কুলদা রায়
এমএমআর জালাল
মাটি মা -------------------------
১৮৯০ সালে সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর মাসে রবীন্দ্রনাথ ২ মাস ১১ দিন ইউরোপ ভ্রমণ করেন। ১৮৯১ সালের ১৩ জানুয়ারী তিনি কালীগ্রামের সদর কাছারি পাতিসর রওনা করেন। বোটে করে পতিসরে পৌঁছাতে ৩ দিন লেগেছিল। তখন বড় মেয়ে বেলার বয়স মাত্র ৪ বছর ৩ মাস। বেলা এর মধ্যেই একটি চিঠি লিখে পাঠিয়েছে পতিসরে। চিঠিটি পড়ে বাবা রবীন্দ্রনাথ আকুল হয়ে উঠেছেন। স্ত্রী মৃণালিনীকে লিখেছেন—আমার মিষ্টি বেলুরাণুর চিঠি পেয়ে তখনি বাড়ি চলে যেতে ইচ্ছে করছিল। আমার জন্য তার আবার মন কেমন করে—তার ঐ একটুখানি মন, তার আবার কী হবে? ...কাল রাত্তিরে আমি খোকাকে স্বপ্ন দেখেছি—তাকে যেন আমি কোলে নিয়ে চটকাচ্ছি। বেশ লাগছে।‘ রবিজীবনীকার প্রশান্ত পাল একটি মন্তব্য করেছেন—পিতৃস্নেহ রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিমূলক রচনায় খুব বেশি প্রকাশ পায়নি। সেই মনটি ধরা পড়েছে এই ধরনের কিছু কিছু পত্রে।
পতিসর পৌছানোর ৫ দিন পরে তিনি চিঠি লিখছেন ইন্দিরাকে—আমার বোট কাছারির কাছ থেকে অনেক দূরে একটি নিরিবিলি জায়গায় বেঁধেছি। এ দেশে গোলগাল কোথাও নেই। ইচ্ছে করলেও পাওয়া যায় না। কেবল হয়তো অন্যান্য বিবিধ জিনিসের সঙ্গে হাটে পাওয়া যেতে পারে। আমি তখন যেখানে এসেছি এ জায়গায় অধিকন্তু মানুষের মুখ দেখা যায় না। চারিদিকে কেবল মাঠ ধূ ধূ করছে—মাঠে শস্য কেটে নিয়ে গেছে, কেবল কাটা ধানের গোড়াগুলিতে সমস্ত মাঠ আচ্ছন্ন। সমস্ত দিনের পর সূর্যাস্তের সময় এই মাঠে কাল একবার বেড়াতে বেরিয়েছিলুম। সূর্য্য ক্রমেই রক্তবর্ণ হয়ে একেবারে পৃথিবীর শেষ রেখার অন্তরালে অন্তর্হিত হয়ে গেল। চারি দিক কী যে সুন্দর হয়ে উঠল সে আর কী বলব।
শুধু এই প্রকৃতিকে দেখছেন না নিবিড়ভাবে—এসময় গভীরভাবে রবীন্দ্রনাথ পর্যবেক্ষণ করছেন মানুষকে—সাধারণ মানুষকে। প্রকৃতি ও মানুষের ধারণার বাঁক বদল ঘটছে। সবে কালিগ্রামে এসেছেন তিনি। বোটে ভোরবেলা কুড়েমিতে ধরেছে। শুয়ে আছেন জানালার পাশে। তাঁকে তাড়া দেবার কেউ নেউ। এদিন প্রজারাও কেউ আসেনি। কাজের ভিড়ভাট্টাও কম।
তিনি ইন্দিরাকে লিখেছেন—
জলের মাঝে মাঝে যে লম্বা ঘাস এবং জলজ উদ্ভিদ জন্মেছে, জেলেরা জাল ফেলতে না এলে সেগুলো সমস্ত দিনের মধ্যে একটু নাড়া পায়না। পাঁচটা-ছটা বড়ো বড়ো নৌকা সারি সারি বাঁধা আছে, তার মধ্যে একটার ছাতের উপর একজন মাঝি আপাদমস্তক কাপড় মুড়ে রোদ্দুরে নিদ্রা দিচ্ছে—আর-একটার উপর একজন বসে বসে দড়ি পাকাচ্ছে। এবং রোদ পোহাচ্ছে। দাঁড়ের কাছে একজন আধ-বৃদ্ধ লোক অনাবৃত গাত্রে বসে অকারণে আমাদের বোটের দিকে চেয়ে আছে। ডাঙার উপরে নানান রকমের লোক অত্যন্ত মৃদুমন্দ অলস চালে কেন যে আসছে, কেন যে যাচ্ছে, কেন যে বুকের মধ্যে নিজের হাঁটু দুটোকে আলিঙ্গন করে ধরে উবু হয়ে বসে আছে, কেন যে অবাক হয়ে বিশেষ কোনো কিছুর দিকে না তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তার কোনো অর্থ পাওয়া যায় না।
পতিসর, ৭ মাঘ, ১২৯৮ বঙ্গাব্দ (১৮৯১)------------------------------
এদিন বোট রয়েছে ছোটো নদীর ঈষৎ বাঁকে। দুই উঁচু পাড়ের মধ্যে কোনটুকুতে। এখানে দূর থেকে বোটটিকে দেখা যায় না। বেশ চুপ করে থাকা যায়। কোন কোন—নৌকাওয়ালারা উত্তর দিক থেকে গুণ টেনে টেনে আসে, হঠাৎ একটা বাঁক ফিরেই এই জনহীন ঘাটের ধারে অকারণে একটা মস্ত বোট বাঁধা দেখে আশ্চর্য হয়ে যায়।–‘হা গা, কাদের বজরা গা?’ ‘জমিদার বাবুর।‘ ‘এখানে কেন?’ কাছারির সামনে কেন বাঁধ নি?’ হাওয়া খেতে এসেছেন?’ হাওয়া খেতে নয়—তিনি এসেছেন হাওয়ার চেয়েও কঠিন জিনিসের জন্য। কি জিনিস? এ প্রশ্নের জবাব তার স্বভাবে আছে।
তিনি লিখেছেন ইন্দিরাকে—
অনেক দূরে দূরে একটা-একটা ছোটো ছোটো গ্রাম আসছে। গুটিকতক খোড়ো ঘর। কতকগুলি চাল শূন্য মাটির দেয়াল, একটা দুটো খড়ের স্তুপ, কুলগাছ আমগাছ বটগাছ এবং বাঁশের ঝাড়, গোটা-তিনেক ছাগল চরছে, গোটা কতক উলঙ্গ ছেলেমেয়ে; নদী পর্যন্ত গড়ানো কাঁচা ঘাট, সেখানে কেউ কাপড় কাচছে, কেউ নাইছে, কেউ বাসন মাজছে; কোনো কোরো লজ্জাশীলা বধু দুই আঙুলে ঘোমটা ঈষৎ ফাঁক করে ধরে কলসী কাঁখে জমিদার বাবুকে সকৌতুকে নিরীক্ষণ করছে। তার হাঁটুর কাছে আঁচল ধরে একটি সদ্যস্নাত তৈলচিক্কন বিবস্ত্র শিশুও একদৃষ্টে বর্তমান পত্রলেখক সম্বন্ধে কৌতুহল নিবৃত্তি করছে—তীরে কতগুলো নৌকো বাঁধা এবং একটা পরিত্যাক্ত প্রাচীন জেলেডিঙি অর্ধনিমগ্ন অবস্থায় পুনরুদ্ধারের প্রতীক্ষায় আছে। ...এখানকার দুপুরবেলার মতো এমন নির্জনতা নিস্তবদ্ধতা আর কোথাও নাই।
১৮ নং পত্র সেই কঠিন জিনিসটিকে আরেকটু বিষদ করে বলেছেন। তিনি কেবল রূপ নয়-অরূপেরও সন্ধান পাচ্ছেন এই পূর্ববঙ্গে। আনন্দ নয়—বেদনার ধনও তার প্রাণ হরণ করছে। তিনি ধীরে ধীরে পাল্টে যাচ্ছেন। অন্য এক রবীন্দ্রনাথকে পেয়ে যাচ্ছি আমরা।
তিনি লিখেছেন—
ঐ-যে মস্ত পৃথিবীটা চুপ করে পড়ে রয়েছে ওটাকে এমন ভালোবাসি—ওর গাছপালা নদী মাঠ কোলাহল নিস্তদ্ভতা প্রভাত সন্ধ্যা সমস্তটা-সুদ্ধ দুহাতে আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছে করে। মনে হয় পৃথিবীর কাছ থেকে আমরা যে-সব পৃথিবীর ধন পেয়েছি এমন-কি কোনো স্বর্গ থেকে পেতুম? স্বর্গ আর কী দিত জানি নে. কিন্তু এমন কোমলতা দুর্বলতাময়, এমন সকরুণ আশঙ্কা-ভরা, অপরিণত এই মানুষগুলোর মতো এমন আপনার ধন কোথা থেকে দিত? আমাদের এই মাটির মা, আমাদের এই আপনাদের পৃথিবী, এর সোনার শস্যক্ষেত্র এর স্নেহ-শালিনী নদীগুলির ধারে, এর সুখদুঃখময় ভালোবাসার লোকালয়ের মধ্যে এই-সমস্ত দরিদ্র মর্ত হৃদয়ের অশ্রুর ধনগুলিকে কোলে করে এনে দিয়েছে। আমরা হতভাগ্যরা তাদের রাখতে পারিনে, বাঁচাতে পারিনে, নানা অদৃশ্য প্রবল শক্তি এসে বুকের কাছ থেকে তাঁদের ছিঁড়ে ছিঁড়ে নিয়ে যায়। কিন্তু বেচারা পৃথিবীর যতদূর সাধ্য তা সে করেছে।
এইখানে এসে সেই কঠিন জিনিসের একটি তালিকাও পাওয়া যাচ্ছে। ১. কোমলতা দুর্বলতা-ময়, এমন সকরুণ আশঙ্কা-ভরা, অপরিণত মানুষগুলি, ২. এই মাট মা, ৩. মানুষদের আপনাদের পৃথিবী, ৪. সোনার শস্যক্ষেত্র, ৫. স্নেহশালিনী নদীগুলি, ৬. দরিদ্র মর্ত হৃদয়ের অশ্রুর ধন। এই ধনগুলি কবির কাছে স্বর্গের চেয়েও বড় কিছু।
তিনি লিখেছেন—
আমি এই পৃথিবীকে ভারী ভালোবাসি। এর মুখে ভারী একটি সুদূরব্যাপী বিষাদ লেগে আছে—যেন এর মনে মনে আছে, আমি দেবতার মেয়ে, কিন্তু দেবতার ক্ষমতা আমার নেই। আমি ভালোবাসি, কিন্তু রক্ষা করতে পারি নে। আরম্ভ করি, সম্পূর্ণ করতে পারি নে। জন্ম দেই, মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে পারি নে। এই জন্যে স্বর্গের উপর আড়ি করে আমি আমার দরিদ্র মায়ের ঘর আরো বেশি ভালোবাসি—এত অসহায়, অসমর্থ, অসম্পূর্ণ, ভালোবাসার সহস্র আশঙ্কায় চিন্তাকাতর বলেই।
মন্তব্য
ভালো লেগেছে ....................
নতুন মন্তব্য করুন