রবীন্দ্রনাথের জমিদারগিরি এবং জমিদারের রবীন্দ্রগিরি : পঞ্চত্রিংশ পর্ব

কুলদা রায় এর ছবি
লিখেছেন কুলদা রায় [অতিথি] (তারিখ: শনি, ২১/০৪/২০১২ - ৯:৪৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কুলদা রায়
এমএমআর জালাল

মুসলমান খণ্ড—৭

কবি আবদুল কাদিরের দিলরুবা কাব্যগ্রন্থখানি ১৯৩৩ সালে কোলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়। কবি রবীন্দ্রনাথ বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ পেয়ে আবদুল কাদিরকে জানান তিনি বইখানি পেয়ে খুব খুশী হয়েছেন। ভাষা ও ছন্দে আবদুল কাদিরের প্রভাব অপ্রতিহত। এবং কবি তাঁর প্রশংসা করে লেখেন, বাংলার কবি সভায় তোমার আসনের অধিকাংশ অসংশয়িত।

তারপর কবি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেন—বিষয় অনুসারে যে কবিতায় তুমি মাঝে আরবী পারসী শব্দ ব্যবহার করেছ আমার কানে তা অসঙ্গত বোধ হয়নি। রবীন্দ্রনাথ আবদুল কাদিরের কবিতার উপর শুধু চোখ বোলাননি। জহুরীর মত খুটে খুটে দেখেছেন তার ভাব, ভাষা, ছন্দ ও শব্দ। ফলে ঐ চিঠিটি সংক্ষিপ্ত হলেও কবি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চোখা মন্তব্য করেছেন খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দিনের মুসলিম বীরাঙ্গনা বইটি সম্পর্কে। লিখেছেন, উদ্দীপনার বেগে মুসলিম বীরাঙ্গনার ভাষাসংযম রক্ষা হয়নি, বলবৃদ্ধির চেষ্টায় তার বলহানী করা হয়েছে। চিঠিটি লেখা হয়েছিল আবদুল কাদিরকে ১৯৩৮ সালে।

আবদুল কাদিরের চিঠিটি পড়েছিলেন খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দিন। রবীন্দ্রনাথের সমালোচনা পড়ে তিনি কবির সঙ্গে মুসলিম বীরাঙ্গনা কাব্যের অন্যান্য দিক বিষয়ে কবির কাছ থেকে শোনার জন্য আলাপের আগ্রহ বোধ করেন। খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দিনকে ১৯৩৮ সালের ১৫ জানুয়ারি কবি চিঠিতে লেখেন, মুসলিম বীরাঙ্গনার আরবী পারসী শব্দ ব্যবহার নিয়ে কোনো আপত্তি করিনে। আমার বক্তব্য এই যে, ঐতিহাসিক যে সকল ঘটনার মধ্যেই স্বতঃই বীরত্বের প্রকাশ আছে তাদের বিবরণ যত সহজ হয় ততই তাদের নিজের দিপ্তি সুস্পষ্ট থাকে, লেখক যদি ব্যগ্র হয়ে কলমের উত্তেজনা প্রয়োগ করেন তাহলে ইতিহাসের স্বাভাবিক শক্তির উপর হস্তক্ষেপ করা হয়—পাঠকের চিত্ত যে অসাড় নয় একথা ধরে নেওয়া ভালো।

এইটুকু লেখার পরে রবীন্দ্রনাথ চিঠিটিতে তারিখ বসিয়েছেন। চিঠিটি এখানেই শেষ হতে পারত। তিনি শেষ না করে আরেকটি বাক্য যুক্ত করেছেন তারিখের পরে—বইখানি (মুসলিম বীরাঙ্গনা) সাধারণের পাঠোপযোগী তাতে সন্দেহ নাই। অর্থাৎ বইটির বিষয়বস্তুকে তিনি প্রশংসা করেছেন। কিন্তু বইটির শব্দ ব্যবহার নিয়ে কিছু অনুযোগ করেছেন।

মুসলিম বীরাঙ্গনার বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের সমালোচনার ভিত্তি তিনটি—
১. ঐতিহাসিক ঘটনা অবলম্বনে সাহিত্য রচনার বিবরণ সহজ হওয়া দরকার।
২. লেখকদের আবেগ প্রকাশ করা ভালো কথা নয়।
৩. পাঠককে চিন্তা করার স্বাধীনতা দিতে হবে। প্রতিটি চিন্তাই সৃজনশীল বলেই বহুরেখিক। এই বহুরৈখিকতাকে লেখক সম্মান না করলে তার বিষয় ক্লিশে হয়ে পড়ে।

আবুল ফজলের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের হয়েছিল ঢাকায় ১৯২৬ সালে। ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয়ের আমন্ত্রণে সেখানে গিয়েছিলেন ৩১ আগস্ট। ১৯৪০ সালে আবুল ফজল তাঁর লেখা চৌচির ও বিচিত্র কথা বই দুটি পাঠিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথকে গল্পকার আবুল ফজল লিখেছিলেন—
‘গল্পগ্রন্থ দুটিতে বঙ্গের পূর্ব সীমান্তবাসী মুসলমান সমাজ ও পরিবার-জীবনের কিছু কিছু ছবি আঁকবার চেষ্টা করা হয়েছে। ফলে তাদেরও মুখের ও জীবনের সাহিত্যে এখনো অপ্রচলিত বহু শব্দ ও প্রকাশ ভঙ্গিমা বাদ দেওয়া সম্ভব হয়নি এবং আমার বিবেচনায় মুসলমান সমাজের ছবি আঁকতে গেলেই এ রকম বহু অপ্রচলিত শব্দ বাংলা ভাষাকে হজম করতেই হবে।

মুসলমান নায়িকা মুসলমান নায়ককে দস্তরখানা বিছিয়ে নাস্তা পরিবেশন করছে, বহু ভেবেও এরকম বাক্যকে বিশুদ্ধ বাংলায় পরিবর্তিত করতে পারিনি। দস্তরখানার কোনো বাংলা প্রতিশব্দ আমি খঁজে পাইনি, তৈয়ার করে নিতেও পারিনি। অথচ দস্তরখানা মুসলমান পরিবারে রোজ দুবেলাই ব্যবহার করা হয়। নাস্তার প্রতিশব্দ জোর করে হয়ত ‘জলখাবার’ করা যায়, কিন্তু তা করলে মুসলমানের কানে তা শব্দের শুদ্ধিকরণের মতই শোনাবে। আর নিশ্চিত মুসলমান জীবনেও শব্দের ব্যবহার না হয়ে পোষাকী হয়েই থাকে।

হাসান সোহরাওয়ার্দীর বাড়ির জেয়াফতে আমার দাওয়াত আছে, এর পরিবর্তে কোন মুসলমান হাসান সোহরাওয়ার্দীর বাড়ির ভোজে আমার নিমন্ত্রণ আছে বলে না, বল্লে অনুবাদের মত শোনাবে।‘

আবুল ফজল চিঠির শেষ দিকে বলেছিলেন, যে জীবনকে অবলম্বন করে সাহিত্য রূপ নেবে, সে জীবনের পরিবেষ্টনকে বাদ দিয়ে সে সাহিত্যের অন্য কোনো স্বধর্ম আশা করা যায় কিনা ভাববার বিষয়। ব্যাকরণ ও অভিধান ঘেটেই সম্ভবত সে স্বধর্ম খুঁজে বের করতে হবে।

চিঠিতে সর্বশেষে তার রচনায় মুসলমান সমাজে প্রচলিত আরবি-ফারসি শব্দের সাহিত্যে ব্যবহার সম্পর্কে কবির অভিমত জানতে চেয়েছিলেন। সে সময় রবীন্দ্রনাথ চোখে কম দেখেন। পড়তে কষ্ট হয়। ডাক্তার চোখকে বিশ্রাম দিতে বলেছেন।

আবুল ফজলকে এর দিন ছয়েক পরে ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৪০ বেশ বড়ো সড়ো একটা জবাব পাঠান। শুরুতেই কবি জানাচ্ছেন, ভাষা ব্যবহার সম্বন্ধে আপনি ঠিকই বলছেন। আচারের পার্থক্য ও মনস্তত্ত্বের বিশেষত্ব অনুবর্তন না করলে ভাষার সার্থকতাই থাকে না, তথাপি ভাষার নমনীয়তার একটা সীমা আছে। ভাষার যেটা মূল স্বভাব তার অত্যন্ত প্রতিকূল করলে ভাব প্রকাশের বাহনকে অকর্মন্য করে ফেলা হয়। প্রয়োজনের তাগিদে ভাষা বহুকাল থেকে বিস্তর নতুন কথা আমদানী করে এসেছে। বাংলাভাষায় পারসী আরবি শব্দের সংখ্যা কম নয় কিন্তু তারা সহজেই স্থান পেয়েছে। ভাষার মূল প্রকৃতির মধ্যে একটি বিধান আছে যার দ্বারা নতুন শব্দের যাচাই হতে থাকে।

ধরা যাক খুন শব্দটি। এটা হত্যা বা কিলিং অর্থে আমাদের ভাষায় পরিচিত এবং বহুল ব্যবহৃত। এই শব্দটি থেকে খুনোখুনি, খুন খারাবি বা খুন জখমও হয়েছে। কাজী নজরুল ইসলাম মোহররম কবিতায় লিখেছেন--
নীল সিয়া আসমান, লালে লাল দুনিয়া,-
“আম্মা ! লা’ল তেরি খুন কিয়া খুনিয়া !”
কাঁদে কোন্ ক্রন্দসী কারবালা ফোরাতে,
সে কাঁদনে আঁসু আনে সীমারেরও ছোরাতে !

এ কবিতায় খুন শব্দটি রক্ত অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু খুন শব্দটি এখানে রক্ত অর্থে ব্যবহার করায় অর্থের সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এক্ষেত্রে খুনের বদলে রক্ত অর্থে প্রচলিত কোনো শব্দ বসালেই যুক্তিযুক্তি হত।

এর পরেই রবীন্দ্রনাথ খুনের মামলাটি করে বসেন। তিনি লিখেছেন—‘খুন খারাবি’ শব্দ ভাষা সহজে মেনে নিয়েছে। আমরা তাকে যদি না মানি তবে তাকে বলব গোঁড়ামী, কিন্তু রক্ত অর্থে খুন শব্দকে ভাষা স্বীকার করেনি। কোনো বিশেষ পরিবারে বা সম্প্রদায়ে ওই অর্থই অভ্যস্ত হতে পারে তবু সাধারণ বাংলা ভাষায় ওই অর্থ চালাতে গেলে ভাষা বিমুখ হবে।

এ সময় কোনো কোনো মুসলিম লেখক বা পত্রিকাগোষ্ঠীর বাংলার শব্দের সঙ্গে অকাতরে এবং অসাহিত্যজনোজিতভাবে আরবী-ফারসি শব্দের বহুল ব্যবহার দেখা দেয়। এমন কি তাদের মাতৃভাষা কী হবে এ সংশয়ও গ্রাস করে। এ বিষয়গুলো নিয়ে আলতাফ চৌধুরীকে রবীন্দ্রনাথ লেখেন, আজকাল সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিকে আশ্রয় করে ভাষা ও সাহিত্যকে বিকৃত করবার যে চেষ্টা করছে তার মতো বর্বরতা আর হতে পারে না। এ যেন ভাইয়ের উপর রাগ করে পারিবারিক বাস্তুঘরে আগুন লাগানো। সমাজের ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে বিরুদ্ধতা অন্যান্য দেশের ইতিহাসে দেখেছি কিন্তু আজ পর্যন্ত নিজের দেশভাষাকে পীড়িত করবার চেষ্টা কোনো সভ্য দেশে দেখা যায়নি।

রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশের মুসলমানদের বাঙ্গালি বলে মনে করেন বলেই এই অনুযোগটি করেছিলেন। তিনি লিখেছেন, বাংলাদেশের মুসলমানকে যদি বাঙ্গালি বলে গণ্য না করতুম তাহলে সাহিত্যিক এই অদ্ভুত কদাচার সম্বন্ধে তাদের কঠিন নিন্দা ঘোষণা না করে সান্ত্বনা পেতুম।

শব্দের কোনো ধর্ম হয় না। ধর্মেরও কোনো শব্দ হয় না। শব্দ জীবনাচরণের সঙ্গে গড়ে ওঠে, ব্যবহৃত হয়—শব্দ বেঁচে থাকে, রূপান্তরিত হয় এবং কখনো কখনো শব্দ মরেও যায়। আবার মৃত শব্দেরা পূনর্জীবিতও হয়। ধরা যাক পিতা শব্দটি। যাত্রাপালায় এখনো ব্যবহৃত হলেও হতে পারে। কিন্তু শব্দটি এখন বাহ্যত আমাদের জীবন থেকে দুরে চলে যাচ্ছে। শব্দটি সংস্কৃত। তবুও কোনো হিন্দুও বর্তমানে পিতা শব্দটিকে সচরাচর ব্যবহার করে না। বাবা শব্দটি সকল বাঙ্গালি ব্যবহার করেন। বাবা শব্দটি আরবী।

মার্কিন দেশে দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে স্প্যানিস প্রচলিত। স্প্যানিস ভাষায় বাবা শব্দ হল পাপী। কিন্তু বাংলায় বাবা শব্দের সমার্থক শব্দ হিসাবে পাপী শব্দটি অপরিচিত। যারা স্পেন দেশে থাকেন বা স্প্যানিস ভাষা জানেন তারা হয়তোবা পাপী বলে মাঝে সাজে সম্বোধন করে থাকেন। বাংলায় পাপী শব্দটির অর্থ যে পাপ করেছে বা ইংরেজিতে সিনার। বাংলা ভাষায় পাপী শব্দটা ব্যবহার করলে শব্দটি পাঠকদের কাছে অনর্থ হয়ে উঠবে। কেউ-ই পাপী হতে চাইবে না। প্রবল আপত্তি করে বসবে। সেক্ষেত্রে ইংরেজী ফাদার শব্দটি বাংলায় এত বেশী পরিচিত যে ফাদার বললে বা লিখলে কেউ আপত্তি করবে না।

সাধারণ লোকের ধারণা বাবু শব্দটি সংস্কৃত শব্দ—সংস্কৃত শব্দ থেকে উঠে এসেছে। বাবু শব্দটি হিন্দুদের নামের আগে দেওয়া না হলে অসম্মানজনক মনে হত। মনে করা হয় বাবু শব্দটি হিন্দু ভদ্রলোক বোঝাতেই ব্যবহৃত হয়। আবার মুসলমানদের সাহেব বলাই চল। বিশিষ্ট সাহিত্যিক আবুল বাশার জানাচ্ছেন-- বাবু শব্দটা ফার্সি। সাহেব শব্দটাও ফার্সি। সুতরাং বাবু শব্দটাতে হিন্দুত্ব খোঁজার কোনো মানেই হয় না। যদি সেটা করা হয় সেটা সাম্প্রদায়িকতা হবে। বাবু শব্দের বুৎপত্তিগত অর্থ হল ‘বু’ মানে গন্ধ এবং ‘বা’ মানে সহিত বা সাথে। অর্থাৎ গন্ধের সহিত অর্থাৎ যে গন্ধ মাখে, সে-ই হচ্ছে ‘বাবু।. সেজন্য কলকাতার বাবু মানে হল সুগন্ধিত হয়ে যে রাস্তায় বেরোয় তার থেকে বাবু, বাবু-সম্প্রদায়। বাবু সম্প্রদায় কলকাতায় জন্মেছিল—তারা জমিদার বা উচ্চবিত্ত। জমিদারদের ভেতর থেকেই তথাকথিত অভিজাত হিন্দু জমিদারদের বাবু বলা হত। পানি শব্দটা আরবী নয়। এটা প্রাকৃত হিন্দি। পানীয় শব্দটা সংস্কৃত। পানীয় থেকে পানি হয়েছে। কিন্তু হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সবাই জলকে পানি বলছে। আবার বাংলাদেশের এক সময় সবাই জলই বলত। এখন হিন্দু-মুসলমান সবাই জলকে পানি-ই বলতে অভ্যস্থ হয়ে উঠেছে। কিন্তু পশ্চিম বঙ্গে হিন্দুরা জলকে পানি বলে পান করবে না। আঙ্কেল শব্দের বাংলা কাকা শব্দটিও সংস্কৃত নয়। চাচা শব্দটির মতই কাকা শব্দটিও বিদেশী।

রবীন্দ্রনাথের বিদায় অভিশাপ কবিতাটি বহুল পঠিত। হিন্দু পুরাণ থেকে বিদায় অভিশাপের কাহিনীটি তিনি গ্রহণ করেছিলেন। তিনি বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করেছিলেন বিদায় শব্দটি আদৌ সংস্কৃত জাত নয়—একটা আরবী শব্দ। রবীন্দ্রনাথ হিন্দু পুরাণের গল্প নিয়ে কাহিনী-কবিতা লিখেছের আরবী শব্দ ব্যবহার করে। একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি—লতা মুঙ্গেস্করের গাওয়া এই গানটি বাংলার সকল মানুষের প্রিয় গান। এই গানের মা শব্দটির মধ্যে যারা সংস্কৃত বা ব্রাহ্মণ্যত্ব খোঁজেন তারা বিদায় শব্দের বেলায় কি করবেন? বাতিল করে দেবেন? আফ্রিকান এবং স্প্যানিস ভাষাতেও মা মানে স্নেহময়ী জননী।

উলু শব্দটি বিষয়ে বঙ্গীয় শব্দার্থকোষে কলিম খান লিখেছেন—বিবাহাদি উৎসবে স্ত্রীলোকের করণীয় মঙ্গলধ্বনিবেশেষ। নিজেদের কোনো সাফল্য প্রকাশ করার জন্য যে ধ্বনি করা হয়, সেটি উলুধ্বনি নাম পেয়েছে। হিন্দু নারীরাই শুধু উলুধ্বনি দেয় না, বিভিন্ন উৎসবে আনন্দে বিয়ে সাদিতে আরবের নারীরাও উলুধ্বনি দেয়। কোনো দেশের খ্রিষ্টানরাও দেয়। হিব্রু ভাষায় হালেলুইয়া নামে একটি শব্দ আছে। ঈশ্বরের উদ্দশ্যে সমবেত ইহুদিরা জয়ধ্বনি করে এই হালেলুইয়া শব্দের মাধ্যমে। কলিম খান মনে করেন এই হালেলুইয়া উলু ধ্বনির জ্ঞাতি।

বই শব্দটি এসেছে আরবী অহি শব্দ থেকে অর্থাৎ বই শব্দটি আল্লার চিন্তার সঙ্গে সম্পর্কিত। অহি হচ্ছে ঈশ্বর বা আল্লার প্রত্যাদেশ। ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ অহি পেতেন। এই অহি শব্দ থেকেই বহি—বহি থেকে বই শব্দটি এসেছে। বই শব্দটি সম্পূর্ণভাবে ধর্মনিরপেক্ষ একটি শব্দ। কিন্তু এক সময় বইকে হিন্দু শব্দ বলে বাতিল করে মুসলমানী শব্দ হিসেবে কিতাব শব্দকে প্রচলন করা হয়েছিল। তৃতীয় বড় বোনকে বা দিদিকে সেজ দিদি বা সেজদি বলা হয়। সেজ দিদির মধ্যে আছে সেহ্ । সেহ্ শব্দটি ফার্সি। সেহ্ শব্দটির অর্থ তিন। যেমন সেতার—তিন তারের সমাহার। ফার্সি সেহ্ এর সঙ্গে সংস্কৃত-ধাতু ‘জ’ যুক্ত হয়ে সেজ শব্দটি তৈরি হয়েছে। অফিস-আদালত-জমি-জিরাত ফার্সি শব্দ। বাংলায় হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে ব্যবহার করেন। এগুলো এখন বাংলা শব্দ-ই। আবার কেদারা শব্দটি চেয়ার অর্থে বাংলায় টেকেনি। চেয়ার শব্দটিই চলেছে। জরকাঠি শব্দটির জন্মমাত্রেই মৃত্যু ঘটেছে। জরকাঠি দিয়ে নয়--থার্মোমিটার দিয়েই বাঙ্গালিদের জ্বর দেখা হয়।

আবার তৎসম শব্দ নির্বান, যোগ, প্রাণায়াম—ইংরেজীতে দিব্যি নির্বানা, ইয়োগা এবং প্রাণায়ামা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এমন কি ‘বাৎসায়নের কামসূত্র’টি কামসূত্র নামেই মার্কিন দেশে লেখা হয়। মেডিটেশন শব্দটির সঙ্গে ধ্যান শব্দটি জায়গা করে নিচ্ছে। এই সব সংস্কৃতজাত বাংলা শব্দগুলি ইংরেজীতে ধীরে ধীরে মিশে গেছে। কেউ আপত্তি করছে না। হালাল বা হারাম শব্দটির সঙ্গে মার্কিনীরা পরিচিত। রেস্তোরাতে বড় বড় করে লেখা হয়—হালাল ফুড। কেউ মুসলিমদের মুখের শব্দ বলে হেলা করে না। এখন হালাম বা হারাম শব্দদ্বয় বাংলা ভাষারই অন্তর্গত। কিন্তু উর্দু শব্দ ‘সাজিস’ ষড়যন্ত্র শব্দ হিসেবে অপরিচিত। সুতরাং সাজিস শব্দটি কেউ ব্যবহার করতে চাইলে ব্রাকেটে ষড়যন্ত্র অর্থটি বলে দেওয়া ছাড়া তার উপায় নেই। রবীন্দ্রনাথ এইখানেই আপত্তি করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন—যে শব্দ সাধারণ্যে ব্যবহৃত বা প্রচলিত সে শব্দ ব্যবহারে বাংলা ভাষা বা সাহিত্যের লাভই হবে। এ কারণে তিনি আহ্বান করেছিলেন মুসলমান সাহিত্যিকদের লেখালেখিতে আসতে। তারা লিখলে তাদের ঘরে ব্যবহৃত শব্দ সাহিত্যের ভাষাকে সমৃদ্ধ করবে। ভাষাগত অসাম্যতা দূর হবে। হিন্দু-মুসলমানদের সম্প্রদায়গত বিভেদও কমে আসবে— তাদের মিলনের পথ দেখাবে।

তিনি আবুল ফজলকে চিঠিতে বলেছেন, আধুনিক মুসলমান সমাজের সমস্যা অই সমাজের অন্তরের দিক থেকে জানতে হলে সাহিত্যের পথ দিয়েই জানতে হবে—এই প্রয়োজন আমি বিশেষ করেই অনুভব করি।... চাঁদের এক পৃষ্ঠায় আলো পড়ে না, সে আমাদের অগোচর, তেমনি দুর্দৈবক্রমে বাংলাদেশের আধখানায় সাহিত্যের আলো যদি না পড়ে তাহলে আমরা বাংলাদেশকে চিনতে পারব না, না পারলে তার সঙ্গে ভুল ঘটতে থাকবে।

এই বিশ্বাস থেকেই তিনি ভাষা বা সাহিত্যে সম্প্রদায়গত ভেদরেখায় বিশ্বাস করতেন না। তাঁর দুরাশা গল্পটি এক মুসলমান রমনীকে নিয়ে লিখতে গিয়ে তিনি উর্দু জবানী ব্যবহার করেছেন। এই রমনীটি বদ্রাওনের নবাব গোলাম কাদের খাঁর মেয়ে। গল্পটি রবীন্দ্রনাথ সাধু ভাষায় লিখেছেন। গল্পে রমনী বলছেন, বাবুজী, এক সময় আমি যে-জেনানায় ছিলাম সেখানে আমার সহোদর ভাইদের প্রবেশ করিতে হইলেও অনুমতি লইতে হইত। আজ বিশ্বসংসারে আমার পর্দা নাই। ...তৎক্ষণাৎ সুগম্ভীর মুখে দীর্ঘ সেলাম করিয়া কহিলাম, বিবিসাহেব, মাপ করো, তোমাকে চিনিতে পারি নাই। রবীন্দ্রনাথ অবলীলায় জেনানর বদলে মহিলামহল, পর্দার বদলে ঘোমটা বা আড়াল, বিবিসাহেবার বদলে বউঠান, মাপ করোর বদলে ক্ষমা করো বসাতে পারতেন। সেটা না করে যে শব্দগুলো ব্যবহার করেছেন—সেগুলো মুসলমান উচ্চবিত্ত পরিবারের নিত্যব্যবহার্য শব্দ। এই শব্দগুলো আমাদের বাঙ্গালী সমাজেও অপরিচিত নয়। ফলে রবীন্দ্রনাথ এ শব্দগুলোকে মুসলমানী শব্দ হিসাবে ব্যবহার করেন নি। মানুষের শব্দ হিসেবেই ব্যবহার করেছেন। একজন মুসলমান নবাব নন্দিনীকে বিশ্বস্তভাবে ফুটিয়ে তুলতে অবিকৃতভাবে শব্দগুলির ব্যবহার সিদ্ধ মনে করেছেন।

ঠিক এই গল্পের অন্যত্রই তিনি সংস্কৃতবহুল শব্দ বহুলভাবে ব্যবহার করেছেন। তিনি লিখেছেন, হিমালয়বক্ষে শিলাতলে একান্তে দুইটি নরনারীর রহস্যালাপকাহিনী সহসা সদ্যসম্পূর্ণ কবোষ্ণ কাব্যকথার মতো শুনিতে হয়, পাঠকের হৃদয়ের মধ্যে দূরাগত নির্জন গিরিকন্দরের নির্ঝরপ্রপাতধ্বনি এবং কালীদাস-রচিত মেঘদূত-কুমার সম্ভবের বিচিত্র সঙ্গীত মর্মর জাগ্রত হইয়া উঠিতে থাকে, তথাপি একথা সকলকেই স্বীকার করিতে হইবে যে, বুট এবং ম্যাকিন্টস পরিয়া ক্যালকাটা রোডের ধারে কর্দমাসনে এক দীনবেশিনী হিন্দুস্থানী রমনীর সহিত একত্র উপবেশনপূর্বক সম্পূর্ণ আত্মগৌরব অক্ষুণ্নভাবে অনুভব করিতে পারে, এমত নব্যবঙ্গ অতি অল্পই আছে।

আমরা ধীরে ধীরে টের পাই রবীন্দ্রনাথের বয়স বাড়ছে আর তিনি তাঁর ভাষার শরীর থেকে সাধুভাষার এই বাহুল্য ছেড়ে যাচ্ছেন। সংস্কৃতশাসিত ভাষাকে মুক্ত করার জন্য এককভাবে লড়াই করে যাচ্ছেন। লড়াইয়ে জয় তাঁরই হচ্ছে। বাঙ্গালীর জীবনের মুখের ভাষাকে সাহিত্যের ভাষা হিসাবে তিনি নির্মাণ করছেন । সে বাঙ্গালী হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান। কোনো ভেদ নেই। পদ্মায় তাঁর নৌকার মাঝি ঝড় এলে আজান দিয়ে উঠেছে। মুসলমান মাঝিটির আল্লা শব্দটি তাঁর কলমে আল্লা শব্দ হিসেবেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাগজের বুকে নেমে এসেছে। একটুকু দ্বিধা আসে নি রবীন্দ্রনাথের মনে। আল্লা সার্বজনীন মানুষেরই শব্দ।


মন্তব্য

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

লেখক যদি ব্যগ্র হয়ে কলমের উত্তেজনা প্রয়োগ করেন তাহলে ইতিহাসের স্বাভাবিক শক্তির উপর হস্তক্ষেপ করা হয়—পাঠকের চিত্ত যে অসাড় নয় একথা ধরে নেওয়া ভালো।

এই লাইনটা সুপার লাগছে।

বাকি প্রসঙ্গ পড়লাম।


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

মন মাঝি এর ছবি

কোনো বিশেষ পরিবারে বা সম্প্রদায়ে ওই অর্থই অভ্যস্ত হতে পারে তবু সাধারণ বাংলা ভাষায় ওই অর্থ চালাতে গেলে ভাষা বিমুখ হবে।

অসাম্প্রদায়িকতার চমৎকার ব্যাখ্যা সত্বেও, এই বাক্যটা থেকে এলিটিজম আর ল্যাঙ্গুএজ-পলিটিক্সের গন্ধ পাওয়া যায় নাকি?

****************************************

কুলদা রায় এর ছবি

রবীন্দ্রনাথ এই সাবধান বাণীটা সেই উচ্চবিত্ত হিন্দু-মুসলমান উভয়ের উদ্দেশ্যেই করেছিলেন। তিনি সংস্কৃত ভাষাবাহুল্যের কবল থেকে বাংলা ভাষাকে রক্ষার কথাও বলেছেন। সুতরাং কোনো অর্থেই এটা সাম্প্রদায়িক হওয়ার কথা নয়।

...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'

অম্লান অভি এর ছবি

অনেক অজানাকে জানা হলো এবং সেই সাথে নিজের না করা কাজটি করলাম 'মন্তব্য'। আগের লেখা গুলো পড়ার আশা রাখলাম এবং আগামীরও।

মরণ রে তুহু মম শ্যাম সমান.....

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।