কুলদা রায়
এমএমআর জালাল
রবীন্দ্রনাথের প্রথম ভ্রমণ : শিলাইদহ-------------------------
পনের বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে যান। বাবার সঙ্গে আসা। এর আগে তিনি হিমালয়ে ঘুরে এসেছেন। বালককে দেবেন্দ্রনাথ জ্যোতির্বিদ্যা, প্রকৃতিপাঠ, ধর্মতত্ত্ব, দায়িত্বজ্ঞানসহ নানাবিষয় শেখাচ্ছেন। বছর দুই আগে যখন হিমালয়ে গিয়েছিলেন--পথে কিছুদিন বোলপুরে শান্তি নিকেতনে থেকেছিলেন। তখন পর্যন্ত ধানগাছই তিনি দেখেননি। শান্তিনিকেতনেও সে সময় মাঠ ফাঁকা ছিল। ধান কাটা হয়ে গেছে সারা।
তারিখটা ১৮৭৫ সালের ৬ ডিসেম্বর। সোমবার। শিলাইদহের রওনা দিয়েছেন বোটে করে। গঙ্গা নদীতে বোট চলেছে। সেখানে বাবার বুক সেলফে খুঁজে পেয়েছেন কবি জয়দেবের গীত গোবিন্দ বইটি।
বাবা-ছেলে ঠিক কোন তারিখে শিলাইদহে পৌঁছেছিলেন ঠিক জানা যায় না। ক্যাশবইতে লেখা আছে, কোলকাতা থেকে ৮ ডিসেম্বর দেবেন্দ্রনাথের কাছে ডাক পাঠানো হয়েছে। ডাকে ছোটোবাবুর জন্য শিলাইদহে পাঠানো হয়েছে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের নাটক সরোজিনী। সদ্য প্রকাশিত হয়েছে। এই নাটকে রবি জ্বল জ্বল চিতা নামে একটি গান লিখে দিয়েছিলেন। নাটকটি সাড়া ফেলেছে। সঙ্গে চিঠি। লিখেছেন কাদম্বরী বৌঠান। পরে এ যাত্রায় আরও তিনটি চিঠি বৌঠান পাঠিয়েছেন। দেবেন্দ্রনাথ একটু কৌতুহলী হয়ে জেনে নিয়েছিলেন পত্রলেখিকার নামটা। এইটুকু।
শিলাইদহ ভ্রমণের একটি সংবাদ বিবরণী তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় মাঘ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। সেখান থেকে জানা যাচ্ছে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ নানাবিধ ধর্মসভায় যোগদান করছেন।
গত ৮ঠা পৌষ শনিবার প্রধান আচার্য মহাশয় জলপথে ভ্রমণ করিতে করিতে রামপুর বোয়ালিয়ায় উপস্থিত হয়েন। তাঁহার আগমণে এখানকার ব্রাহ্মমণ্ডলী মহা ঊৎসাহিত হইয়া, গত ৫ ই পৌষ (১৯ ডিসেম্বর, ১৮৭৫) প্রাতঃকালে অত্রত্য ব্রাহ্মসমাজে উপসনা কার্য্য সম্পাদন করেন। উপসনাসমাজে প্রায় তিনশতেরও অধিক ভদ্রলোকের সমাগম হয়।...শ্রীযুক্ত প্রধান আচার্য্য মহাশয় বেদী গ্রহণ করেন। ...স্বাধ্যায়ের পরে প্রধান আচার্য্যের কনিষ্ঠ পুত্র শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সুমর্ধর স্বরে একটি মনোহর ব্রাহ্মসঙ্গীত করেন। (তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, মাঘ সংখ্যা)।
সেবারে রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে বোটে ছিলেন না। ছিলেন কুঠি বাড়িতে। কুঠি মানে নীলকুঠি। এই কুঠিটি কিনেছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর নীলকর সাহেবদের কাছ থেকে।
শিলাইদহ : দহের শেলী সাহেব থেকে কোথায় পাব তারে -----------------------------
শিলাইদহ কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালি উপজেলার একটি গ্রাম। এটা পূর্বে নদিয়া জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। পরগণারটির নাম বিরাহিমপুর। নদীয় কালেক্টরের ৩৪৩০ নং তৌজি। দ্বারকানাথের বাবা রামলোচন ঠাকুর এই জমিদারিটি কিনেছিলেন। শিলাইদহের উত্তরে পদ্মা এবং পশ্চিম দিকে গড়াই নদী। এই দুটি নদী গ্রামটিকে আধখানা চাঁদের মতো ঘিরে আছে।
গ্রামটির নাম আগে শিলাইদহ ছিল না। ছিল খোরশেদপুর। তিনটি মৌজা নিয়ে গ্রামটি গঠিত। খোরশেদপুর, কশবা ও হামিরহাট। এই তিনটি মৌজাকে একত্র করে শেলী সাহেবের নামে নাম দেওয়া হয় শিলাইদহ। পদ্মা ও গোরাই নদীর সংযোগস্থল একটি দহের আকার নিয়েছে। দহ অর্থ নদী বা জলাশয়ের অতলস্পর্শ ও ঘূর্ণিময় অংশ।
শেলী একজন নীলকর সাহেব। কুঠি স্থাপনের আগে থেকেই এখানে সাহেব বাস করতেন। শেলী ও তার স্ত্রীর কবরও ছিল পুরনো কুঠি বাড়িতে। রবীন্দ্রনাথ কবর দুটি দেখেছিলেন। খোরশেদপুরে খোরশেদ ফকির বাস করতেন। তার নামে একটি দরগাও রয়েছে। এই ফকিরের নামে একটি কিংবদন্তী আছে।
রবীন্দ্রনাথ যখন শিলাইদহে থেকেছেন তখন উচ্চ বর্ণের হিন্দু প্রজাদের সংখ্যাও কম ছিল না। গ্রামের মাঝখানে একটি মন্দির ছিল—গোপীনাথদেবের মন্দির। রাজা সীতারাম এই মন্দিরটি স্থাপন করেছিলেন। রানী ভবানী শিলাইদহ গ্রামটির অধিকার নিলে দেবসেবায় ব্রহ্মত্র জমি দান করেছিলেন। এই জমির আয় দিয়ে এই মন্দিরের ব্যয়নির্বাহ করা হত। গোপীনাথ মন্দির প্রাঙ্গণে একটি রথ ছিল। কাঠের তৈরী। বেশ কারুকার্য্যখচিত। এই রথের কারণে এই জায়গাটি রথতলা নামে পরিচিত। ছেলেবেলা—লেখায় রবীন্দ্রনাথ রথতলার মাঠের নাম করেছেন।
পদ্মা ও গড়াই নদীর সংযোগস্থলে বুনাপাড়া। এখানেই কুঠিরহাট ও শিলাইদহ খেয়াঘাট। অনেক বড়ো বাগানের মধ্যে কুঠিবাড়িটি। তিনতলা। নীচের তলায় জমিদারি কাছারি অফিস। উপরতলায় জমিদারবাবুদের বাসস্থান। ১২৯০ বঙ্গাব্দে পদ্মানদীর ভাঙনে কুঠিবাড়িটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। তার মালামাল নিয়ে নদী থেকে কিছু দূরে নতুন কুঠিবাড়ি নির্মিত হয়।
রবীন্দ্রনাথ শিলাদহে এই ভ্রমণকালে কবি জয়দেবের গীতগোবিন্দ হাতে নিয়েছেন। বইটি ফোর্ট উইলিয়াম থেকে প্রকাশিত। বাংলা অক্ষরে ছাপা। রবীন্দ্রনাথ বহুবার গীতগোবিন্দ পড়েছেন। এর আগে সংস্কৃত ঋজুপাঠ, কুমারসম্ভব ও শকুন্তলা পড়েছিলেন। সংস্কৃত ভাষায় লেখা হলেও বাংলায় প্রেমগীতি সাহিত্য গীতগোবিন্দ থেকেই শুরু। রবীন্দ্রনাথের বাবা দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্মসমাজের প্রধান আচার্য্য। ব্রাহ্মরা রাধাকৃষ্ণ বিষয়ে কোনো ধর্মীয় ভক্তি পুষত না। কিন্তু সকল বিদ্যা পড়ায় কোনো বাঁধা নিষেধ ছিল না। বিদ্যাপতির পদাবলী, গীতগোবিন্দর আদিরসাত্মক বর্ণনাসমৃদ্ধ প্রেমরহস্য কিশোর কবি রবীন্দ্রনাথের চিত্তকে আবিল করেছিল। তিনি লিখেছেন—জয়দেব যাহা বলিতে চাহিয়াছেন তাহা কিছুই বুঝি নাই। কিন্তু ছন্দে ও কথায় মিলিয়া আমার মনের মধ্যে যে জিনিসটি গাঁথা হইয়াছিল তাহা আমার পক্ষে সামান্য নহে। জয়দেব সম্পূর্ণ না বুঝলেও কাব্যের সৌন্দর্যে তার মন ভরে উঠেছিল। এ কারণে তিনি একটি খাতায় গীতগোবিন্দ পুরোটাই লিখে নিয়েছিলেন।
পিতৃস্মৃতি’তে লিখেছেন—আমার মনে আছে, নিভৃতনিকুঞ্জগুহং গতয়া নিশি রহসী নিরীয় বসন্তং—এই লাইনটি আমার মনে ভারি একটি সৌন্দর্যের উদ্রেক করিত—ছন্দের ঝংকারের মুখে নিভৃতনিকুঞ্জগুহং এই একটিমাত্র কথাই আমার পক্ষে প্রচুর ছিল। গদ্যরীতিতে সেই বইখানি ছাপানো ছিল বলিয়া জয়দেবের বিচিত্র ছন্দকে নিজের চেষ্টায় আবিষ্কার করিয়া লইতে হইত—সেটাই আমার বড়ো আনন্দের কাজ ছিল।
পরে তিনি এই বৈষ্ণব পদাবলীর ভাষা আয়ত্ব করেছিলেন। লিখেছিলেন ভানুসিংহের পদাবলী। পরের বছর লিখেছিলেন—গহন কুসুম-কুঞ্জ মাঝে
মৃদুল মধুর বংশি বাজে...
এ সময় আরও পড়েছেন নতুন বৌঠানের চিঠি। তার উত্তরও পাঠিয়েছেন। সরোজিনী নাটকটি আবার পড়েছেন। এইবার মাত্র কয়েকদিনই ছিলেন। কোলকাতায় ফিরে গেছেন ২২ ডিসেম্বর। তাকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছেন রামসর্ব্বস্ব ভট্টাচার্য। এ বাবদ খরচ হয়েছে ২০ টাকা।
প্রবলপ্রতাপান্বিত মহর্ষির বাবার সামনে ভালো করে পল্লীর রূপের সঙ্গে তাঁর আত্মীয়তা এবারে ঘটতে পারেনি। সব সময়ই বাবাগিরির একটা শেকল তাকে পাখা মেলতে দেয়নি। তবে তাঁর তৃষ্ণা জন্মেছে। ভেতর ঘরে পল্লীর জন্য হাতছানি বেড়ে ওঠেছে।
২৩ ডিসেম্বর ভারতসম্রাজ্ঞী রানী ভিক্টোরিয়ার বড় ছেলে প্রিন্স অব ওয়েলস সেরাসিস নামে রাজকীয় জাহাজে করে কোলকাতায় আগমণ করেছেন। সে উপলক্ষ্যে নগরীর সৌধগুলি ও রাজপথগুলি বিচিত্র আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হয়েছে। নড়েচড়ে উঠছে কোলকাতা। সে সময়ই শিলাইদহে কেরোসিনের অভাবে টেমির আলো নিভে যায় সন্ধ্যার পর পরই। জোনাকি জ্বলে। শুক্লপক্ষে চাঁদ ওঠে। তারার আলো জাগে। এই পর্যন্ত। শিয়ালের হুক্কাহুয়া জাগে। দূরে কোথাও মাঝে মাঝে বাঘের আওয়াজ শোনা যায়।
রবীন্দ্রনাথ যখন তার বাবার সঙ্গে শিলাইদহে গিয়েছেন—তখন তার বয়স চৌদ্দ পনের। সদ্য কিশোর। স্কুল পালানো স্বভাবের কারণে সবাই বিরক্ত। ছকে বাঁধা লেখাপড়া তিনি করতে চান না। স্কুলে অনুপস্থিত থাকছেন। পড়া করছেন না। এজন্য অসুস্থতার ভানও করতে হচ্ছে। পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন না। দাদারা বড় ক্লাশে উঠে যাচ্ছেন। তিনি সেই এক ক্লাশেই থেকে যাচ্ছেন। শিক্ষকরা তাকে নানা ধরনের সাহিত্য পড়ানোর চেষ্টা করছেন। এর মধ্যে ম্যাকবেথ, কালিদাসের শকুন্তলা, কুমারসম্ভব—তার মনে ধরেছে। পড়ছেন। কিছু কিছু তর্জমাও করছেন নিজ থেকে। প্রখ্যাত সঙ্গীতবিশারাদ যদুভট্টাচার্য ঠাকুরবাড়িতে গান শেখানোর দাযিত্ব নিয়েছেন। তিনি ধ্রুপদ, বিশেষত খাণ্ডারবাণী ধ্রুপদে বিশেষ দক্ষ ছিলেন। তানসেনবংশীয় বীনকার কাশেম আলী খাঁর কাছে তিনি সেতার শিক্ষা করেছিলেন। সুরবাহার ও পাখোয়াজেও তাঁর দক্ষতা ছিল। তাঁর কাছে রবীন্দ্রনাথ সঙ্গীতের তালিম নিয়েছেন এ বছর। তবে যদু ভট্ট যখনই তাঁকে শেকলে বাঁধতে চেয়ছেন-তখনই তিনি ফুড়ুৎ। তবে যা শিখেছেন নিজের মতো করেই শিখেছেন।
এ বছরের মার্চ মাসের ২৫ তারিখে রবীন্দ্রনাথ তাঁর মাকে হারিয়েছেন। তাঁকে দেখার দায়িত্ব নিয়েছেন নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবী। জুন মাসে বেনে পুকুরে ন-দিদি স্বর্ণকুমারীর জন্য বাবা দেবেন্দ্রনাথ একটি বাড়ি কিনে দিয়েছেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সরোজিনী নাটকটি কোলকাতায় থিয়েটারে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। প্রধান ভূমিকায় অভিনয় করেছেন সেকালের নামী অভিনেত্রী নটি বিনোদিনী। রবীন্দ্রনাথের লেখা গান জ্বল জ্বল চিতা এ নাটকের প্রধান আকর্ষণ।
এ সময় পর্যন্ত ভারতে কোনো রাজনৈতিক দল ছিল না। বঙ্গে ভূম্যধিকারী সভা নামে জমিদারদের একটা সংগঠন ছিল। তার মাধ্যমে কেবল জমিদারদের স্বার্থ দেখা হত। বৃটিশ শাসকদের সঙ্গে জমিদারদের সমস্যা নিয়ে কথা বলত। মুসলমান জমিদাররা এই সংগঠনটিকে তাদের যথার্থ প্রতিনিধি বলে স্বীকার করতে পারেননি। তারা ১৮৬৫ সালে মোহামেডান এসোসিয়েশন অব ক্যালকাটা নামে আলাদা একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। সে সময়ে ইংরেজী শিক্ষার প্রসারের ফলে সরকারী ও বেসরকারী নানা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত চাকুরীজীবীদের মধ্যে দিয়ে একটি মধ্যবিত্ত সম্পদ্রায় গড়ে উঠেছিল। তারা প্রথম দিকে ধর্ম ও সমাজসেবামূলক বিভিন্ন আন্দোলন নিয়ে মেতে উঠেছিল। কিন্তু সকল শ্রেণী পেশার মানুষের প্রতিনিধিত্বমূলক কোনো রাজনৈতিক সংগঠন ছিল না। অথচ রাজনৈতিক সচেতনতা মধ্যবিত্তদের মধ্যে গড়ে উঠছিল।
১৮৭৫ সালে সেপ্টেম্বর মাসে ইন্ডিয়া লীগ নামে একটি সভা গড়ে ওঠে। এটা পরের বছরে ইন্ডিয়া এসোসিয়েশন গঠন করে। ঠিক দশ বছর পরে গঠিত হয় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস। প্রথম রাজনৈতিক সংগঠন। ছাত্রদের মধ্যে গঠিত হয় স্টুডেন্ট এসোসিয়েশন। ঠাকুরবাড়ির কিছু তরুণ এই সভার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এসব কিন্তু হচ্ছে কোলকাতায়। আর কোলকাতা থেকে প্রথম বারের মত অজপাড়াগাঁ শিলাইদহে গিয়ে দেখতে পেলেন—নদী আর মানুষ নিঃসঙ্গে নির্জনে বয়ে চলেছে। তাঁর দেখা তার চেনা নাগরিক মানুষের সঙ্গে--প্রকৃতির সঙ্গে--জীবনের সঙ্গে এর কোনো মিল নেই।
এটা অন্যজীবন।
ছবি পরিচিতি.
১. খুব ছেলেবেলায় ঘোড়ার পিঠে রবি।
২. জ্যোতিরিন্দ্রনাথের করা স্কেচ থেকে গগণেন্দ্রনাথের রবি স্কেচ।
সব কটি পর্ব এক সঙ্গে পড়ার লিংক
মন্তব্য
পড়লাম।
নতুন মন্তব্য করুন