রবীন্দ্রনাথের জমিদারগিরি—জমিদারের রবীন্দ্রগিরি : ষষ্ঠদশ পর্ব

কুলদা রায় এর ছবি
লিখেছেন কুলদা রায় [অতিথি] (তারিখ: মঙ্গল, ০৩/০১/২০১২ - ১১:৫৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


কুলদা রায়
এমএমআর জালাল

শিলাইদহে দ্বিতীয় ভ্রমণ : দাদার সঙ্গে বাঘ শিকার

-----------------------------------------------------------

দেবেন্দ্রনাথ হিমালয়ে যাবেন। জমিদারী দেখার দ্বায়িত্ব দিয়ে গেলেন পঞ্চম ছেলে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের উপর। বলে গেলেন-কোলকাতায় বসে জমিদারী দেখা চলবে না। যেতে হবে সোজা শিলাইদহে। সে সময়ে জমিদারিতে বেশ কিছু গোলমাল চলছিল। বিশেষ করে জমিদারীতে প্রজাসাধারণের কাগজপত্রাদি সুরক্ষিত ছিল না। জমিদারদের অনুপস্থিতিতে নায়েব আমলারা এটা নিয়ে প্রজাদের হয়রানী করত। প্রজাদের নিপীড়নের খবর সে সময়ে কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদারের গ্রামবার্তা প্রকাশিকায় প্রকাশিতও হয়েছিল। এ কারণে কাঙ্গাল হরিনাথের বাড়িতে জমিদারের পাইক পেয়ারারা চড়াও হয়েছিল। খবর পেয়ে হরিনাথের বন্ধু লালন ফকির এসে লড়াই করে পাইক পেয়াদাদের ভাগিয়ে দিয়েছিল। সুতরাং দেবেন্দ্রনাথ জমিদারী নায়েব আমলাদের হাতে রাখাটা ভালো মনে করেননি।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ চলেছেন শিলাইদহে ১৮৭৬ সালের ফাল্গুনে। । সঙ্গে নিয়েছেন ছোটো ভাই রবিকে। বাবার সঙ্গে আড়াই মাস আগে শিলাইদহ থেকে ঘুরে গেছেন। বাবার বিশাল ব্যক্তিত্বের ছায়ার গ্রাম দেখে আশ মেটেনি। এবার দাদার অবাধ স্নেহের অধিকারে তিনি চলেছেন শিলাইদহে।

তারা উঠেছেন শিলাইদহের কুঠি বাড়িতে। ক্যাশ বহির হিসাব থেকে দেখা যাচ্ছে, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এ সময় দেবেন্দ্রনাথের কাছ থেকে স্বাধীনভাবে ব্যবসা করার জন্য পাঁচহাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন। সুদ দিতে হবে বার্ষিক ছয় টাকা হারে। বাবার কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার প্রয়োজন হল কেন? কারণ ঠাকুর বাড়ির সব এজমালি সম্পত্তি দেবেন্দ্রনাথের হাতেই ছিল। ছেলেমেয়েরা আত্মীয়স্বজনরা এখান থেকে নিয়মিত মাসোহারা পেতেন। আর জ্যোতিরিন্দ্ররনাথ, রবীন্দ্রনাথসহ যারা ঠাকুরবাড়ির এস্টেটে চাকরী করতেন তারা নিয়মিত বেতন পেতেন। ঋণ নিয়ে কেউ কেউ স্বাধীন ব্যবসা করেছেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এই ঋণের টাকা দিয়ে শুরু করেছিলেন পাটের ব্যবসা।

সে সময়ে বয়সের পার্থক্য থাকলেও জ্যোতিদাদার সঙ্গে রবির সম্পর্কটা বন্ধুর মত। রবি লেখাপড়ায় মোটেই মনোযোগী নয়। কবি হয়ে উঠেছেন। নানা বিষয়ে নিজের মতো করে পড়ালেখা করছেন। মনটা তার আকাশে চরে বেড়ানো পাখির মত মুক্ত। কোএথাও বাঁধা পড়তে চায় না। তাকে দেওয়া দরকার স্নেহ আর অবাধ স্বাধীনতার অধিকার। তাঁকে রূপে ভোলানো যাবে না। ভালোবাসায় ভোলানো সম্ভব। এই কারণে প্রতিভাবান ছোটো ভাইটিকে নতুন দাদা শিলাইদহের নির্জন প্রকৃতির কাছে নিয়ে এলেন। তাঁকে দিতে চাচ্ছেন বাংলার প্রকৃতিপাঠ। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন—তিনি নিশ্চয়ই ভেবেছিলেন, এই থেকে এই বাইরে চলাচল এ একটা চলতি ক্লাশের মতো। সেখান থেকে তিনি খোরাক পান আপনা হতেই । তার কিছুকাল পরে জীবনটা যখন আরও উপরের ক্লাসে উঠেছিল তিনি মানুষ হচ্ছিলেন এই শিলাইদহে ।

ছেলেবেলা গ্রন্থে লিখেছেন—পুরনো নীলকুঠি তখনো খাড়া ছিল। পদ্মা ছিল দূরে। নীচের তলায় কাছারি, উপরের তলায় আমাদের থাকবার জায়গা। সামনে খুব মস্ত একটা ছাদ। ছাদের বাইরে বড় বড়ো ঝাউগাছ, এরা একদিন নীলকর সাহেবের ব্যবসার সঙ্গে বেড়ে উঠেছিল। লিখেছেন, আজ কুঠিয়াল সাহেবের দরবার একেবারে থম থম করছে । কোথায় নীলকুঠির যমের দূত সেই দেওয়ান , কোথায় লাঠি-কাঁধে কোমর-বাঁধা পেয়াদার দল , কোথায় লম্বা-টেবিল-পাতা খানার ঘর যেখানে ঘোড়ায় চড়ে সদর থেকে সাহেবরা এসে রাতকে দিন করে দিত — ভোজের সঙ্গে চলত জুড়ি-নৃত্যের ঘূর্ণিপাক , রক্তে ফুটতে থাকত শ্যাম্পেনের নেশা , হতভাগা রায়তদের দোহাই-পাড়া কান্না উপরওয়ালাদের কানে পৌঁছত না , সদর জেলখানা পর্যন্ত তাদের শাসনের পথ লম্বা হয়ে চলত । সেদিনকার আর যা-কিছু সব মিথ্যে হয়ে গেছে , কেবল সত্য হয়ে আছে দুই সাহেবের দুটি গোর। লম্বা লম্বা ঝাউগাছগুলি দোলাদুলি করে বাতাসে, আর সেদিনকার রায়তদের নাতি-নাতনিরা কখনো কখনো দুপুররাত্রে দেখতে পায় সাহেবের ভূত বেড়াচ্ছে কুঠিবাড়ির পোড়ো বাগানে ।

বাবার সঙ্গে প্রথমবার শিলাইদহে এলেও বিখ্যাত বাবার কারণে শিলাইদহের সঙ্গে তাঁর আত্মীয়তা গড়ে উঠতে পারে সে সময়ে। জ্যোতিদাদার ডাকে দ্বিতীয়বার এসে শিলাইদহকে গভীর করে দেখার অবসর পেলেন। জীবনে এই প্রথমবার একলা থাকা মন নিতে পেরেছেন। বেছে নিয়েছেন উপরের তলায় ছোটো একটি কোণের ঘর। এই ঘরে ছুটির আনন্দ আছে। এই আনন্দটা তাঁর কাছে দীঘির কালো জলের মত অথৈ। এই কোণের ঘর থেকে দেখতে পাচ্ছেন—বউ-কথা-কও ডাকছে তো ডাকছেই। উড়ো ভাবনা ভাবছি তো ভাবছিই। এর মধ্যে তিনি মালতী পুঁথিতে লিখছেন আমের বোলের মত পদ্য।

কবিতা লেখার পাশাপাশি রবি ঘোড়ার চড়ে বেড়াতে লাগলেন। জ্যোতিদাদা নিজেও ঘোড়ায় চড়া পছন্দ করতেন। রবি চড়তেন টাট্টু ঘোড়া। ঘোড়ায় চড়ে সোজা চলে যেতেন রথতলার বড়ো মাঠটিতে। ...সেই এবড়ো থেবড়ো মাঠে পড়ি-পড়ি করতে করতে ঘোড়া ছুটিয়ে আনতুম। আমি পড়ব, তার মনে এই জোর ছিল বলেই আমি পড়িনি। পরে তিনি বড়ো ঘোড়ায়ও চড়েছেন। তবে সেটা সুখের হয়নি।

দুভাই মাঝে মাঝে বাঘ শিকারে বেরিয়েছেন। বিশ্বনাথ নামে এক অসীম-সাহসী শিকারীর কাছে গল্প শুনে শুনে শিকারে প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। শিলাইদহের জঙ্গলে তখন মাঝে মাঝে বাঘ পড়ত। জ্যোতিদাদার সঙ্গে তিনি অন্তত দুবার বাঘ শিকারে গিয়েছিলেন। ভালো বন্দুক চালাতে জানতেন জ্যোতিদাদা।

ছেলেবেলায় লিখেছেন—
বাঘ-শিকারের ইচ্ছা ছিল তাঁর (জ্যোতিদাদার) মনে । বিশ্বনাথ শিকারী একদিন খবর দিল, শিলাইদহের জঙ্গলে বাঘ এসেছে । তখনি বন্দুক বাগিয়ে তিনি তৈরি হলেন । আশ্চর্যের কথা এই, আমাকেও নিলেন সঙ্গে । একটা মুশকিল কিছু ঘটতে পারে, এ যেন তাঁর ভাবনার মধ্যেই ছিল না ।

ওস্তাদ শিকারী ছিল বটে বিশ্বনাথ । সে জানত , মাচানের উপর থেকে শিকার করাটা মরদের কাজ নয় । বাঘকে সামনে ডাক দিয়ে লাগাত গুলি । একবারও ফসকায় নি তার ।

ঘন জঙ্গল। সেরকম জঙ্গলের ছায়াতে আলোতে বাঘ চোখেই পড়তে চায় না। একটা মোটা বাঁশগাছের গায়ে কঞ্চি কেটে কেটে মইয়ের মতো বানানো হয়েছে। জ্যোতিদাদা উঠলেন বন্দুক হাতে । আমার পায়ে জুতোও নেই, বাঘটাতাড়া করলে তাকে যে জুতোপেটা করব তার উপায় ছিল না। বিশ্বনাথ ইশারা করলে। জ্যোতিদাদা অনেকক্ষণ দেখতেই পান না। তাকিয়ে তাকিয়ে শেষকালে ঝোপের মধ্যে বাঘের গায়ের একটা দাগ তাঁর চশমাপরা চোখে পড়ল। মারলেন গুলি। দৈবাৎ লাগল সেটা তার শিরদাঁড়ায় । সে আর উঠতে পারল না । কাঠকুটো যা সামনে পায় কামড়ে ধরে লেজ আছড়ে ভীষণ গর্জাতে লাগল । ভেবে দেখলে মনে সন্দেহ লাগে । অতক্ষণ ধরে বাঘটা মরবার জন্যে সবুর করে ছিল, সেটা ওদের মেজাজে নেই বলেই জানি । তাকে আগের রাত্রে তার খাবার সঙ্গে ফিকির করে আফিম লাগায় নি তো! এত ঘুম কেন ।

আরও একবার বাঘ এসেছিল শিলাইদহের জঙ্গলে। আমরা দুই ভাই যাত্রা করলুম তার খোঁজে, হাতির পিঠে চড়ে । আখের খেত থেকে পট পট করে আখ উপড়িয়ে চিবতে চিবতে পিঠে ভূমিকম্প লাগিয়ে চলল হাতি ভারিক্কি চালে । সামনে এসে পড়ল বন । হাঁটু দিয়ে চেপে, শুঁড় দিয়ে টেনে গাছগুলোকে পেড়ে ফেলতে লাগল মাটিতে । তার আগেই বিশ্বনাথের ভাই চামরুর কাছে গল্প শুনেছিলুম, সর্বনেশে ব্যাপার হয় বাঘ যখন লাফ দিয়ে হাতির পিঠে চড়ে থাবা বসিয়ে ধরে । তখন হাতি গাঁ গাঁ শব্দে ছুটতে থাকে বনজঙ্গলের ভিতর দিয়ে, পিঠে যারা থাকে গুঁড়ির ধাক্কায় তাদের হাত পা মাথার হিসেব পাওয়া যায় না। সেদিন হাতির উপর চড়ে বসে শেষ পর্যন্ত মনের মধ্যে ছিল ঐ হাড়গোড়-ভাঙার ছবিটা । ভয় করাটা চেপে রাখলুম লজ্জায় । বেপরোয়া ভাব দেখিয়ে চাইতে লাগলুম এ দিকে, ও দিকে । যেন বাঘটাকে একবার দেখতে পেলে হয় । ঢুকে পড়ল হাতি ঘন জঙ্গলের মধ্যে । এক জায়গায় এসে

থমকে দাঁড়াল । মাহুত তাকে চেতিয়ে তোলবার চেষ্টাও করল না । দুই শিকারী প্রাণীর মধ্যে বাঘের ‘ পরেই তার বিশ্বাস ছিল বেশি । জ্যোতিদাদা বাঘটাকে ঘায়েল করে মরিয়া করে তুলবেন , নিশ্চয় এটাই ছিল তার সবচেয়ে ভাবনার কথা । হঠাৎ বাঘটা ঝোপের ভিতর থেকে দিল এক লাফ । যেন মেঘের ভিতর থেকে বেরিয়ে পড়ল একটা বজ্রওয়ালা ঝড়ের ঝাপটা । আমাদের বিড়াল কুকুর শেয়াল দেখা নজর — এ যে ঘাড়েগর্দানে একটা একরাশ মুরদ , অথচ তার ভার নেই যেন । খোলা মাঠের ভিতর দিয়ে দুপুরবেলার রৌদ্রে চলল সে দৌড়ে । কী সুন্দর সহজ চলনের বেগ । মাঠে ফসল ছিল না । ছুটন্ত বাঘকে ভরপুর করে দেখবার জায়গা এই বটে — সেই রৌদ্রঢালা হলদে রঙের প্রকাণ্ড মাঠ ।

এক মালি তার ঘরে ফুল দিয়ে যেত। সুন্দর করে সাজিয়ে রাখত। রবির হঠাৎ ইচ্ছে হল, এই ফুল দিয়ে কবিতা লিখবেন। ঠিক ফুল দিয়ে নয়। ফুলের রঙ দিয়ে। ফুলের পাপড়ি টিপে টিপে রস বের করে লিখতে চেষ্টা করলেন। সেটা অনেক ঝামেলা মনে হর। তিনি ছিদ্রযুক্ত কাঠের বাটির উপর হামানদিস্তার নোড়া দড়িতে-বাঁধা চাকার সাহায্যে ঘুরিয়ে বৃহদাকারে ফুলের রস উৎপাদকারী একটি যন্ত্র তৈরি করতে পরিকল্পনা করলেন । দাদাকে বলতেই মিস্ত্রী তৈরি করে দিল ফুলের পাপড়ি থেকে রস বের করার যন্ত্র। কিন্তু তাতে কালি পাওয়া গেল না। পাওয়া গেল পাপড়ির কাদা। তা দিয়ে লেখা যায় না। জ্যোতিদাদা দেখলেন, ফুলের রস আর কলের চাপের ছন্দ মিলল না। তবু কিশোর মুখের উপর হেসে উঠলেন না। তার ইচ্ছেকে সম্মান করলেন।

স্কুলের ছাত্র হিসেবে রবির ব্যর্থতা সাইকে হতাশ করেছিল। সবাই ধরেই নিয়েছিল রবির কিছু হবে না। তিনি নিজেও হারিয়েছিলেন আত্মবিশ্বাস। কিন্তু জ্যোতিদাদা তার স্বাধীন ইচ্ছেকে সম্মান জানিয়ে, নানা কাজে প্রবৃত্ত করে তাঁর হারানো আত্মবিশ্বাসকেই ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করেছেন। শিলাইদহ এই আত্মআবিষ্কারের আর আত্মবিকাশের উর্বর ক্ষেত্র।

........................................
রবীন্দ্রনাথের জমিদারগিরি—জমিদারের রবীন্দ্রগিরি : পঞ্চদশ পর্ব


মন্তব্য

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

কমেন্টে আবদুল মাঝির বাঘ দিয়ে নৌকা চালানোর গল্পটা জুড়ে দিন।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

তাপস শর্মা এর ছবি

ভালো লাগছে। চলুক

সাজ্জাদ সাজিদ এর ছবি

বাংলা সাহিত্যের এই প্রবাদ পুরুষের জীবন ঘেঁষা টুকরো টুকরো সব গল্প তুলে ধরার এই প্রয়াসকে স্বাগত জানাই।
ভালো লাগছে। চলুক

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।