কুলদা রায়
এমএমআর জালাল
নদী, আপন বেগে—বদলের সুর
কালিগ্রামের নদীটি মুমূর্ষু নাড়ির মত অতি ক্ষীণ। এই নদী পথে রবীন্দ্রনাথ যাত্রা করেছেন শাহাজাদপুরের দিকে। তারিখ ১২ মাঘ। বোট চলছে সকাল থেকে সন্ধ্যা সাতটা-আটটা পর্যন্ত। কবি বিশ্রামে আছেন বোটের মধ্যে। তাঁর নিজের কোনো গতি নেই। এদিন পড়তেও ইচ্ছে করছে না কিছু। লিখতেও না। কোনো কাজ করতে মন জাগছে না। চুপ করে বসে আছেন। কিন্তু দিব্যি টের পাচ্ছেন বাইরে একটি গতি বয়ে যাচ্ছে। সেটা অশান্ত। তার কোনো ক্লান্তি নেই। তিনি নিজের ভিতরে এরকম একটি প্রাণবন্ত গতি অনুভব করছেন।
শাহাজাদপুরে আসার পথে একটু বড়ো নদীতে বোট ঢুকে পড়েছে। সেখানে জল এবং ডাঙা দুটি অল্প বয়েসী ভাইবোনের মত। এর পরে পাড় আর নেই। থৈ থৈ জল।
তারপর খানিকটা সবুজ ঘাস—পৃথিবীর স্বচ্ছ জল। চারিদিকে জেলেদের বাঁশ পোতা—জেলেদের মাছ নেবার জন্য চিল উড়ছে। পাঁকের উপরে নিরীহ বক –নানারকমের জলচর পাখি—জলে ভাসা শ্যাওলা, পাকের মধ্যে অযোনীসম্ভুত ধানগাছ, কোথাও স্থির জল—সেখানে মশার ভন ভন। এখানে কবির বোট থেমে যায়। ঘুম নামে।
পরদিন ভোরে বোটটি আবার চলছে। বারো তের হাতে ছোটো খালের মধ্যে দিয়ে চলেছে। বিল থেকে সড় সড় করে জল নেমে আসছে প্রবল বেগে। জলের স্রোত বিদ্যুৎ বেগে বোটটিকে টেনে নিয়ে চায়। মাঝিরা লগি হাতে সামলাতে চেষ্টা করছে। সামলাতে না পারলে ডাঙার উপরে বোটটিকে আছড়ে ফেলতে পারে।
দিনটি মেঘলা। মাঝে মাঝে বৃষ্টি পড়ছে। শীতে সবাই কাঁছে। বেলা দুটোয় রোদ উঠেছে। এ সময় তাদের বোটটি ঢুকছে সেই নদীর দিকে—যার দুই ধার খুব উঁচু। সেখানে গাছপালা। লোকালয়। শান্তিময়। সুন্দর। নিভৃত।
ছিন্নপত্রে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন—আমাদের বাংলাদেশের একটি অপরিচিত অন্তঃপুরবাসিনী নদী। কেবল স্নেহ এবং কোমলতা এবং মাধুর্য পরিপূর্ণ। চাঞ্চল্য নেই। অথচ অবসরও নেই। গ্রামে যে মেয়েরা ঘাটে জল নিতে আসে এবং জলের ধারে বসে বসে অতি যত্নে গামছা দিয়ে আপনার শরীরখানি মেজে তুলতে চায়--তাদের সঙ্গে এর যেন প্রতিদিনের মনের কথা এবং ঘরকন্যার গল্প চলে।
সন্ধ্যাবেলায় বোটটি বাঁকের মুখে নিরালায় রাখা হয়েছে। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে, জলে একটিও নৌকো নেই। বহুদূরে গ্রামগুলি ঘুমিয়ে আছে। কেবল ঝিঁ ঝিঁ পোকা ডাকছে। আর কোনো শব্দ নেই। আছে নিস্তব্দতার গভীর অনুবাদ।
কিছুদিন আগে রবীন্দ্রনাথ ইউরোপ ভ্রমণ করে এসেছিলেন। বাংলার এই রূপের সঙ্গে একটা তুলনা করতে পেরেছেন তিনি সেই য়ুরোপের সঙ্গে। ভারত বর্ষের যেমন বাঁধাহীন পরিস্কার আকাশ, বহুদূর বিস্তৃত সমতল ভূমি আছে—এমন যুরোপের কোথাও আছে কিনা সন্দেহ। এই জন্যে আমাদের জাতি যেন বৃহৎ পৃথিবীর সেই অসীম ঔদাস্য আবিষ্কার করতে পেরেছে। এই জন্যে আমাদের পূরবীতে কিংবা টোড়িতে সমস্ত বিশাল জগতের হাহাধ্বনি যেন ব্যক্ত করছে, কারও ঘরের কথা নয়। পৃথিবীর একটা অংশ আছে যেটা কর্মপটু, স্নেহশীল, সীমাবদ্ধ, তার ভাটা আমাদের মনে প্রভাব বিস্তার করবার অবসর পায়নি। পৃথিবীর যে ভাবটা নির্জন, বিরল অসীম, সেই আমাদের উদাসীন করে দিয়েছে। তাই সেতারে যখন ভৈরবীর মিড় টানে আমাদের ভারতবর্ষীয় হৃদয়ে একটা টান পড়ে।
এই পৃথিবীর ভাবটা কিন্তু তার বেড়ে ওঠা কোলকাতার নয়। কোলকাতা তাঁর কাছে—সেই বাঁশতলার গলি, জোড়াসাঁকোর মোড়, সেই ছেকরা গাড়ির আস্তাবল, সেই ধূলো, সেই ঘড় ঘড়—হুড় মুড়—হৈ হৈ, সেই মাছি-ভন ভন ময়রার দোকান, সেই ঘোরতর হিজি বিজি হ-য-র-ল-ব। সেখানে তিন হাজার গির্জের চূড়ো, কলের চিমনি, জাহাজের মাস্তুল নীল আকাশে যেন গুতো মারতে উঠেছে। কোলকাতা তার সমস্ত লোষ্ট্রকাষ্ঠ দিয়ে প্রকৃতিকে গঙ্গা পার করেছে—তার উপর আবার এক পাঁচিল-দেওয়া নিমতলার ঘাট, মানুষের মরেও সুখ নেই।
সুখের ভাবটা পাচ্ছেন বাংলায়। তিনি যেখানে বোটে করে ঘুরছেন ছোটো বড়ো বিভিন্ন নদীতে। দেখতে পাচ্ছেন বিস্তীর্ণ মাঠ, মুক্ত আকাশ, আশেপাশের গ্রাম, সাধারণ ,মানুষের শান্ত নিস্তরঙ্গ সরল জীবনযাত্রা। তার হৃদয়ে ধরা পড়েছে—হাসি-কান্না-সুখ-দুঃখ ভরা বিভিন্ন চরিত্র। তার হৃদয়ে জারিত হয়ে এই সুর মুখর হয়েছে তার ছোটো গল্প। পরবর্তীতে এই সুরেই বদলে যাচ্ছে তার সামাজিক ও রাজনৈতিক ভাবনা। তাঁর লেখা-পত্তর। তাঁর ভুবনজোড়া জগৎখানি। সেটা বাংলার মুখ।
মন্তব্য
নতুন মন্তব্য করুন