন্দোৎসবের ধারা। দ্বিতীয়টি হল—পাঠকক্ষে নির্জনে বসে জ্ঞানচর্চার ধারা। তৃতীয়টি হল বুদ্ধিনির্ভর, বিবর্তনকামী, জ্ঞানাশ্রয়ী ভক্তিবাদের ধারা। এই ভক্তিবাদের ধারাটি আদি ব্রাহ্মসমাজের নিরাকার ব্রহ্মোপসনার মধ্যে দিয়ে বিকশিত হয়েছিল দেবেন্দ্রনাথের নেতৃত্ব।
দ্বিজেন্দ্রনাথ এর মধ্যে থেকেও থাকেননি। একা বসে তত্ত্ব জ্ঞান, গণিতচর্চা আর ছড়া লিখে দিন কাটিয়েছেন। বাংলা শর্টহ্যান্ড লিখনপদ্ধতির প্রবর্তন করেন। রবীন্দ্রনাথ বড়োদাদা বিষয়ে লিখেছেন—গান গাইতে পারতেন না, বিলিতি বাঁশি বাজাতেন। সমাজের নির্দিষ্ট করে দেওয়া রীতিনীতি থেকে ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দকে মূল্য দেওয়ার ধারণাটাও তাঁর মধ্যে প্রবলভাবে ছিল। সামাজিক অনুশাসনের প্রতিবাদ হিসাবে চিন্তাজগতে ব্যক্তিমানসের অভ্যুত্থান ঘটানো ছিল রেনেসাঁর মূল কথা। দ্বিজেন্দ্রনাথ ব্যক্তিগতভাবে এই ধারারই অনুসারী ছিলেন।
১৮৭৫ সালে মেজ ভাই সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে বিদ্বজ্জনসমাগম সভার প্রথম অধিবেশনটি বসিয়েছেন তিনি। তৎকালীন বাংলার বিদ্বজ্জনেরা ঠাকুরবাড়িতে ঘোরাফেরা করছেন। বিদ্বজ্জনসমাগম সভার উদ্দেশ্য ছিল—সাহিত্যসেবীদের মধ্যে পরস্পর আলাপ-পরিচয় ও তাঁহাদের মধ্যে সদ্ভাব বাড়ানো। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনস্মৃতিতে লিখেছেন—এই উপলক্ষে অনেক রচনা ও কবিতাদিও পঠিত হইত, গীতবাদ্যের আয়োজন থাকিত, নাট্যাভিনয়ও প্রদর্শিত হইত এবং সর্ব্বশেষে সকলের একত্র প্রীতিভোজনের মধ্যে দিয়ে এই সাহিত্য-মহোৎসবের পরিসমাপ্তি হইত। বছরে একবার এই সভার অধিবেশন হত। দ্বিতীয় অধিবেশনে বালক রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির খেদ নামে একটি কবিতা পড়েছিলেন। তখন ভারতী নামে একটি পত্রিকা বের হয়েছে দ্বিজেন্দ্রনাথের সম্পাদনায়। রচনা করছেন বেশ কিছু ব্রাহ্মসঙ্গীতও। ১৯২১ সালে তিরি গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলনের সমর্থক হয়ে উঠেছেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এই অসহযোগ আন্দোলনকে সমর্থন করতে পারেননি। এখানে দাদার সঙ্গে তাঁর ভাবনার পথটি আলাদা হয়ে গেছে।
পশুপাখির প্রতি দ্বিজেন্দ্রনাথের ছিল বড়ো ভাব। সুধাকান্ত চৌধুরী লিখেছেন—
দূর থেকে তাকিয়ে দেখলাম দক্ষিণের বারান্দায় বড়োবাবু তাঁর চেয়ারে বসে আছেন, তাঁর সামনে একটি টেবিল পাতা। সেই টেবিলের উপরে ছিল দুই একটি ছোটো ছোটো প্লেট। দূরের থেকে দেখতে পাইনি সেই প্লেটগুলিতে কী আছে। তবে দেখলাম অই টেবিলের উপরে তিন-চার রকমের পাখি ঠোকর দিয়ে প্লেট থেকে কি সব খাচ্ছে। দেখলাম একটা গাছের থেকে দুটো কাঠবিড়ালী দৌঁড়ে গিয়ে বড়ো বাবুর চেয়ার বেয়ে টেবিলের উপরে লাফ দিয়ে উঠছে। তাদের বড়োবাবু বিস্কুটের মতো কী একটা পদার্থ ভেঙে ভেঙে দিচ্ছেন। তারা পেছনের দুই পায়ে বসে সামনের দু-পা দিয়ে ধরে যেন ছোটো ছোটো হাত দিয়ে ধরে সেই খাবার খাচ্ছে। পাখিগুলোও কী সব খাচ্ছে—এরা হল সকালবেলায় বড়োবাবুর প্রাতরাশের সময়ের মজলিশের সভ্যবৃন্দ।
তিনি বাংলা গানের প্রথম স্বরলিপি তৈরী করেন। এটাকে পরে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ পূর্ণরূপ দেন। তিনি সাঁতাশটি বই লিখেছেন। আত্মজীবনীতে দ্বিজেন্দ্রনাথ লিখেছেন—
আমি অনেক লিখিয়াছি; এই লেখাপড়া ছাড়া আমি আর জীবনের বড়ো একটা কিছুই করিতে পারিতে পারিলাম না। কখনো আমি বিষয়কর্ম ভালো করিয়া বুঝিতে পারিতাম না—বাবা ইদানিং আমাকে কোনও বিষয়কর্মে থাকিতে দিতেন না। দ্বিজেন্দ্রনাথ জমিদারী দেখেছিলেন মাত্র মাসখানেক। এর মধ্যে আবার তিনি সাহজাদপুরেও গিয়েছিলেন। সেখানে নিজের উদ্যোগে প্রজাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের সুখ দুঃখের খোজ খবর নিয়েছেন। তাদের খাজনা মউকূপের প্রস্তাব করছেন। এ ঘটনায় আমলারা বেশ মুশকিলে পড়ে গিয়েছিল। আর তখন তখুনি তাকে বাদ দিয়ে তার ছেলে দ্বিপেন্দ্রনাথকে জমিদারী দেখার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। দ্বিপেন্দ্রনাথ পাঁচ বছর জমিদারি পরিচালনা করেন। এর পরে রবীন্দ্রনাথ জরিদারি পারিচালনার ভার পান।
সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর : বিলেতি হাওয়া------------------------------------
সেকালে জোঁড়া সাঁকোর ঠাকুরবাড়ি ছিল একান্নবর্তী পরিবার। পাঁচ ও ছ নম্বর বাড়ি মিলিয়ে বিশাল বাড়ি। সত্যন্দ্রনাথের বাল্যকালে বাড়িটা ভাগ হয়ে যায়। ভাগ হওয়া আগে থেকেই হিন্দুত্বের সঙ্গে ব্রাহ্মধর্মের বিরোধ জেগে উঠেছে দেবেন্দ্রনাথের মতো তাঁর ছেলেমেয়েদের মধ্যেও। নয় বছর বয়সের একটি স্মৃতি বলছেন দেবেন্দ্রনাথের মেজো ছেলে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ‘এক সময়ে আমাদের বাড়ি সরস্বতী পূজা হত। মনে আছে একবার সরস্বতী পূজার অর্চনায় গিয়েছি—শেষে ফিরে আসবার সময় আমার হাতে যে দক্ষিণার টাকা ছিল তাই দেবীর পায়ের উপরে সজোরে নিক্ষেপ করে দে ছুট। তাতে দেবীর মুকুট ভেঙে পড়ল।
ছেলেবেলার বর্ণনা দিয়েছেন—ছেলেবেলায় আমাদের ব্যায়ামচর্চার অভাব ছিল না। ভোরে উঠে জোড়াসাঁকো থেকে গড়ের মাঠ বরাহনগর প্রভৃতি দূর দূর পাল্লা পদব্রজে বেড়িয়ে আসতুম।..তা ছাড়া ঘোড়ায় চড়া, সাঁতার দেওয়া এসব ছিল।...হীরা সিং বলে একজন পালোয়ানের কাছে আমরা কুস্তি শিখতাম। রবীন্দ্রনাথকেও কুস্তি শিখিয়েছিলেন এই হীরা সিং। সংস্কৃত শেখাতে আসতেন বাণেশ্বর বিদ্যালংকার। এর মধ্যে আরবী সাহিত্যেও বেশ বুৎপত্তি লাভ করেছেন।
১৮৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে প্রথম বিভাগে পাশ করেন। তার সঙ্গে আরও পাশ করেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় এবং কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য। প্রেসিডেন্সী কলেজে পড়ার সময় ব্রাহ্মধর্মের প্রতি তিনি আকৃষ্ট হন। তার সহপাঠী ছিলেন কেশবচন্দ্র সেন। দেবেন্দ্রনাথ কেশবচন্দ্র সেনের সঙ্গে পরিচিত হন সত্যেন্দ্রনাথের মাধ্যমে। কেশবচন্দ্র সেনকে তার বাড়ির লোকেরা হিন্দু লোকাচার না মানার জন্য অত্যাচার করছিল। এ কারণে তিনি জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কেশব চন্দ্রের প্রভাবে সমাজ এক নতুন মূর্তি গ্রহণ করেছিল। সত্যন্দ্রনাথও সেই কর্মকাণ্ডে মেতে উঠেছিলেন। এ সময়ই দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্মসমাজের বেদি থেকে হৃদয়ভেদী প্রার্থনা আর উপদেশ দিচ্ছেন। আর ঠাকুরবাড়ির সবাই গান লিখছেন। গানে সুর দিচ্ছেন ব্রাহ্মসমাজের সভাগায়ক বিষ্ণু চক্রবর্তী। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের প্রথম সঙ্গীত গুরু। তিনি ৬০০ ব্রাহ্মসঙ্গীতের সুর করেছিলেন। গানের সারল্যের আদর্শটি রবীন্দ্রনাথ বিষ্ণু চর্কবর্তীর কাছ থেকেই শিখেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ যে বছর জন্মেছিলেন সে বছরই তাঁর বড়ো দিদি সুকুমারীর বিয়ে হয়েছে হিন্দুপদ্ধতির বদলে ব্রাহ্মধর্মানুসারে। এটা ছিল তৎকালীন ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার বিরুদ্ধে বড়ো ধরনের বিদ্রোহ। ঠাকুর পরিবার আবার একঘরে হয়েছিল এ কারণে। ব্রাহ্মমত ধীরে ধীরে তাত্ত্বিক রূপ থেকে আনুষ্ঠানিক ধর্মমতের চেহারা পেয়েছে। পৌত্তিলকতার বিরুদ্ধেওতাদের বিদ্রোহ সমাজে জায়গা করে নিচ্ছে।
সত্যেন্দ্রনাথ তাঁদের বাড়ির ছোটো ছোটো ভাই বউদের ঘোমটা খুলে দিতেন। নারী স্বাধীনতার জন্য মেতে উঠেছেন। বাবার মতানুসারে জ্ঞানদানন্দিনী দেবীকে বিয়ে করেন ১৮৫৯ সালে। তিনি বিলেতে স্ত্রীকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু বাবা দেবেন্দ্রনাথ সে অনুমতি দেননি। ১৮৬৩ সালে ইংলণ্ড থেকে আইসিএস পাশ করেন। তাঁর পোস্টিং হল আমেদাবাদে অ্যাসিস্টেন্ট কালেক্টর ও ম্যাজিস্ট্রেট পদে বোম্বাই প্রদেশ। তাঁর প্রভাবে তারপর থেকেই ঠাকুরবাড়িতে বিলেতের ছোয়া লাগল। বোম্বাই প্রদেশের অভিজ্ঞতা নিয়ে তারা সর্বভারতীয় ভাবনার উন্মেষ ঘটতে শুরু করেছিল। দেবেন্দ্রনাথ অন্তঃপুরের রক্ষণশীলতার প্রাচীর বিন্দুমাত্র ফাঁটল ঘটাতে রাজি ছিলেন না। তাঁর প্রচেষ্টা ছিল শুধুমাত্র ধর্মসংস্কারের প্রতি। কিন্তু বাড়ির মধ্যে সেই রক্ষণশীলতার প্রাচীর ভেঙে দিয়েছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ ও তার স্ত্রী জ্ঞানদান্দিনী দেবী। ভেঙে দিয়েছিলেন তারা পর্দাপ্রথা ।
কিছুদিন পরে সত্যেন্দ্রনাথ স্ত্রীকে পুরনো নিয়ম ভেঙে বাড়ির বাইরে বের করে নিয়ে গেলেন বোম্বাইতে। তিনি লিখেছেন, ‘জাহাজে করে যেতে হবে। বাবামহাশয় তাতে কোনো কোনো উচ্চবাচ্য করলেন না। এখন কথা হচ্ছে ঘাটে উঠা যায় কী করে? গাড়ি করে তো যাওয়া চাই। আমি প্রস্তাব করলুম বাড়ি থেকেই গাড়িতে ওঠা যাক। কিন্তু বাবামহাশয় সম্মত হলেন না। বললেন মেয়েদের পালকি করে যাবার যে নিয়ম আছে তাই রক্ষা হোক।‘ অসূর্যম্পশ্যা কুলবধূ কর্মচারীদের চোখের সমানে দিয়ে বাহির বাড়ির দেউড়ি ডিঙিয়ে গাড়িতে উঠবেন, এ তাঁর কিছুতেই মনঃপুত হল না। সুতরাং গাড়িতে নয়—সত্যেন্দ্রনাথের স্ত্রীকে গাড়িতে নয় পালকীতে করে জাহাজঘাটায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
...তখন অন্তঃপুরে অবরোধপ্রথা পূর্ণমাত্রায় বিরাজমান। তখনো মেয়েদের একই প্রাঙ্গণের এ বাড়ি হইতে ও বাড়ি যাইতে হইলে ঘেরাটোপ মোড়া পালকীর সঙ্গে প্রহরী ছোটে, তখনো নিতান্ত অনুনয় বিনয়ে মা গঙ্গাস্নানে যাইবার অনুমতি পাইলে বেহারারা পালকী সুদ্ধ তাঁহাকে জলে চুবাইয়া আনে।
সত্যেন্দ্রনাথের ছেলে সুরেন্দ্রনাথের জন্ম হয় ১৮৭২ সালে। মেয়ে ইন্দিরা দেবীর জন্ম হয় এক বছর পরে। তখন তাঁদের ধাত্রীমা রাখা হয়েছিল এক মুসলমান মহিলাকে। ইন্দিরা দেবী লিখেছেন—‘আমি তো মুসলমানীর দুধ পর্যন্ত খেয়েছি’।. অথচ মুসলমানের খাদ্যের ঘ্রাণ নাকে আসায় ঠাকুর পরিবারের পূর্বপুরুষের জাত গিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ সত্যেন্দ্রনাথের কাছে বারবার গেছেন তাঁর কর্মস্থলে। পারিবারিক বিষয়াদিতে পরামর্শ নিয়েছেন। মেজোবৌঠানের সঙ্গে তাঁর মধুর সম্পর্ক হয়েছে। তারা তাঁকে বিলেতেও নিয়ে গেছেন। বিলেতি কেতা শেখার ব্যবস্থা করেছেন। তাঁর স্ত্রী মৃণালিনী বালিকা বধু বলে সন্তানসহ মৃণালিনী দেবীকে জ্ঞানদানন্দিনী তার হেফাজতে রেখেছেন।
জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর সম্পাদনায় বালক পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন এই পত্রিকার প্রদান লেখক। তিনি ফটোগ্রাফীর চর্চাও করতেন। তিনিই প্রথম সাড়ির নিচে পায়জামা পরা, সায়া পরা, জামা পরা ও বম্বে ধরনের সাড়ি পরা ঠাকুর পরিবারে প্রচলন করেন। তারপর বাংলায় এই পদ্ধতি প্রচলিত হয়। তারাই বঙ্গে বাঙ্গালীদের মধ্যে জন্মদিন পালন প্রথার চালু করেন। বেশ কিছু বইও লেখেন তিনি।
চাকরি শুরুর দুবছর পরে সত্যেন্দ্রনাথ বিচার বিভাগে চলে যান। ৩৩ বছর চাকরী করে অবসর নেন ১৮৯৭ সালে। তখন ছিলেন সাতারা জেলার ডিস্ট্রিক্ট অ্যান্ড সেসন জজ। অবসর নিয়ে কোলকাতায় বসবাস শুরু করলেন জোড়াসাঁকোর বাইরে আলাদা বাসা নিয়ে। তাঁদের বাড়িতে কলকাতার ধনী অভিজাত সমাজের অনেকেই আগমন করতেন। বিশেষ করে তরুণদের আগমন ছিল চোখে পড়ার মত। তাঁর রূপসী ও বিদূষী কন্যা ইন্দিরা দেবী এইসব সভায় উপস্থিত থাকতেন। রবীন্দ্রনাথের খুব স্নেহের কলকাতায় এসেই সত্যেন্দ্রনাথ বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে যুক্ত হন। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সঙ্গেও তিনি জড়িয়ে পড়েন। তিনি নিজে জমিদারী দেখেন নি কখনো। তার ছেলে সুরেন্দ্রনাথ জমিদারীর কাজের দায়িত্ব নিয়েছিলেন দেবেন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরে ১৯০৫ সালে। তার অবিবেচনার কারণে জমিদারিতে প্রচুর দেনা হয়ে যায়। ফলে ঋণ করতে হয়েছিল।
সত্যেন্দ্রনাথ নয়টি বাংলা ও তিনটি ইংরেজি গ্রন্থ রচনা করেন। সেসবের মধ্যে সুশীলা ও বীরসিংহ নাটক (১৮৬৭), বোম্বাই চিত্র (১৮৮৮), নবরত্নমালা, স্ত্রী স্বাধীনতা, বৌদ্ধধর্ম (১৯০১), আমার বাল্যকথা ও বোম্বাই প্রয়াস (১৯১৫), ভারতবর্ষীয় ইংরেজ (১৯০৮) ইত্যাদি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করে। এছাড়াও তার কৃত তিলকের ভগবদ্গীতাভাষ্য, (কালিদাস) এর মেঘদূত এবং তুকারামের অভঙ্গের অনুবাদ সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। তিনি বেশকিছু ব্রহ্মসঙ্গীত ও দেশাত্মবোধক গানও রচনা করেন এবং কিছুকাল তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা সম্পাদনা করেন।
১৯২৩ সালের ৯ জানুয়ারি তার মৃত্যু হয়।
লিংক ------------------------
রবীন্দ্রনাথের জমিদারগিরি—জমিদারের রবীন্দ্রগিরি : একাদশ পর্ব :
বারটি পর্ব একসঙ্গে পড়ার লিংক
মন্তব্য
এই পরিবারের সকলেরই নাম কিছুইন্দ্রনাথ ঠাকুর। পড়তে পড়তে গুলিয়ে ফেলি কেডা মূলইন্দ্রনাথ ঠাকুরের কী
ব্রাকেটে যদি দিয়ে দিতেন (রবীন্দ্রনাথে ভাই কিংবা কাকা) তাহলে পড়তে একটু সুবিধা হয়
আসলেই তা-ই !!
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
নতুন মন্তব্য করুন