কুলদা রায়
এমএমআর জালাল
একটি নাটকের কাহিনী-----
আবুল মনসুর আহমদ হুজুর কেবলা নামে একটি স্যাটায়ার গল্প লিখেছিলেন উনিশ শ সাতচল্লিশ সালের আগে। গল্পটি নাটক আকারেও বিভিন্ন জায়গায় মঞ্চস্থ হয়ে আসছে বহুকাল আগে থেকেই। স্নাতক ক্লাশে পাঠ্যও বটে। কখনো আবুল মনসুর আহমদকে মুরতাদ ঘোষণা করা হয় নি। তাঁর ঘরও পুড়িয়ে দেওয়া হয় নি। এটাই স্বাভাবিক। গভীরভাবে ইসলামধর্মবিশ্বাসী লেখক ও ডানপন্থী রাজনীতিক আবুল মনসুর আহমদ পরবর্তী জীবনে আদর্শিক দিক থেকে প্রতিক্রিয়াশীল পন্থারই সমর্থক ছিলেন।
সাতক্ষীরার স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে গত ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় কালিগঞ্জের ফতেপুর হাইস্কুলে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে প্রখ্যাত এই ‘হুজুর কেবলা’ নাটক মঞ্চস্থ করা হয়। নাটকটিতে মহানবী (সাঃ) হযরত মুহাম্মদ সম্পর্কে কটুক্তি করা হয়েছে এই অভিযোগ এনে স্থানীয় দৈনিক দৃষ্টিপাত পত্রিকায় একটি সংবাদ ছাপা হয় ২৯ মার্চ। সংবাদটি রচনা করেন স্থানীয় সংবাদদাতা মিজানুর রহমান। তার বাড়ি সাতক্ষীরার ফতেহপুরে। পিতা মাওলানা আজিজুর রহমান।
এই সংবাদটি প্রকাশিত হওয়ার পরে এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনায় যথাযথ তদন্ত ও সত্যতা যাচাই না করেই কালিগঞ্জ থানার সাবেক ওসি ফরিদউদ্দিন অতি উৎসাহী হয়ে ৩০ মার্চ ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগে থানায় একটি মামলা রেকর্ড করে এবং ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রেজোয়ান হারুন, সহকারী প্রধান শিক্ষক মিতা রানী হাজরাকে বাড়ি থেকে স্কুলে ডেকে এনে গ্রেফতার করে। এরপর দুটো হামলা ঘটে দুটি গ্রামে।
প্রথম হামলা—স্থান ফতেপুর গ্রাম
এদিকে মামলা ও গ্রেফতারের ঘটনার পরও শনিবার সকাল ১১টার দিকে কৃষ্ণনগর, বালিয়াডাঙ্গা ও রামনগর গ্রাম থেকে কয়েক হাজার মানুষ লাঠি-শাবল নিয়ে হামলে পড়ে ফতেপুর গ্রামে। কৃষ্ণনগর ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান ও সাবেক চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে হাজার হাজার মানুষ হামলা চালিয়ে ভাংচুর, লুটপাট ও অংগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটালেও সেখানে থাকা পুলিশ সদস্যরা ছিল একেবারেই নির্বিকার। ফতেপুর গ্রামের পার্শ্ববর্তী কয়েক হাজার লোক ওই গ্রামে হামলা চালায় এবং প্রথম দফায় দুই স্কুল শিক্ষকের বাড়িসহ আটটি বসত বাড়িতে হামলা, ভাংচুর, লুটপাট করে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। প্রধান শিক্ষক রোজোয়ান হারুনের বাড়িটির পুড়িয়ে দিলে তাঁর ঘরের মধ্যে পবিত্র কোরআন শরীফের একটি কপিও পুড়ে যায় বলে জানান সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক।
দ্বিতীয় হামলা—চাকদা গ্রাম
ফতেপুর গ্রামে অব্যাহত হামলা ও তান্ডবের পর রবিবার ফতেপুর গ্রামবাসী এলাকায় শান্তি মিছিল ও প্রতিরোধ গড়ে তুললেও ফতেপুর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে চাকদহা গ্রামে একই ইস্যুকে পুঁজি করে এই হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটানো হয়। হামলায় অংশ নেয়া অধিকাংশ ব্যক্তির ১৬ থেকে ২৫ বছর বয়সী বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
চাকদা গ্রামে সেই ঘটনা—(দৈনিক জনকণ্ঠ থেকে)
রবিবার দুপুরে বাড়ির পুকুর ঘাটে বসে শ্যামাপদের স্ত্রী ললিতা সরদার (৪৫) ও পাশের গ্রামের ফজর আলির স্ত্রী আনুরা (৪০)এর মধ্যে কথা হয় ফতেপুরের হামলার ঘটনা নিয়ে। ফতেপুরের নিরীহ গ্রামবাসীর বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া অন্যায় হয়েছে এমন মন্তব্যে নাখোশ হয় আনুরা বেগম। নবীজি সম্পর্কে কটূক্তি করেছে ললিতা এমন প্রচারে বিকাল থেকেই এই সরদার পরিবারের বাড়ির সামনে লোক জড়ো হতে থাকে। সন্ধ্যার কিছু আগে স্থানীয় নাজিমগঞ্জ বাজার কমিটির সভাপতি ফিরোজ কবীর কাজল, স্থানীয় ইউপি মেম্বারসহ সকলে ললিতার বাড়িতে বসে তাকে এধরনের কথা বলার জন্য ক্ষমা চাইতে চাপ প্রয়োগ করে। সমঝোতা বৈঠকে উত্তেজিত হয়ে ওঠে বাইরের গ্রাম থেকে আসা ২ শতাধিক যুবক ও ক্যাডার। তারা লাথি মেরে তাদের ভারতে পাঠিয়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে জড়ো হতে থাকে, এসব বাড়ি থেকে প্রায় ৫শ’ গজ দূরের চৌরাস্তায়।
পরিস্থিতি ঘোলাটে হতে পারে এই আশঙ্কায় সেখানে প্রায় ৩০ সদস্যের পুলিশ রাখা হয়। সন্ধ্যার পর প্রায় ৭টার দিকে মোবাইলের মাধ্যমে ডেকে আনা হয় উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে কয়েক হাজার কিশোর যুবককে। পূর্ব প্রস্তুতি নিয়ে থাকা এসকল বহিরাগতরা আধাঘণ্টার মধ্যেই চিৎকার দিতে দিতে জড়ো হয় এসকল বাড়ির সামনে। পুলিশের উপস্থিতিতে তারা ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে বাড়ির মধ্যে। একপর্যায়ে জীবন বাঁচাতে পরিবারের নারী ও শিশু সদস্যরা ঘর থেকে বের হয়ে নিরাপদ আশ্র্রয়ের জন্য ছুটতে থাকলে শুরু হয় লুটপাট। দরজা জানালা ভেঙ্গে তারা ঘরে ঢুকে টাকা, স্বর্ণালঙ্কার, মূল্যবান কাপড়সহ জমির দলিল, মূল্যবান কাগজপত্র সব কিছু লুট করতে থাকে দলবদ্ধ ভাবে। ঘর থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় তারা সুজিতের স্ত্রীর কানের দুল খুলে নেয়। ললিতার হাতে থাকা সোনার গয়নার কৌটা কেড়ে নেয় তারা কৃষ্ণপদ, শ্যামাপদ, রন সরকার, সুধীর সরদার, নিরঞ্জন, শিবু, ভবরঞ্জন, জগদীশ, বিশ্বজিতসহ ১০টি পরিবারের ওপর হামলা চালিয়ে সর্বস্ব লুট করা হয়। লুটের মালামাল নিরাপদ স্থানে রেখে এসে তারা পেট্রোল দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয় শ্যামাপদ সরদারের পাকা ঘরে। এ সময় পুড়িয়ে দেয়া হয় কৃষ্ণপদের ৩টি, শ্যামাপদের ২টি, রনসরকারের ৩টি ও সুধীর সরদারের ১টি বসতঘর। পুলিশের উস্থিতিতে প্রায় ৩ ঘণ্টা ধরে এই নারকীয় তা-ব চললেও পুলিশ ছিল নির্বিকার ও নীরব দর্শক।
আগুন নেভাতে বাধা ধর্মীয় ইস্যুকে পুঁজি করে চাকদহা গ্রামে ধর্মান্ধদের হামলা ও অগ্নিসংযোগের তাণ্ডবে পুলিশ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদ্যের নমনীয়তার কারণে আগুন নেভাতে যাওয়া অগ্নিনির্বাপক দলের সদস্যরা এলাকায় ঢুকতে পারেনি। আগুনের লেলিহান শিখায় ৮টি বাড়ি পুড়ে শেষ না হওয়া পর্যন্ত হামলাকারীরা অগ্নিনির্বাপক দলের সদস্যদের ব্যারিকেড দিয়ে রাখে। রাতে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, এডিশনাল ডিআইজি, র্যাব সদস্যসহ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেন।
এর পরে--
এ ধরনের মানবিক বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটার পরেও আশ্চর্য নিরাবতা অবলম্বন করে দেশের মিডিয়া। শুধু দৈনিক জনকণ্ঠই গুরুত্ব দিয়ে বিস্তারিতভাবে ঘটনাটির খবর প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদে রাজধানীর সড়ক অবরোধ করলে তখন অন্যান্য মিডিয়া খবরটি প্রকাশ করতে শুরু করে। তাদের খবর প্রকাশের ঢংটি এমনভাবে প্রকাশিত হয় যেন সাতক্ষীরার ঘটনাটি অতি সাধারণ এবং সেটার জন্য সড়ক অবরোধ করে যানবহন চলাচলের অসুবিধা ঘটনার কোনো মানে হয় না।
যারা নিয়মিত কলাম লেখেন—সেই নামী বুদ্ধিজীবী-কলমজীবীরাও অধিকাংশ হাত গুটিয়ে থাকেন। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ মৌলবাদীদের বিরাগভাজন হওয়ার ভয়ে চুপ করে বসে আছে। আর বিএনপি সংখ্যালঘুদের কোনো দ্বায়িত্ব কোনোকালেই বহন করে নি। এখনও করছে না। জামাতের পত্রিকা সংগ্রাম ও নয়াদীগন্ত প্রকারন্তরে ক্ষতিগ্রস্থদের কটুক্তিকারী হিসাবে অভিযুক্ত করে তাদের শাস্তি দাবী করেছে। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান দেশের নানা বিষয়ে সোচ্চার হলেও এ বিষয়ে টু শব্দ করেন নি। মুহাম্মদ জাফর ইকবাল কিছু লেখেন নি। লেখেননি সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। সদাবাক বদরুদ্দিন উমর এটার পিছনে শ্রেণীদ্বন্দ্বের কারণ খুজে দেখার চেষ্টা করছেন হয়তো। পেলে হয়তো লিখতেও পারেন। না পেলে লিখবেন না। আনু মুহাম্মদ তিনিও নীরব। হুমায়ূন আহমদ নিউ ইয়র্কে অসুস্থ। অসুস্থ অবস্থায় অনেকগুলো বই লিখছেন। সেগুলো প্রকাশিতও হয়েছে—হচ্ছে। সেগুলো নিয়ে তিনি বিজি।
ফেসবুক, ব্লগসহ অন্তর্জালের উদ্ধীপ্ত সচেতন তরুনদের মধ্যেও দুএকজনের ছাড়া সাতক্ষীরার ঘটনাটি নিয়ে তেমন কোনো প্রতিবাদমূলক লেখা বা পোস্ট প্রকাশিত হতে দেখা যায় না। অথচ এই তরুণ লেখক- বুদ্ধিজীবীরা দেশ ও বিদেশের যে কোনো ধরনের ছোটোখাটো নির্যাতন-নীপিড়ন-বর্বরতার প্রতিবাদে এককভাবে--জোটবদ্ধভাবে সোচ্চার হয়ে ওঠেন।
এর মধ্যে রসময় গুপ্ত ওরফে শফিক রেহমান নেড়ী কুত্তার ইন্টারভিউ নিয়ে খালেদা জিয়ার পিছে ছুটছেন। ফরহাদ মজহার ২০০১ সালের নির্বানোত্তর সংখ্যালঘুদের নির্যাতনকে মিডিয়ার বানানো কাহিনী বলে পত্রিকায় কলাম লিখেছিলেন। এখন বিএনপির মীর্জা ফখরুলের পাশে বসে কার্ল মার্কসের সঙ্গে পাকিস্তানীদের পুনর্মিত্রতা নিয়ে কথা বলতে বসে আছেন। তাঁর জন্য এই ঘটনাটি বিপ্লবের সুচনা। তিনি আনন্দিত। আশঙ্কা করা যায় তিনি অচিরেই লিখবেন এ ধরেনর বিপ্লব কেন জরুরী। সেটা তার চিন্তা পত্রিকায় ছাপা হবে। এর সঙ্গে যুক্ত করবেন লালনকে, চৈতন্যকে এবং ফয়েজ আহম্মেদ ফয়েজকে। খতিব সাহেবের কাছে আবারও তওবা পড়ার জন্য দৈনিক প্রথম আলোর মতিউর রহমান আরেকটি সুযোগের অপেক্ষা করবেন। এরকম সার্কাসটিক অনেক ঘটনাই ঘটতে পারে।
এবং সাতক্ষীরায় সব কিছু শান্ত হয়ে আসবে। এই ঘটনা ভুলে সবাই ভুলে যাবে। ভুলিয়ে দেওয়ার সকল আয়োজন চলছে। এরপরে আবারও সাতক্ষীরার বদলে হয়তো ঝিনাইদাহে ঘটবে। কুড়িগ্রামে ঘটবে। অথবা নরসিংদীতে, ভোলায়, হবিগঞ্জে বা যে কোনো স্থানেই ঘটতে পারে। তারও ক্ষেত্র প্রস্তুত আছে। পাকিস্তান আমলে বিভিন্ন সময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে। এই দাঙ্গার প্রধান টার্গেটই ছিল সংখ্যালঘুরা। একাত্তরে পাকিবাহিনীর প্রধান লক্ষ্যই ছিল এই সংখ্যালঘুদের নির্মুল করা। স্বাধীন বাংলাদেশেও বিরানব্বইতে, ছিয়ানব্বইতে, দুই হাজার এক সালে নির্বাচনোত্তর সহিংসার শিকার হয় এই সংখ্যালঘুরা। এগুলো করেছে এরশাদের জাতীয় পার্টি, খালেদার বিএনপি, গোলাম আযমের জামাতে ইসলামী এবং হাসিনার আওয়ামী লীগ তেমন সোচ্চার হয় নি-- চুপ করে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পছন্দ করেছে। প্রকারন্তরে তাদের এই চুপ করে থাকাটাই সাম্প্রদায়িক শক্তিকে শক্তিশালী করে। চিনাপন্থী রাজনীতিকদের সমর্থন সবসময়ই বিএনপি-জামাতের দিকে। আর প্রগতিশীল বামদের শক্তি ক্রমশ কমছে। তাদের কণ্ঠ ক্ষীণ হয়ে আসছে। ভরসা কমছে।
কিন্তু প্রকৃত ভরসা আছে-----
তবে ভরসার কথা হল—আমাদের একজন আনোয়ার শাহাদত আছেন তাঁর মুভি কারিগরকে নিয়ে। কারিগর মুভিতে আনোয়ার শাহাদাত দেখিয়েছেন--একাত্তরে একটি এলাকায় পাকিবাহিনীর সংখ্যালঘু হত্যা থামিয়েছিল পবিত্র ধর্মগ্রন্থ ছুঁয়ে একটি মিথ্যা কথা বলে একজন সামান্য হাজাম বা গ্রাম্য কারিগর। তাতে ধর্মের কোনো অমর্যাদাই হয়নি--মানবতা রক্ষায় কাজ করেছে। এই আনোয়ার শাহাদতই আমাদের প্রকৃত সহজ মানুষ। তার কারিগর মুভির মোতালেব কারিগরই প্রকৃত মানুষ।
প্রকৃতই বাংলাদেশের আপামর মানুষ সম্প্রীতির সহজ মানুষ। তারা অতীতে সকল প্রকার দাঙ্গা ফেসাদকে রুখে দাঁড়িয়েছে। গণহত্যাকে রক্ত দিয়ে ঠেকিয়েছে। বুক দিয়ে সংখ্যালঘুদের বাঁচিয়েছে। এবারও বাঁচাবে। ভবিষ্যতেও বাঁচাবে। এই ভরসাই আমাদের বাঁচতে শেখায়। সেই সহজ মানুষের দিকেই চেয়ে আছি। আর কারো দিকে নয়।
সংযুক্ত : ১. সাতক্ষীরা ঘটনাটির ভিডিও ক্লিপের লিংক-- ভিডিও
২। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যা : ভিন্ন অধ্যায়
মন্তব্য
লেখাটির জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। মিডিয়ায় মৃদু আলোচনা ছাড়া কোনো খবর চোখে পড়েনি। সচলায়তনে কেউ লিখবেন এই আশা করছিলাম। আবার ধন্যবাদ।
হায়রে ধর্মানুভূতি! এটা নিয়ে বিস্তারিত জানতে চাচ্ছিলাম। অনেক ধন্যবাদ লেখাটার জন্য।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ পুরো ঘটনাটি তুলে ধরার জন্য। এক আশ্চর্য অদ্ভুত কারনে মিডিয়া প্রতিবার এই ইস্যুটি নিয়ে নীরব থাকে। সামান্য যা লেখা এসেছে তা যে প্রকৃত ঘটনার থেকে অনেক দূর, তা আপনার লেখা থেকে বুঝা গেল।
খুব খারাপ লাগে যখন নিজ দেশে পরবাসী হয়ে যাই। নিজের উপর ঘৃণা হয়, নিজের অসহায়ত্ব দেখে।
লেখার জন্যে ধন্যবাদ। এর চেয়ে সময়োপযোগী বিষয় আর কী হতে পারে!
আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয় কেউ কেউ হয়তো এমন ভাবেন যে গত আমলে তো অনেক সত্য কথা বলে ফেলেছি এই আমলে বরং একটু বিশ্রাম করি। এরা বেঁচে যাচ্ছেন হুমায়ুন আজাদ বেঁচে নেই বলে। আজ তিনি থাকলে আরো কিছু নতুন মুখোশ অন্তত শনাক্ত হতো।
কিছুদিন আগেই চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে এ ধরনের সংখ্যালঘু নির্যাতন হয়েছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এক শিবির নেতা নিহত হওয়ার জের ধরে।
...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'
চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে লিখেছিলাম, মৃদু আলোচনাও হয়েছিলো, দেশের মিডিয়া সেবারেও নিরব ছিলো, নিরব ছিলো বুদ্ধিজীবি ও উন্নত মানসিকতার মানুষেরাও| কিছুই বদলায়নি আবার ঘটেছে একই ঘটনা, শুধু জায়গার পরিবর্তন, মানসিকতা একই, এবারেও নিরব ছিলো দেশের বেশিরভাগ মানুষ|
"সংখ্যালঘু" বাংলাদেশে একটি নির্বাচনীয় তুরুপের তাস, যারা ঠিকঠাক ভাবে খেলতে পারে ভোটগুলো তাদের ঝুলিতে যায়, সাম্প্রদায়িকতা বাংলাদেশ কখন দেখেনি? এটা একটা প্রশ্ন, দেশে প্রতিটি সরকার পরিবর্তনে একই ঘটনা ঘটছে| সাম্প্রদায়িকতা তখনি চোখে আসে যখন এটি সহিংসতায় রূপ নিচ্ছে, কিন্তু এছাড়া প্রতিনিয়ত দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নানা নির্যাতন সহ্য করতে হচ্ছে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভাবে, সে ব্যাপারে হিসেব তো করছিনা আমরা| আর এটাও নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, পূর্ববর্তী অনেক নির্বাচনের মতই আগামী নির্বাচনেও সাম্প্রদায়িক উস্কানি হবে নির্বাচন জেতার একটি হাতিয়ার, এটাই বাংলাদেশ|
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি শুধু মুখেই বলা হয়, কাজে অধিকাংশ মানুষই তাতে বিশ্বাসী নয়| এরকম ঘটনা আগেও ঘটেছে, এখনও ঘটছে, ভবিষ্যতেও ঘটবে| কিছুই পরিবর্তন হবেনা, শুধুমাত্র নোংরা রাজনীতি হবে, সাম্প্রদায়িক মানুষগুলো একটু হাতের আর মুখের সুখ পাবে|
মানবিক অনুভূতির থেকে আমাদের ধর্মীয় অনুভূতি একটু বেশিই প্রবল কিনা !!
----------------------------------------------------------------------------------------------
"একদিন ভোর হবেই"
খারাপ লাগে, এই সব ঘটনা দেখতে দেখতে বুড়ো হয়ে গেলাম, কিন্তু কোন সমাধানের পথ পেলাম না।
একটা বিষয় খুব পরিস্কার, রাজনৈতিক ইস্যু ছাড়া এ ধরনের ঘটনা ঘটে না। সব গুলো সাম্প্রদায়ীক দাঙ্গার আগে একটা রাজনৈনিক ইস্যু থাকে। এরশাদের পতনের আগেও কিন্তু খোদ ঢাকাতেই ঘটেছিল। এখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে, কাজেই মোক্ষম সময়।
অবাক লাগে সরকারের প্রস্তুতি দেখে।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
আপনার লেখার জন্য ধন্যবাদ।
এক আশ্চর্য অদ্ভুত কারনে মিডিয়া প্রতিবার এই ইস্যুটি নিয়ে নীরব থাকে।
এই ঘটনাটি মিডিয়াতে দেখি নি, শুনি নি এবং পড়িনি। আপনার লেখা পড়ে কারণটাও বুঝলাম।
এই বিষয়ে লেখার জন্য ধন্যবাদ। ছড়িয়ে পড়ুক লেখাটা।
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
লেখাটা মেইন স্ট্রিম মিডিয়া সুকৌশলে এড়িয়ে গেছে, আমাদের সবার উচিত এই লেখাটা ছড়িয়ে দেওয়া।
লিংক ছাড়াও পুরো গল্পটি এখানে পেস্ট করে দিলাম।
হুজুর কেবলা –
আবুল মনসুর আহমদ
এক
এমদাদ তার সবগুলি বিলাতি ফিনফিনে ধুতি,সিল্কের জামা পোড়াইয়া ফেলিল; ফ্লেক্সের ব্রাউন রঙের পাম্প সুগুলি বাবুর্চিখানার বঁটি দিয়া কোপাইয়া ইলশা-কাটা করিল। চশমা ও রিস্টওয়াচ মাটিতে আছড়াইয়া ভাঙ্গিয়া ফেলিল; ক্ষুর স্ট্রপ,শেভিংস্টিক ও ব্রাশ অনেকখানি রাস্তা হাঁটিয়া নদীতে ফেলিয়া দিয়া আসিল;বিলাসিতার মস্তকে কঠোর পদাঘাত করিয়া পাথর-বসানো সোনার আংটিটা এক অন্ধ ভিক্ষুককে দান করিয়া এবং টুথক্রিম ও টুথব্রাস পায়খানার টবের মধ্যে ফেলিয়া দিয়া দাঁত ঘষিতে লাগিল।
অর্থাৎ এমদাদ অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করিল! সে কলেজ ছাড়িয়া দিল।
তারপর সে কোরা খদ্দের কল্লিদার কোর্তা ও সাদা লুঙ্গি পরিয়া মুখে দেড় ইঞ্চি পরিমাণ ঝাঁকড়া দাড়ি লইয়া সামনে-পিছনে সমান-করিয়া চুলকাটা মাথায় গোল নেকড়ার মতো টুপি কান পর্যন্ত পরিয়া চটিজুতা পায়ে দিয়া যেদিন বাড়িমুখে রওনা হইল,সে দিন রাস্তার বহুলোক তাকে সালাম দিল।
সে মনে মনে বুঝিল, কলিযুগেও দুনিয়ায় ধর্ম আছে।
কলেজে এমদাদের দর্শনে অনার্স ছিল।
কাজেই সে ধর্ম,খোদা,রসূল কিছুই মানিত না। সে খোদার আরশ,ফেরেশতা,ওহী,হযরতের মেরাজ লইয়া সর্বদা হাসিঠাট্টা করিত।
কলেজ ম্যাগাজিনে সে মিল,হিউম,স্পেন্সার,কোমতের ভাব চুরি করিয়া অনেকবার খোদার অস্তিত্বের অসারতা প্রমাণ করিয়াছিল।
কিন্তু খেলাফৎ আন্দোলনে যোগদান করিয়া এমদাদ একেবারে বদলাইয়া গেল।
সে ভয়ানক নামাজ পড়িতে লাগিল। বিশেষ করিয়া নফল নামাজ সে একেবারে তন্ময় হইয়া পড়িল।
গোল-গাল করিয়া বাঁশের কঞ্চি কাটিয়া সে নিজ হাতে একছড়া তসবিহ তৈরি করিল। সেই তসবির উপর দিয়া অষ্টপ্রহর অঙ্গুলি চালনা করিয়া সে দুইটা আঙ্গুলের মাথা ছিঁড়িয়া ফেলিল।
কিন্তু এমদাদ টলিল না। সে নিজের নধর দেহের দিকে চাহিয়া বলিল : হে দেহ,তুমি আমার আত্মাকে ছোট করিয়া নিজেই বড় হইতে চাহিয়াছিলে! কিন্তু আর নয়।
সে আবার দ্বিগুণ উৎসাহে তসবিহ চালাইতে লাগিল।
দুই
দিন যাইতে লাগিল।
ক্রমে এমদাদ একটা অস্বস্তি বোধ করিতে লাগিল।
বহু চেষ্টা করিয়াও সে এবাদতে তেমন নিষ্ঠা আনিতে পারিতেছিল না। নিজেকে বহু শাসাইল,বহু প্রক্রিয়া অবলম্বন করিল;কিন্তু তথাপি পোড়া ঘুম তাকে তাহাজ্জতের নামাজ তরক্ করিতে বাধ্য করিতে লাগিল।
অগত্যা সে নামাজে বসিয়া খোদার নিকট হাত তুলিয়া কাঁদিবার বহু চেষ্টা করিল। চোখের পানির অপেক্ষায় আগে হইতে কান্নার মতো মুখ বিকৃত করিয়া রাখিল। কিন্তু পোড়া চোখের পানি কোন মতেই আসিল না।
সে স্থানীয় কংগ্রেস ও খেলাফৎ কমিটির সেক্রেটারি ছিল।
সেখানে প্রত্যহ সকাল-বিকালে চারিপাশের বহু মওলানা মৌলবী সমবেত হইয়া কাবুলের আমিরের ভারত আক্রমণের কতদিন বাকি আছে তার হিসাব করিতেন এবং খেলাফত নোট-বিক্রয় লব্ধ পয়সায় প্রত্যহ পান ও র্জদা এবং সময়-সময় নাশতা খাইতেন।
ইহাদের একজনের সুফী বলিয়া খ্যাতি ছিল। তিনি এক পীর সাহেবের স্থানীয় খলিফা ছিলেন এবং অনেক রাত পর্যন্ত ‘এলহু’ ‘এলহু’ করিতেন।
অল্পদিন পূর্বে ‘এস্তেখারা’ করিয়া তিনি দেখিয়াছিলেন যে,চারি বৎসরের মধ্যে কাবুলের আমির হিন্দুস্থান দখল করিবেন।
তাঁহার কথায় সকলেই বিশ্বাস করিয়াছিলো;কারণ মেয়েলোকের উপর জিনের আসর হইলে তিনি জিন ছাড়াইতে পারিতেন।
এই সুফী সাহেবের নিকট এমদাদ তার প্রাণের বেদনা জানাইল।
সুফী সাহেব দাড়িতে হাত বুলাইয়া মৃদু হাসিয়া ইংরাজী-শিক্ষিতদের উদ্দেশ্য করিয়া অনেক বাঁকা বাঁকা কথা বলিয়া উপসংহারে বলিলেন : হকিকতান যদি আপনি রুহের তরক্কী হাসেল করিতে চান,তবে আপনাকে আমার কথা রাখিতে হইবে। আচ্ছা;মাস্টার সাহেব,আপনি কার মুরিদ?
এমদাদ অপ্রতিভভাবে বলিল : আমি ত কারো মুরিদ হই নাই।
সুফী সাহেব যেন রোগ নির্ণয় করিয়া ফেলিয়াছিলেন এইভাবে মাথা নাড়িতে নাড়িতে বলিলেন : হ-ম্,তাই বলুন। গোড়াতেই গলদ। পীর না ধরিয়া কি কেহ রুহানিয়ৎ হাসেল করিতে পারে? হাদীস শরীফে আসিয়াছে : [এইখানে সুফী সাহেব বিশুদ্ধরূপে আইন-গাইনের উচ্চারণ করিয়া কিছু আরবী আবৃত্তি করিলেন এবং উর্দুতে তার মানে-মতলব বয়ান করিয়া অবশেষে বাংলায় বলিলেন] : জযবা ও সলুক খতম করিয়া ফানা ও বাকা লাভে সমর্থ হইয়াছেন এরূপ কামেল ও মোকাম্মেল,সালেক ও মজযুব পীরের দামন না ধরিয়া কেহ জমিরের রওশনী ও রুহের তরক্কী হাসেল করিতে পারে না।
হাদীসের এই সুস্পষ্ট নির্দেশের কথা শুনিয়া এমদাদ নিতান্ত ঘাবড়াইয়া গেল।
সে ধরা-গলায় বলিল : কি হইবে আমার তাহা হইলে সুফী সাহেব?
সুফী সাহেব এমদাদের কাঁধে হাত রাখিয়া বলিলেন : ঘাবড়াইবার কোন কারণ নাই। কামেল পীরের কাছে গেলে একদিনে তিনি সব ঠিক করিয়া দিবেন।
স্বস্তিতে এমদাদের মুখ উজ্জ্বল হইয়া উঠিল।
সে আগ্রহাতিশয্যে সুফী সাহেবের হাত চাপিয়া ধরিয়া বলিল : কোথায় পাইব কামেল পীর? আপনার সন্ধানে আছে?
উত্তরে সুফী সাহেব সুর করিয়া একটি ফরাসী বয়েত আবৃত্তি করিয়া তার অর্থ বলিলেন : জওহরের তালাশে যারা জীবন কাটাইয়াছে,তারা ব্যতীত আর কে জওহরের খবর দিতে পারে? হাজার শোকর খোদার দরগায়,বহু তালাশের পর তিনি জওহর মিলাইয়াছেন।
সুফী সাহেবের হাত তখনও এমদাদের মুঠার মধ্যে ছিল। সে তা আরো জোরে চাপিয়া ধরিয়া বলিল : আমাকে লইয়া যাইবেন না সেখানে?
সুফী সাহেব বলিলেন : কেন লইয়া যাইব না? হাদীস শরীফে আসিয়াছে : (আরবী ও উর্দু) যে ব্যক্তি আল্লাহ্র রাস্তায় আসিতে চায়, তার সাহায্য কর।
সংসারে একমাত্র বন্ধন এবং অভিভাবক বৃদ্ধা ফুফুকে কাঁদাইয়া একদিন এমদাদ সুফী সাহেবের সঙ্গে পীর-জিয়ারতে বাহির হইয়া পড়িল।
তিন
এমদাদ দেখিল : পীর সাহেবের একতলা পাকা বাড়ি। বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। অন্দরবাড়ির সব ক’খানা ঘর পাকা হইলেও বৈঠকখানাটি অতি পরিপাটি প্রকাণ্ড খড়ের আটচালা।
সে সুফী সাহেবের পিছনে পিছনে বৈঠকখানায় প্রবেশ করিল। দেখিল : ঘরে বহু লোক জানু পাতিয়া বসিয়া আছেন। বৈঠকখানার মাঝখানে দেওয়াল ঘেঁষিয়া অপেক্ষাকৃত উচ্চ আসনে মেহেদি-রঞ্জিত দাড়ি বিশিষ্ট একজন বৃদ্ধ লোক তাকিয়া হেলান দিয়ে আলবোলায় তামাক টানিতেছেন।
এমদাদ বুঝিল : ইনিই পীর সাহেব।
‘আসসালামু আলাইকুম’ বলিয়া সুফী সাহেব সোজা পীর সাহেবের নিকট উপস্থিত হইয়া হাঁটু পাতিয়া বসিলেন। পীর সাহেব সম্মুখস্থ তাকিয়ার উপর একটি পা তুলিয়া দিলেন। সুফী সাহেব সেই পায়ে হাত ঘষিয়া নিজের চোখে মুখে ও বুকে লাগাইলেন।
তৎপর পীর সাহেব তাঁর হাত বাড়াইয়া দিলেন। সুফী সাহেব তা চুম্বন করিয়া দাঁড়াইয়া উঠিলেন এবং পিছাইয়া-পিছাইয়া কিছু দূর গিয়া অন্যান্য সকলের ন্যায় জানু পাতিয়া বসিলেন।
পীর সাহেব এতক্ষণে কথা বলিলেন : কিরে বেটা,খবর কি? তুই কি এরই মধ্যে দায়েরায়ে হকিকতে মহব্বত ও জযবায়েযাতী-বনাম হোব্বে এশক হাসিল করিয়া ফেললি নাকি?
পীর সাহেবের এই ঠাট্টায় লজ্জা পাইয়া সুফী সাহেব মাথা নিচু করিয়া মাজা ঈষৎ উঁচু করিয়া বলিলেন,হযরত,বান্দাকে লজ্জা দিতেছেন!
পীর সাহেব তেমনি হাসিয়া বলিলেন : তা না হইলে নিজের চিন্তা ছাড়িয়া অপরের রুহের সুপারিশ করিতে আমার নিকট আসিলেন কেন? কই তোর সঙ্গী কোথায়? আহা! বেচারা বড়ই অশান্তিতে দিনপাত করিতেছে।
এই বলিয়া পীর সাহেব চক্ষু বুজিলেন এবং প্রায় এক মিনিট কাল ধ্যানস্থ থাকিয়া চক্ষু মেলিয়া বলিলেন: সে এই ঘরেই হাজির আছে দেখিতেছি।
উপস্থিত মুরিদগণের সকলে বিস্ময়ে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করিতে লাগিল। এমদাদ ভক্তি ও বিস্ময়ে স্তব্ধ হইয়া একদৃষ্টে পীর সাহেবের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। মেহেদি-রঞ্জিত দাড়ি-গোঁফের ভিতর দিয়া পীর সাহেবের মুখ হইতে এক প্রকার জ্যোতি বিকীর্ণ হইতে লাগিল।
সুফী সাহেব এমদাদকে আগাইয়া আসিতে ইশারা করিলেন। সে ধীরে ধীরে পীর সাহেবের সম্মুখে উপস্থিত হইয়া সুফী সাহেবের ইঙ্গিতে অনভ্যস্ত হাতে কদম-বুসি করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া রহিল।
পীর সাহেব “বস বেটা,তোর ভাল হইবে। আহা,বড় গরীব!” বলিয়া আলবোলার নলে দম কষিলেন।
সুফী সাহেব আমতা-আমতা করিয়া বলিলেন : হযরত এর অবস্থা তত গরীব নয়। বেশ ভাল তালুক সম্পত্তি-
পীর সাহেব নলে খুব লম্বা টান কষিয়াছিলেন;কিন্তু মধ্যপথে দম ছাড়িয়া দিয়া মুখে ধোঁয়া লইয়াই বলিলেন : বেটা,তোরা আজিও দুনিয়ার ধন-দৌলত দিয়া ধনী-গরিব বিচার করিস। এটা তোদের বুঝিবার ভুল। আমি গরিব কথায় দুনিয়াবী গোরবৎ বুঝাই নাই। মুসলমানদের জন্য দুনিয়ার ধন-দৌলত হারাম। এই ধন-দৌলত এনসানের রুহানিয়ত হাসেলে বাধা জন্মায়,তার মধ্যে নফসানিয়ত পয়দা করে। আল্লাহতালা বলিয়াছেন : (আরবী ও উর্দু) বেশক দুনিয়ার ধন-দৌলত শয়তানের ওয়াস-ওয়াসা,ইহা হইতে দূরে পলায়ন কর। কিন্তু দুনিয়ার মায়া কাটান কি সহজ কথা? তোদের আমি দোষ দিই না। তোদের অনেকেই এখন যেকেরের দরজাতেই পড়িয়া আছিস। যেকরে জলী ও যেকরে খফী- এই দুই দরজার যেকের সারিয়া পরে ফেকেরের দরজায় পৌঁছিতে হয়। ফেকের হইতে যহুর এবং যহুর হইতে মোরাকেবা-মোশাহেদার কাবেলিয়ত হাসেল হয়। খোদার ফজলে আমি আরেফিন,সালেহীন ও সিদ্দিকিনের মোকামাতের বিভিন্ন দায়েরার ভিতর দিয়া যেভাবে এলমে-লাদুন্নির ফয়েজ হাসেল করিয়াছি,তোদের কলব অতটা কুশাদা হইতে অনেক দেরি অনেক-
-বলিয়া তিনি হুক্কার নলটা ছাড়িয়া দিয়া সোজা হইয়া বসিলেন এবং চোখ বুজিয়া ধ্যানস্থ হইলেন।
কিছুক্ষণ চোখ বুজিয়া থাকিয়া হাসিয়া উঠিলেন এবং চিৎকার করিয়া বলিলেন : কুদরতে-ইয্দানী,কুদরতে-ইয্দানী। মুরিদরা সব সে-চিৎকারে সন্ত্রস্ত হইয়া উঠিলেন।
কিন্তু কেহ কোনও কথা জিজ্ঞাসা করিতে সাহস করিলেন না।
পীর সাহেব চিৎকার করিয়াই আবার চোখ বুজিয়াছিলেন। তিনি এবার ঈষৎ হাসিয়া চোখ মেলিয়া বলিলেন : আমরা কত বৎসর হইল এখানে বসিয়া আছি?
জনৈক মুরিদ বলিলেন : হযরত,বৎসর কোথায়? এই না কয়েক ঘণ্টা হইল।
পীর সাহেব হাসিলেন। বলিলেন : অনেক দেরি- অনেক দেরি। আহা বেচারারা চোখের বাহির আর কিছুই দেখিতে পায় না।
অপর মুরিদ বলিলেন : হুজুর কেবলা,আপনার কথা মোটেই বুঝিতে পারিলাম না।
পীর সাহেব মৃদু হাসিয়া বলিলেন : অত সহজে কি আর সব কথা বুঝা যায় রে বেটা? চেষ্টা কর,চেষ্টা কর।
মুরিদটি ছিলেন একটু আবদেরে রকমের। তিনি বায়না ধরিলেন : না কেবলা,আমাদিগকে বলিতেই হইবে। কেন আপনি বৎসরের কথা জিজ্ঞাসা করিলেন?
পীর সাহেব বলিলেন : ও-কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করিস না। তার চেয়ে অন্য কথা শোন। এই যে সাদুল্লাহ (সুফী সাহেবের নাম) একটি ছেলেকে আমার নিকট মুরিদ করিতে লইয়া আসিল,আমি সে-কথা কি করিয়া জানিতে পারিলাম? আজ তোমরা তাজ্জব হইতেছ। কিন্তু ইনশাআল্লাহ, যখন তোমরা মোরাকেবায়ে-নেসবতে-বায়নান্নাসে তালিম লইবে,তখন অপরের নেসবত সম্বন্ধে তোমাদের কলব আয়নার মতো রওশন হইয়া যাইবে। আলগরজ ইহাও খোদার এক শানে-আজিম। সাদুল্লাহ যখন আমার দস্ত-বুসি করে,তখন তার মুখের দিকে আমার নজর পড়িল এবং সঙ্গে সঙ্গে আমার রুহ সাদুল্লাহর রুহের দিকে মোতাওয়াজ্জাহ হইয়া গেল। সেখানে আমি দেখিলাম,সাদুল্লার রুহ আর একটা নূতন রুহের সঙ্গে আলাপ করিতেছে। উহাতেই আমি সব বুঝিয়া লইলাম। আল্লাহু আজিমুশশান।
বলিয়া পীর সাহেব একজন মুরিদকে হুক্কার দিকে ইঙ্গিত করিলেন।
মুরিদ হুক্কার মাথা হইতে চিলিম লইয়া তামাক সাজিতে বাহির হইয়া গেল।
পীর সাহেব বলিলেন : তোমরা আমার নিজের নুৎফার ছেলের মতো। তথাপি তোদের নিকট হইতে আমাকে অনেক গায়েবের কথা গোপন রাখিতে হয়। কারণ তোমরা সে-সমস্ত বাতেনি কথা বরদাশত করিতে পারিবে না। যেকের ও ফেকের দ্বারা কলব কুশাদা করিবার আগেই কোনও বড় রকমের নূরে তজল্লী তাতে ঢালিয়া দিলে তাতে কলব অনেক সময় ফাটিয়া যায়। এলমে-লাদুন্নি হাসেল করিবার আগেই আমি একবার লওহে-মাওফুযে উপস্থিত হইয়াছিলাম। তখন আমি মাত্র দায়েরায়ে-হকিকতে-লাতা আইউনে তালিম লইতেছিলাম। সায়েরে-নাযাবীর ফয়েজ তখনও আমার হাসেল হয় নাই। কাজেই আরশে-মওয়াল্লার পরদা আমার চোখের সামনে হইতে উঠিয়া যাইতেই আমি নূরে-ইয্দানী দেখিয়া বেহুশ হইয়া পড়িলাম। তারপর আমার জেসমের মধ্যে আমার রুহের সন্ধান না পাইয়া আমার মুর্শেদ-কেবলা- তোরা তো জানিস আমার ওয়ালেদ সাহেবই আমার মুর্শেদ -লওহে মাহফুজ হইতে আমার রুহ্ আনিয়া আমার জেসমের মধ্যে ভরিয়া দেন,এবং নিজের দায়রার বাহিরে যাওয়ার জন্য আমাকে বহুৎ তম্বিহু করেন। কাজেই দেখিতেছিস,কাবেলিয়ত হাসেল না করিয়া কোনও কাজে হাত দিতে নাই। খানিকক্ষণ আগে আমি জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম : আমরা কত বৎসর যাবত এখানে বসিয়া আছি? শুনিয়া তোরা অবাক হইয়াছিলি। কিন্তু এর মধ্যে যে ঘটনা ঘটিয়াছে,তা শুনিলে তো আরো তাজ্জব হইয়া যাইবি। সে জন্যই সে কথা বলিতে চাই না। কিন্তু কিছু কিছু না বলিলে তোরা শিখবি কোথা হইতে? তাই সে কথা বলাই উচিত,মনে করিতেছি। সাদুল্লাহ এখানে আসিবার পর আমি আমার রুহকে ছাড়িয়া দিয়াছিলাম। সে তামাম দুনিয়া ঘুরিয়া সাত হাজার বৎসর কাটাইয়া তারপর আমার জেসমে পুনরায় প্রবেশ করিয়াছে। এই সাত হাজার বৎসরে কত বাদশাহ ওফাত করিয়াছে,কত সুলতানাৎ মেসমার হইয়াছে,কত লড়াই হইয়াছে;সব আমার সাফ-সাফ মনে আছে। সেরেফ এইটুকুই বলিলাম; ইহার বেশি শুনিলে তোদের কলব ফাটিয়া যাইবে।
ইতিমধ্যে তামাক আসিয়াছিল।
পীর সাহেব নল হাতে লইয়া ধীরে ধীরে টানিতে লাগিলেন।
সভা নিস্তব্ধ রহিল। কলব ফাটিয়া যাইবার ভয়ে কেহ কোনও কথা জিজ্ঞাসা করিল না।
এমদাদ পীর সাহেবের কথা কান পাতিয়া শুনিতেছিল। কৌতূহল ও বিস্ময়ে সে অস্থিরতা বোধ করিতে লাগিল।
সে স্থির করিল,ইহার কাছে মুরিদ হইবে।
চার
পীর সাহেব অনেক নিষেধ করিলেন। বলিলেন : বাবা,সংসার ছাড়িয়া থাকিতে পারবে না,তাসউওয়াফ বড় কঠিন জিনিস ইত্যাদি।
কিন্তু এমদাদ তাওয়াজ্জোহ লইল।
পীর সাহেব নিজের লতিফায় যেকের জারি করিয়া সেই যেকের এমদাদের লতিফায় নিক্ষেপ করিলেন।
এমদাদ প্রথম লতিফা যেকরে-জলী আরম্ভ করিল।
সে দিবানিশি দুই চোখ বুজিয়া পীর সাহেবের নির্দেশমত ‘এলহু’ ‘এলহু’ করিতে লাগিল।
পীর সাহেব বলিয়াছিলেন : খেলওয়াৎ-দর-অঞ্জুমান দ্বারা নিজের কলবকে স্বীয় লতিফার দিকে মুতাওয়াজ্জাহ করিতে পারিলে তার কলবে যাতে আহাদিয়াতের ফয়েজ হাসেল হইবে এবং তার রুহ ঘড়ির কাঁটার ন্যায় কাঁপিতে থাকিবে।
কিন্তু এমদাদ অনেক চেষ্টা করিয়াও তার কলবকে লতিফায় মুতাওয়াজ্জাহ করিতে পারিল না। তৎপরিবর্তে তার চোখের সামনে পীর সাহেবের মেহেদি-রঞ্জিত দাঁড়ি ও তার রূপা-বাঁধানো গড়গড়ার ছবি ভাসিয়া উঠিতে লাগিল।
ফলে তার কলবে যাতে-আহাদিয়তের ফয়েজ হাসেল হইয়া তার রুহকে ঘড়ির কাঁটার মতো কাঁপাইবার পরিবর্তে ফুফু-আম্মার স্মৃতি বাড়ি যাইবার জন্য তার মনকে উচাটন করিয়া তুলিতে লাগিল।
দিন যাইতে লাগিল।
অনাহারে অনিদ্রায় এমদাদের চোখ দুটি মস্তকের মধ্যে প্রবেশ করিল। তার শরীর নিতান্ত দুর্বল ও মন অত্যন্ত অস্থির হইয়া পড়িল।
সে বুঝিল,এইভাবে আরও কিছুদিন গেলে তার রুহু বস্তুতই জেসম হইতে আযাদ হইয়া আলমে-আমরে চলিয়া যাইবে।
সে স্থির করিল : পীর সাহেবের কাছে নিজের অক্ষমতার কথা নিবেদন করিয়া সে একদিন বিদায় হইবে।
কিন্তু বলি বলি করিয়াও কথাটা বলিতে পারিল না।
একটা নূতন ঘটনায় সে বিদায়ের কথাটা আপাতত চাপিয়া গেল! দূরবর্তী একস্থানে মুরিদগণ পীর সাহেবকে দাওয়াত করিল।
প্রকাণ্ড বজরায় একমণ ঘি,আড়াই মণ তেল,দশ মণ সরু চাউল,তিনশত মুরগী,সাত সের অম্বুরি তামাক এবং তেরজন শাগরেদ লইয়া পীর সাহেব ‘মুরিদানে’ রওয়ানা হইলেন।
পীর সাহেবের ভ্রমণ বৃত্তান্ত ইংরেজিতে লিখিয়া কলিকাতার সংবাদপত্রে পাঠাইবার জন্য এমদাদকেও সঙ্গে লওয়া হইল। নদীর সৌন্দর্য, নদীপারের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য এমদাদের কাছে বেশ লাগিল।
পীর সাহেব গন্তব্যস্থানে উপস্থিত হইলেন।
তিনি মুরিদগণের নিকট যে অভ্যর্থনা পাইলেন,তাহা দেখিলে অনেক রাজা-বাদশাহ রাজত্ব ছাড়িয়া মোরাকেবা-মোশাহেদায় বসিতেন।
পীর সাহেব গ্রামের মোড়লের বাড়িতে আস্তানা করিলেন।
বিভিন্ন দিন বিভিন্ন মুরিদের বাড়িতে বিরাট ভোজ চলিতে লাগিল।
পীর সাহেবের একটু দূরে বসিয়া গুরুভোজ করিয়া এমদাদ এত দিনের কৃচ্ছ সাধনার প্রতিশোধ লইতে লাগিল। ইহাতে প্রথম প্রথম তার একটু পেটে পীড়া দেখা দিলেও শীঘ্রই সে সামলাইয়া উঠিল এবং তার শরীর হৃষ্টপুষ্ট ও চেহারা বেশ চিকনাই হইয়া উঠিতে লাগিল।
পীর সাহেবের ভাত ভাঙিবার কসরত দেখার সুযোগ ইতিপূর্বে এমদাদের হয় নাই। এইবার সে ভাগ্য লাভ করিয়া এমদাদ বুঝিল : পীর সাহেবের রুহানীশক্তি যত বেশিই থাকুক না কেন,তাঁর হজমশক্তি নিশ্চয়ই তার চেয়ে বেশি।
সন্ধ্যায় পুরুষদের জন্য মজলিশ বসিত।
রাতে এশার নামাজের পর অন্দর মহলে মেয়েদের জন্য ওয়াজ হইত। কারণ অন্য সময় মেয়েদের কাজে ব্যস্ত থাকিতে হয়।
সেখানে পুরুষদের প্রবেশ নিষেধ ছিল।
স্ত্রীলোকদিগকে ধর্মকথা বুঝাইতে একটু দেরি হইত। কারণ মেয়েলোকের বুদ্ধিসুদ্ধি বড় কম- তারা নাকেস-আকেল।
কিন্তু বাড়িওয়ালার ছেলে রজবের সুন্দরী স্ত্রী কলিমন সম্বন্ধে পীর সাহেবের ধারণা ছিল অন্যরকম। মেয়ে-মজলিশে ওয়াজ করিবার সময় তিনি ইহারই দিকে ঘন-ঘন দৃষ্টিপাত করিতেন।
তিনি অনেক সময় বলিতেন : তাসাউওয়াফের বাতেনী কথা বুঝিবার ক্ষমতা এই মেয়েটার মধ্যেই কিছু আছে। ভাল করিয়া তাওয়াজ্জোহ দিলে তাকে আবেদা রাবেয়ার দরজায় পৌঁছাইয়া দেওয়া যাইতে পারে।
এশার নামাজের পর দাঁড়িয়ে চিরুনি ও কাপড়ে আতর লাগান সুন্নত এবং পীর সাহেব সুন্নাতের একজন বড় মো’তেকাদ ছিলেন।
ওয়াজ করিবার সময় পীর সাহেবের প্রায়ই জযবা আসিত।
সে জযবাকে মুরিদগণ ‘ফানাফিল্লাহ’ বলিত।
এই ফানাফিল্লাহ্র সময় পীর সাহেব ‘জ্বলিয়া গেলাম’ ‘পুড়িয়া গেলাম’ বলিয়া চিৎকার করিয়া চিৎ হইয়া শুইয়া পড়িতেন। এই সময় পীর সাহেবের রুহ আলমে-খালক হইতে আলমে-আমরে পৌঁছিয়া রুহে ইযদানির সঙ্গে ফানা হইয়া যাইত এবং নূরে ইয়াদানি তাঁর চোখের উপর আসিয়া পড়িত। কিন্তু সে নূরের জলওয়া পীর সাহেবের চক্ষে সহ্য হইত না বলিয়া তিনি এইরূপ চিৎকার করিতেন।
তাই জযবার সময় একখণ্ড কাল মখমল দিয়া পীর সাহেবের চোখ-মুখ ঢাকিয়া দিয়া তাঁর হাত-পা টিপিয়া দিবার ওসিয়ত ছিল।
এইরূপ জযবা পীর সাহেবের প্রায়ই হইত।
-এবং মেয়েদের সামনে ওয়াজ করিবার সময়েই একটু বেশি হইত।
এই সব ব্যাপারে এমদাদের মনে একটু খট্কার সৃষ্টি হইল।
কিন্তু সে জোর করিয়া মনকে ভক্তিমান রাখিবার চেষ্টা করিতে লাগিল।
সে চেষ্টায় সফল হইবার আগেই কিন্তু ও-পথে বাধা পড়িল। প্রধান খলিফা সুফী বদরুদ্দীন সাহেবের সঙ্গে পীর সাহেবকে প্রায়ই কানাকানি করিতে দেখিয়া এমদাদের মনের খট্কা বাড়িয়া গেল। তার মনে পীর সাহেবের প্রতি একটা দুর্নিবার সন্দেহের ছায়াপাত হইল।
এমন সময় পীর সাহেব অত্যন্ত অকস্মাৎ একদিন ঘোষণা করিলেন : তিনি আর দু-এক দিনের বেশি সে অঞ্চলে তশরিফ রাখিবেন না।
এই গভীর শোক সংবাদে শাগরেদ-মুরিদগণের সকলেই নিতান্ত গমগিন হইয়া পড়িল।
জনৈক শাগরেদ সুফী সাহেবের ইশারায় বলিলেন : হুজুর কেবলা আপনি একদিন বলিয়াছিলেন;এবার এ-অঞ্চলের মুসলমানগণকে কেরামতে-নেসবতে বায়নান্নাস দেখাইবেন? তা না দেখাইয়াই কি হুজুর এখান হইতে তশরিফ লইয়া যাইবেন? এখানকার মুরিদগণের অনেকেই বলিতেছেন : হুজুর মাঝে মাঝে কেরামত দেখান না বলিয়া উম্মী মুরিদগণের অনেকেই গোমরাহ হইয়া যাইতেছে। মওলানা লকবধারী ঐ ভণ্ডটা ও-পাড়ার অনেক মুরিদকে ভাগাইয়া নিতেছে; সে নাকি বৎসর বৎসর একবার আসিয়া কেরামত দেখাইয়া যান।
পীর সাহেব গম্ভীর মুখে বলিলেন : (আরবী ও উর্দু) আল্লাহ্ই কেরামতের একমাত্র মালিক,মানুষের সাধ্য কি কেরামত দেখায়? ও-সব শয়তানের চেলাদের কথা আমার সামনে বলিও না। তবে হ্যাঁ,মোরাকেবায়ে-নেসবতে বায়নান্নাস-এর তরকিব দেখাইব বলিয়াছিলাম বটে, কিন্তু তার আর সময় কোথায়?
সমস্ত সাগরেদ ও মুরিদগণ সমস্বরে বলিয়া উঠিলেন : না হুজুর,সময় করিতেই হইবে,এবার উহা না দেখিয়া ছাড়িব না।
অগত্যা পীর সাহেব রাজি হইলেন।
স্থির হইল,সেই রাত্রেই মোরাকেবা বসিবে।
সারাদিন আয়োজন চলিল।
রাত্রে মৌলুদের মহফেল বসিল। হযরত পয়গম্বর সাহেবের অনেক অনেক মোওয়াজেযাত বর্ণিত হইল।
মৌলুদ শেষে খাওয়া-দাওয়া হইল এবং তৎপর মোরাকেবার বৈঠক বসিল।
পাঁচ
পীর সাহেব বলিলেন : আজ তোমাদের আমি যে মোরাকেবার তরকিব দেখাইব,ইহা দ্বারা যে-কোনও লোকের রুহের সঙ্গে কথা বলিতে পারি। আমি যদি নিজে মোরাকেবায় বসি,তবে সেই রুহ গোপনে আমার সঙ্গে কথা বলিয়া চলিয়া যাইবে। তোমরা কিছুই দেখিতে পাইবে না। তোমাদের মধ্যে একজন মোরাকেবায় বস,আমি তার রুহের দিকে তোমরা যার কথা বলিবে তার রুহের তাওয়াজ্জোহ দেখাইয়া তারই রুহের ফয়েজ হাসিল করিব। তৎপর তোমরা যে-কেহ তার সঙ্গে কথা বলিতে পারিবে।
সকলে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করিতে লাগিল।
কেহই কোন কথা বলিল না, মোরাকেবায় বসিতে কেহই অগ্রসর হইল না।
এমদাদ দাঁড়াইয়া বলিল : আমি বসিব।
পীর সাহেব একটু হাসিলেন।
বলিলেন : বাবা,মোরাকেবা অত সোজা নয়,তুই আজিও যেকরে খফী আমল করিস নাই,মোরাকেবায় বসিতে চাস?
বলিয়া তিনি হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিলেন।
দেখাদেখি উপস্থিত সকলেই হাসিয়া উঠিল।
লজ্জায় এমদাদের রাগ হইল। সে বসিয়া পড়িল।
পীর সাহেব আবার বললেন : কি,আমরে মুরিদগণের মধ্যে আজও কারও এতদূর রুহানী তরক্কী হাসেল হয় নাই, যে মোরাকেবায় বসিতে পারে? আমার খলিফাদের মধ্যেও কেহ নাই?
বলিয়া তিনি শাগরেদদের দিকে দৃষ্টি ফিরাইলেন।
প্রধান খলিফা সুফী সাহেব উঠিয়া বলিলেন : হুজুর কেবলা কি তবে বান্দাকে হুকুম করিতেছেন? আমি ত আপনার আদেশে কতবার মোরাকেবায়-নেসবতে-বায়নান্নাসে বসিয়াছি। কোনও নূতন লোককে বসাইলে হইত না?
সুফী সাহেব আরও অনেকবার বসিয়াছেন শুনিয়া মুরিদগণের অন্তরে একটু সাহসের উদ্রেক হইল।
তারা সকলে সমস্বরে বলিল : আপনিই বসুন,আপনিই বসুন।
অগত্যা পীর সাহেবের আদেশে সুফী সাহেব মোরাকেবায় বসিলেন।
পীর সাহেব উপস্থিত দর্শকদের দিকে চাহিয়া বলিলেন : কার রুহের ফয়েজ হাসিল করিব?
মুরিদগণের মুখের কথা যোগাইবার আগেই জনৈক সাগরেদ বলিলেন : এই মাত্র মৌলুদ-শরীফ হইয়াছে;হযরত পয়গম্বর সাহেবের মোয়াজেযা বয়ান হইয়াছে। তাঁরই রুহ আনা হোক।
সকলেই খুশী হইয়া বলিলেন : তাই হউক,তাই হউক।
তাই হইল।
সুফী সাহেব আতর-সিক্ত মুখমলের গালিচায় তাকিয়া হেলান দিয়া বসিলেন। চারিদিকে আগরবাতি জ্বালাইয়া দেওয়া হইল। মেশক্ যাফরান ও আতরের গন্ধে ঘর ভরিয়া গেল।
পীর সাহেব তাঁর প্রধান খলিফার রুহে শেষ পয়গম্বর হযরত মোহাম্মদের রুহ-মোবারক নাযেল করিবার জন্যে ঠিক তাঁর সামনে বসিলেন।
শাগরেদরা চারিদিক ঘিরিয়া বসিয়া মিলিত-কণ্ঠে সুর করিয়া দরুদ পাঠ করিতে লাগলেন। পীর সাহেব কখনও জোরে কখনও বা আস্তে নানা প্রকার দোওয়া কালাম পড়িয়া সুফী সাহেবের চোখে-মুখে ফুঁকিতে লাগিলেন।
কিছুক্ষণ ফুঁকিবার পর শাগরেদগণকে চুপ করিতে ইঙ্গিত করিয়া পীর সাহেব বুকে হাত বাঁধিয়া একদৃষ্টে সুফী সাহেবের বুকের দিকে চাহিয়া রহিলেন।
সুফী সাহেবের বুকের দুইটা বোতাম খুলিয়া তাঁর বুকের খানিকটা অংশ ফাঁক করিয়া দেওয়া হইয়াছিল। পীর সাহেব তাঁর দৃষ্টি সেইখানেই নিবদ্ধ করিলেন।
অল্পক্ষণ মধ্যেই সুফী সাহেবের শরীর কাঁপিতে লাগিল। কম্পন ক্রমেই বাড়িয়া গেল। সুফী সাহেব ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলিতে লাগিলেন এবং হাত পা ছুঁড়িতে ছুঁড়িতে মূর্ছিতের ন্যায় বিছানায় লুটাইয়া পড়িলেন।
পীর সাহেব মুরিদগণের দিকে চাহিয়া বলিলেন : বদর বাবাজীর একটু তকলিফ হইল!
কি করিব? পরের রুহের উপর অন্য রুহের ফয়েজ হাসেল আসানির সঙ্গে করে বেলকুল না-মোমকেন। যা হউক,হযরতের রুহ তশরিফ আনিয়াছেন। তোমরা সকলে উঠিয়া কেয়াম কর।
-বলিয়া তিনি স্বয়ং উঠিয়া পড়িলেন। সকলেই দাঁড়াইয়া সমন্বরে পড়িতে লাগিল : ইয়া নবী সালাম আলায় কা ইত্যাদি।
কেয়াম ও দরুদ শেষ হইলে অভ্যাসমত অনেকেই বসিয়া পড়িল।
পীর সাহেব ধমক দিয়া বলিলেন : হযরতের রুহে পাক এখনও এই মজলিশে হাজির আছেন,তোমরা কেহ বসিতে পারিবে না। কার কি সওয়াল করিবার আছে করিতে পার।
এমদাদ একটা বিষয় ধাঁধায় পড়িয়া গেল। সে ইহাকে কিছুতেই সত্য বলিয়া মানিয়া লইতে পারিল না।
-মাথায় এক ফন্দি আঁটিয়া অগ্রসর হইয়া বলিল : কেবলা আমি কোন সওয়াল করিতে পারি?
পীর সাহেব চোখ গরম করিয়া বলিলেন : যাও না,জিজ্ঞাসা কর না গিয়া!
-বলিয়া কণ্ঠস্বর অপেক্ষাকৃত মোলায়েম করিয়া আবার বলিলেন : বাবা সকলের কথাই যদি রুহে পাকের কাছে পৌঁছিত,তবে দুনিয়ার সব মানুষই ওলি-আল্লাহ হইয়া যাইত।
এমদাদ তথাপি সুফী সাহেবের দিকে চাহিয়া বলিল : আপনি যদি হযরত পয়গম্বর সাহেবের রুহ হন,তবে আমার দরুদ-সালাম জানিবেন।
হযরতের রুহ কোন জবাব দিলো না।
পীর সাহেব এমদাদের কাঁধে হাত দিয়ে তাকে একদিকে ঠেলিয়া দিয়া বলিলেন : অধিকক্ষণ রুহে পাককে রাখা বে-আদবি হইবে। তোমাদের যদি কাহারও সিনা সাফ হইয়া থাকে, তবে আসিয়া যে কোন সওয়াল করিতে পার।
-বলিতেই পীর সাহেবের অন্যতম খলিফা মওলানা বেলায়েতপুরী সাহেব আসর হইয়া ‘আসসালামো আলায়কুম ইয়া রসূলুল্লাহ’ বলিয়া সুফী সাহেবের সামনে দাঁড়াইলেন।
সকলে বিস্মিত হইয়া শুনিল সুফী সাহেবের মুখ দিয়া বাহির হইল : ওয়া আলায়কুমস্ সালাম,ইয়া উম্মতী।
মওলানা সাহেব বলিলেন : হে রেসালাত-পনা, সৈয়দুল কাওনায়েন,আমি আপনার খেদমতে একটা আরজ করিতে চাই।
আওয়াজ হইল : শীগগির বল,আমার আর দেরী করিবার উপায় নাই।
মওলানা : আমাদের পীর দস্তগির কেবলা সাহেব নূরে-ইযদানির জলওয়া সহ্য করিতে পারেন না,ইহার কারণ কি? তার আমলে কি কোনও গলদ আছে?
কঠোর সুরে উত্তর হইল : হ্যাঁ,আছে।
পীর সাহেব শিহরিয়া উঠিলেন। তিনি কাঁদ-কাঁদ সুরে নিজেই বলিলেন : কি গলদ আছে,‘ইয়া রসূলুল্লাহ? আমার পঞ্চাশ বৎসরের রঞ্জকশি কি তবে সব পণ্ড হইয়াছে?- বলিয়া পীর সাহেব কাঁদিয়া ফেলিলেন।
সুফী সাহেবের অচেতন দেহের মধ্যে হইতে আওয়াজ হইল : হে আমার পিয়ারা উম্মত, ঘাবড়াইও না। তোমার উপর আল্লাহর রহমত হইবে। তুমি মারফত খুঁজিতেছ। কিন্তু শরীয়ত ত্যাগ করিয়া কি মারফত হয়?
পীর সাহেব হাত কচলাইয়া বলিলেন : হুজুর, আমি কবে শরীয়ত অবহেলা করিলাম?
উত্তর হইল : অবহেলা কর নাই, কিন্তু পালনও কর নাই। আমি শরিয়তে চার বিবি হালাল করিয়াছি। কিন্তু তোমার মাত্র তিন বিবি। যারা সাধারণ দুনিয়াদার মানুষ তাদের এক বিবি হইলেও চলিতে পারে। কিন্তু যারা রুহানী ফয়েজ হাসিল করিতে চায়,তাদের চার বিবি ছাড়া উপায় নাই! আমি চার বিবির ব্যবস্থা কেন করিয়াছি,তোমরা কিছু বুঝিয়াছ? চার দিয়াই এ দুনিয়া,চার দিয়াই আখেরাত। চারদিকে যা দেখ সবই খোদা চার চিজ দিয়া পয়দা করিয়াছেন। চার চিজ দিয়া খোদাতা’লা আদম সৃষ্টি করিয়া তার হেদায়েতের জন্য চার কেতাব পাঠাইয়াছেন। সেই হেদায়েত পাইতে হইলে মানুষকে চার এমামের চার তরিকা মানিয়া চলিতে হয়। এইভাবে মানুষকে চারের ফাঁদে ফেলিয়া খোদাতা’লা চার কুরসির অন্তরালে লুকাইয়া আছেন। এই চারের পরদা ঠেলিয়া আলমে-আমরে নূরে-ইয্দানিতে ফানা হইতে হইবে, দুনিয়াতে চার বিবির ভজনা করিতে হইবে।
পীর সাহেব সকলকে শুনাইয়া হযরতের রুহের দিকে চহিয়া বলিলেন : এই বৃদ্ধ বয়সে আবার বিবাহ করিব?
-তুমি বৃদ্ধ? আমি ষাট বৎসর বয়সে নবম বার বিবাহ করিয়াছিলাম।
পীর সাহেব মিনতি ভরা কণ্ঠে বলিলেন : না রেসালাত-পানা আমি আর বিবাহ করিব না।
-না কর,ভালই। কিন্তু তোমার রুহানী কামালিয়ত হাসেল হইবে না, তুমি নূরে- ইযদানির জলওয়া বরদাশত করিতে পারিবে না। তোমার মুরিদানের কেহই নফসানিয়তের হাত এড়াইতে পারিবে না।
পীর সাহেব হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া বলিলেন : আমি নিজের জন্য ভাবি না ইয়া রসূলুল্লাহ; কিন্তু যখন আমার মুরদিগণের অনিষ্ট হইবে,তখন বিবাহ করিতে রাজি হইলাম। কিন্তু আমি এক বুড়িকে বিবাহ করিব।
-তুমি তওবা আসতাগফার পড়। তুমি খোদার কলম রদ করিতে চাও? তোমার বিবাহ ঠিক হইয়া আছে। বেহেশতে আমি তার ছবি দেখিয়া আসিয়াছ।
-সে কে,ইয়া রসূলুল্লাহ?
-এই বাড়ির তোমার মুরিদের ছোট ছেলে রজবের স্ত্রী কলিমন।
-ইয়া রসূলুল্লাহ,আমি মুরিদের স্ত্রীকে বিবাহ করিব? সে যে আমার বেটার বউ-এর শামিল।
-ইয়া উম্মতি,আমি আমার পালিত পুত্র যায়েদের স্ত্রীকে নিকাহ্ করিয়াছিলাম,আর তুমি একজন মুরিদের স্ত্রীকে নিকাহ্ করিতে পারিবে না?
ইয়া রসূল্লাহ,সে যে সধবা।
রজবকে বল স্ত্রীকে তালাক দিতে। কলিমন তোমার জন্যই হালাল। এ মারফতি নিকায় ইদ্দত পালনের প্রয়োজন হইবে না। আমি আর থাকিতে পারি না। চলিলাম। অররহহুমাতুল্লাহ আলায়কুম,ইয়া উম্মতি।
মূর্ছিত সুফী সাহেব একটা বিকট চিৎকার করিলেন। পীর সাহেবের অপর অপর শাগরেদরা তাঁকে সজোরে পাখার বাতাস করিতে লাগিলেন।
মুরিদগণের সনির্বন্ধ অনুরোধ সত্ত্বেও পীর সাহেব মাথা নাড়িয়া বলিতে লাগিলেন : চাই না আমি রুহানী কামালিয়ত। আমি মুরিদের বউকে বিবাহ করিতে পারিব না।
গ্রাম্য মুরিদগণ আখেরাতের ভয়ে পীর সাহেবের অনেক হাতে-পায়ে ধরিল। পীর সাহেব অটল।
এই সময় প্রধান খলিফা সুফী সাহেব স্মরণ করাইয়া দিলেন : এই নিকাহ না করিলে কেবল পীর সাহেবের একারই রুহানী লোকসান হইবে না, তাঁর মুরিদগণের সকলের রুহের উপরও বহুত মুসিবত পড়িবে। তখন পীর সাহেব অগত্যা নিজের রেজামন্দী জানাইয়া দাঁড়িতে হাত বুলাইতে বুলাইতে বলিতে লাগিলেনঃ ছোবহান আল্লাহ! এ সবই কুদরতে এলাহী! তাঁরই শানে-আজিম! আল্লাহ্ পাক নিজেই কোরান-মজিদ ফরমাইয়াছেন (আরবী ও উর্দু)…।
বাপ-চাচা পাড়া-পড়শীর অনুরোধে,আদেশে,তিরস্কারে ও অবশেষে উৎপীড়নে তিষ্ঠিতে না পারিয়া রজব তার এক বছর আগে বিয়া-করা আদরের স্ত্রীকে তালাক দিল এবং কাপড়ের খুঁটে চোখ মুছিতে মুছিতে বাড়ির বাহির হইয়া গেল।
কলিমনের ঘন-ঘন মূর্ছার মধ্যে অতিশয় ত্রস্ততার সঙ্গে শুভকার্য সমাধান হইয়া গেল।
এমদাদ স্তম্ভিত হইয়া বর বেশে সজ্জিত পীর সাহেবের দিকে চাহিয়া ছিল। তার চোখ হইতে আগুন ঠিকরাইয়া বাহির হইতেছিল।
এইবার তার চেতনা ফিরিয়া আসিল। সে এক লাফে বরাসনে-উপবিষ্ট পীর সাহেবের সম্মুখে উপস্থিত হইয়া তাঁর মেহেদি-রঞ্জিত দাড়ি ধরিয়া হেচকা টান মারিয়া বলিল : রে ভণ্ড শয়তান! নিজের পাপ-বাসনা পূর্ণ করিবার জন্য দুইটা তরুণ প্রাণ এমন দুঃখময় করিয়া দিতে তোর বুকে বাজিল না?
আর বলিতে পারিল না। শাগরেদ-মুরিদরা সকলে মার মার করিয়া আসিয়া এমদাদকে ধরিয়া ফেলিল এবং চড়-চাপড় মারিতে লাগিল।
এমদাদ গ্রামের মাতব্বর সাহেবের দিকে চাহিয়া বলিল : তোমরা নিতান্ত মূর্খ। এই ভণ্ডের চালাকি বুঝিতে পারিতেছ না? নিজে শখ মিটাইবার জন্য যে হযরত পয়গম্বর সাহেবকে লইয়া তামাসা করিয়া তাঁর অপমান করিতেছে। তোমরা এই শয়তানকে পুলিশে দাও।
পীর সাহেবের প্রতি এমদাদের বেয়াদবিতে মুরিদরা ইতিপূর্বে একটু অসন্তুষ্ট হইয়া ছিল। এবার তার মস্তিষ্ক বিকৃতি সম্বন্ধে তারা নিঃসন্দেহ হইল। মাতব্বর সাহেব হুকুম করিলেন : এই পাগলটা আমাদের হুজুর কেবলার অপমান করিতেছে। তোমরা কয়েকজন ইহাকে কান ধরিয়া গ্রামের বাহির করিয়া দিয়া আস।
ভূলুণ্ঠিত পীর সাহেব ইতিমধ্যে উঠিয়া ‘আস্তাগফেরুল্লাহ’ পড়িতে পড়িতে তাঁর আলুলায়িত দাঁড়িতে আঙ্গুল দিয়া চিরুনি কর
...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'
লেখকদের ধন্যবাদ
কোনদিন বুকে বাজে নাই মোল্লাদের/পুরোহিতদের---
আপনাকে, দৈনিক জনকণ্ঠকে আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীকে জানাই অশেষ ধন্যবাদ।
এই লেখা ছড়িয়ে পড়ুক।
লেখাটির জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। পূর্ণাঙ্গভাবে ঘটনাটি তুলে ধরার জন্য আপনাকে অভিবাদন। বাংলাদেশের মিডিয়ার কাছে এরচেয়ে বেশী প্রত্যাশা করি না। সাথে আবুল মনসুর আহমেদের পুরো গল্পটি শেয়ার করার জন্য আবারো ধন্যবাদ।
আর ধর্মের জগদ্দল পাথরের নিচে চাপা পড়ে আছে মানবতা।
আমরা কি এই বাঙলাদেশ চেয়েছিলাম?
বাংলাদেশ বানান ঠিক করে লিখতে শিখুন আগে।
ইংরেজি সাহিত্যের ভাষায় অ্যলিটারেশন বলে একটা টার্ম আছে যার মানে হলো কোন লেখকের লেখা কোন শব্দ বা লেখার অংশবিশেষ হুবহু ব্যবহার করা।
ওটা হুমায়ূন আজাদের বইয়ের নাম। আমার বাংলাদেশের নাম নয়।
প্রথমত, আপনি যেটার কথা বলতে চাইছিলেন সেটাকে এলিউশান বলে, এলিটারেশন না।
অন্য কারো কথা হিসেবে লিখলে (এ ক্ষেত্রে হুমায়ুন আজাদ) কোট চিহ্ন আশা করেছিলাম। যাই হোক, এ নিয়ে সচলে অতীতে বিতর্ক হয়েছে, কিছু মানুষ সচেতনভাবেই ঐ বানান ব্যবহার করে বলে। আপনি সেই দলে নেই সেটাই আনন্দের কথা।
An allusion is a figure of speech that makes a reference to, or representation of, people, places, events, literary work, myths, or works of art, either directly or by implication. ধন্যবাদ।
আমি নিজেই ইংরেজি সাহিত্যর ছাত্র ছিলাম। কিন্তু আপনার মন্তব্য পড়ে দ্রুত মতামত জানাতে গিয়ে টার্মটা গুলিয়ে ফেলেছিলাম। লক্ষ্য করুন, নিজের নামে লগ ইন পর্যন্ত করি নি।
দয়া করে বিভ্রান্তি ছড়াবেন না। বাংলাদেশ বানান আমরা ঠিক করেই লিখতে পারি। আপনি ভুল দেখলে আপনার কম্পউটারের সফটওয়্যার চেক করুন।
নিলয় নন্দীতো নিজেই স্বীকার গেলেন উনি ভিন্ন বানানে বাংলাদেশ বানান লিখেছেন! আপনি ভুল জায়গায় নাক ঢুকিয়েছেন।
সঞ্জয় মজুমদার, রীতিমতো হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম।
হুমায়ূন আজাদ কোন দেবতা নন যে তাঁর সব বক্তব্য মুখস্থ রাখতে হবে।
কিন্তু এত দ্রুত সব ভুলে গেলে চলবে কীভাবে? আপনার সফটয়্যার ভিন্ন কিছু বলছে কি না দেখুন তো?
এখানে
কিংবা
এখানে
আমি নিলয় নন্দী এবং সাফি দু’জনের কাছেই দুঃখ প্রকাশ করছি। আমার একটা বোঝার ভুলের কারনে মন্তব্যটা এখানে দিয়েছিলাম।
ওকে ব্রাদার। ভুল করাটা মানুষের লক্ষণ। ভুল স্বীকার করতে পারাটা বড় মানুষের লক্ষণ।
বরং আমরাই একটা জরুরী আলোচনার মধ্যে ঢুকে অন্য পথে প্রবাহিত হয়ে গেছি।
জানা ছিলো না।
এ ধরনের যে কোন ঘটনাই ছড়িয়ে পড়ুক সবার মাঝে। বিবেক বুদ্ধি গুলো কিছু হলেও কাজ করতে শুরু করবে।
হতাশ লাগে_____ ক্লান্তির মৌনতা।
ফেসবুকেই এই ব্যাপারে যা অল্প কিছু আলোচনা দেখেছিলাম, অন্য সব মিডিয়া আশ্চর্য নীরব ছিল। দেশের বেশিরভাগ মানূষ কী জানবে বা না জানবে তা আজো নির্ধারণ করে অল্প কিছু লোক।
_________________
[খোমাখাতা]
পোস্টটির জন্য ধন্যবাদ দাদা।
এ সহ্য করা বড় কঠিন। এইসব বালের ধর্মানুভূতির কারণে সংখ্যালঘু নির্যাতন দেখলে মনে হয় দেশে প্রকাশ্যে ধর্মপালন, ধর্মচর্চা, ধর্মালোচনা, ধর্মানুভূতি প্রকাশ নিষিদ্ধ করে দেওয়া উচিৎ!!!
_____________________
Give Her Freedom!
বাঙালির ধর্মানুভূতি ও শিশ্ন দুটোই অতি সংবেদনশীল।
উফফ!! ভয়ংকর!! জানোয়ারের অধম সেই মানুষগুলো। ভিডিওটা ছড়িয়ে দেয়া দরকার সবখানে।
এরকম ঘটনাগুলো মিডিয়া আড়াল করার পেছনে সরকারী কোন নিষেধাজ্ঞা আছে কিনা। সরকার ভাবমুর্তি নষ্ট হবার ভয়ে অনেক ঘটনা চেপে রাখার চেষ্টা করে। এটাও কি তার অংশ?
এটু একটু ভুল বললেন বোধহয়। আবুল মনসুর আহমদ প্রতিক্রিয়াশীল পন্থার সমর্থক ছিলেন এটা আপনার কাছ থেকেই প্রথম শুনলাম। বরং বর্তমান আওয়ামীলীগ থেকে অনেক বেশী প্রগতিশীল চেতনার লোক ছিলেন তিনি। হয়তো জানেন তিনি আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম একজন।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
ভয় হচ্ছে দিনদিন কী এসব ঘটনা কী কেবল বাড়তেই থাকবে? প্রতিকার কই?
------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
১। পোস্টের জন্য কৃতজ্ঞতা। স্বাধীন ব্লগের শক্তিটা এখানেই। সে কারো ধার না ধরে সত্যটা প্রকাশ করে।
২। আপনি ঘটনাবলীর যে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন তার তথ্যসূত্রগুলো উল্লেখ করে দিন। নয়তো এর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলে ঘটনাটিকে ভিন্ন খাতে নিয়ে যাবার অপচেষ্টা চালাবে।
৩। যেসব সুশীলেরা নিজেদের পেয়ারের সরকার বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে পারে এমন বিবেচনায় সংখ্যালঘু নির্যাতনের মতো ঘটনায় নিশ্চুপ থাকে, নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর উচিত তাদেরকে সর্ব কালে বর্জন করা।
৪। রাষ্ট্রের ক্ষমতায় যে দলই থাকুক, তাদের শ্রেণীচরিত্র অভিন্ন হলে সব আমলেই এমন জঘন্য ঘটনা ঘটতে থাকবে।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
ঘ্যাঁচাঙ
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
প্রতিবাদ হচ্ছে , কে বলেছে প্রতিবাদ কেও করছে না। কিন্তু কিসের প্রতিবাদ ???????? প্রেস ক্লাবের সামনের মানব বন্ধনের কিছু ছবি দেখুন...http://www.somewhereinblog.net/blog/chintakori/29575923
যতই আমার দেশ নিয়ে গর্ব করি না কেন, প্রতি মূহুর্তে কেও না কেও মনে করিয়ে দেয় , তুই শালা মালাওনের বাচ্চা .........
সেটাতেও দুঃখ পাই না , কিন্তু বড় অসহায় লাগে তথাকথিত বুদ্ধি(পর)জীবি, চোখ খুলে দেয়ার ঠিকাদার পত্রিকা ,এবং হাল আমলের সবথেকে সচেতন ফেসবুক বন্ধুরা যারা কিনা প্রতিদিন সকল সমস্যার মুন্ডুপাত করে একটি মূল্যবান স্টাটাস দিয়ে থাকেন, তাদের এই বিষয়ে আশ্চর্য রকম নিরবতা দেখে , এবং চুপি চুপি সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়ান পোস্টে লাইক দেখে।
তারপর ও কেন জানি বলে উঠি , অনেক ভাল আছি আমি আমার এই দেশে......
একটা ক্ষোভ জমা হচ্ছিল সচলের উপর কেন এই বিষয় নিয়ে কেও কোন কথা বলছে না??? ধন্যবাদ কুলদা রায়কে ......
আপনার লিংক থেকে ছবি দেখে মজা লাগল। অন্যতম অংশগ্রহণকারী আওয়ামী উলেমা লিগ।
...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'
বাংলাদেশ আওয়ামী উলামা লীগ! চমৎকার! কে যেনো বলেছিলেন, হাসিনা আমিনীর চে উলামা লীগরেই বেশি ডরায়। একারণেই রাষ্ট্রধর্ম। একারণেই ধর্মানুভূতির পক্ষে হাইকোর্টের রায়। নবিজির লানত পরুক এদের উপর!
খুবই দুঃখজনক ঘটনা। এটা কোন মেইনস্ট্রিম মিডিয়ায় চোখে পড়েনি। যে জিনিসটা লক্ষ্যনীয় তা হলো লুটপাটের গন্ধই পেয়ে
অল্প সময়ে কয়েক হাজার কিশোর যুবক জড়ো হওয়া। এটাই এখনকার বাস্তব অবস্হা। সবাই খালি অন্যের গলা কেটে উপরে উঠতে চায়।
হামলাকারীদের বয়স ১৬ থেকে ২৫ এর মধ্যে। এ থেকেই বিপদ সম্পর্কে টের পাওয়া যায়। বাংলাদেশের মানুষ ক্রমশ ধর্মান্ধ হয়ে উঠছে। আজ থেকে ১০ বছর আগেও যে পরিবারটিকে দেখেছি গান-বাজনা-বাংলা সংস্কৃতিকে বরণ করে নিতে, আজ তাদেরকেই দেখছি রাজাকারদের ভাষায় কথা বলতে; তারা এমনকি অনুতাপও করে কেন তারা আগে বিপথ (মানে অনৈসলামিক পথে) ছিল। অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে মানুষের এই ক্রমবর্ধমান সাম্প্রদায়িক মনোভাব আজকের বাংলাদেশের জন্য একটা বড় হুমকি। যেটা অনেকেরই চোখে পড়ছে না। ধর্মনিরেপেক্ষ বলে কথিত দলগুলোর আপোষকামিতা ও ক্ষমতালিপ্সা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের আন্দোলনকে ভয়ানক ক্ষতিগ্রস্ত করেছে বলে আমার ধারণা।
এমন একটি লেখা খুব দরকার ছিল। লেখাটা ছড়িয়ে দেয়া দরকার। কৃতজ্ঞতা লেখককে।
ফেসবুকে পড়লাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কজন শিক্ষক সাতক্ষীরার ঘটনা নিয়ে একটি আর্টিকেল লিখেছেন। লেখাটি তাঁরা বহুল প্রচারিত পত্রিকায় প্রকাশের জন্য দিয়েছেন। কিন্তু পত্রিকাটির সম্পাদক লেখাটি ছাপতে গড়িমসি করছেন। ঘটনার সত্যতার যাচাইয়ের প্রয়োজন অনুভব করেছেন। অবশেষে ভিডিওটি দেখার পরে সম্পাদক সাহেব জানিয়ে কিছু সত্যতা থাকায় তারা আর্টিকেলটি প্রকাশ করবেন বলে তাঁদের জানিয়েছেন। ঘটনাগুলো ঘটছে ২৭ মার্চ থেকে। আর এখনও এই বদলে যাওদের বদলে দাওদের ঘটনাটি যাচাইয়ের দরকার পড়ছে। কী ভয়াবহ অবস্থা!
...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'
Who ever have done such things, they didn't do it because they are religious and hurt by any word in that drama. They are simply criminals. And trust me, if there were 50 criminals involved on that violence, there were 500 at least who were watching that violence, didn't like it, but said nothing. It could be any Muslim's house, and still people wouldn't say a word there. And about police... we all know them well. Sure they got their percentage from those robbers.
দেশটা মনে হয় দিন দিন প্রতিক্রিয়াশীল লোকদের দখলে চলে যাচ্ছে।
/----------------------------------------------------
ওইখানে আমিও আছি, যেইখানে সূর্য উদয়
প্রিয়দেশ, পাল্টে দেবো, তুমি আর আমি বোধহয়
কমরেড, তৈরি থেকো,গায়ে মাখো আলতা বরণ
আমি তুমি, আমি তুমি, এভাবেই লক্ষ চরণ।।
প্রতিক্রিয়াশীলদের বিশেষ অনুভূতি অকারণে আঘাত প্রাপ্ত হয় কেন?
সবকিছু নষ্টদের দখলে চলে যাচ্ছে।
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
আবুল মনসুর আহমদের সুযোগ্য পুত্র মাহফুজ আনাম এই নিয়ে কিছু বলে নাই? তার বাবার নাটকের কারণে কিছু লোক মার খেলো, সে চুপ কেনু কেনু কেনু?
নতুন মন্তব্য করুন