রবীন্দ্রনাথের জমিদারগিরি এবং জমিদারের রবীন্দ্রগিরি : অষ্টাবিংশ পর্ব

কুলদা রায় এর ছবি
লিখেছেন কুলদা রায় [অতিথি] (তারিখ: শনি, ২৫/০২/২০১২ - ১২:৩০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কুলদা রায়
এমএমআর জালাল

প্রজানীপিড়ন খণ্ড : ছয়

১৮৯১ সালে শিলাইদহে কুঠিবাড়িতে পূণ্যাহ অনুষ্ঠানের আয়োজন চলছে। পূণ্যাহ অনুষ্ঠানে জমিদার বা তার প্রতিনিধির উপস্থিতিতে প্রজারা খাজনা দেয়। সেদিন তারা সাধ্যমত ধোপদুরস্ত পোষাকে জমিদারের সামনে আসে। তাদেরকে মিষ্টি মুখ করানো হয়। কখনো কখনো ভোজেরও আয়েজন করা হয়।

সেদিন প্রজারা এসেছে ভোরবেলা কুঠিবাড়িতে। পূণ্যাহর আয়োজন সমাপ্ত। বন্দুকের আওয়াজ রোশনচৌকি হুলুধ্বনি আর শঙ্খধ্বনিতে কাছারি মুখরিত। রবীন্দ্রনাথ তখন বাবুমশাই। ধূতি পাঞ্জাবী চাদর পরে তিনি কাছারিতে নেমে এলেন। প্রথামত পূণ্যাহর শুরুতে ব্রাহ্মসমাজের আচার্য্যের প্রার্থনা—পরে হিন্দুমতে পূজা। পুরোহিত বাবুমশাইয়ের কপালে এঁকে দিলেন চন্দনের তিলক। তখন তিনি নতুন কাপড় চাদর দই মাছ ও দক্ষিণা দান করবেন পুরোহিত এবং পরেই প্রজাদের করদান পর্ব শুরু হবে।

অমিতাভ চৌধুরী ‘জমিদার রবীন্দ্রনাথ : শিলাইদহ পর্বে’ লিখেছেন, দ্বারকানাথের আমল থেকে সম্ভ্রম ও জাতবর্ণ অনুযায়ী পূণ্যাহ অনুষ্ঠানে থাকে বিভিন্ন ধরনের আসনের বন্দ্যোবস্ত। হিন্দুরা চাদর-ঢাকা সতরঞ্জির উপর এক ধারে, তার মধ্যে ব্রাহ্মণের স্থান আলাদা। মুসলমান প্রজাদের জন্য চাদর ছাড়া সতরঞ্জির উপর-অন্যধারে। সদর ও অন্য কাছারির কর্মচারীরা নিজ নিজ পদমর্যাদাঅনুসারের বসেন পৃথক পৃথক স্থানে। আর জমিদার বাবুমশাইয়ের জন্য ভেলভেট মোড়া সিংহাসন। এখানে বৈষম্যপূর্ণ জাতপাতের চূড়ান্ত ব্যবস্থা করা হয়।

বাবুমশাই রবীন্দ্রনাথ এই বৈষম্যপূর্ণ আসন ব্যবস্থা মানলেন না। তিনি নায়েব মশাইকে বললেন, পূণ্যাহ জমিদার ও প্রজার মিলন অনুষ্ঠান। সুতরাং এই শুভ দিনে সকলের আসনেও মিলন থাকতে হবে। তিনি নায়েবকে বললেন, সব আসন তুলে দিন। হিন্দু-মুসলমান, ব্রাহ্মণ-চণ্ডাল সবার জন্য একই ধরনের আসনের ব্যবস্থা করুন।

নায়েব মশাই এ প্রথার দাস। তিনি নতুন বাবুমশাইকে বললেন, আনুষ্ঠানিক দরবারের প্রাচীন রীতিটি বদলানোর অধিকার কারো নেই। রবীন্দ্রনাথ আরো স্পষ্ট করে তৎক্ষণাৎ জবাব দিলেন , আমি বলছি তুলে দিতে হবে। এ রাজ-দরবার নয়, মিলনানুষ্ঠান।
সদর নায়েবের সেই একই জবাব, অসম্ভব। এ নিয়ম ভাঙা চলবে না।

কিন্তু রবীন্দ্রনাথ জানেন এ প্রাচীন প্রথা বদলে যাওয়ার ইতিহাস আছে ঠাকুর পরিবাবেই। দ্বারকানাথের সময়ে ব্রাহ্মধর্মই ছিল না এখানে। দ্বারকানাথ ছিলেন আচারসর্বস্ব হিন্দু। সুতরাং তার সময়ে পূণ্যাহর দিনে ব্রাহ্মসমাজের আচার্য্যের প্রার্থনা বিষয়টি ছিল না। সেটা দেবেন্দ্রনাথ জমিদারী নেওয়ার পরে পুরনো প্রথার সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন। তিনি প্রথার বদল করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ হাসলেন। প্রথার মধ্যেই প্রথা ভাঙার বিষয় আছে। সেটা তিনি জানেন।
উপস্থিত সকলে স্তম্ভিত, বিস্মিত। নতুন বাবুমশায়ের আচরণে কারো মুখে কথা নেই। সদর নায়েব মশাই রবীন্দ্রনাথকে বললেন, সিংহাসনে বসুন।
রবীন্দ্রনাথ জানিয়ে দিলেন, আসনের জাতিভেদ দূর না করলে তিনি কিছুতেই বসবেন না। সাধারণ দরিদ্র প্রজার অপমান তিনি সহ্য করবেন না।
নায়েব বলল, আপনাকে প্রথার বাইরে যাওয়া যাবে না।

তিনি নায়েব মশায়কে ক্রুদ্ধ কণ্ঠ বললেন, প্রথা আমি বুঝি না। সবার একাসনে বসতে হবে। জমিদার হিসাবে এই আমার প্রথম হুকুম।
নায়েব তখন ঘোষণা করলেন, প্রথার পরিবর্তন ঘটালে তারা একযোগে পদত্যাগ করবেন। রবীন্দ্রনাথ অবিচলিত। তিনি উপস্থিত প্রজামণ্ডলীকে উদ্দেশ্য বললেন, এই মিলন উৎসবে পরস্পরে ভেদ সৃষ্টি করে মধুর সম্পর্ক নষ্ট করে দেওয়া চলবে না। প্রিয় প্রজারা, তোমরা সব পৃথক পৃথক আসন, পৃথক ব্যবস্থা—সব সরিয়ে দিয়ে একসঙ্গে বসো। আমিও বসব। আমি তোমাদেরই লোক।

অপমানিত নায়েব-গোমস্তার দল পদত্যাগ করলেন। তারা সবিস্ময়ে দূরে দাঁড়িয়ে দেখলেন, রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে হিন্দু-মুসলমান প্রজারা প্রকাণ্ড হল ঘরের সব চাদর সব চেয়ার নিজেরাই সরিয়ে দিয়ে ঢালা হল ফরাসের উপর বসে পড়ল। মাঝখানে বসলেন রবীন্দ্রনাথ।

তার পর তিনি প্রজাদের ডেকে বললেন, যাও, সদর নায়েব আর আমলাদেরদের ডেকে আনো। সবাই একসঙ্গে বসে পুণ্যাহ উৎসব করি। রবীন্দ্রনাথ আমলাদের অনুরোধ করলেন পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করতে। উৎসব শুরু হল। দলে দলে আরো লোক কাছারিবাড়িতে এসে এসে ভেঙে পড়ল। এবং সেদিন থেকে ঠাকুর এস্টেটের পুণ্যাহ সভায় শ্রেণীভেদেরদের ব্যবস্থা উঠে গিয়েছিল।
এই ব্যবস্থা পরবর্তীকালেও রবীন্দ্রনাথ চালু রেখেছিলেন।

এই ঘটনাটি ফলে তিন ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। প্রথমত, প্রজাদের মনে রবীন্দ্রনাথ জমিদারীর প্রচলিত প্রভুত্বমার্কা ভাবমূর্তিটি ভেঙে ফেলতে সক্ষম হলেন। তিনি তাদের লোক হয়ে উঠলেন। দরিদ্র প্রজারা বুঝতে পারল, তাদের দুঃখের দিন ঘোচার লগ্ন উপস্থিত হয়েছে।

আমলারা বুঝতে পারল তাদের দুঃসময় শুরু হয়েছে। তাদের চোখ দিয়ে জমাদারকে সব কিছু দেখতে হবে এই ব্যবস্থার বদল এসেছে—এই নতুন জমিদার নিজের চোখে দেখেন। শুধু দেখেন না, অসঙ্গত বিষয় বদলে দেওয়ার জন্য নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন কঠিন করে। ফলে আমলাদের ভেতরে রবীন্দ্রবিরোধিতার বীজ রোপিত হল।

আর রবীন্দ্রনাথ বুঝলেন, তার সামনে কঠিন পরীক্ষা। সঙ্গে সঙ্গে তিনি আরো সংকল্পবদ্ধ হলেন, আরো স্পষ্ট বুঝতে পারলেন, এখানে তাঁকে কি করতে হবে, কিভাবে অগ্রসর হতে হবে এবং প্রতিপদে বাধা আসবে কোন পক্ষ থেকে।

১৮৯৬ সালে অমৃত বাজার পত্রিকার একটি রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, নড়াইলের জমিদার আমলাদের এই দৌরাত্ম্য সহ্য করতেন না। তারা যদি প্রজাদের উপর পীড়ন করত—সে অভিযোগ শোনা মাত্র জমিদার তাদেরকে চাকরীচ্যূত করতেন। এই জমিদার কিন্তু রায় বাহাদুর বা খানবাহাদুর কোন পদকই পান নি বৃটিশ রাজের কাছ থেকে। রবীন্দ্রনাথ সেটা করেন নি। তিনি সবার ভেতর থেকে বদলে দেওয়ার ধারণাটি সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছেন।

রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে সদর কাছারিতে কাজ করতে এসেই সেরাস্তার কাগজ পত্রের নানা ঝামেলা দেখতে পাচ্ছিলেন। এই কাগজপত্রে গোলমালের সূত্র ধরেই তাদেরকে নিপীড়নের সুযোগ নিত নায়েব-গোমস্তারা। এই নিপীড়নের জন্য প্রজা-অসন্তোষের সৃষ্টি হত। রবীন্দ্রনাথের আগে দ্বারকানাথ, দেবেন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রনাথ, গণেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, গুনেন্দ্রনাথ, দ্বিপেন্দ্রনাথ পার্যায়ক্রমে জমিদারী পরিচালনা করলেও তাঁরা কিন্তু কেউই এই কাগজপত্রের শৃঙ্খলা আনার চেষ্টা করেন নি। সবাই আমলাদের ব্যবস্থাই মেনে নিয়েছেন। আমলার উপর ভার দিয়ে নিশ্চিন্ত থেকেছেন। আমলাদের চোখ দিয়েই সব কিছু দেখতে অভ্যস্ত হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ গোড়ায় এসে এই গলদটি দুর করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি অক্লান্তভাবে পরিশ্রম করে দুই মাস প্রচেষ্টায় সেই কাজ করার চেষ্টা করেছিলেন। ১৮৯১ সালের ৪ ডিসেম্বর তারিখে শ্রীশচন্দ্র মজুমদারকে লেখা একটি চিঠিতে তিনি জানান--

আমাদের বিরাহিমপুরের সেরেস্তা সবচেয়ে বিশৃঙ্খল—আমি আজ মাস দু’এর অধিককাল এটাকে আয়ত্ত করার চেষ্টায় আছি। এখনো পেরে উঠলুম না। এককালে এই পরগণা নীলকরদের ইজারাধীন ছিল। সেই সময়ে তারা অনাদরে কাগজপত্র সমস্ত নষ্ট করে বসে আছে। সেই অবধি এ পর্যন্ত গোলমাল চলেই আসছে।

‘শ্রীনিকেতনের ইতিহাস ও আদর্শ’ নামে এক কথিকায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, আমি শহরের মানুষ, শহরে আমার জন্ম। আমার পূর্বপুরুষরা কলকাতার আদিম বাসিন্দা। পল্লীগ্রামের কোনো স্পর্শ আমি প্রথম-বয়সে পাই নি। এইজন্য যখন প্রথম আমাকে জমিদারির কাজে নিযুক্ত হতে হল তখন মনে দ্বিধা উপস্থিত হয়েছিল, হয়তো আমি এ কাজ পারব না, হয়তো আমার কর্তব্য আমার কাছে অপ্রিয় হতে পারে। জমিদারির কাজকর্ম, হিসাবপত্র, খাজনা-আদায়, জমা-ওয়াশীল—এতে কোনোকালেই অভ্যস্ত ছিলুম না; তাই অজ্ঞতার বিভিষিকা আমার মনকে আচ্ছন্ন করেছিল। সে অঙ্ক ও সংখ্যার বাঁধনে জড়িয়ে পড়েও প্রকৃতিস্থ থাকতে পারব এ কথা ভাবতে পারি নি।

কিন্তু কাজের মধ্যে যখন প্রবেশ করলুম, কাজ তখন আমাকে পেয়ে বসল। আমার স্বভাব এই যে, যখন কোনো দায় গ্রহণ করি তার মধ্যে নিজেকে নিমগ্ন করে দিই, প্রাণপণে কর্তব্য সম্পন্ন করি, ফাঁকি দিতে পারি নে। এক সময় আমাকে মাস্টারি করতে হয়েছিল, তখন সেই কাজ সমস্ত মন দিয়ে করেছি, তাতে নিমগ্ন হয়েছি এবং তার মধ্যে আনন্দ পেয়েছি। যখন আমি জমিদারির কাজে প্রবৃত্ত তখন তার জটিলতা ভেদ করে রহস্য উদ্ঘাটন করতে চেষ্টা করেছি।। আমি চিন্তা করে যে-সকল রাস্তা বানিয়েছিলুম তাতে আমি খ্যাতি লাভ করেছিলুম। এমন-কি, পার্শ্ববর্তী জমিদারেরা আমার কাছে তাঁদের কর্মচারী পাঠিয়ে দিতেন কী প্রণালীতে আমি কাজ করি তাই জানবার জন্য।

আমি কোনোদিন পুরনো বিধি মেনে চলি নি। এতে আমার পুরাতন কর্মচারীরা বিপদে পড়ল। তারা জমিদারীর কাগজপত্র এমনভাবে রাখত যা আমার পক্ষে দুর্গম। তারা আমাকে যা বুঝিয় দিত তাই বুঝতে হবে, এই তাদের মতলব। তাদের প্রণালী বদলে দিলে কাজের ধারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, এই ছিল তাদের ভয়। তারা আমাকে বলত যে, যখন মামলা হবে তখন আদালতে নতুন কাগজপত্র গ্রহণ করবে না, সন্দেহের চোখে দেখবে। কিন্তু যেখানে কোনো বাঁধা সেখানে আমার মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে, বাঁধা আমি মানতে চাই নে। আমি আদ্যোপান্ত পরিবর্তন করেছিলুম, তাতে ফলও হয়েছিল ভালো।

আরেকটা কাজ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। জমিদারের সঙ্গে প্রজার দূরত্ব ঘুচিয়ে দিয়েছিলেন। তাদের জন্য তাঁর দরোজা খুলে দিয়েছিলেন। তিনি লিখেছেন ঐ কথিকায়—প্রজারা আমাকে দর্শন করতে আসত, তাদের জন্য সর্বদাই আমার দ্বার ছিল অবারিত—সন্ধ্যা হোক, রাত্রি হোক, তাদের কোনো মানা ছিল না। এক-এক সময সমস্তদিন তাদের দরবার নিয়ে দিন কেটে গেছে, খাবার সময় কখন অতীত হয়ে যেত টের পেতেম না। আনন্দ ও উৎসাহের সঙ্গে এ কাজ করেছি। যে ব্যক্তি বালককাল থেকে ঘরের কোণে কাটিয়েছে, তার কাছে গ্রামের অভিজ্ঞতা এই প্রথম। কিন্তু কাজের দুরূহতা আমাকে তৃপ্তি দিয়েছে, উৎসাহিত করেছে, নূতন পথনির্মাণের আনন্দ আমি লাভ করেছি।

কেন এই কাজগুলো তিনি করেছেন তার একটি বিবরণী দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ছিন্নপত্রে—
তারিখ ১০ মে, ১৮৯৩, শিলাইদহ
আমার এই দরিদ্র চাষীগুলোকে দেখলে আমার ভারী মায়া করে। এরা যেন বিধাতার শিশু সন্তানের মতো নিরুপায়। তিনি তাদের মুখে নিজের হাতে কিছু তুলে না দিলে এদের আর গতি নেই। পৃথিবীর স্তন যখন শুকিয়ে যায় তখন এরা কেবল কাঁদতে জানে—কোনোমতে একটুখানি ক্ষুধা ভাঙলেই আবার সমস্ত ভুলে যায়। সোসিয়ালিস্টরা যে সমস্ত পৃথিবীময় ধন বিভাগ করে সেটা সম্ভব কি অসম্ভব ঠিক জানি নে—যদি একেবারেই অসম্ভব হয় তা হলে বিধির বিধান বড়ো নিষ্ঠুর, মানুষ ভারি হতভাগ্য। কেননা, পৃথিবীতে যদি দুঃখ থাকে তো থাক, কিন্তু তার মধ্যে এতটুকু ছিদ্র একটু সম্ভাবনা রেখে দেওয়া উচিৎ যাতে সেই দুঃখ মোচনের জন্য মানুষের উন্নত অংশ অবিশ্রাম চেষ্টা করতে পারে। একটা আশা পোষণ করতে পারে। যারা বলে কোনোকালেই পৃথিবীর সকল মানুষকে জীবনধারনের কতকগুলি মূল আবশ্যক জিনিসও বণ্টন করে দেওয়া নিতান্ত অসম্ভব অমূলক কল্পনাপ্রসূত, কখনোই সকল মানুষ খেতে-পরতে পারে না, পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ চিরকালই অর্ধাশনে কাটাবেই, এর কোনো পথ নেই—তারা ভারি কঠিন কথা বলে। কিন্তু এ-সমস্ত সামাজিক সমস্যা এমন কঠিন, বিধাতা আমাদের এমনি একটি ক্ষুদ্র জীর্ণ বস্ত্রখণ্ড দিয়েছে, পৃথিবীর একদিকে ঢাকতে গিয়ে আর-এক দিক বেরিয়ে পড়ে—দারিদ্র্য দূর করতে গেলে ধন চলে যায়, এবং ধন গেলে সমাজের কত যে শ্রীসৌন্দর্য উন্নতির কারণ চলে যায় তার আর সীমা থাকে না।

শ্রীনিকেতনের কথিকায় রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, যতদিন পল্লীগ্রামে ছিলেম ততদিন তাকে তন্ন তন্ন করে জানবার চেষ্টা আমার মনে ছিল। কাজের উপলক্ষ এক গ্রাম থেকে আর-এক দূর গ্রামে যেতে হয়েছে, শিলাইদা থেকে পতিসর, নদী-নালা-বিলের মধ্য দিয়ে—তখন গ্রামের বিচিত্র দৃশ্য দেখেছি। পল্লীবাসীদের দিনকৃত্য, তাদের জীবনযাত্রার বিচিত্র চিত্র দেখে প্রাণ ঔৎসৃক্যে ভরে উঠত। আমি নগরে পালিত, এসে পড়লুম পল্লীশ্রীর কোলে, মনের আনন্দে কৌতুহল মিটিয়ে দেখতে লাগলুম। ক্রমে এই পল্লীর দুঃখদৈন্য আমার কাছে সুস্পষ্ট হয়ে উঠল, তার জন্যে কিছু করব এই আকাঙ্ক্ষায় আমার মন ছটফট করে উঠেছিল। তখন আমি যে জমিদারি-ব্যবসায় করি, নিজের আয়-ব্যয নিয়ে ব্যস্ত, কেবল বনিক-বৃত্তি করে দিন কাটাই, এটা নিতান্তই লজ্জার বিষয় মনে হয়েছিল। তার পর থেকে চেষ্টা করতুম—কী করলে এদের মনে উদ্বোধন হয়, আপনাদের দায়িত্ব এরা আপনি নিতে পারে। আমরা যদি বাইরে থেকে সাহায্য করি তাতে এদের অনিষ্টই হবে। কী করলে এদের মধ্যে জীবনসঞ্চার হবে, এই প্রশ্নই তখন আমাকে ভাবিয়ে তুলেছিল। একেই রবীন্দ্রনাথ আত্মশক্তির উদ্বোধন বলেছেন।

এর মধ্যে নিজের অবস্থান সম্পর্কেও তার মিথ্যা মোহ ছিল না। ছিল না মানুষ সম্পর্কে ভুল ধারণা। তিনি লিখেছেন আত্মসমালোচনার ঢংএ—
...অন্তরের মধ্যে আমিও যে এদেরই মতো দরিদ্র সুখদুঃখ কাতর মানুষ, পৃথিবীতে আমারও কত ছোট ছিট বিষয়ে দরবার, কত সমান্য কারণে মর্মান্তিক কান্না, কত লোকের প্রসন্নতার উপরে জীবনের নির্ভর। এই সমস্ত ছেলেপিলে-গোরুলাঙ্গল-ঘরকন্না-ওয়ালা সরল হৃদয় চাষাভূষোরা আমাকে কী ভুলই না জানে।! আমাকে এদের সমজাতি মানুষ বলেই জানে না। ...আমাকে এখানকার প্রজারা যদি ঠিক জানত, তাহলে আপনাদের একজন বলে চিনতে পারত।


মন্তব্য

ধ্রুব বর্ণন এর ছবি

দেখা যায় জমিদার রবীন্দ্রনাথ তাইলে ছিলেন বাংলার অ্যাভাটার।

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

অ্যাভাটারের ন্যারেটিভ [ মন খারাপ ] হইল হোয়াইট ম্যানস বার্ডেনের ন্যারেটিভ। শোষিত শ্রেণীর বিপ্লবের নেতৃত্বগত/আদর্শিক মালিকানা শোষক শ্রেণীরই 'মানবিক' অংশের নিকট ন্যস্ত করার লিবারল হিউম্যানিস্ট ঝোঁককে অ্যাভাটার বিপন্ন করে না, পুর্নবয়ান করে।

এখন রবীন্দ্রনাথকে এই জায়গায় রাখা কঠিন হইতে পারে, কারণ, রবীন্দ্রনাথ উল্লেখযোগ্য শ্রেণীবিপ্লব বা সংস্কারের নেতৃত্ব দেন নাই, যদিও তার ভিতরে মানবিক আদর্শ ষোল আনা ছিল। 'কবি' রবীন্দ্রনাথ আর 'প্রশাসক' রবীন্দ্রনাথের কাটাকুটি খেলার একটা রাজনীতি আছে, এই দেশে। এই কাটাকুটির আসলে কোনো ভিত্তি নাই, কারণ, রবীন্দ্রনাথের 'প্রশাসনিক' করিৎমা [ক্যারিশমার বাংলা কর্লাম :)] তার স্বকালের স্ট্যান্ডার্ডে খুব খারাপ ছিল বইলা মনে হয়। অন্যদিকে ক্যারিশমাটিক কবি এবং 'ইন্টেলেকচুয়াল' হিসাবে তার ধারে কাছে বহুকাল কেউ ছিল না।

যাই হোক। অ্যাভাটার প্রসঙ্গে ফেরত আসি।

ঔপনিবেশিক কৃষকচৈতন্যে স্বশ্রেণীর নেতৃত্বের ক) সামর্থ্য এবং/অথবা খ) 'ধারণা' গড়ে না উঠায়, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তিত ভূস্বামী/ভদ্রলোক শ্রেণীর প্রণোদিত সংস্কারবাদিতা কৃষকসমাজের 'প্রগতি'র দায় গ্রহণ করে। অথবা, এই বাক্যটাকে উল্টা দিক থাইকা পড়তে পারেন। ঔপনিবেশিক কৃষকচৈতন্যে স্বশ্রেণীর নেতৃত্বের ক) সামর্থ্য এবং/অথবা খ) 'ধারণা' গড়ে না উঠার দায়, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তিত ভূস্বামী/ভদ্রলোক শ্রেণীর প্রণোদিত সংস্কারবাদিতার। সোজা দিক থাইকা পড়লে, এইটা 'ইতিহাস'। উল্টা দিক থাইকা পড়লে, এইটা 'নিম্নবর্গের ইতিহাস' ইংরেজী ভাষায় সমধিক পরিচিতি সাবঅলটার্ন হিস্টরিওগ্রাফি নামে। দুইটাই 'পাঠপদ্ধতি' - কোনোটাই ফেলা যাবে না, আপাতত।


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

ধ্রুব বর্ণন এর ছবি

কুলদা রায়ের এই রচনা কাটাকুটি খেলনেওয়ালাদের 'সমুচিত' উত্তর হইতে পারে। আমার আগ্রহ জমিদারির পক্ষেবিপক্ষের বাকবিতণ্ডা থেকে উৎসারিত ভিন্ন একটা পাঠ নিয়ে, যেইটা প্রদান মনে হয় কুলদা রায়ের এই রচনার উদ্দেশ্য নয়। তথাপি সেই পাঠ নেওয়া যাচ্ছে।

শোষিত শ্রেণীর বিপ্লবের নেতৃত্বগত/আদর্শিক মালিকানা শোষক শ্রেণীরই 'মানবিক' অংশের নিকট ন্যস্ত করার লিবারল হিউম্যানিস্ট ঝোঁককে অ্যাভাটার বিপন্ন করে না, পুর্নবয়ান করে

এই কথাটাকে ঘিরে যদি কুলদা রায়ের রচনাটাকে দেখি, সেটাকে কী বলবেন? সেটা কি এই ঝোঁককে বিপন্ন করে নাকি পুনর্বয়ান করে? নাকি এই ব্যাপারে ক্লীব?

কবিত্বের সাথে জমিদারির কাটাকুটি একটা ভিত্তিহীন রাজনীতি। আপনার এই কথাটাই কিন্তু কাটাকুটি খেলার সবচেয়ে সমুচিত জবাব। এই জবাবটা কেনো সমুচিত জবাব, সেইটারে আরো বিস্তারিত করতে পারি আমরা। কিন্তু তার বদলে আপনি যদি কাটাকুটি খেলাটারে কাটানোর জন্যে নিজেই কাটাকুটি খেলেন, তাইলে কিন্তু আমি হিতে বিপরীত দেখছি। জমিদারি শেষ। এখন জমিদারের (অ)শোষণ দেখান কি প্রশাসনিক (অ)করিৎমা দেখান কি তারে অ্যাভাটার দেখান, দিন শেষে জমিদাররেই জিতাইয়া দিতেছেন, এবং সেইভাবে কিন্তু আসলে রবীন্দ্রনাথরেই হারাইয়া দিতেছেন।

ঔপনিবেশিক কৃষকচৈতন্যে স্বশ্রেণীর নেতৃত্বের ক) সামর্থ্য এবং/অথবা খ) 'ধারণা' গড়ে না উঠায়, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তিত ভূস্বামী/ভদ্রলোক শ্রেণীর প্রণোদিত সংস্কারবাদিতা কৃষকসমাজের 'প্রগতি'র দায় গ্রহণ করে।

এইটারে আমি ইতিহাস না বইলা ওরিয়েন্টালিজম বলবো। এই পাঠ ক্রিস্টোফার হিচেন্সরা নিতে সর্বাধিক আগ্রহী। জমিদার ছিলো বইলা জমিদাররে ভিলেন বানানো আমার ভিত্তিহীন মনে হয়। কিন্তু সমাজসংস্কারে সে অগ্রণী ছিলো, অ্যাভাটারোচিত নায়ক ছিলো, এই পাঠ দেয়ার চেষ্টা করলে জমিদাররে জিতাইতে গিয়া হারাইয়া দেয়া হয়। বৈষম্যপূর্ণ আসন ব্যবস্থা (লেখা থেকে) বানায়ও জমিদার, ভাঙেও জমিদার। কৃষক এখানে অক্রিয়াশীল। কৃষক গরীব এখানে অপেক্ষা করতেছে জমিদারের লিবারল হিউম্যানিস্ট হইয়া ওঠার জন্য। এখানে সকল দিকে যেহেতু কৃষক হারে আর সকল দিকে যেহেতু জমিদার জেতে, এখানে জমিদাররে আরো বড় করার সম্ভাবনা শূন্য। জমিদারি নিয়া কাটাকুটি খেলায় নামলে তাই জমিদারের অধঃপতন ছাড়া অন্য কোনো সম্ভাবনা খোলা নাই। সেটাই বলতে চাচ্ছিলাম।

আমার বরং তাই আগ্রহ "কাটাকুটি খেলার একটা রাজনীতি আছে, এই দেশে। এই কাটাকুটির আসলে কোনো ভিত্তি নাই" এই ভাবনাটারে 'এই দেশে' আরো আগাইয়া নেওয়ার। যারা কাটাকুটি খেলে আর যারা কাটাকুটির বিপরীতে কাটাকুটি খেলে, দুই দলেরই বয়ানে কমন যে পাঠটা উৎসারিত হয়, সেইটা হইলো পূজনীয়, স্মরণীয়, অনুসরণীয় ব্যক্তির সার্বিক হিরোত্ব। স্মরণীয় হইলে সার্বিক হিরোত্ব থাকতে হইবে, সার্বিক হিরোত্ব না থাকলে স্মরণীয় হইতে পারবে না। এই দুইটা বক্তব্য আসলে একই কথা উচ্চারণ করে।

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

ওরিয়েন্টালিজম। হ । 'ইতিহাস' কোটেশন মার্কের ভিত্রে রাখছিলাম।

প্রশ্ন, রবীন্দ্রনাথরে ভিলেইন বানানির প্রপাগান্ডার বিরুদ্ধে আপনি কী করণীয় ধার্য করবেন? ধরে নিতেছি, এই প্রপাগান্ডা সাম্প্রদায়িক বিষাক্ততার ফলে আমাদের মাথাব্যথার কারণ। প্রপাগান্ডা ডিসম্যান্টল/ ডিমিস্টিফাই /ডিবাগ করবেন কেমনে? রবীন্দ্রনাথের জমিদারি সংক্রান্ত প্রপাগান্ডার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের জমিদারি সংক্রান্ত 'তথ্য' দিয়াই তো? এখন তথ্য নানা জটিল প্রক্রিয়ায় নিয়ন্ত্রিত হয়, সেইটা এক কথা। কিন্তু মিথ্যার মোকাবেলায় তথ্য হাজির করার কাজটা এই পোস্টের লেখকদ্বয় করতেছেন। তথ্য হাজির হওয়ার পরে আমরা আমাদের পাঠ নেয়া শুরু করতে পারি। অর্থাৎ - মিথ্যা > তথ্য > পাঠ। এই পোস্ট থেকে এই প্রবাহের আমি কেবল মাঝেরটা গ্রহণ করতেছি।


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

ধ্রুব বর্ণন এর ছবি

রবীন্দ্রনাথরে ভিলেইন বানানির প্রপাগান্ডার বিরুদ্ধে আপনি কী করণীয় ধার্য করবেন

তথ্যের বিকল্প নাই। কিন্তু ইতিহাসে পাঠহীন তথ্য একা দুর্বল। ফলে আপনি তথ্যে থামলেও পাঠেও যাতে প্রপাগান্ডার পতন ঘটে, তার জন্যে তথ্যের পাশাপাশি ব্যক্তির নায়ক-ভিলেইন ফল্স ডিলেইমা হইতে মানুষরে বাইর কইরা আনার সক্রিয়া প্রচেষ্টায় অংশ নিতে হবে। যতক্ষণ আপনি এই ফল্স ডিলেইমায় আছেন, মানুষরে রাখতেছেন, প্রপাগান্ডারে আপনি আসলে ডিসম্যান্টল করতে কখনো পারতেছেন না। প্রপাগান্ডাগুলা অবরোহী। এর কেবল তথ্যগত উত্তরও অবরোহী। অবরোহী রচনা, আলোচনার দুর্বলতা তো জানেন।

তথ্য হাজির হওয়ার পরে আমরা আমাদের পাঠ নেয়া শুরু করতে পারি।

ঠিকাছে।

দুইটা অপবচন দিয়া ক্ষান্ত হই।

~মানুষ দেবতারে পূজা করে, কিন্তু মানুষরে ভালোবাসে।

~মানুষরে অসীমতক বড় করা যায়। কিন্তু দেবতা নিয়া তর্কে দেবত্বের অধঃপতনই কেবল সম্ভাব্য।

ধ্রুব বর্ণন এর ছবি

আরেকটা বিষয়, অ্যাভাটার হইতে কিন্তু ভালো প্রশাসক হওয়া লাগে না। "ভিতরে মানবিক আদর্শ ষোল আনা" থাকাই যথেষ্ট।

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

মানবিক উইদিন কোট


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।