কুলদা রায়
এমএমআর জালাল
প্রজানিপীড়ণ খণ্ড : চার
ডঃ আহম্মেদ শরিফ লিখেছেন, ঠাকুর-পরিবার প্রজানীপিড়ন করেছেন। আবুল আহসান চৌধুরী ডঃ শরীফকে চিঠিতে উত্তর দিয়েছিলেন, সেখানে ঠাকুর-পরিবারের প্রজানীপিড়নের স্বপক্ষে কিছু কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, এ রকম কিছু তথ্য পাওয়া যায়। বলেছিলেন সেটা ১৯৮৫ সালের লেখা চিঠি। আর ২০১১ সালে আবুল আহসান চৌধুরী বলেছেন শাশ্বতিকী পত্রিকায়—
পূর্ববঙ্গের জমিদারির দেখভাল দ্বারকানাথ ঠাকুর নিজেও একসময় করেছেন- সে একেবারে গোড়ার দিকের কথা। তাঁর হাতেই এসব জমিদারি-সম্পত্তি কেনা। পরে দেবেন্দ্রনাথ নিজে দেখাশুনা করেছেন এবং তাঁর বড় ছেলে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরও এ অঞ্চলের-- বিশেষ করে সাজাদপুরের জমিদারি দেখাশুনা করেছেন। অন্য ছেলেদের মধ্যে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা ভালো যোগাযোগ ছিল শিলাইদহ অঞ্চলের সঙ্গে। দ্বিজেন্দ্রনাথ পাবনার প্রজা-বিদ্রোহের সময় খুব ভালো ভূমিকা পালন করেন নি, এটা ১৮৭৩ দিকের কথা, সিরাজগঞ্জের সাজাদপুর অঞ্চলে যে কৃষক-বিদ্রোহ হয়েছিল তা দমনের জন্যে ঠাকুর-জমিদারেরা যথেষ্ট জবর-জুলুম ও নানা কূট-কৌশলও খাটিয়েছিলেন। আলাভোলা দ্বিজেন্দ্রনাথ প্রজাপীড়নে যে কতো দড় হতে পারেন -- কাঙাল হরিনাথের অপ্রকাশিত ডায়েরি ও গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকার পাতায় তার নমুনা আছে।
দ্বারকানাথ ব্যবসা করেছেন। জমিদারী কিনেছেন। এবং জমিদারী পরিচালনা করেছেন বৃটিশকর্মচারীদের মাধ্যমে। নিজে জমিদারি পরিচালনা করেন নি। তার সময়ে প্রজানীপিড়ন হওয়াটা অসম্ভব কিছু নয়। দেবেন্দ্রনাথ যখন ঠাকুর-পরিবারের হাল ধরেন তখন তো জমিদারীই একমাত্র পারিবারিক আয়ের উৎস। সুতরাং যে কোনোভাবেই হোক না কেন জমিদারীটা টিকিয়ে রাখা তার দরকার ছিল। আবার তার বিশাল পরিবারের জন্য এবং ব্রাহ্মধর্মপ্রচারসহ নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জন্যও অর্থ প্রয়োজন ছিল। তিনি নিজেও জমিদারী এলাকায় গিয়েছেন। সেটা খুবই কম। আবার সেখানে যাওয়ার উদ্দেশ্যও যতটা না জমিদারী তার চেয়ে বেশী ছিল ব্রাহ্মধর্মসভার উপাসনা সভায় যোগদান। বাল্যকালে রবীন্দ্রনাথও দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গেই এরকম একটা সফরে প্রথমবারের মত শিলাইদহে গিয়েছিলেন। দেবেন্দ্রনাথের জমিদারী নায়েব-গোমোস্তারা পরিচালনা করতেন। পরে দায়িত্ব দিয়েছিলেন তার পুত্র, জামাই এবং নাতিদের উপর। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজে জমিদারী এলাকায় গিয়ে জমিদারী দেখেছেন। প্রজাদের সঙ্গেও তার ভালো সম্পর্ক ছিল। কিন্তু দীর্ঘ সময়ে অন্যরা জমিদারী সরাসরি দেখেন নি। নায়েব-গোমস্তা এবং ইংরেজ সাহেবদের উপরই খাজনা আদায়ের দায়িত্ব দিয়ে রেখেছেন। কোলকাতার সেরেস্তায় বসে হিসাবপত্র দেখেছেন।
দেবেন্দ্রনাথের সময়ে বৃটিশ নীলকর কেনী সাহেব শিলাইদহের জমিদারীর খাজনা আদায়ের ইজারা নিতে চেয়েছিল। কেনী সাহেব ছিল দুর্ধর্ষ রকমের পীড়ক নীলকর। প্রজারা দেবেন্দ্রনাথকে অনুরোধ করেছিল—কেনীকে ইজারা না দিতে। দেবেন্দ্রনাথ প্রজাদের অনুরোধ শুনেছিলেন। কিন্তু তার নিজের ধর্মপ্রচারকর্মে এত বেশী মগ্ন ছিলেন যে নিজে জমিদারিতে কি হল না হল, বা নায়েব-আমলারা জমিদারীতে কি করল না করল তা নিয়ে মাথা ঘামাতে চান নি বা পারেন নি। তিনি পুত্র, জামাই এবং নাতিদের উপর দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তারা জমিদারী এলাকায় গেলে হয়তো আমলানির্ভরতা কমানো সম্ভব হত। সবাই সেটা করেন নি। ফলে প্রজানীপিড়নের ছিদ্র সব সময়ই কিছু না কিছু থেকে গিয়েছিল।
দেবেন্দ্রনাথের সময়ের একটা ঘটনার কথা লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ ছিন্নপত্রে ইন্দিরা দেবীকে।
তারিখ : ২১ আগস্ট, ১৮৯৩ খ্রীস্টাব্দ।
‘আজ একজন এসে বলেছিল, সে বছর ভালো ধান হয় নি বলে চুঁচড়োয় বুড়ো বাপের কাছে এনছাপ নিতে গিয়েছিলুম, তা সে বললে, আমি তোদের কিছু ছেড়ে দিচ্ছি, তোরাও আমাকে কিছু খেতে দিস। তার কাছে দরবার করতে গিয়েছিলুম বলে সেই মনোবাদে এখানকার আমিন আমাকে ফেরেবি মকদ্দমা করে তিন মাস জেল খাটিয়েছিল। আমি তখন তোমার মাটিকে সেলাম করে ভিন এলাকায় চলে গিয়েছিলুম।‘
প্রজা কথিত এই বুড়ো বাপ হলেন রবীন্দ্রনাথের বাবা দেবেন্দ্রনাথ।
১৮৭৫ সালের মার্চ মাসে দেবেন্দ্রনাথের পত্নী সারদা দেবীর মৃত্যুর হলে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে দেবেন্দ্রনাথ বেশিদিন থাকেন নি। তিনি বহুকাল কাটিয়েছেন চুঁচড়াতে। ১৮৯৮ সালের নভেম্বর মাসে তিনি কোলকাতায় ফিরে আসেন।
পশ্চিমবঙ্গের হুগরী জেলার একটি ছোটো শহর হল চুচড়া। হুগলী শহরটি ছিল পর্তুগিজদের অধিকারে এবং চুঁচুড়া ছিল ওলন্দাজদের দখলে। অষ্টাদশ শতকের শেষ ভাগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী দুই-ই দখল করে ও পরে ১৮৬৫ সালে এই দুই প্রশাসনিক অঞ্চলকে একত্রিত করা হয়। বাড়ি ও ব্রাহ্ম সমাজের কর্তারা আবশ্যক মতো চুঁচড়ায় যেতেন নানা কাজে তাঁর আদেশ ও উপদেশ নিতে।
এই বুড়ো প্রজা লোকটি দেবেন্দ্রনাথের কাছে গিয়েছিলেন কালীগ্রাম থেকে হুগলীর চুঁচড়ায়। গিয়েছিলেন খাজনা মাপ করার দাবী নিয়ে। সে বছর ফসল ভালো হয় নি বলে খাজনা দেওয়ার সামর্থ্য নেই। কাছারির নায়েব-গোমস্তারা তাদের কাছে খাজনা চেয়েছে। ফসল হওয়া—না হওয়াটা নিয়ে তাদের মাথা ব্যাথা নেই। তাদের মাথা হল—খাজনা দেও। দেওয়ার সামর্থ্য না থাকলে মহাজনের কাছে যাও। না হলে পাইক পেয়াদা দিয়ে পিটিয়ে ঢিঁট করা হবে। এইতো আমলা শ্রেণীর চরিত্র। তারা মাপ করেন না। সব কিছু গাপ করেন।
এই তথ্য থেকে ধারণা করা যায়—সে সময় জমিদার দেবেন্দ্রনাথ জমিদারী এলাকায় ছিলেন না। ছিলেন চুঁচুড়াতে। প্রজারা তার কাছে যেতেও পারত। দাবী করতে পারত। প্রজা আর দেবেন্দ্রনাথের সংলাপ থেকে বোঝা যাচ্ছে প্রজা একা যায় নি চুঁচড়াতে। সঙ্গে আরও প্রজা ছিল। তাদের সবার দাবী নিয়েই তারা জমিদারের সঙ্গে কথা বলেছে। জমিদার তাদের কথা বিশ্বাস করেছেন। মেনে নিয়ে কিছু খাজনা মাপও করে দিয়েছেন। দেবেন্দ্রনাথ বলেছেন, তোরাও কিছু দিস। কিছু দিয়ে যেন জমিদারকেও বাঁচিয়ে রাখে। তাহলে দেখা যাচ্ছে জমিদার দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে তার প্রজাদের সম্পর্ক মন্দ নয়। একটা সমঝোতার মধ্যে আছে। উভয়ে উভয়ের জন্য ভাবে। সমস্যা বোঝো। পাশে দাড়ায়। আবার এবং প্রজারা জমিদারের এই সিদ্ধান্তে খুশী হয়েই কালীগঞ্জে ফিরে এসেছে।
তবে এই খানেই ঘটনাটি শেষ নয়। আরওকিছু অংশ আছে। প্রজারা জমিদারের কাছ থেকে খাজনা মাপ পেয়ে কাছারিতে গেছে সেই খাজনা দিতে। আর নায়েব-গোমস্তা-আমিনরা তাদের এড়িয়ে সরাসরি জমিদারের কাছে যাওয়ার অপরাধে তাদেরকে জেলে পুরেছে প্রতারণা মামলায়। জেল খেটেছে তিন মাস। তাহলে ঘটনা কি বলে? বলে প্রজা নিপীড়িত হয়েছে দেবেন্দ্রনাথের জমিদারীতে। সেটা করেছে তার কাছারির আমলারা। জমিদার দেবেন্দ্রনাথ যদি কালিগ্রামে থাকতেন, তাহলে আমলারা এই প্রজানীপিড়ন করার সাহস পেত না। তিনি এ বিহীত করতে পারতেন। প্রজারাও তার কাছে নালিশ জানাতে পারত।
প্রজাটি মনে কষ্ট পেয়েছে। মনে কষ্ট পেয়ে আবার দেবেন্দ্রনাথের কাছে ছুটে যায় নি নালিশ জানাতে। চলে গেছে দেবেন্দ্রনাথের জমিদারী এলাকা ছেড়ে অন্য পার্শ্ববর্তী জমিদারের এলাকায়।
পাশের জমিদারের কাছ থেকে কিছু জমি নিয়ে চাষ করতে শুরু করেছে। জমিতে ফসলও হয়েছে। সে সময়ে প্রজাটি দেখতে পেল দেবেন্দ্রনাথের জমিদারী এলাকার কিছু জমিদারীর জমিসম্পত্তি অন্যায়ভাবে দখল করে রেখেছে এই জমিদার। তা হয়তো দেবেন্দ্রবাবুর কাছারির নায়েব বাবুরা জানে না। এই খবরটি প্রজা দেবেন্দ্রবাবুর কাছারিতে এসে জানিয়ে গেছে। তখন তারা জমিগুলো উদ্ধার করে নিয়েছে। এই অপরাধে সেই জমিদার প্রজাটির ধানসহ জমিজমা সব কেড়ে নিয়েছেন। প্রথম ঘটনাটির ক্ষেত্রে নিপীড়ক জমিদার নয়—দেবেন্দ্রনাথের আমলা। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে নিপীড়ক জমিদার।
প্রজাটি কেন ফসল হারানোর মত বিপজ্জনক কাজ করল? কেন দেবেন্দ্রনাথের কাছারিতে পাশের দখলদার জমিদারের জমি দখলের ঘটনাটি বলতে এসেছিল? এর উত্তর আছে ছিন্নপত্রের ঐ চিঠিতে—বুড়ো বলছেন রবীন্দ্রনাথকে—
‘আমি যার মাটিতে বুড়োকাল পর্যন্ত মানুষ হয়েছি তার হিতের কথা আমি বলতে পাব না? এই বলে সে চোখ থেকে দুই-এক ফোঁটা জল মুছে ফেললে।‘
যে সময়ে প্রজাটির মুখ থেকে এই ঘটনাটি শুনেছিলেন, তখন ফ্রান্সের আর্টিস্টদের কিছু খবরাদি পড়ছিলেন পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ। তিনি তখন বলেছিলেন, কোথায় প্যারিসের আর্টিস্টদের উন্মত্ততা আর কোথায় আমার কালীগ্রামের সরল চাসী প্রজাদের দুঃখদৈন্যনিবেদন। আমার কাছে এই সমস্ত দুঃখপীড়িত অটল-বিশ্বাস-পরায়ণ অনুরক্ত প্রজাদের মুখে বড়ো একটি কোমল মাধুর্য আছে। বাস্তবিক এরা যেন আমার একটি দেশজোড়া বৃহৎ পরিবারের লোক। এই-সমস্ত নিঃসহায় নিরুপায় নিতান্তনির্ভর সরল চাষাভূষোদের আপনার লোক মনে করিয়া একটি সুখ আছে।
তাহলে রবীন্দ্রনাথের বাবা দেবেন্দ্রনাথের জমিদারীমেজাজটা বাস্তবিকই নির্মম মনে হয় না এই সব ঘটনা থেকে। তিনি নিজেও লিখেছেন তার আত্মজীবনীতে জমিদারী এলাকা ভ্রমণের কথা। কিন্তু সেখানে বেশীর ভাগই উল্লেখ করেছেন বাহ্মধর্মের কথা, তার আধ্যাত্ম্য দর্শনের বয়ান। জমিদারী বিষয় সম্পত্তি নিয়ে তার তেমন মাথা ব্যাথা ছিল না। তবে তিনি যে উদাসীন ছিলেন তা কিন্তু নয়। বিষয়সম্পত্তির ক্ষেত্রে তিনি সকলের চেয়ে সজাগ ছিলেন। ১৮৫৩ সালে লেখা তাঁর একটা চিঠিতে দেখা যাচ্ছে তিনি শিলাইদহ ইত্যাদি স্থানে নিজে গিয়ে জমিদারী পরিচালনা করছেন। জীবনস্মৃতিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন জমিদার দেবেন্দ্রনাথ বিষয়ে—
..তিনি (দেবেন্দ্রনাথ) তখন নিজে পড়িতে পারিতেন না। গত মাসের ও গত বৎসরের সঙ্গে তুলনা করিয়া সমস্ত আয়ব্যয়ের বিবরণ তাঁহার সম্মুখে ধরিতে হইত। প্রথমমত মোটা অঙ্কগুলো তিনি শুনিয়া লইতেন এবং মনে মনে তাহার যোগবিয়োগ করিয়া লইতেন। মনের মধ্যে যদি কোনো অসংগতি অনুভব করিতেন তবে ছোটো ছোটো অঙ্কগুলো শুনাইয়া যাইতে হইত। কোনো কোনো দিন এমন ঘটিয়াছে, হিসাবে যেখানে কোনো দুর্বলতা থাকিত সেখানে তাঁহার বিরক্তি বাঁচাইবার জন্য চাপিয়া গিয়াছি, কিন্তু কখনো তাহা চাপা থাকে নাই। হিসাবের মোট চেহারা তিনি চিত্তপটে আঁকিয়া লইতেন। যেখানে ছিদ্র পড়িত সেখানেই তিনি ধরিতে পারিতেন। এই কারণে মাসের ওই দুটা দিন বিশেষ উদ্বেগের দিন ছিল।..
এ বিষয়ে সমীর সেনগুপ্ত মন্তব্য করেছেন, দেবেন্দ্রনাথের চরিত্রে দার্শনিকতা ও বৈষয়িকতার অদ্ভুত পরস্পরবিরোদী সহাবস্থান দেখা যায়। তাঁর ধর্মবোধ, ন্যায়পরায়ণতা, অপৌত্তলিক ধর্মে ও একমেবোদ্বিতীয়ম ঈশ্বরে বিশ্বাস, নানা জনহিতকর কর্মে উৎসাহ ইত্যাদি বিষয়ে বহুবিখ্যাত, কিন্তু তাঁর চরিত্রের বৈষয়িক ও প্রভুত্বপ্রিয় দিকগুলি ত পরিচিত নয়। সব কিছু থেকে দূরে থেকেও তাঁ জমিদারী, আদি ব্রাহ্মসমাজ ও পরিবারকে কঠোর নিয়ন্ত্রণ রাখতেন। তাঁর শাসনকালেই তাঁর জমিদারীতে প্রজাপীড়নের সংবাদ হরিনাথ মজুমদারের (১৮৩৩-১৮৯৬) গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকায় প্রকাশিত হয়।
তাহলে গ্রামবার্তা প্রকাশিকায় দেবেন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে প্রজানিপীড়নের অভিযোগ উঠেছিল। রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে নয়। বাবা দেবেন্দ্রনাথ যদি প্রজানীপিড়ন করেও থাকেন, তাহলে অপরাধটা দেবেন্দ্রনাথের। রবীন্দ্রনাথের নয়। তাহলে বাবার অপরাধে ছেলে অপরাধী হবে কেন?
প্রফেসর আবুল আহসান চৌধুরী আরেকটি তথ্য জানাচ্ছেন, রবীন্দ্রনাথের পূর্ববঙ্গের জমিদারির দেখভাল দ্বারকানাথ ঠাকুর নিজেও এক সময় করেছেন—সে একেবারে গোড়ার দিকের কথা। তাঁর হাতেই এসব জমিদারি-সম্পত্তি কেনা। পরে দেবেন্দ্রনাথ নিজে দেখাশুনা করেছেন এবং বড় ছেলে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরও এ অঞ্চলের—বিশেষ করে সাজাদপুরের জমিদারি দেখাশুনা করেছেন। ...দ্বিজেন্দ্রনাথ পাবনার প্রজা-বিদ্রোহের সময় খুব ভালো ভূমিকা পালন করেন নি, এটা ১৮৭৩ দিকের কথা, সিরাজগগঞ্জের সাজাদপুর অঞ্চলে যে কৃষক-বিদ্রোহ হয়েছিল তা দমনের জন্যে ঠাকুর-জমিদারেরা যথেষ্ট জবর-জুলুম ও নানা কূটকৌশলও খাটিয়েছিলেন। আলাভোলা দ্বিজেন্দ্রনাথ প্রজাপীড়নে যে কতো দড় হতে পারেন—কাঙাল হরিনাথের অপ্রকাশিত ডায়েরি ও গ্রামবার্তা প্রকাশিকার পাতায় তার নমুণা ছড়িয়ে আছে।
কিন্তু তথ্য বলে অন্য কথা। বলে, দ্বিজেন্দ্রনাথ পুরোপুরি তাত্ত্বিক জগতের মানুষ ছিলেন, কোনো কিছু গড়ে তোলার কি পরিচালনা করার গুণাবলি বা উৎসাহ তাঁর চরিত্রে ছিল না। দেবেন্দ্রনাথ তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্রের চরিত্র ভালো করেই বুঝতেন, জমিদারি পরিচালনা করার তাঁর উপরে তাই অর্পন করেন নি। তার চেয়ে অচলিত ছন্দে বাংলায় ছড়া লেখা তাঁর কাছে অনেক কাঙ্ক্ষণীয় ছিল।
তবু দেবেন্দ্রনাথ তাঁকে ১২৯১ (১৮৮৪) সালে জোড়াসাকোর হিসাবপত্র বড় ছেলে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে দেখার দায়িত্ব দেন। তিনি এই কাজটি পছন্দ করতেন না। মাত্র দেড় মাস পরে তাই তাঁর পুত্র দ্বিপেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে এ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তার মানে দ্বিজেন্দ্রনাথ মাত্র দেড় মাস জমিদারি পরিচালনা করেছিলেন। দ্বিপেন্দ্রনাথ ২৩ আগস্ট ১৮৮৪ তারিখ থেকে ঠাকুরপরিবারের জমিদারির হিসেবপত্র পরীক্ষা করার দায়িত্ব পালন করেন। দ্বিপেন্দ্রনাথ পাঁচ বছর এই কাজ করেন। ১৮৭৩ সালে দ্বিজেন্দ্রনাথ জমিদারি পরিচালনা করতে গেছেন শিলাইদহে—এরকম তথ্য পাওয়া যায় না। তিনি গিয়েছেন ১৮৮৪ সালে।
দ্বিজেন্দ্রনাথ জমিদারী দেখেছিলেন মাত্র মাসখানেক। এর মধ্যে আবার তিনি সাহজাদপুরেও গিয়েছিলেন। সেখানে নিজের উদ্যোগে প্রজাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের সুখ দুঃখের খোজ খবর নিয়েছেন। তাদের খাজনা মউকূপের প্রস্তাব করছেন। এ ঘটনায় আমলারা বেশ মুশকিলে পড়ে গিয়েছিল। আর তখন তখুনি তাকে বাদ দিয়ে তার ছেলে দ্বিপেন্দ্রনাথকে জমিদারী দেখার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। দ্বিজেন্দ্রনাথ ১৮৮৪ সালের জুন মাসে প্রথম সপ্তাহে জমিদারি পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। ছেড়ে দিয়েছিলেন ২২ আগস্ট। দ্বিপেন্দ্রনাথ পাঁচ বছর জমিদারি পরিচালনা করেন। এর পরে রবীন্দ্রনাথ জরিদারি পারিচালনার ভার পান।
এ ঘটনাটির একটি ছোটো বিবরণী লিখেছেন সৈয়দ মুজতবা আলী লিখেছেন বড়বাবু নামে প্রবন্ধে—একবার বাম্পার-ক্রপ হলে পর সুযোগ বুঝে পিতা মহর্ষিদেব তাঁকে খাজনা তুলতে গ্রামাঞ্চলে পাঠান। গ্রামের দুরাবস্থা দেখে তিনি তার করলেন, সেন্ড ফিফটি থাউজেন্ড। (তাঁর গ্রামোন্নয়ন করার বোধ হয় বাসনা হয়েছিল!)।. উত্তর গেল, কাম ব্যাক!’
দ্বিপেন্দ্রনাথ দেবেন্দ্রনাথের বড়ো আদরের নাতি ছিলেন। তিনি কোলকাতায় থেকেই জমিদারি পরিচালনা করতেন। শিলাইদহে যাওয়ার প্রয়োজন করেন নি। দেবেন্দ্রনাথও এই নাতিটিকে যাওযার জন্য পীড়াপীড়ি করেন নি। সে রকম তথ্য পাওয়া যায় না। সুতরাং দ্বিপেন্দ্রনাথের জমিদারী পরিচালনার কালটি পুরোপুরি আমলানির্ভর জমিদারী কাল। সুতরাং না্য়েব-গোমস্তারা যা বলবে, সেটাই সহি।
দ্বিজেন্দ্রনাথের আলাভোলা রূপটির আরও কিছু নমুণা পাওয়া যায় সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখায়-- লোকমুখে শুনেছি সকলের অজান্তে এক ভিখিরি এসে তাঁর (দ্বিজেন্দ্রনাথ) কাছে ভিক্ষা চাইলে তিনি বললেন, ‘আমার কাছে তো এখন কিছু নেই। তুমি এই শালখানা নিয়ে যাও।‘ প্রাচীন যুগের দামী কাশ্মিরী শাল। হয়তো বা দ্বারকানাথের আমলের। কারণ তাঁর শালে শখ ছিল। ভিখিরি প্রথমটায় নাকি নিতে চায় নি। শেষটায় যখন বড়বাবুর চাকর দেখে বাবুর উরুর উপর শালখানা নেই, সে নাতি দিনেন্দ্রনাথে খবর দেয়। তিনি বোলপুরে লোক পাঠিয়ে শালখানা ‘কিনিয়ে’ ফেরত আনান। ভিখিরি নাকি খুশী হয়েই ‘বিক্রি’ করে; কারণ এর রকম দামী শাল সবাই চোরাই বলেই সন্দেহ করতো। কথিত আছে, পরের দিন যখন সেই শালই তাঁর উরুর উপর রাখা হয় তখন তিনি সেটাই লক্ষ্যই করলেন না, যে এটা আবার এল কি করে!
সুতরাং এই আলাভোলা লোকটি কি করে প্রজানীপিড়নের কাজটি করাবেন? লাঠিয়াল ভাড়া করে এবং পাঞ্জাবী গুন্ডা ভাড়া করে প্রজাদের ঢিট করার উদ্যোগ নিয়েছেন, তাদের ঘর-জ্বালিয়ে দিয়েছেন, কাঙাল হরিনাথকে শিক্ষা দেবার জন্য লাঠিয়াল পাঠিয়েছেন—এটা ঠিক মেলে না। তথ্য বলছে, দ্বিজেন্দ্রনাথ এই কাজ করেন নি। তিনি উল্টো প্রজাদের ঘরে ঘরে ঘুরেছেন। তাদের অবস্থা সরেজমিনে দেখেছেন। বাবাকে তাদের দুর্দশা মোচনের জন্য টাকা পাঠাতে তার করছেন। এবং আমলারা জমিদারকে বলে কয়ে তাকে কোলকাতায় ফেরত নেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন।
আবুল আহসান চৌধুরী লিখেছেন, কাঙাল হরিনাথের ডা্য়েরিতে এবং গ্রামবার্তা প্রকাশিকায় দ্বিজেন্দ্রনাথের এই প্রজানীপিড়নের সংবাদ ছাপা হয়েছিল। কাঙাল হরিনাথের ডায়েরিটি ছাপা হল না কেন এতদিন? বাঁধা কোথায় ছিল? গ্রামবার্তার প্রকাশিকার মূল খবরটিও কোথাও পাওয়া যায় না।
আসলে সে সময় প্রজানীপিড়নের ঘটনাটাটি ঘটেছে ঠিকই। তবে সেটার জন্য কোনো ভাবেই দ্বিজেন্দ্রনাথকে দায়ী নন। কাজটি করেছিল না্য়েব-গোমস্তারা। দুর্নামটি রটেছে দ্বিজেন্দ্রনাথের নামে।
মন্তব্য
নতুন মন্তব্য করুন