কুলদা রায়
এমএমআর জালাল
প্রজানিপীড়ণ খণ্ড : তিন
১৮৬৮ সালের অমৃত বাজার পত্রিকা থেকে সে সময়ের পুলিশি ব্যবস্থা সম্পর্কে কিছু চিত্র পাওয়া যায়। সে সময়ে পূর্ব বঙ্গে প্রতিটি জেলায় গড়ে ৮০০-১০০০ জন পুলিশ নিযুক্ত ছিল। মফস্বলে পুলিশের দুর্দান্ত প্রতাপ—তা মফস্বলবাসীরা বিলক্ষণ জানেন। রিপোর্টে লেখা হয়েছে, একজন কনস্টাবল গ্রামকে গ্রাম অস্থির করিয়া তুলিয়াছে। এরূপে তাহারা কত স্থানে কত সময়ে তাদের পোষাক পরিয়া প্রজার নিকট হইতে বলপূর্বক অর্থ লয়, তাহার সংখা হিসাব করিয়া ওঠা যায় না। এরূপ অত্যাচার করিলে তাহাদের ধরিবার সম্ভাবনাও নাই। পালে মিশিয়া গেলে আর চিনিবার উপায় নাই। রিপোর্টটিতে পুলিশ কর্তৃক ডাকাতি করার ঘটনার উল্লেখ আছে।
এই রিপোর্টটি প্রকাশের ছয়মাস পরে ১৮৮৯ সালের ২৫ মার্চ পত্রিকাটি লিখেছে, বৎসর বৎসর পুলিশ ধনাগার হইতে অল্প টাকা শোষণ করিতেছে না।...পুলিশের সম্মুখে চুরি হইতেছে., ঘটনাস্থলে চোর ধৃত হওয়া দূরে থাকুক, ৫ বৎসর দিনরাত্রি পরিশ্রম করিয়াও তাহার কিছু অনুসন্ধান হয় না। পুলিশের উর্দ্ধতন কর্তা চোর ধরিতে না পারিয়া উল্টো অভিযোগ করিয়াছে—আদৌ চুরি হইতেছে না, লোখে মিছামিছি চুরির এজাহার দিতেছে।
...অত্যাচার করিয়া করিয়া পুলিশ লোকের নিকট এরূপ ঘৃণা ও আশঙ্কার পাত্র হইয়া দাঁড়াইয়াছে যে, ইচ্ছাপূর্বক কেহ উহাকে দোষানুসন্ধানে সাহায্য করে না।
আবার পুলিশ পর্যন্ত যাইয়া যদি তাহারা অব্যাহতি পায়, তবু একষ্ট অনেকে লইতে পারে। কিন্তু তাহার পর আবার সাক্ষী শ্রেণীভুক্ত হইয়া মাজিস্ট্রেট, হয়ত দাওরা পর্যন্ত দৌড়াদৌড়ি করতে হয়। একে হলপ পড়িয়া সাক্ষ্য দেওয়া এদেশীয়দের সংস্কার বিরুদ্ধ তাহাতে আবার হাকিমের বিশেষত সিবিলিয়ান সাহেবেরা, তাহাদের প্রতি অভদ্র ব্যবহার করেন, তাহাতে নিতান্ত বাধ্য না হইলে আর কেহ সাক্ষ্য দিতে সম্মত হয়েন না।...অনেক সময় আবার অনেক সিবিলিয়ান মনপুত কথা না বলিলে সাক্ষীদিগকে হাজতে পাঠান। না বুঝিতে পারিয়া সাক্ষ্য দেওয়ার সময় ভুল কহিয়া ফেলিলে তাহাদিগকে কঠিন পরিশ্রমের সহিত ফাটক ভোগ করিতে হয়।
পুলিশ ছাড়াও চৌকিদারী প্রথা গ্রামে বলবৎ ছিল বঙ্গদেশে। আঠার শতকে শুরুর দিকে বিখ্যাত ডাকাতরা গ্রামে চৌকিদারীর কাজ করত। তারা গ্রামে চুরি-ডাকাতির থেকে লোক্জনের সম্পত্তি রক্ষা করত। এক একজন ডাকাত দুইশত গ্রামের চৌকিদারী করার ভার নিত। তার অনুগত বাহিনীর সদস্যদেরকে বিভিন্ন গ্রামের দায়িত্বে দিত। এটা সত্ত্বেও কোনো গ্রামে যদি চুরি হত, তাহলে তারা চোর ধরত। চোর ধরতে না পারলে ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তিকে তারা ক্ষতিপূরণ প্রদান করত। এইজন্য ডাকাতদেরকে গ্রামবাসীরা উপযুক্ত কর দিত। প্রতি ডাকাত সর্দারদের অধীনে ৪০০-৫০০ ডাকাত সদস্য কাজ করত। তারা কখনো এই ব্যবসাটি গোপন করত না। সবাই তাদেরকে ডাকাত এবং চৌকিদার হিসাবে চিনতে। তারা নিজেরা তাদের এক্তিয়ার বহির্ভুক্ত এলাকায় কখনোই ডাকাতি করত না। অন্য এলাকায় করত।
বৃটিশ এসে এই ডাকাতদের অনেককেই আটক করেছিল। এদের কারো কারো প্রাণদণ্ড হয়েছিল—কারো যাবজ্জীবন হয়েছিল। একারণে ডাকাত দল আকারে ছোটো হয়ে গিয়েছিল। আগে যেখানে দুই-তিনশত গ্রামের দায়িত্ব নিত একজন ডাকাত সর্দর তার বড় ডাকাত বাহিনী থাকার কারণে, কিন্তু দলটির আকার ছোট হয়ে যাওয়ার কারণে এবং প্রকাশ্যে চলাফেরার অসুবিধার কারণে তারা একটি বা দুটি গ্রামের দায়িত্ব নেওয়ার মত সাহস করত। তারা রাতে পাহারা দিত। যদি এরপরও চুরি হত—তাহলে চোরের খোঁজ খবর করে দিত। এভাবে গ্রামের লোকজন এইসব ডাকাতদের উপর সন্তুষ্ট ছিল। তাদের উপর নির্ভর করা যেত। তাদের কাজটাই ছিল প্রজাদের জন্য কাজ করা করা। সরকার নিয়ে তাদের কোনো মাথা ব্যাথা ছিল না। বৃটিশদের তৎপরতার কারণে ডাকাতদের এই বিকল্পটি পেশাটি নষ্ট হয়ে যায় এবং তারা দুর্বল হয়ে পড়ায় আবার ডাকাতি-চুরি-ছ্যাচড়ামীর মত পেশায় জড়িয়ে পড়ে গোপনে গোপনে।
নির্ভরযোগ্য স্থানিয় প্রজাব্যবস্থাপনার চৌকিদারী ব্যবস্থা ধ্বংস করে বৃটিশরা গ্রামে গ্রামে চৌকিদারী প্রথা সৃষ্টি করছে। কোনো কোনো এলাকায় কোনো দুষ্কর্ম সংঘটিত হলে সরকারকে জানানোই হল চৌকিদারের মূল দায়িত্ব। ১৮৬৫ সালে সরকার থেকে একটি সার্কুলার জারি করে চৌকিদারদের কাজ সম্পর্কে জানানো হয়—চৌকিদাররা নিম্নলিখিত পরিস্থিতিতে সরকারকে খবর জানাবে--
১. যদি ডাকাতরা জোটবদ্ধ হয়।
২. গ্রামে চোরে থলিদার থাকে।
৩. ডাকাতি,খুন, ঘর জ্বালানি, চুরি প্রভৃতি হয়।
৪. যদি সহমরণ হওয়ার আশঙ্কা থাকে-- জমিদারের তদন্তে সংবাদকে খবর দেওয়াই হল চৌকিদারদের কাজ।
এ ছাড়া আরও কিছু নিত্য নৈমিত্তিক দায়িত্ব ছিল চৌকিদারদের—
১. থানায় কয়েকদিন পর পর হাজিরা দেওয়া।
২. ডাকাতি, চুরি, খুন করতে উদ্যত ব্যক্তিকে ও ফেরারী গ্রেফতারে সাহায্য করা।
৩. ডাকাতসহ যে কোনো বদমাস গ্রামে প্রবেশ অনুপ্রবেশ করলে সরকারকে জানানো।
৪. গ্রামে খুন, ডাকাতি, চুরি, দাঙ্গা ইত্যাদি হলে সরকারকে অবহিত করা।
চৌকিদাররা প্রজাদের কোনো কাজ করে না—তারা সরকারের কাজ করে। অথচ তাদেরকে বেতন দেয় প্রজা। অমৃতবাজার পত্রিকায় অভিযোগ করে বলা হয়—চৌকিদার পুলিশের ভৃত্য—প্রজাসাধারণের নয়। পুলিশ যা যা বলে তারা তাই তাই করে। পুলিশ যখন গ্রামে প্রবেশ করে—তখন চৌকিদার-পুলিশকে দেখে মনে হয় শৃগাল যেমন ব্যাঘ্রের পাছে পাছে থাকে সেই রকম চৌকিদাররাও পুলিশের সঙ্গে থেকে প্রজাদের নানা কায়দায় দোহন করে থাকে। প্রজাদের কাছ থেকে নানা ভয়ভীতি দেখিয়ে—বা ফাটকে পুরে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে পুলিশ টাকা পয়সা আদায় করে, সে কাজে চৌকিদাররা পুলিশদের সহযোগিতা করে সেই ঘুষের টাকার একটা ভাগ পায়। পুলিশকে সন্তুষ্ট রাখাই চৌকিদারের কাজ। তারা গ্রামে পাহারা দেয় না।
১৮৬৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি আমৃতবাজার পত্রিকায় লেখা হয়েছিল—বাঙ্গালার জেলে আর কয়েদী ধরে না। কয়েদীর সংখ্যা ক্রমে বাড়িতেছে। কিন্তু অপরাধের সংখ্যা কমিতেছে না। চোরের এবার বড় প্রাদুর্ভাব। এই রিপোর্ট থেকে আরও জানা যাচ্ছে, ডাকাতি কমেছে। তার কারণ অন্য। অমৃতবাজার এরপর ছোট্ট একটা প্রশ্ন করেছে—দণ্ড দ্বারা কোন্ অপরাধ কমিতেছে, তাহা আমরা জানিতে ইচ্ছা করি। ইংরেজ শাসনের ল এন্ড অর্ডার, আমলা, মাজিস্ট্রেট, পুলিশ এবং চৌকিদারী বঙ্গদেশের অপরাধ কমাতে পারে নি। আগে ছিল দেশীয়য় শোষক—এখন এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, শুধু বড় নয়, বিদেশী বৃহৎ শোষক।
তখন আমলারা বেতন অল্প বেতন পেত। নিয়মিত ঘুষ নেওয়াটাই ছিল তাদের অন্যতম দ্বায়িত্ব। একজনকে জেলে আটকালে –তার জায়গায় পদায়নপ্রাপ্ত অন্য আমলা এসে আরও ঘুষ নেয়। ফাঁসি দিয়েও ব্যাভিচার কমছে না—খুন থামছে না। দুষ্ট লোকের জন্য আমলারা ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে দিতে সদাসর্বদা প্রস্তুত। পয়সা দিয়ে ন্যায়-অন্যায়ের ধার না ধারে আমলারা যে কোনো কাজই করে দিচ্ছে। এ সবই ছিল জমিদার,ব্যবসায়ী, প্রতারক ধনীদের জন্য আদর্শ শাসনকাঠামো।
১৮৬৯ সালে ১০ জুন অমৃত বাজার পত্রিকা লিখেছে, হাকিম, মুন্সেফ, ডেপুটি কালেক্টররা অসাধু আচরণে অভ্যস্থ। সবর্ত্র ঘুষের কারবার। দেশী কর্মচারীরা নেয় একশত টাকা ঘুষ—বিদেশী কর্মচারীরা চারশত টাকার নিচে খুশী নয়।
কতকগুলি জমিদারের পুরনাখাতা অনুসন্ধান করিলে দেখা যাইবে, দশ হাজার, বিশ হাজার, মাজিস্ট্রেট কি জজের কিত্রিম নাম দিয়া বকশিস বলিয়া লেখা আছে। অধিক দিনের কথা নয়, প্রায়. দশ বৎসর হইল একজন সিবিলিয়ান জজ এক লক্ষ টাকা পাইয়া গুরুতর মকদ্দমার ন্যায় বিক্রি করেন। তিনি এখন উচ্চ বিচারপতি।
অমৃতবাজারের অই রিপোর্টটিতে ফরেস্টারদের দূর্নীতিরও তথ্য আছে। অভিযোগ করেছে, টাকা পেলে ইউরোপীয় ডাক্তার মিথ্যা সার্টিফিকেট প্রদান করে।
স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সম্পর্কে লেখা হয়েছে ১৮৬৯ সালের ১ জুলাই সংখ্যার অমৃতবাজারে, আট দশ বৎসর যাবৎ বঙ্গদেশ সংক্রামক জ্বরের আক্রমণে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। এক গ্রাম সুস্থ হলেও অন্য গ্রামের মানুসজন অসুস্থ হয়ে ধুকছে। এইরূপ মেলেরিয়া বঙ্গদেশের প্রায় সর্বত্রই বিচরণ করছে। পল্লীগ্রামেই এই রোগের বিশেষ প্রাদুর্ভাব। শহারাঞ্চলে কম। কারণ শহরের সাহেবদের দৃষ্টি রয়েছে। সেখানে নেটিভরা নয়—সাহেবরাও বাস করে।
পল্লীগ্রামের পথঘাট পুকুর অপরিস্কার। এগুলো নিষ্কাশনের কোনো ব্যবস্থা নেই। আগে লোকজন ধর্ম্মবুদ্ধিতে পথঘাট পরিস্কার রাখতেন। নূতন পুকুর খনন করতেন। পুরনো পুকুর সংস্কার হত। বর্তমানে পুকুর জলাশয়ের জল নির্মল নয়। পানের অযোগ্য—দুর্গন্ধযুক্ত। জীবানুদুষ্ট। বর্ষাকালে ঐ সব পুকুর ডোবার জল উপচে পড়ে। রাস্তাঘাট ডুবে যায়--প্যাক কাদায় চলাচলের অনুপযুক্ত হয়ে ওঠে।
পুকুরের পাড় গ্রামের লোকজনের বিষ্টাত্যাগের স্থান। মলিন আবর্জনা, পচাঘাস, লতা, পাতা, ঝাড়, জঙ্গল পথঘাট-জলাশয় পূর্ণ। মশা-মাছি ঘিন ঘিন করে। সবকিছুই অস্বাস্থ্য কর। বর্ষাকাল পল্লীগ্রাম বসবাসের উপযুক্ত নয়। বর্ষার শেষে পীড়ার উৎপত্তি এবং শীত ঋতুর শেষ পর্যন্ত এই রোগ প্রবল হয়ে থাকে। গ্রামে কোনো মিউনিসিপালিটি না থাকায় এইসব জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি দেখার কেউ নেই। উপার্জনের ন্যূনতা হেতু সেখানে ডাক্তার গমন করেন না। অনেক অসমাপ্ত কম্পাউন্ডার বা অসমাপ্ত পাথ অর্থাৎ দুই এক বৎসর বা দুই এক মাস মেডিকেল কলেজে হাজিরা দিয়েছেন এমন ব্যক্তিরা পল্লীগ্রামের চিকিৎসা করেন। ফলে প্রকৃত চিকিৎসা সুবিধা থেকে পল্লীবাসীরা আঞ্চিত।
এর মধ্যে চলছে ইংরেজ শাসন এবং জমিদারের খাজনা আদায়ের কাছারি। এই সময়ের এইসব পল্লীচিত্র পাওয়া যাচ্ছে তৎকালীন সংবাদপত্রের পাতায়। ইংরেজরা খাজনা দাবী করত জমিদারদের কাছে—জমিদাররা প্রজাদের ঘাড়ে ধরে অস্থিমজ্জাসহ আদায় করে ছাড়ত। দেখা যেত প্রজার শরীরের শীর্ণ হচ্ছে—খাজনা বাড়ছে। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে প্রবলদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে ওঠাটাই স্বাভাবিক।
এইরকম পরিস্থিতির মধ্যে ১৮৭১ সালের দিকে পাবনা সিরাজগঞ্জ এলাকার জমিদাররা খাজনা বেআইনীভাবে বাড়িয়ে দিলে প্রজারা খাজনা দেওয়া বন্ধ করেছিল। খাজনা জমা দিচ্ছিল কোর্টের কাছে। তারা দাবী করেছিল, জমিদাররা বেআইনীভাবে জমির খাজনা বাড়িয়েছে। জমিদার পক্ষ ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে কোর্টের কাছে বলে যে, তারা (জমিদাররা) মোটেই খাজনা বাড়ায়নি। যে হারে এ বছর প্রজাদের কাছে খাজনা দাবী করেছে গত ১০ বছর ধরে এই হারেই খাজনা আদায় করে আসছে। ১৮৭২ সালের এপ্রিল মাসে শাহাজাদপুরের মুন্সেফ জমিদারদের পক্ষে রায় দেয়। কিন্তু ডিসেম্বর মাসে রাজশাহীর সিবিল কোর্ট প্রজাদেরদের পক্ষে রায় দেয়। কোর্ট বিশ্বাস করে যে প্রজাদের অভিযোগ সত্য—জমিদারদের খাজনাসংক্রান্ত কাগজপত্র ভুয়া। এভাবে জমিদারদের বিরুদ্ধে প্রজাদের একটা নৈতিক জয় ঘটে।
আরেকটি ঘটনাও ঘটেছিল পাবনা সিরাজগঞ্জ এলাকায় এই সময়। এ এলাকায় পাট একটি অর্থকরী ফসল হিসাবে চাষ হতে থাকে। পাটের দরও ভালো পাওয়া যাওয়া শুরু করেছিল। এর ফলে পাটের ব্যবসার মাধ্যমে কৃষকদের মধ্যে একটি গ্রামীণ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে। এরা খাজনা আদায়কারী জমিদারদের বিরুদ্ধে একটি পাল্টা শক্তি হিসাবে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। ১৮৭৩ সালে পাটের বাজার দর হঠাৎ করে পড়ে যাওয়ায় কৃষকরা এবং এই মধ্যবিত্ত শ্রেণী একটা দুরাবস্তার মধ্যে পড়ে যায়। জমিদাররারা এই অর্থনৈতিক দুরাবস্থাকে আমলে নিতে পারে নাই। সে সময়ে আমলে নেওয়ার অবস্থাও তাদের ছিল না। তাদের ঘাড়ে জমিদারি বাঁচানোর জন্য এবং তাদের বিলাসী জীবনের জন্য যে কোনো প্রকারেই খাজনা আদায় করাটাই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল। ফলে এই এলাকায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। একটি দুর্ভিক্ষঅবস্থার সৃষ্টি হয়। কিন্তু সিরাজগঞ্জ এলাকার কিছু জমিদার খাজনার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। ফলে এই এলাকায় প্রজারা বিক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠে। তারা একটি প্রজা লীগও গঠন করে।
তখন ঐ এলাকার জমিদার ছিলেন ঠাকুর পরিবারের দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথের বয়স ছিল মাত্র ১২ বছর। রবীন্দ্রনাথের সবেমাত্র উপনয়ন হয়েছে। দেবেন্দ্রনাথ ধর্মকাজে কোলকাতায় থাকেন না। বা জমিদারী এলাকায় যান না। গেলেও কদাচিৎ। জমিদারীর ভার নায়েব-গোমস্তা আর ইংরেজ কর্মচারীর উপর। তিনি ভ্রমণে ব্যস্ত থাকেন। প্রায়ই হিমালয়ে যান। জমিদারীর প্রজাবিষয়ে এক ধরনের স্বাভাবিক ঔদ্যাসীন্য ছিল।
এই ১৮৭৩ সালে বালক রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে দেবেন্দ্রনাথ প্রথমে শান্তিনিকেতনে গেলেন ১০ ফেব্রুয়ারি। সেখান থেকে মার্চের শুরুতে হিমালয়ের উদ্দেশ্য রওনা হলেন। চার মাস কাটিয়ে (১৮৭৩ সালের ফেব্রুয়ারি ১০-মে ২৩) কোলকাতায় ফিরে এলেন। দেবেন্দ্রনাথকে জমিদারী এলাকায় দেখা গেল না। দেখা গেলেও তা ছিল ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে ভ্রমণ।
এই সময়েই কোর্টের রায় অমান্য করে জমিদাররা খাজনা আদায়ের জন্য প্রজাদের উপর জোর জবরদস্তি চালিয়ে যেতে থাকে। ফলে ১৮৭৩ সালের মে মাসে পাবনা প্রজা লীগ টিকে থাকার লক্ষ্য জমিদারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এই বিদ্রোহ গোটা পাবনা জেলায়ই ছড়িয়ে পড়ে। এই কৃষক নেতদের প্রধান নেতার নাম ঈশানচন্দ্র রায়। সবার কাছে তিনি ঈশান রাজা নামে পরিচিত হয়েছিলেন। তার দুজন প্রধান অনুসারীর নাম খুদী মোল্লা এবং শম্ভুনাথ পাল।
এই বিদ্রোহীরা পাবনা-সিরাজগঞ্জ পরগণাকে জমিদারমুক্ত স্বাধীন এলাকা ঘোষণা করে। তারা একটা স্থানীয় প্রশাসনিক কাঠামোও প্রণয়ন করে। এমনকি তারা বিদ্রোহী সেনাবাহিনীও গঠন করে জমিদারদের লাঠিয়াল বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করা শুরু করে। প্রশাসনিক বিভিন্ন বিভাগ বা শাখায় তাদের অনুগত লোকজনদের নিয়োগ দেয়। কিছু কিছু অনুগত প্রজা বিদ্রোহী সেনাবাহিনীর দায়িত্বে ছিল এবং তারা জেলার বিভিন্ন এলাকায় দায়িত্ব পেয়েছিল। প্রথম দিকে পাবনা আন্দোলনটি আইনসম্মত ও অহিংস ছিল। কিন্তু ধীর ধীরে যখন বিদ্রোহী প্রজালীগের শক্তি বেড়ে গেল তখন তারা আর অহংস থাকতে পারে নি। তারা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছিল।
এই প্রজা লীগের কর্মকাণ্ড সাধারণ মানুষের শান্তি ভঙ্গ করা শুরু করেছিল তখন বৃটিশ সরকার শান্তি রক্ষার্থে কিছু ব্যবস্থা নিয়েছিল। বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার জর্জ ক্যাম্পবেল ইংরেজদের পক্ষে ৪ জুলাই ১৮৭৩ একটি অধ্যাদেশ জারি করে সকল প্রকার অশান্তি দূরীকরণের ঘোষণা দেন। তিনি জমিদারদের নির্যাতনের পরিবর্তে আইনের পথে যাওয়ার পরামর্শ দেন। আর এই সময় এই আন্দোলন থামানোর জন্য প্রচুর পুলিশ পাঠানো হয় পাবনা-সিরাজগঞ্জ এলাকায়। ফলে ঐ এলাকায় স্বাভাবিক পরিস্থিতি নষ্ট হয় এবং ১৮৭৩-১৮৭৪ সালে একটি দুর্ভিক্ষ ঘটে। মিস ফ্লোরেন্স নামে এক ইংরেজ মহিলা তখন দুর্ভিক্ষের তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখান যে বাংলার দুর্ভিক্ষের জন্য দায়ী অনুন্নত সেচব্যবস্থা। পাশাপাশি তাদের দারিদ্র, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বা খাজনাআদায়কারী বা জমিদার এবং সুদখোর মহাজনের কর্মকাণ্ডই এই দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি করেছে।
এক সঙ্গে পঁচিশ পর্ব পড়ার লিংক--রবীন্দ্রনাথের জমিদারগিরি—জমিদারের রবীন্দ্রগিরি
মন্তব্য
নতুন মন্তব্য করুন