রবীন্দ্রনাথের জমিদারগিরি—জমিদারের রবীন্দ্রগিরি : সপ্তদশ পর্ব

কুলদা রায় এর ছবি
লিখেছেন কুলদা রায় [অতিথি] (তারিখ: বুধ, ১১/০১/২০১২ - ১০:২১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


কুলদা রায়
এমএমআর জালাল

জমিদারিতে প্রথম চাকরী----------------

রবীন্দ্রনাথের বিয়ের আগেই দেবেন্দ্রনাথ তাঁকে জমিদারির কাজ পরিচালনার জন্য প্রস্তুত হতে চিঠি দিয়েছিলেন। এই সময়কালে দেবেন্দ্রনাথ মাঝে মাঝে অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন। জ্যোতিদাদা জমিদারী ভালোই দেখাশুনা করতেন। মূল ম্যানেজার হিসাবে কাজ করতেন তাঁদের বড় ভগ্নিপতি সারদাপ্রসাদ। রবীন্দ্রনাথের বিয়ের দিনেই তাঁর মৃত্যুর সংবাদ এসেছিল। এর কয়েকমাস পরে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী কাদম্বরী আত্মহত্যা করেন। তৃতীয় ভাই হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরও অকালে মৃত্যুবরণ করেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জাহাজের ব্যবসা মার খায়। তখন থেকেই তিনি বিষয়ে মনোযোগ হারান। জমিদারি দেখা ছেড়ে দেন। দেবেন্দ্রনাথ এরপর বড় ছেলে দ্বিজেন্দ্রনাথকে শিলাইদহে পাঠান পরিদর্শনের ভার দিয়ে। কাজটি তাঁর ভালো না লাগায় তাঁর ছেলে দ্বিপেন্দ্রনাথ এই দ্বায়িত্ব পালন করেন। বড় নাতি হিসেবে তিনি ছিলেন দেবেন্দ্রনাথের খুব আদরের। জমিদারী এলাকায় তিনি যাননি। তাঁর নায়েব-গোমস্তারা প্রজাদের সঙ্গে বেশ ঝামেলাও তৈরি করেন। তখন দেবেন্দ্রনাথ ছোটো ছেলে রবীন্দ্রনাথকে জমিদারি পরিচালনার কাজে পরিদর্শক হিসাবে নিয়োগ করেন।

২ অঘ্রাণ (নভেম্বর ১৮৮৯) রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে রওনা করেন। সঙ্গে স্ত্রী মৃণালিনী দেবী, বড় মেয়ে বেলা ও ছেলে রথীন্দ্রনাথ। সঙ্গে একজন সহচরী। ভাইপো বলেন্দ্রনাথও তাঁদের সঙ্গে আছেন। শিলাইদহে তখন তারা কুঠিবাড়িতে নয়—বোটে আশ্রয় নিয়েছেন। বোট আসলে বজরা। বজরাটির নাম ছিল 'হাউজ বোট পদ্মা'। .তার এ রকম আরও তিনটি নৌকা ছিল। নাম 'লালডিঙ্গি',‘চপলা' ও 'চঞ্চলা'।. তবে তার সবচেয়ে প্রিয় ছিল 'হাউজ বোট পদ্মা'। এ সময় ভাগ্নি ইন্দিরা দেবীকে প্রায়ই চিঠি লিখেছেন। সেসব চিঠিতে পূর্ববঙ্গ ভ্রমণের বিবরণ দিয়েছেন। পূর্ববঙ্গের সহজ সরল অনিন্দ্যসুন্দর প্রকৃতির মতই চলিত ভাষায় তাঁর লেখা এই চিঠিগুলো ছিন্নপত্র নামে সংকলন করেন ইন্দিরা দেবী।

ছিন্নপত্রে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন—
শিলাইদহের অপরপারে একটা চরে আমাদের বোট লাগানো আছে। প্রকাণ্ড চর—ধূ ধূ করছে—কোথাও শেষ দেখা যায় না—মাঝে মাঝে এক এক জায়গায় নদীর রেখা দেখা যায়—আবার অনেক সময়ে বালিকে চর বলে ভ্রম হয়—গ্রাম নেই—লোক নেই—তরু নেই, তৃণ নেই—বৈচিত্রের মধ্যে জায়গায় জায়গায় ফাটল-ধরা ভিজে কালো মাটি, জায়গায় জায়গায় শুকনো সাদা বালি, পূর্ব দিকে মুখ ফিরিয়ে চেয়ে দেখলে দেখা যায় উপরে অনন্ত নীলিমা আর নীচে অনন্ত পাণ্ডুরতা, আকাশ শূন্য এবং ধরণীও শূণ্য, নীচে দরিদ্র শুষ্ক কঠিন শূন্যতা আর উপরে অশরীরি উদার শূন্যতা।...সন্ধ্যার সময়ই আমরা বেড়াতে বেরোই এবং সেই ছবিটিই মনে অঙ্কিত হয়ে আছে। পৃথিবী যে বাস্তবিক কী আশ্চর্য সুন্দরী তা কলকাতায় থাকরে ভুলে যেতে হয়।...সন্ধ্যেবেলা এই বৃহৎ চরের মধ্যে ছাড়া পেয়ে অনুচর-সমেত ছেলেরা একদিকে যায়, বলু একদিকে যায়, আমি একদিকে যাই। দুটি রমণী আর এক দিকে যায়।

এই প্রকৃতি রবীন্দ্রনাথের কাছে বৃহৎ নিস্তব্ধ নিভৃত পাঠাশালা হয়ে উঠেছে। এদিন একটি কাণ্ড ঘটেছিল। কবির স্ত্রী মৃণালিনী সহচরীসহ বেড়াতে গিয়ে পথ হারিয়ে ফেলেছিলেন। গফুর, প্রসন্ন, বোটের মাঝিমাল্লারা তাদের খুঁজে বের করেছিল। রবীন্দ্রনাথ দুশ্চিন্তায় কখনো মনে করেছিলেন তারা চোরাবালিতে পড়েছে, কখনো আশঙ্কা করেছেন বলেন্দ্রনাথ জন্মরোগ মূর্ছায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। আবার ভয়ও পাচ্ছেন—বন্যজন্তু তাঁদের হয়তো আক্রমণ করেছে। গোটা সময়টাই মস্ত একটা বিভীষিকার মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্রনাথের কেটেছে। সে সময় চরে আরাম কেদারায় বসে এনিম্যাল ম্যাগনিটিজম নামে একটি বই পড়ছিলেন। এদের চিন্তায় পড়াটা আর সেদিন আগাতে পারেনি বলেও জানিয়েছেন ইন্দিরাকে।

রবীন্দ্রনাথ তখন নানা কাজে ব্যস্ত। তাদের বোটে গ্রাম্য গাইয়েরা গান গাইতে আসত। একজন বৈষ্ণব কাঙাল ফিকির চাঁদ ফকিরের গান শুনিয়ে যেত। আর একজন মুসলমন গায়ক শুনাউল্লা আসতেন। শিলাইদহের গগণ হরকরার গাণও তারা শুনেছেন। বলেন্দ্রনাথ এই গানগুলো একটি খাতায় লিখে নিয়েছেন। এইবার রবীন্দ্রনাথও তার পরিবারের সদস্যগণ বাউল ও অন্যান্য লোকসঙ্গীত সংগ্রহ করেন। ভারতী পত্রিকায় সেগুলো প্রকাশও করা হয়েছে। এইবারে রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে কতদিন ছিলেন তা বিশেষ জানা যায় না। তিনি কোলকাতায় সপরিবারে ফিরে আসেন। তখন পৌষ মাস।

জানুয়ারীতে শাহজাদপুরে তিনি আসেন। ছিলেন ফ্রেব্রুয়ারী পর্যন্ত। তখন পৌষ ফাগুনের পালা। পাবনা জেলার ইউসুফশাহী পরগণাতে এইবারই তিনি একলা এসেছেন। প্রথমবারে এসেছিলেন বাবার সঙ্গে। দ্বিতীয়বার জ্যোতিদাদার সঙ্গে। তৃতীয়বার সপরিবারে। এইবার একা একা বাংলা দেখবেন।
একা এসে তাঁর ছোটো ছোটো ছেলেমেয়ের জন্য মন কেমন করছে। স্ত্রীকে চিঠি লিখেছেন—বেলি খোকার জন্যে এক একটা মনটা ভারি অস্থির বোধ হয়। বেলিকে আমার নাম করে দুটো ‘অড খেতে দিয়ো। আমি না থাকলে সে বেচারা ত নানা রকম জিনিষ খেতে পায় না। খোকাকেও কোন রকম করে মনে করিয়ে দিয়ো’।

চিঠিতে আরও জানা যাচ্ছে, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন একদল উকিল আর স্কুলের শিক্ষক। একজন ইস্কুল ইন্সপেক্টরও আছেন। স্কুলে তাঁর বই চালাবার কথাবার্তাও হয়েছে তাদের সঙ্গে। সঙ্গে একখানা রাজর্ষি বই ছিল। সেটি স্কুল ইন্সপেক্টরের হাতে দিয়েছেন। পরে স্কুলগুলোতে ২৫টি বই বিক্রি হয়েছে। এ বাবদ পাওয়া গেছে ২৫ টাকা।

উকিল আর মাস্টারবাবুরা এসেছিলেন শাহজাদপুরের সুনীতিসঞ্চারিনী সভায় সভাপতিত্ব করার অনুরোধ করতে। ২০ জানুয়ারী রবীন্দ্রনাথ এ স্কুলটি পরিদর্শনে যান। তিনি ঘুরে ঘুরে সব ক্লাসরুমগুলো দেখেছেন। ছাত্ররা যাতে ভয় না পায়, সেজন্য তাদেরকে তিনি কোনো প্রশ্ন করেননি। তারা যাতে সহজসরল মুডে থাকে সে ব্যাপারটি খেয়াল রেখে ক্লাশরুমগুলোতে গিয়েছেন। কিন্তু তারা যথেষ্ট ঘাবড়ে গিয়েছিল। বোধহয় ঘাবড়ে যাওয়ার পিছনে হেড মাস্টার সাহেবের কিছু অবদান ছিল বলে কবির মনে হয়েছিল। এই ঘটনাটি বেশ কৌতুক ভরে চিঠিতে লিখেছেন ইন্দিরা দেবীকে কালিগ্রাম থেকে। তারিখ নেই চিঠিতে। শুধু সন লেখা ১৮৯১--
কাল যখন কাছারি করছি, গুটি গুটি পাঁচ ছয় ছেলে হঠাৎ অত্যন্ত সংযতভাবে আমার সামনে এসে দাঁড়ালে—কোনো প্রশ্ন করতে না করতে একেবারে বিশুদ্ধ বঙ্গভাষায় আরম্ভ করে দিল, ‘পিতঃ, অভাগ্য সন্তানগণের সৌভাগ্যবশতঃ জগদীশ্বরের কৃপায় প্রভুর পুনর্বার এতদ্দেশে শুভাগমণ হইয়াছে’।. এমনি করে আধ-ঘণ্টা-কাল বক্তৃতা করে গেল, মাঝে মাঝে বক্তৃতা ভুলে যাচ্ছিল, আবার আকাশের দিকে চেয়ে সংশোধন করে নিচ্ছিল। বিষয়টা হচ্ছে তাদের স্কুলে টুল এবং বেঞ্চির অপ্রতুল হয়েছে—সেই কাষ্ঠাসন-অভাবে ‘আমরাই বা কোথায় উপবেশন করি, আমার পূজনীয় শিক্ষক মহাশয় উপস্থিত হইলে তাহাকেই বা কোথায় আসন দান করা যায়? ছোট্ট ছেলের মুখে হঠাৎ এই অনর্গল বক্তৃতা শুনে আমার এমনি হাসি পাচ্ছিল। বিশেষত এই জমিদারী কাছারিতে, যেখানে অশিক্ষিত চাষারা নিতান্ত গ্রাম্য-ভাষায় আপনাদের যথার্থ দারিদ্রদুঃখ জানায়—যেখানে অতিবৃষ্টি দুর্ভিক্ষ গোরু বাছুর হাল লাঙ্গল বিক্রি করেও উদরান্নের অনটনের কথা শোনা যাচ্ছে, যেখানে ‘অহরহ’ শব্দের পরিবর্তে ‘রহরহ’, অতিক্রমের স্থলে অতিক্রয় ব্যবহার, সেখানে টুল-বেঞ্চির অভাবে সংস্কৃত বক্তৃতা কানে এমনি অদ্ভুত শোনায়। অন্যান্য আমলা এবং প্রভুরা এই ছোকরার ভাষার প্রতি এতাদৃশ দখল দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল—তারা মনে মনে আক্ষেপ করছিল, ‘বাপ-মারা আমাদের যত্ন করে লেখাপড়া শেখায়নি, নইলে আমরাও জমিদারের সামনে দাঁড়িয়ে এইরকম শুদ্ধ ভাষায় নিবেদন করতে পারতুম। আমি শুনতে পেলুম একজন আরেকজনকে ঠেলে ঈষৎ বিদ্বেষের ভাবে বলছে, ‘একে কে শিখায় দিয়েছে?’ আমি তার বক্তৃতা শেষ না হতেই তাকে থামিয়ে বললুম, ‘আহা, তোমাদের টুল-বেঞ্চির বন্দোবস্ত করে দেব।‘ তাতেও সে দমল না। সে যেখানে বক্তৃতা ভঙ্গ করেছিল সেইখান থেকে আবার আরম্ভ করলে—যদিও তার আবশ্যক ছিল না, কিন্তু শেষ কথাটি পর্যন্ত চুকিয়ে প্রণাম করে বাড়ি ফিরে গেল।

জানুয়ারী ২৩, ১৮৯১।. রবীন্দ্রনাথ পতিসর ত্যাগ করে নদীপথে শাহজাদপুরে গিয়েছেন। সেখান থেকে প্রমথ চৌধুরী জানাচ্ছেন, দিন দশেক সেখানে থাকবেন। এজন্য শাহজাদপুরের বেড়াতে আসার জন্য তাঁকে নিমন্ত্রণ করছেন। তিনি একা একা এই জমিদারী পরিচালনা করতে করতে—জমিজমা ও বাকি-বকেয়া কাজ করতে করতে হাপিয়ে উঠেছেন। তিনি গোটা চারেক বই এনেছেন। ইউরোপের ডাইরী লিখছেন। ২৭ জানুয়ারী মেজো মেয়ে রেণুকার জন্ম হয়েছে কোলকাতায়।

১ ফেব্রুয়ারী ইন্দিরা একটি চিঠিতে জানাচ্ছেন—তিনি ডাইরীটা লিখছিলেন, তার নায়েব এসে কাছারিতে নিয়ে গেলেন। লেখা বাদ দিতে হল। সে সময় জমিদারীই ছিল একমাত্র উপার্জনের উপায়। সুতরাং ভালোভাবে পরিচালনা না করে উপায় নেই। তাই একাজে তিনি কখনো অবহেলা করতেন না।
কিন্তু জমিদারী সম্মান বজায় রাখার জন্য যে-সব আড়ম্বরের আয়োজন ছিল সেগুলো তিনি মনে প্রাণে অপছন্দ করতেন। ইন্দিরা দেবীকে চিঠিতে লিখছেন, প্রজারা যখন সসম্ভ্রম কাতরভাবে দরবার করে, এবং আমলারা বিনীত করজোড়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তখন আমার মনে হয় তাদের চেয়ে এমনি আমি কি মস্ত লোক যে আমি একটু ইঙ্গিত করলেই এদের জীবনযাত্রা এবং আমি একটু বিমুখ হলেই এদের সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে। ...অন্তরের মধ্যে আমিও যে এদেরই মতো দরিদ্র সুখদুঃখকাতর মানুষ, পৃথিবীতে আমারও কত ছোটো ছোটো বিষয়ে দরবার, কত সামান্য কারণে মর্মান্তিক কান্না, কত লোকের প্রসন্নতার উপরে জীবনের নির্ভর। ...Prstige মানে হচ্ছে মানুষ সম্বন্ধে মানুষের ভুল বিশ্বাস, আমাকে এখানকার প্রজারা যদি ঠিক জানত, তাহলে আপনাদের একজন বলে চিনতে পারত, সেই ভয়ে সর্বদা মুখোষ পরে থাকতে হয়।

এই সময়ে তিনি জমিদারিতে চাকরী করতেন। তিনি মালিক নন। ইচ্ছে করলেও জমিদারী প্রথার বিরুদ্ধে যাওয়ার উপায় ছিল না তাঁর। তাঁর বাবার জমিদারীর কঠোর বিধিবিধান মাথার উপরে ছিল। ছিল প্রথার কঠোর বন্ধন। কিন্তু যখণ তিনি আরও পরে নিজেই জমিদারীর অধিকারী হয়েছিলেন—তখন এগুলো উঠিয়ে দিয়েছিলেন।


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।