কুলদা রায়
এমএমআর জালাল
রবীন্দ্রনাথের জন্মের কাল
---------------
ঠাকুরবাড়ির আঙিনার আলো-------------------------------------------
ইংরেজদের শাসনের একশো বছর পূর্তি হয় ১৮৫৭ সালে। এ বছরই সিপাহী বিদ্রোহ ঘটে। ইংলন্ডের মহারানী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হাত থেকে শাসনভার নিয়েছেন। ১৮৫৮ সাল থেকে পরিবর্তনের কাল শুরু হয়েছে।
এর পঞ্চাশ বছর আগে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। নামে কিন্তু কলেজ হলেও সুনিয়ন্ত্রিণ ছিল ইংরেজদের হাতে। কলেজটি ইংরেজি শিক্ষা বিস্তারে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। ১৮৫৭ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। বিধবা বিবাহ পাশ হয়েছে ১৮৫৬ সালে।
দেবেন্দ্রনাথের তত্ত্ববোধিনী সভা ব্রাহ্মসমাজে রূপান্তরিত হয়ে ধর্মআন্দোলনে পরিণত হয়েছে। কেশবচন্দ্র সেন মশাই এই আন্দোলনকে নবপ্রাণ দিচ্ছেন।
বাংলা সাহিত্য জগতে বিরাট পরিবর্তন হচ্ছে। বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্য লিখতে শুরু করেছেন। প্যারীচাঁদ মিত্র আলালের ঘরের দুলাল লিখে বাবুদের ফুঁটো করে দিয়েছেন। নাটক লিখছেন রামনারায়ণ তর্কালঙ্কার—দীনবন্ধু মিত্র—মাইকেল মধুসূদন দত্ত।
উনবিংশ শতাব্দির প্রথমার্থে ইংরেজদের সাহচর্যে ও ইংরেজীসাহিত্যর হাত ধরে বাংলার স্রোতহীন জীবনে এক আলোড়ন এসেছিল। দিয়েছিল ভিন্ন ধরনের দৃষ্টিভঙ্গী। উনবিংশ শতাব্দির দ্বিতীয়ার্ধে নানা দ্বন্দ্ব-সংঘাতে দেশীয় ভাবধারা মিলিত হয়ে এক বিমিশ্র সংস্কৃতির উদ্ভব হয়। উনিশ শতকের প্রথম পঞ্চাশ বছর বিদেশী চিন্তাভূমির কর্ষণযন্ত্র দিয়ে বাঙালির মানসভূমি বিদেশী সাহিত্যের ভাবরসে কর্ষিত হয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে এসে সেই কর্ষিত ভূমিতেই বীজ বপন করে রাজনীতি শিক্ষা সমাজ ধর্ম ও সাহিত্য সর্বক্ষেত্রেই বাংলা তখন ফসল ফলানো শুরু করেছে। বাংলা তখন এক নতুন সভ্যতার দরোজায় পৌঁছে গেছে।
গোটা উনিশ শতক ধরেই কোলকাতার ঠাকুর পরিবার ব্যবসা বানিজ্য ও ইংরেজদের চাকরির বদৌলতে সমাজে সম্পদ, সামাজিক সম্মান ও প্রতিপত্তির সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছেছিল। দ্বারকানাথের সময়ে গেছে তা চূড়ান্ত সীমায়। দেবেন্দ্রনাথের সময় থেকে সেসব হারিয়ে কেবল জমিদারিনির্ভর এক উচ্চবিত্ত পরিবার হিসাবে পরিগণিত হয়েছিল।
এই আর্থিক অবনতির সঙ্গে সঙ্গে ঠাকুরবাড়ির পূজা অর্চনার অনুষ্ঠান ধর্মকর্মও বদলে গেছে। দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করায় সব ধরনের পৌত্তলিকতা বর্জন করেন। ঠাকুরবাড়ির বিখ্যাত দুর্গাপূজা উঠে যায়। দ্বারকানাথের শ্রাদ্ধ পুরোপুরি হিন্দুধর্মঅনুসারে না করায় দেবেন্দ্রনাথকে আত্মীয়স্বজন ত্যাগ করেন। এইসব কারণে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের বদলে ঠাকুর পরিবার বেছে নেন কিছু অসাম্প্রদায়িক আচার অনুষ্ঠান—মাঘোৎসব, বর্ষশেষ, নববর্ষ ইত্যাদি। এই অনুষ্ঠানগুলোতে যোগ দেন অনাত্মীয়-- অন্যপথের লোকজন।
সে সময় ধনী পরিবারে বাংলাভাষার বদলে ইংরেজি ভাষাই আদরণীয় ছিল। ঠাকুর পরিবারে ইংরেজি ভাষার বদলে বাংলা ভাষায় কথা বার্তা বলা, চিঠিপত্র লে ও লেখাপড়াও বাংলাভাষায় প্রচলন হয়। এই বাংলাভাষা ঠাকুরবাড়ির ভাষা নামে পরিচিত হয়েছিল। তারা বেশভূষা, আদবকায়দা ও চালচলেনও স্বতন্ত্র হয়ে উঠেছিল। এইভাবে তারা অর্থবিত্তের বদলে সাংস্কৃতিক অভিজাত্য অর্জন করেছিল।
ঠাকুরপরিবারের দ্বারকানাথ ইউরোপে গিয়েছিলেন। তার ছেলে দেবেন্দ্রনাথ নিজে না গেলেও তার ছেলে-আত্মীয়স্বজনরা লেখাপড়ার উদ্দেশ্য ইংলন্ড যাওয়া শুরু করেছেন। ইউরোপীয় শিল্প সাহিত্য দর্শন তারা আত্মস্থ করলেও দেবেন্দ্রনাথের উপনিষদের মাধ্যমে গভীরভাবে প্রাচীনভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। চৈত্রমেলা বা হিন্দুমেলার সঙ্গে সঙ্গে বাংলার লোকসস্কৃতির সঙ্গেও তাদের পরিচয় ঘটেছে। ঠাকুরবাড়িতে যাত্রা পালাগান বাউলগানের আসর বসেছে। আবার বিষ্ণ চক্রবর্তী নিধুবাবু রূপচাঁদপক্ষীদের ছড়া কালোয়াতি আখড়াই গানের প্রবেশ ঘটেছে।
ঠাকুরবাড়িতে আশ্রিত দরিদ্র আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে, বাড়ির চাকর মহলের মাধ্যমে রূপকথা লোককথা পাঁচালিগানেরও অবাধ প্রবাহ ছিল। এই সকলের মেলবন্ধনে ঠাকুরবাড়িতে পুরনোর সঙ্গে নতুনের সহযাত্রা ঘটেছে। বৈচিত্র্যের সঙ্গে বিরোধ নয়-- ঐক্যের জয়ধ্বনী ঘোষিত হয়েছে। ফলে শুধু শিল্প সংস্কৃতির মত মানসপরিবর্তন নয়—ব্যবসা জমিদারীর ক্ষেত্রেও তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গিতে এই পরিবর্তনের পালা শুরু হয়েছে। ফলে দেখা যায়—দ্বারকানাথের পরবর্তি প্রজন্ম আর ব্যবসায়ে সিদ্ধি লাভ করতে পারেন নি। নতুন করে জমিদারী-বিত্তবেসাত বাড়াতে পারেননি। কিন্তু মানবচিত্তবিদ্যায় তাঁদের পূর্বপুরুষকে টপকে গেছেন।
শেকসপীয়র ওয়ালস্কট প্রভৃতি ইংরেজ লেখকদের পাশাপাশি ঠাকুর পরিবার ফরাসী কাব্যসাহিত্যের দিকেও হাত বাড়িয়েছেন। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ চিন্তা ও সৃষ্টির সঙ্গে তারা পরিচিত হয়ে আত্মস্থ করেছেন। স্বদেশী সাহিত্যকে নব নব ভাবসম্পদে ও সৌন্দর্য পূর্ণ বিকশিত করেছেন। ঠাকুরবাড়িতে নিয়মিত এসেছেন সেসময়কার প্রখ্যাত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার দত্ত, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, মাইকেল মধুসুদন দত্ত, রাজনারায়ণ বসু প্রমুখ। রবীন্দ্রনাথের জন্মের আগেই ঠাকুরবাড়ির পরিবেশে সাহিত্যরসের সৃজনশীল ধারা পূর্ণমহিমায় প্রবাহমান ছিল।
রামমোহনের সময় থেকেই ব্রাহ্মধর্মসমাজে উপসনার অঙ্গ হিসাবে সঙ্গীতকে গ্রহণ করা হয়েছিল। দেবেন্দ্রনাথ কৃষ্ণ ও বিষ্ণু চক্রবর্তী নামে দুজন বেতনভোগী গায়ক ব্রাহ্মসমাজের গান গাইতেন এবং গানের সুর দিতেন। রামমোহন, দেবেন্দ্রনাথ, দ্বেজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ, গণেন্দ্রনাথ অনেক হিন্দি গান গান ভেঙ্গে বাংলায় ব্রাহ্মসঙ্গীত রচনা করেছেন। একা বিষ্ণু চক্রবর্তী ৬০০ গানের সুর দিয়েছেন। ঠাকুরবাড়িতে যদু ভট্ট গান শেখাতেন। দ্বারকানাথ নিজেও ইউরোপীয় সঙ্গীত শিখেছিলেন। সঙ্গীতের এই ধারা পরবর্তী প্রজন্মে সঞ্চালিত হয়েছে। এবাবে দেখা যায় ঠাকুরবাড়িতে বিশুদ্ধ সঙ্গীতের একটি পরিবেশ গড়ে উঠেছিল।
চিত্রবিদ্যারও বাড়িতে স্বাভাবিক ও সহজ চর্চা ছিল। গুণেন্দ্রনাথ, গগণেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রখ্যাত শিল্পী ছিলেন। তাদের ধারাবাহিকতায় গগনেন্দ্রনাথের পুত্র অবনীন্দ্রনাথ ভারতের শ্রেষ্ঠ শিল্পী ছিলেন। এছাড়াও হিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও সহজাত শিল্পপ্রতিভা ছিল। এরা সবাই মিলে বাংলার শিল্পচর্চার ধারাটাই পাল্টে দিয়েছিলেন।
ঠাকুরবাড়ির ঘরগেরস্থালি--------------------
পিরালী ব্রাহ্মণ হওয়ায় জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে অভিজাত বা কুলীন ব্রাহ্মণেরা বিবাহসম্পর্ক করত না। ফলে তাঁদের নিজস্ব পিরালী ক্ষুদ্র গণ্ডীর মধ্যেই বিয়েসাদি হত। খুলনা-যশোর এলাকায় পিরারী থাক থাকায় এখান থেকে গরীব ঘর থেকে পাত্রী আনা হত। ফলে বিয়ের পরে এই গরীব আত্মীয়স্বজনদের আশ্রয় হত ঠাকুরবাড়িতে। তাদের ভরণপোষণেরও দ্বায়িত্ব নেওয়া হত। দেওয়া হত চাকরীবাকরী। ঠাকুর বাড়ির সেরেস্তায় বা অন্যত্র কাজকর্ম করত। এরকম কজনের নামও পাওয়া যাচ্ছে। জ্যোতি, গুপি, পচা ও পুঁটে। জ্যোতি বাজার করত। গুপি দুধ দোহাত। পচা ও পুঁটে পাই ফরমাস খাটত। ছেলেদের সঙ্গে খোসগল্প করত। তাদের বউয়েরাও মাঝে মাঝে এসে থাকত। আবার দেশগাঁয়েও যেত বিষয়সম্পত্তি দেখার জন্য।
ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার জন্য যেসব পাত্র যোগাড় করা হত পেঁয়াজ খাওয়া ব্রাহ্ম শ্বশুরের কারণে তাদের জাত যেত। ফলে তাদেরকে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত করে ঘরজামাই করে রাখা হত। এভাবে ঠাকুরবাড়িতে এই আশ্রিত লোকজনেরা শাখাপ্রশাখা মিলে রীতিমত একটি কলোনীতে রূপান্তরিত করে ফেলেছিল।
ঠাকুরবাড়ি ছিল একান্নবর্তী পরিবার। ধান আসত জমিদারী থেকে। গোলাবাড়িতে মজুত হত। ঢেঁকিশালে ভানা হত। রান্না হত এজমালি মাইনে করা ঠাকুরের হাতে। রান্নার মধ্যে ডাল, সবজি, মাছ, মাংস অন্তর্ভুক্ত ছিল। রবীন্দ্রনাথের নদিদি স্বর্ণকুমারীর মেয়ে সরলাদেবী স্মৃতিচারণ করেছেন—
আমি যখন প্রায় পাঁচ বছর বয়সে (১৮৭৭ সাল) জন্মপুরীতে ফিরে এসে তার হাওয়ায় মানুষ হতে লাগলাম, তখন সে পুরী জমজম গমগম করছে। প্রতি মহলে মহলে ঘরে ঘরে লোক। কর্তাদাদা মহাশয়ের (দেবেন্দ্রনাথ) ছেলে মেয়ে, জামাই-বউ, নাতি-নাতনি, দাসদাসীতে বাড়ি ভরা। সে বাড়ির রান্নাঘরে দশ-বারজন বামুন ঠাকুর ভোর থেকে রান্না চড়ায়। সে প্রকাণ্ড রান্নাঘরের দুপাশে ভাগ করা মেঝেতে পরিস্কার কাপড় পেতে ঢালা হয়। সে ভাত স্তুপাকার হয়ে প্রায় কড়িকাঠ স্পর্শ করে। তারই পরিমাণে ব্যঞ্জনাদি প্রস্তুত করে দিনে সেই ভাতব্যঞ্জন ও রাত্রে লুচিতরকারি—লোক গুণে গুণে পাথরের থালাবাটিতে সাজিয়ে মহলে মহলে ঘরে ঘরে দিয়ে আসে বামুনেরা।
...ঘরে ঘরে বামুনেরা যে খাবার দিয়ে যেত সেটা হল সরকারি রান্নাঘরের যোগান, এর উপরে ছিল প্রতি মহলে তোলা উনুনে গিন্নিদের নিজের নিজের রুচি ও স্বামীর ফরমান অনুযায়ী বেসরকারি বিশিষ্ট রান্না আলাদা করে হত।‘ তখন দিনে ১৩০ লিটার দুধ আসত। তখন টাকায় ছসের করে দুধ। সামনে এসে দুইয়ে দিয়ে যেত গয়লারা। সে দুধে পুরো বন্যা বয়ে যাওয়ার মতো ব্যাপার।
রবীন্দ্রনাথের জন্মকালে কোলকাতা-----------------
জোড়াসাঁকোর বাড়িটি ছিল কোলকাতার চিৎপুর রোডে। এটা ছিল আধা শহুরে আধা গ্রাম্য। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন-তখন শহর এবং পল্লী অল্পবয়সের ভাইভগিনীর মতো অনেকটা এরকম চেহারা লইয়া প্রকাশ পাইত।
তখন চিৎপুর রাস্তায় মেঘ কল্লে কাদা হয়। ধুলো উড়িয়ে স্যাকড়া ড়াড়ি চলে। ঘোড়ার গাড়ির চালায় হাড়জিরজিরে ঘোড়া। তার পিঠে চাবুক পড়ে। বাসগাড়ি-রেলগাড়ি কখনো আসে নি।
তখন কোলকাতার লোকজন খুব ঢিলেঢালা। কাজের চাপ খুব বেশী ছিল না। কেরানী বাবুরা তামাক খেয়ে পান চিবুতে চিবুতে আফিসে যেতেন। পালকী বা ভাড়াগাড়ি তাদের নিয়ে যেত। টাকাওয়ালা বাবুদের জন্য ছিল তকমা আঁকা গাড়ি। বক্সে পাগড়ীপরা কোচম্যান। পিছনে দুজন সহিস। তারা পথচারী দেখলেই হেঁইয়ো হেঁইয়ো বলে পিলে চমকে দিত। মেয়েদের ঘরের দরোজা দরজা বন্ধ। বাইরের দরোজাও বন্ধ। গাড়িতে চড়া ছিল লজ্জার। আর কেউ যদি মেয়েদের পা, মোজা বা সেমিজ দেখে ফেললে লজ্জার শেষ নেই। তবু বাবুদের মেয়েরা পালকীতে চেপে কখনো কখনো বাইরে যেত। পালকীর চারিদেকে মোটা কাপড় দিয়ে ঘেরা থাকত। পালকীর ভেতরটা অন্ধকার। গুমোট। তাকে কেউ দেখতে পেত না। সেও কাউকে দেখত পেত না। এই পালকীটাকে চলমান গোরস্থানের মত দেখতে ছিল। এদের পাশে পাশে পাহারাদার হিসাবে দেওয়ানজীরা চলত। তাদের মোটা গোঁফ। মাথায় পাগড়ী। হাতে পিতলে বাঁধানো লাঠি। এই পাহারাদাররা ব্যাংকে বাবুদের সঙ্গে যেত। কুটুমবাড়িতে মেয়েদের পৌঁছে দিত। আর পূজাপার্বনের দিনে বাড়ির গিন্নিকে গঙ্গাতে পালকীশুদ্ধ চুবিয়ে আনত। এটা তাদের গঙ্গা স্নান। আর ছিল কোলকাতায় এখানে ওখানে বিস্তর শুড়িখানা। মেদো মাতালদের হৈহুল্লা। ঠাকুরবাড়ির পাশেই ছিল কোলকাতার সবচেয়ে বড় বেশ্যাপাড়া।
জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি------------------
জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির ফটক পেরিয়ে দুটি বাড়ি ছিল একই প্রাঙ্গনে। একটির নাম আদিবাড়ি বা আদি ভদ্রাসন বাড়ি। অন্যটি বৈঠকখানা বাড়ি। প্রথমটি দোতলা। আর দ্বিতীয়টি তেতলা। অনেকগুলো ঘর, অনেকগুলো মহল আর অনেকখানি বাগান জুড়ে এই দুই বাড়ি মিলিয়ে এক বাড়ি।
বাড়ির ঈশানকোণে বিশাল এক তেঁতুল গাছ। সেই তেঁতুল গাছের ছায়ায় ছিল ছিরু মেথরদের ঘর। বাহির-বাড়িতে দোতলায় দক্ষিণ-পূর্ব কোণে চাকরদের মহল। এ ঘরে বালক রবীন্দ্রনাথদের দিন কাটত। পুকুরের ধারে তারা গয়লানির গোয়াল ঘর।
দেবেন্দ্রনাথ বৈঠকখানার বাড়িটি গিরীন্দ্রনাথদের ছেড়ে দিয়ে আদি ভদ্রাসন বাড়িটিতে চলে আসেন। পরে এই বাড়িটিকে তেতলা করা হয়।
ঠাকুরবাড়ির অন্ধকার----------------------------
আর ভেতরবাড়িতে একতলায় আলোবাতাসহীন ছোটো ছোটো ঘরগুলিতে গ্রাম থেকে আগত আত্মীয় স্বজনদের বাস। রবীন্দ্রনাথ নারী শিক্ষা নামে এক বক্তৃতায় লিখেছেন—
ছেলেবেলা থেকে আমাদের বাড়িতে দেখেছি কত নিঃসহায় অনাথা স্থান পেয়েছে। প্রকাণ্ড বাড়িটি তাদের বসবাসে একেবারে পায়রার খোপের মত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু অধিবাসিনীদের অবস্থা ছিল তখন অতি শোচনীয় ছিল। তাদের অশিক্ষিত মন আত্মাবমাননাতে পূর্ণ হয়ে থাকত। তারা কোথাও আত্মমর্যাদা অনুভব করতে পারেনি। তখনকার দিনে দেশের অন্যান্য মেয়েদের মত তারা অভ্যস্ত অজ্ঞানতা ও অন্ধকারের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছিল। তারা পরস্পরে ঈর্ষা করেছে, নিজেদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টির দ্বারা যতরকম কুচিন্তার প্রশ্রয় দিয়েছে। মানুষের জগতে তাদের স্থান কত তলায়, তা বোধ করবার শক্তি তাদের ছিল না। এর ফলে হয়েছিল বাড়িময় অশান্তি, পরস্পরের লাগালাগি ও কলহ বিবাদ।
ওদের সামনে জীবনের সকল পথই রুদ্ধ, সংকীর্ণ অস্বাস্থ্যকর আশ্রয়ে পরের অনুগ্রহের জুয়াখেলায় তাদের রাত্রিদিন কলুষিত।
এই আলোঅন্ধকারের ভেতর থেকে রবীন্দ্রনাথ এসেছেন। শিখেছেন রবীন্দ্রগিরি।
----------------------------------
সবগুলো পর্ব একসঙ্গে পড়ার লিংক
মন্তব্য
সবগুলো পর্বই আগ্রহ নিয়ে পড়ছি। চমৎকার পরিশ্রমী লেখা, চলুক।
অসংখ্য ধন্যবাদ।
আপনার এই সিরিজটি পড়ার দূর্দান্ত লোভ আমার ছিল, কিন্তু সময়ের অভাবে পড়া হয়নি। আজ পড়লাম এবং খুব ভালো লাগল। চেষ্টা করব সব গুলো পড়তে।
সত্যি দারুণ একটা কাজ।
নতুন মন্তব্য করুন