কুলদা রায়
এমএমআর জালাল
হুমায়ূন আহমেদ দেয়াল নামে একটি উপন্যাস লিখেছেন। উপন্যাসটি ছাপা করবে অন্যপ্রকাশ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। তারা হুমায়ূন আহমেদের বই প্রকাশ করে থাকে। হুমায়ূন আহমেদ এই প্রকাশনা সংস্থার মালিককে সহোদরের মত দেখেন। এই সব প্রকাশকগণ হুমায়ূন আহমেদের পিছনে টাকার বস্তা নিয়ে ছোটেন। তাদেরকে বই লিখে দেন। তাঁর একটি বই পেলে আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া যায়। হুমায়ূন আহমেদ অকুণ্ঠচিত্তে স্বীকারও করেন, তিনি টাকার জন্যই লেখেন। বই আকারে ছাপা হওয়ার আগে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার সাময়িকী পাতায় প্রকাশ করা হয়েছে দেওয়াল উপন্যাসের দুটি চুম্বক পর্ব। প্রিন্ট মিডিয়া এবং অন্তর্জাল মিডিয়ার কল্যাণে ও হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয়তার কারণে এই দুপর্বটি বহু পাঠকের গোচরে এসেছে। একটি রচনা বই আকারে বের হওয়ার আগে দুটি বিশেষ পর্ব প্রকাশ করার ঘটনাটি এদেশে অভূতপূর্ব। বানিজ্যিক মুভি ট্রেলারের সঙ্গে বেশ মিল আছে।
একাত্তরের আগে হুমায়ুন আহমেদ-------------------------------------
হুমায়ূন আহমেদ জ্যোৎস্না ও জননী গল্প উপন্যাসের ভুমিকায় লিখেছেন—মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হয় আমার বয়স তখন তেইশ। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।...গল্প-উপন্যাসে আদর্শ ভালো ছাত্রের কিছু চিত্র আঁকা হয়। আমি ছিলাম সে রকম একজন। ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের অতি উত্তেজনাময় সময়ে অতি উত্তজনামুক্ত এক তরুণ যুবক।...বাইরে যখন ভয়াবহ আন্দোলন চলছে, আমি তখন দরোজা বন্ধ করে গান শুনছি—কেন পান্থ এ চঞ্চলতা?
একাত্তর : পিরোজপুর—স্বরূপকাঠি—শর্ষিণার মুরীদ---------------------------------------------
হুমায়ূন আহমেদের বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদকে একাত্তরে পিরোজপুরে বলেশ্বর নদীর পাড়ে পাকবাহিনী গুলি করে হত্যা করেছিল। সে সময়ে তাঁর আম্মা ছেলেমেয়েকে নিয়ে পিরোজপুর জেলার কলাখালি ইউনিয়নের কলাখালি গ্রামে লুকিয়ে ছিলেন। যারা আশ্রয় দিয়েছিলেন, তারা তাদেরকে রাখতে ভয় পেয়েছিলেন। সেখান থেকে পান্তাডুবি, বেতকা, চাঁদকাঠি পার হয়ে চলে গিয়েছিলেন গুয়ারেখা ইউনিয়নে। সেটা পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলায়। এক সেনাশাসক এরশাদ স্বরূপকাঠি উপজেলার নামটি বদলে দিয়েছেন। বদলি নাম হয়েছে নেছারাবাদ। শর্ষিণার পীর সাহেবের নাম এই নেছারাউদ্দিন। তিনি একাত্তরের ঘাতক বাহিনীর সহযোগী ছিলেন। তার বাড়ির ঘাট, নেছারিয়া মাদ্রাসা ছিল রাজাকার-পাকআর্মিদের ক্যান্টনমেন্ট। শর্ষিণা থেকে ক মাইল পূবে সঙ্গীতকাঠি, মুসলিমপাড়া, মাহমুদকাঠি পার হলেই কুড়িয়ানার পেয়ারাবাগান শুরু। এইখান থেকে পেয়ারাবাগান চলে গেছে ঝালকাঠি পর্যন্ত। এই পেয়ারাবাগানে নারকীয় হত্যাকাণ্ড করেছিল পাকবাহিনী। শর্ষীণার পীরবাহিনী সর্বতোভাবে এই হত্যাকাণ্ডের অন্যতম কাতেল। ঘটনাচক্রে গুয়ারেখার আশ্রয়দাতা হুমায়ূন আহমেদ ও জাফর ইকবালকে তাদের বাড়িতে রাখতে সাহস করেননি। হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন—জীবন বাঁচানোর জন্য শর্ষীণার মাদ্রাসায় ছাত্র হিসেবেও ভর্তি হয়েছেন। তিনি মাথায় করে পাক বাহিনীর ভারী গুলির বাক্স বয়েছেন।
স্বরূপকাঠীর গুয়ারেখার যে এলাকাটিতে হুমায়ূন আহমেদরা আশ্রয় নিয়েছিলেন--সেই গ্রামের পূর্বদিকের গ্রাম বাতটনাতলায় মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকেই মুক্তিবাহিনী গড়ে উঠেছিল। তারা সেখানে এবং স্বরূপকাঠিতে পাকবাহিনী আর তাদের দোসরদের সঙ্গে মরণপণ যুদ্ধ করেছিল। এমন কি স্বরূপকাঠির পেয়ারাবাগান এলাকা আটঘর কুড়িয়ানায় দুর্ধর্ষ নারী মুক্তিযোদ্ধারা বাহিনীও ছিল। সেটা একটা ইতিহাস। এই ইতিহাস নিয়ে তথ্যপূর্ণ বই লিখেছেন কুড়িয়ানার শিক্ষক ও মুক্তিযোদ্ধা ব্রজেন্দ্রনাথ মল্লিক। বইটির নাম রক্তাক্ত রূপসী বাংলা। এই ইতিহাসটিকে একটু বদলে দেওয়ার চেষ্টা দেখা যায় কোনো কোনো চিনাপন্থীর রচনায়। চীনাপন্থীদের অধিকাংশই একাত্তরে পাকবাহিনীকে সমর্থন করেছিল। কিন্তু তাদেরই একটি অংশ সিরাজ সিকদারের পূর্ব বাংলার সর্বহারার পার্টি ঝালকাঠির একটি ছোটো অংশে কিছুদিন যুদ্ধ করেছিল পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে। এমন কি তারা মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করেছিল। পরে সেখান থেকে তারা চলে যায় আরও দক্ষিণে। এইটুকু। দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে যে আওয়ামী মন্ত্রীর বিরুদ্ধে সেই মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের কন্যা রুবাইয়াত হোসেন পরিচালিত সিনেমা মেহেরজানে এইরকম একটি লাইন বলার কোসেস আছে যে পেয়ারাবাগানে চিনাপন্থীরা বিস্তৃত এলাকা জুড়ে তুমুল যুদ্ধ করেছিল। কিন্তু ইতিহাস বলে পেয়ারা বাগান এলাকার মূল মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন শেখ মুজিবের অনুসারী। এটাই ইতিহাস। একাত্তরে একটা সময় পর্যন্ত এই ইতিহাসের কাছেই ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ।
হুমায়ূন আহমেদের বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ পিরোজপুরের ডিএসপি ছিলেন। তিনি সাহিত্য করতেন, সঙ্গীত ভালোবাসতেন, স্বাধীনতার ঘোষণা শুনে উল্লাশ করেছিলেন, তিনি জ্যোৎস্নাপ্রিয় ছিলেন। তাঁকে যখন হত্যা করা হয়, তখন পিরোজপুর শহরে ডিসির বাংলোর পাশে জেলা স্কুলে পাকবাহিনীর ক্যাম্প ছিল। সে সময়ে বালিপাড়ার সাউথখালির দেল্লা রাজাকার বর্তমানে যুদ্ধাপরাধীর দায়ে বিচারাধীন রাজাকার মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী পাকবাহিনীর সহযোগী হিসেবে বেশ সক্রিয় ছিল। পাড়েরহাট বাজার, টগরা, লক্ষ্মীদিয়া, লাহুড়ী এইসব গ্রামে তার নেতৃত্ত্বে নির্মমভাবে বাঙালিদেরকে হত্যা করা হয়েছে। সে সময়ে ভাগিরথী নামে কদমতলা ইউনিয়নের ভোরা গ্রামের এক গ্রাম্যবধুকে মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য সরবারহ করার অপরাধে দিনের আলোতে মোটর সাইকেলের পিছনে দড়ি দিয়ে বেঁধে সারা শহরে ৫ মাইল ঘুরিয়ে টেনে হিচড়ে মেরে ফেলেছিল। ভোরা গ্রামটি হুমায়ূন আহমেদের ভগ্নিপতির বাড়ি চিলা গ্রামের খুব কাছেই। এই ভাগিরথীর কাহিনীটি হুমায়ূনের বইতে নেই। এই পাড়েরহাটের ঘটনা তাঁর জ্যোৎস্না ও জননীর গল্পে উপন্যাসে আসেনি। এই বইটিকে তিনি মনে করেন মুক্তিযুদ্ধের শ্রেষ্ঠ কাজ। লেখক সব কিছু লেখেন না। লিখবেন না। কিন্তু সত্যকে লিখবেন। সত্য কি? সত্য হল ঘটনা। এইসব সত্য একাত্তরে ঘটেছিল।
২.
রাজাকার নানাজানের আদর্শ : নখ থেকে চুল পর্যন্ত ভদ্রলোক--------------------------------------------------
একাত্তরে হুমায়ূন আহমেদ তাঁর বাবাকে হারালেও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন নি। দেশের ভিতরেই থেকেছেন। জীবন বাঁচানোর জন্য এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পালিয়ে বেড়িয়েছেন। তিনি লিখেছেন—নেত্রকোণার বারহাট্টায় তাকে পাকবাহিনী ধরেও ফেলেছিল। কদিন বন্দী রেখে মেরে ফেলার পরওয়ানা দিয়েছিল। পরে তিনি ঢাকার মীরপুরে ছিলেন। এর মধ্যে তাঁর নানাজান রাজাকার হিসেবে নিহত হন।
তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন—
“মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা পাকিস্তানকে সাপোর্ট করেছেন তাদের মধ্যে আমার নানাও একজন, যিনি মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে মারা গেছেন। আমার এই নানার মতো ভদ্রলোক, পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত এত পরিপূর্ণ ভদ্রলোক এই জীবনে দেখিনি। আমার নানা একটি আদর্শ নিয়ে বড় হয়েছেন। একটি পূর্ণ মুসলিম রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখতেন।
হয়তো হুমায়ূনের নানাজান খুব ভালো নানাজান ছিলেন, আয়েশা ফয়েজের স্নেহময় বাবা ছিলেন, হয়তো তাঁর পরিবারের জন্য তিনি আদর্শ ভদ্রলোক ছিলেন। হুমায়ূন আহমেদ আর একটি গুরুত্বপূর্ণ খবর দেন--তার নানাজান সে সময়ে হিন্দুদের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছিলেন। পাঠকদের স্পষ্ট করে দেন—নানাজান এই সাম্প্রদায়িক আচরণের কারণে হিন্দুদের সঙ্গে থাকাটা নিরাপদ মনে করেননি। তিনি আলাদা রাষ্ট্র চেয়েছেন মুসলমানদের জন্য। তিনি আরও উল্লেখ করেন--এই নির্যাতনকারী হিন্দুরা আসলে বর্ণহিন্দু—তারা সে সময়ে কেবল মুসলমানদেরই নির্যাতন করত না, তারা নিম্নবর্ণের হিন্দুদেরও নির্যাতন করত। নিম্নবর্ণের হিন্দুরা কি মুসলমানদের নির্যাতন করত? সে রকম প্রমাণ আজ অব্দি কোথাও পাওয়া যায়নি। আর উচ্চবর্ণের মুসলমান বা আশরাফ শ্রেণীর মুসলমান-- যারা ছিলেন জমিদার বা উচ্চবিত্ত, তারা কেমন ব্যবহার করতেন সে সময়ের নিম্নবর্গের মুসলমান বা নিম্নবর্গের হিন্দুদের সঙ্গে? উচ্চবর্গের মুসলমানের সঙ্গে উচ্চবর্গের হিন্দুদের ব্যবহারটা কেমন ছিল? এই প্রশ্নের জবাব দেননা হুমায়ূন আহমেদ। তাঁর বয়ান থেকে শুধু পাওয়া যায় , নির্যাতিত সম্প্রদায় একটি নয়—দুটো। নির্যাতিত মুসলমান বর্ণহিন্দুদের সঙ্গে বাস করাটা নিরাপদ মনে করেন না, তাদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র দরকার বলে মনে করেন; নির্যাতিত নিম্নবর্ণের হিন্দুদের জন্য তেমন কোনো ভাবনা নানাজানের মাথায় নেই। তাদের জন্য আলাদা রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তাটার কথাটা বলছেন না। নিম্নবর্ণের হিন্দুরা তাহলে কোথায় যাবে? দু সম্প্রদায়ই যদি সমভাবে নির্যাতিত হয়েই থাকে তাহলে দু সম্প্রদায়ের জন্যই একত্রে আলাদা রাষ্ট্রের দরকার। সে রাষ্ট্রে শুধুমাত্র একটি সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাওয়াটা পা থেকে নখ পর্যন্ত ভদ্রলোকের চিন্তার পক্ষ কি সুস্থতা?
এ ধরনের প্রশ্নবিদ্ধ ভদ্রলোকীয় সুস্থতাই হুমায়ূনের নানাজানের আদর্শ। এই আদর্শের জন্যই তিনি পাকিস্তান রাষ্ট্রটি চেয়েছেন। চেয়েছেন-- কেবলমাত্র সেই পাকিস্তান রাষ্ট্র বর্ণহিন্দুকর্তৃক নির্যাতিত মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষা করবে। অনেক যুদ্ধ করে সেই আকাঙ্খিত পাকিস্তান রাষ্ট্রটিকেও তাঁরা পেয়েছেন। এই পাকিস্তান রাষ্ট্রটিকে টিকিয়ে রাখার দায়ও তাদের রয়েছে তার ভুলত্রুটিসমেত—তাঁর বাঙালি শোষণনির্যাতনসমেত। এই আদর্শের কারণেই নানাজান মুক্তিযুদ্ধকে হিন্দুরাষ্ট্র ফেরত আনার ষড়যন্ত্র মনে করেন। হিন্দুদের হত্যা করলেও তিনি বিচলিত হন না।
একটি পরিসংখ্যান : নির্যাতনকারীর হিসাব-------------------------
সব বর্ণহিন্দুই কি নির্যাতনকারীর ভূমিকায় ছিলেন? ১৯৪৭ সালে যখন ভারত ভাগ হয়নি—হবে হবে করছে, সে সময়ে পূর্ববঙ্গে মুসলমানের সংখ্যা ছিল ৫৫%, হিন্দুদের সংখ্যা ছিল ৪৫%। এই হিন্দুদের মধ্যে আবার নিম্নবর্ণের হিন্দুদের সংখ্যাটাই বেশি ছিল। তাদের সংখ্যা ছিল শতকরা ৪০ জন। আর মাত্র ৫% বর্ণহিন্দু—ব্রাহ্মণ-কায়স্থ। এরাই ছিলেন জমিদার, তালুকদার, আমলা, ব্যবসায়ী-বনিক সম্প্রদায়ের অন্তর্গত। এদের মধ্যে শতকরা কত ভাগ ব্রাহ্মণ বা কায়স্থ মুসলমানদের নিপীড়ন করেছে? ১%? ২%? অথবা ৩%? তাহলে মাত্র ১-৩% বর্ণহিন্দুদের নিপীড়নের কারণে একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর প্রতি ক্ষোভ বা ঘৃণা প্রকাশ করাটা কতটা ন্যায়সঙ্গত? এই সাম্প্রদায়িক নির্যাতন একটা রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে নিহিত। রাষ্ট্র যদি এমন ব্যবস্থা রাখে যেখানে একজন বর্ণহিন্দু একজন মুসলমান বা নিম্নবর্ণের হিন্দুকে ঘৃণা করতে পারে—সেটা উৎখাতের জন্য অই বর্ণহিন্দু ও নিম্নবর্ণসমেত সকল হিন্দুর বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক পন্থাগ্রহণ-করে তাহলে কি রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে এই ঘৃণার অবসান করা যাবে? মনে হয় না। কিন্তু রাষ্ট্র যদি এমন ব্যবস্থা করে, যেখানে—সংখ্যাগরিষ্ঠ বা সংখ্যালঘিষ্ঠ বা বর্ণবাদের কোনো জায়গাই থাকবে না সেখানে কোনো ধরনের বর্ণবাদ বা ঘৃণাবাদের স্থান থাকে না। সেটা ফিরে আসারও কোনো সুযোগ থাকে না। তাহলে রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যেই পরিবর্তনটা চাইতে হবে। সেটাই সুস্থ চিন্তা। ঘৃণার জবাব ঘৃণা দিয়ে হয় না। সেটা অসভ্যতা।
কনফিউজড নানাজান : দায়ী মুক্তিযোদ্ধা---------------------------
হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন, এসব (বর্ণহিন্দুদের নির্যাতন) দেখে দেখে সে সময়ের মুসলমানরা বড় হয়েছেন এবং তাদের মনে হয়েছে একটি পৃথক রাষ্ট্র প্রয়োজন। অনেক যুদ্ধের পর তারা তা পেয়েছেন। যখন তারা দেখলেন চোখের সামনে দিয়ে সেই রাষ্ট্র ভেঙে যাচ্ছে, তখন তারা মনে করেছেন আবার হিন্দু রাজত্ব শুরু হয়ে যাবে। তখন পাকিস্তানকে সাপোর্ট করা শুরু করেন। কিন্তু পাকিস্তান আর্মির অন্যায়গুলো ক্রমেই চোখে পড়তে থাকে। তারা দেখলেন পাকিস্তানি আর্মিরা তো কেবল হিন্দু মারছে না, সমানে মুসলমানদেরও খুন করছে। ‘ আমার নানা দেখলেন , তার অতি আদরের বড় মেয়ের পুলিশ অফিসার স্বামীকে (বা আমার বাবাকে) বেধে নিয়ে আর্মিরা গুলি করে মেরে ফেলল। তিনি হতভম্ব হয়ে গেলেন। কি হচ্ছে এসব? কোনদিকে যাবেন? তিনি কি পাকিস্তান আর্মির সঙ্গেই থাকবেন , নাকি কমন যে স্রোত আছে তাদের সঙ্গে যোগ দেবেন?’ এই নিয়ে কনফিউশন তৈরি হলো তার মধ্যে। তিনি এই কনফিউশন দূর করতে পারলেন না।
পাকবিহিনী যখন হিন্দুদের মারছে তখনও তিনি কনফিউজড নন। যখন পাকবাহিনী মুসলমানদেরও মারা শুরু করেছেন তখন কিছুটা কনফিউশন তার মধ্যে তৈরী হচ্ছে। যখন তার তার আদরের বড় মেয়ের স্বামী—হুমায়ূনের বাবাকে মেরে ফেলল—তখনো তিনি পুরোপুরি কনফিউজড হয়ে আছেন। সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না—তিনি কোনদিকে যাবেন, পাকিস্তান আর্মির সঙ্গে যাবেন, না, কমন স্রোতের দিকে যাবেন? হুমায়ূনের বাবাকে পাক বাহিনী মেরেছিল ১৯৭১ সালের ৬ মে। এরপর পাকবাহিনীর হত্যা-নির্যাতন চলেছে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত। হুমায়ূন তার কনফিউজড ভদ্রলোক রাজাকার নানাজানের কথা বলছেন। নানাজানের এই রাজাকার হওয়ার পেছনে একটি অজুহাত আবিস্কার করে বসে আছেন—পাকিস্তান ভেঙে গেলে সেটিা হিন্দুদের রাজত্ব হয়ে যাবে। এবং রাজাকাররা সে সময়ে কি করেছেন সেটা বলছেন না। তাঁর জ্যোৎস্না ও জননী গল্প নামক সেই বিখ্যাত উপন্যাসটির কোথাও বলছেন না—রাজাকাররা খুব খারাপ ছিলেন। তারা পাকবাহিনীর গণহত্যায় সহযোগিতা করেছে। নানাজানের উপাখ্যানের মধ্যে দিয়ে হুমায়ূন রাজাকারদের প্রতি সহানুভূতিই তৈরী করে দিচ্ছেন। বোঝাতে চেষ্টা করছেন--রাজাকাররা চুল থেকে নখ পর্যন্ত ভদ্রলোক। হিন্দুদের প্রতি এক ধরনের ঘৃণাই তৈরী করে দেন। এই ঘৃণা অজস্র রক্তের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়। ঘৃণা প্রতিস্থাপিত হয় আরেকটি নতুন ঘৃণা সৃষ্টি করে।
তিনি তাঁর কনফিউজড নানাজানের দোষ দেখতে পান না। দোষটি দেখেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকদের—তারা কেন তাঁর নানাজানকে বোঝায়নি। বুঝিয়ে সুজিয়ে তাকে কেন কমনস্রোতে নিয়ে আসেনি। সুতরাং তাকে, তাঁর রাজাকার অথচ ভদ্রলোক নানাজানকে ক্ষমা করাটাই জরুরী। বাস্তবতা হল, সেই সময়ে যারা রাজাকার ছিল—রাজাকারের নেতৃত্বে ছিল—তাদেরকে বোঝানোর কোনো সুযোগই ছিল না। যারা কোনোভাবে রাজাকার নানাজানদের বোঝানোর সুযোগ নিতে গিয়েছেন, তাদেরকে আর পৃথিবীর আলো দেখতে হয়নি। তাদের শহীদের সারিতে চলে যেতে হয়েছে। হুমায়ুন আহমেদ রাজাকারদের এই শহীদ বানানো প্রকল্পটিরই বড় সাক্ষী। তাঁর মা আয়েশা ফয়েজ লিখেছেন তাঁর আত্মজীবনীতে—তার আব্বার বন্ধু পিরোজপুরের পিচ কমিটির চেয়ারম্যান সৈয়দ আফজাল তার স্বামীকে পাকবাহিনীর হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। সে সন্দেহ তিনি করেছেন। (মাহফুজ আহমেদ, ঘরে-বাইরে হুমায়ূন আহমেদ হাজার প্রশ্ন, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ১৯৯৪. পৃ.৩১-৩২)। সৈয়দ আফজাল এখন নেই। তিনি মারা গেছেন। রাজাকারদের কাছে তিনি শহীদ। তাঁর ছেলেরা আছেন। তাঁদের পিরোজপুর শহরের বাড়িতেই যুদ্ধাপরাধী মাওলানা দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর নির্বাচনী অফিস এবং থাকার স্থান। সেই বাড়িটি যে রাস্তায় অবস্থিত, সে রাস্তাটির নাম শহীদ ফয়জুর রহমান আহমেদ সড়ক। একাত্তরে যুদ্ধাপরাধী মৃত সৈয়দ আফজালের সহযোগী দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর বিরুদ্ধে হুমায়ূন আহমেদের ভাই মুহাম্মদ জাফর ইকবাল মুখ খুললেও হুমায়ূন আহমেদ টু শব্দটি করেন নি। তার বিরুদ্ধে একটিও অভিযোগ তোলেন নি।
হুমায়ূনের ভেতরে শহীদ আব্বা—রাজাকার নানাজান ---------------------
হুমায়ূন আহমেদের জীবনে বিপরীতধর্মী দুটো ট্রাজেডী আছে। এক) তাঁর বাবাকে মেরে ফেলেছে পাকআর্মিরা। দুই) তাঁর রাজাকার নানাকে হত্যা করেছে মুক্তিযোদ্ধারা। পাকআর্মিদের প্রতি তাঁর ক্ষোভ আছে। আবার রাজাকার নানাজানকে হত্যার কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিও তাঁর ক্ষোভ আছে। শহীদ বাবার জন্য তাঁর কষ্ট আছে। আবার নানাজানের প্রতি শ্রদ্ধা আছে—ভালোবাসা আছে। তাঁর কোনো দোষ দেখতে পান না। তাঁর কোনো ত্রুটি খুঁজে পান না। তাঁকে ক্ষমা করে দিতেই চান। একজন লেখক যখন এই রাজাকার নানাজানের প্রতি সমর্থনের কথাটি লেখেন বা বলেন, তখন তার প্রতি কনভিন্সড হয়েই লেখেন বা বলেন। তিনি রাজাকার নানাজানের আদর্শ বা চিন্তার প্রতি এক ধরনের দায়বদ্ধতা থেকেই তাঁর রাজনীতির ভেতরে কোনো পাপ দেখেন না, তাঁর রাজনীতির কারণে ৩০ লক্ষ বাঙালি-হত্যাকাণ্ডের মত মানবতাবিরোধী কাজকে সমর্থন করার মধ্যে কোনো অপরাধ দেখেন না—হত্যাকারীদের সমর্থনকারীকে ক্ষমা করে দেওয়ার মতো ভয়ঙ্কর দাবীটিও খুব নিরীহভাবে করেন। তাঁর ভেতরে যেমন তাঁর শহীদ বাবা বাস করেন তাঁর ভালোমানুষী আদর্শসহ—তেমনি তাঁর মধ্যে রাজাকার নানাজানও তার পাকিস্তানপন্থার আদর্শসহ-ই কাজ করেন। নানাজান নানাভঙ্গিতে তার লেখার মধ্যে দেখা দিয়ে যান। এ অর্থে তিনি অর্ধেক মুক্তিযোদ্ধা--অর্ধেক রাজাকার। এভাবে লেখক তার ব্যক্তিগত-বিশ্বাস লালিত-আদর্শের সঙ্গে একাত্ম হতে না পারলে সত্যিকারের লেখাটি লিখতে পারেন না। এটাই চরম সত্যি।
তিনি যখন জ্যোৎস্না ও জননী গল্প উপন্যাসটি লেখেন—তখন শুধু উপন্যাসের আখ্যানের উপরই ভরসা রাখতে পারেন না। আখ্যানের প্রবেশক হিসেবে একটি ভূমিকা জুড়ে দেন। সেখানে সংশয় তুলে দেন নবীন পাঠকের মাথার ভিতরে যে, একাত্তরের দলিলে যে পাকবাহিনী কর্তৃক নারী ধর্ষণের তথ্য দেওয়া হয়েছে তা সত্যকে ধারণ করে না। যাদের ভোগ করা হয়—সেই নারীদের কিভাবে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল—তিনি তার বাস্তবতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন এবং গভীর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেন যে, (মুক্তিযুদ্ধের দলিলে) বলা হয়েছে যে তাদের হাতে বই খাতা কলমসহ গ্রেফতার করা হয়েছিল—তখন, একাত্তরে বইখাতা কলমসহ মেয়েদের পথে হাঁটার কথা নয়, তখন স্কুল কলেজ বন্ধ ছিল— তাহলে বইখাতা হাতের এই স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীরা এই পাকবাহিনীর নির্যাতন ক্যাম্পে আসে কিভাবে? এটা সত্যি হতে পারে না। নবীন পাঠকের মাথায় সন্দেহ সন্দেহ এসে যায়—পাকবাহিনী কর্তৃক নারী নির্যাতন-নারী ধর্ষণ ব্যাপারটিকেও সন্দেহ করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের দলিলে প্রকাশিত তথ্যগুলো ঠিক নয়। গোঁজামিল আছে।
গল্প-উপন্যাস দাঁড়ায় নিজের ক্ষমতার উপরে—তাদের আখ্যানটিই বলে দেয় লেখকের নিজের কথা—লেখার কথাটি—লেখার উদ্দেশ্য। সেক্ষেত্রে গল্প উপন্যাসে লেখকের ভূমিকা প্রদান রীতিটা প্রচলিত নয়। একটি উপন্যাসের ভূমিকার প্রয়োজন আছে কিনা সেটা তর্ক সাপেক্ষ, হুমায়ূন তার অধিকাংশ উপন্যাসে এই ভূমিকা পদ্ধতি এড়িয়ে গেছেন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই—কিন্তু খাপছাড়াভাবে জ্যোৎস্না ও জননীর গল্প উপন্যাসে তিনি ভূমিকা দিয়ে নবীন পাঠকের পাঠচেতনার মধ্যে একটা জাজমেন্ট তৈরী করে দেন, কায়দা করে বুঝিয়ে দেন যে,—একাত্তর নিয়ে আমাদের রচিত ইতিহাস—ভূয়া হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। সেটা মনে রেখেই তাঁর এই উপন্যাসটি পড়তে হবে। বোঝা যায়—হুমায়ূন আহমেদের রাজনৈতিক ভাবনাটি পরিস্কার নয়। দোদুল্যমান। সংশয়পূর্ণ। খিচুড়িমার্কা। এই সূত্রেই বোঝায় যায়-- একই সঙ্গে তিনি পাকিবাহিনীর প্রতি ক্ষুদ্ধ তার বাবাকে হত্যা করার জন্য। আবার মুক্তিযোদ্ধাদেরও প্রতি ক্ষুদ্ধ তাঁর নানাজানকে হত্যা করার জন্য। এই মুক্তিযুদ্ধ এবং রাজাকারতন্ত্রের মিশেলে হুমায়ূন অদৃষ্টনির্ভর একজন জনপ্রিয় লেখক মাত্র—যার কোনো দায় নেই। দায় আছে একমাত্র অর্থের প্রতি। ফলে এই দায়হীন-ইতিহাস-ভূগোলহীন লেখকের ঐতিহাসিক রচনাকর্মে ভুল নির্মাণ আসাটা খুব স্বাভাবিক।
৩.
একাত্তর-উত্তর হুমায়ুন-ভাবনার জগৎ : মুক্তিযুদ্ধ মাইনাস বঙ্গবন্ধু------------------------
হুমায়ূন আহমদের পরিবার লেখক পরিবার। তিন ভাই-ই লেখালেখির জগতে ঈর্ষণীয়ভাবে জনপ্রিয়। কিন্তু তাঁদের সবার লেখাতেই মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদি নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বা মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগের পক্ষে যায় এমন বক্তব্য এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ্যণীয়। বঙ্গবন্ধু সমালোচনার উর্ধ্বে নন এবং আওয়ামী লীগের রাজনীতিরও অনেক সমালোচনা করার আছে—কিন্তু একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতে গেলে অবশ্যই বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের অবদানটা স্বীকার করতে হবে। এই অবদান অস্বীকার করার অর্থ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাসকেই অস্বীকার করা হয়। এই প্রবণতা শুধু পাকিপন্থীই নয়-- এদেশের চিন্তাপন্থী রাজনীতিকদের একটি ধরন। কারণ চিনাপন্থী রাজনীতিককের সখ্যতা ১৯৬৫ সালের পর থেকে পাকিপন্থার সঙ্গে হাত ধরে চলে। এই সখ্যতা রাজনীতির ক্ষেত্র থেকে মনোজগতে অনিবার্যভাবে চালান হয়ে যায়।
হুমায়ূন আহমেদ যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন তিনি তখন বিএনপি-জামায়াত-চিনাপন্থী সাদা দলের সদস্য ছিলেন। যে কোনো কারণেই হোক না কেন এই সাদা দলের রাজনীতির প্রতি হুমায়ূন আহমেদের এক ধরনের কোমলতাই ছিল বা এখনো আছে। তারই সহকর্মী হুমাযূন আজাদ যখন আক্রান্ত হন মৌলবাদিদের দ্বারা এবং পরবর্তীতে যখন এরই ধারাবাহিকতায় হুমায়ূন আজাদ মারা যান তখন সুইডেন থেকে হুমায়ূন আজাদের বিরুদ্ধে আঙুল তুলে তিনি বলেছিলেন--‘হুমায়ুন আজাদ যে বইটি (পাক সার জামিন সার বাদ) লিখেছিলেন তা এত কুৎসিত, যে কেউ বইটা পড়লে আহত হবে৷ তার জন্য মৌলবাদী হতে হয় না৷’ হুমায়ূন আজাদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগটি করেছিলেন ১৮ জুলাই ২০০৮ তারিখে সমকাল পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে। এ ধরনের অভিযোগ জামায়াতে ইসলামীরাই হুমায়ুন আজাদের বিরুদ্ধে করে থাকে। হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকার থেকে হুমায়ূন আজাদের প্রতি তাঁর সহানুভূতি পাওয়া যায় না। তাঁর হত্যাকাণ্ডকেই প্রকান্তরে সমর্থন করে। ব্যক্তি হুমায়ূন আজাদকে কারো অপছন্দ থাকতে পারে, তাঁর সাহিত্যের চুলচেরা বিশ্লষণ করে দেখানো যেতে পারে তাতে কতটা পরিণত সাহিত্য-কতটা অপরিমিত আবেগ আছে, তার বিশ্বাসকেও অবিশ্বাস করার অধিকার যে কারোরই আছে—কিন্তু তাঁকে মেরে ফেলার মত কাণ্ডকে সমর্থন কোনোভাবেই করা যায় না। তাঁকে মেরে ফেলার পিছনে কোনো অজুহাত দাঁড় করানো--খুনীদের প্রতি সহানুভূতি সৃষ্টি করানোর মত কাণ্ড বিবেকহীনতা ছাড়া আর কিছুই নয়। এটা ঠিক যে হুমায়ূন আজাদের বিশ্বাসটি ছিল স্বচ্ছ-তীর্যক। এই বিশ্বাসটা একাত্তরের ঘাতককে তার চিন্তাকাঠামো ও অবস্থানকে নাড়িয়ে দিতে সক্ষম। এই সক্ষমতা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের চিন্তা ও তৎপরতার একটি শক্তি। এটাকে অস্বীকার করা, অশ্রদ্ধা করা—তাঁর হত্যাকাণ্ডকে জায়েজ করাটা আর যাই হোক— সদর্থ বহন করে না। এই ধরনের বক্তব্য যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষেই যায়। হুমায়ূন আহমেদ এই বক্তব্য কখনো প্রত্যাহার করেননি।
সংখ্যাগরিষ্ঠের সংস্কৃতিনির্মাণপ্রকল্প------------------------
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশ সেক্যুলার অসাম্প্রদায়িক চেতনার দিকে ফেরে—শাশ্বত বাঙালির মধ্যে যাত্রা করে। তখন প্রগতির দিকে মুখ ফেরানোর যে অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছিল, উদার অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি বিকাশের যে উন্মুক্ত ক্ষেত্র তৈরী হয়েছিল—সেইখানে তরুণপ্রজন্মের চেতনার সূত্রমুখটাকে-- সংস্কৃতির গতিমূখটাকে পাল্টে দেওয়ার একটা চেষ্টা দেখা যায় পাকিস্তানপন্থীদের লেখায়-বলায়-করায়—কৌশলে সংবিধানে নির্দেশিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণী-সম্প্রদায়-জাতি নির্বিশেষে সকলের জন্য রাষ্ট্রে সমানাধিকার-কে বদলে দিয়ে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠের সংস্কৃতি প্রচলনেরই চেষ্টা করে আসছেন। এই ধারাটিকে কখনো সূক্ষভাবে কখনো স্থুলভাবে হুমায়ূন আহমেদ অনুসরণ করে আসছেন। তাঁর টিভি নাটকগুলোতেই একাজগুলো লক্ষ্যণীয়ভাবে উপস্থিত। প্রবলভাবে দেখা যায় সাহিত্য বা নাটক-চলচ্চিত্র নির্মাণের মধ্যে দিয়ে তিনি তাঁর সেই পাকিস্তানপন্থী নানাজানের মতই নিপীড়িত, দুটি নয়—দুটির মধ্যে একটি সম্প্রদায়ের প্রতিভু হয়ে আধুনিকতার খোলসে ধর্মতন্ত্রকেই পথ করে দেন। বাঙালির সৌজন্যপ্রকাশক-সংস্কৃতির মধ্যেও যে আধুনিকতার দিকে যাত্রা শুরু হয়েছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে,—হুমায়ূন পাঠে-হুমায়ূন দর্শনে তাঁর পাঠক-দর্শক তার আগে পাকিস্তান পর্বেই ফিরে যায়। সাম্প্রদায়িক প্রতিক্রিয়াশীল পীরবাদি ধর্মতন্ত্রের দিকে যাত্রা করে। সে কোনো না কোনোভাবে অদৃষ্টবাদি হিমুতে পরিণত হয়। এই হিমু প্রবলভাবে জনবিচ্ছিন্ন, আবেগাক্রান্ত, বিষণ্ন, এবং সূক্ষ মৌলবাদী সংস্কৃতির ধারক ছাড়া আর কিছুই নয়।
গণতন্ত্রের সংখ্যাগরিষ্ঠতার ধারণাটি ভুল ব্যবহার করে থাকেন প্রতিক্রিয়াশীলরা। সংখ্যাগরিষ্ঠদের ভোটে একটি সরকার নির্বাচিত হয়। সরকার সংবিধানের রক্ষক হিসাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ-সংখ্যালঘিষ্ঠ উভয়কেই সমভাবে বিবেচনা করে। সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে যখন একটি সরকার নির্বাচিত হয়, তখন সেই নির্বাচিত সরকারটি আর সংখ্যাগরিষ্ঠের সরকার থাকে না। সকলের সরকার হয়ে ওঠে। সুতরাং রাষ্ট্রপরিচালনার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের রাগ ক্ষোভ বা আবেগের বশবর্তী হয়ে কারো প্রতি কোন ধরনের পক্ষপাত করার কথা নয় সরকারের। এটা সরকার যেমন মানবেন—সকলপ্রকার জনগণও রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে মেনে চলবেন। রাষ্ট্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে কিছু থাকার কথা নয়। সংখ্যালঘিষ্ঠ বলেও কেউ নেই। রাষ্ট্র সবার। সুতরাং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠের জন্য আলাদা ভাবনা—আলাদা সংস্কৃতি প্রচলনের অর্থটা প্রতিক্রিয়াশীলতারই নামান্তর।
৪.
দেয়ালের সাহিত্য : খুনীদের সাফাই---------------------------------
দেয়াল উপন্যাসটির দুটো পর্ব প্রথম আলোতে প্রকাশিত হয়েছে। এ দুপর্বেই হুমায়ূন আহমেদ ইতিহাসের ভুলপাঠ দিচ্ছেন। এখানে যতটুকু উপাখ্যান দেখা যাচ্ছে, তার উৎস হিসেবে ম্যাসকারনেহাসের ব্লাডি অব লিগেসিকেই ব্যবহার করেছেন হুমায়ূন। এই বইটা মাসকারেনহাস লিখেছিলেন কর্নেল ফারুকদের মত কিছু কিলারদের সাক্ষাৎকার নিয়ে। ফলে এটা তো কিলারদের একপক্ষীয় ইতিহাস। এখানে সত্যিকারের ইতিহাসটা পাওয়া যাবে না। হুমায়ূন আহমেদ এই ইতিহাসটাকেই অনুসরণ করেছেন। তার এই দুটো পর্ব থেকেই থিসিস দিচ্ছেন—পঁচাত্তরের মুজিব হত্যাকাণ্ড কোনো দেশীয়-আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের ফল নয়। এটা ফারুক নামে অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা কাম অতি ভালো একজন আর্মি পার্সনের ব্যক্তিগত পরিকল্পনায় ঘটেছে। অথচ তথ্য বলে ফারুককে মাত্র চারদিনের জন্য মুক্তিযুদ্ধে দেখা যায়। বাকী সময়টা বিদেশে ছিল। দেয়াল থেকে হুমায়ূন জানাচ্ছেন মোশতাক আহমদ লোকটাও খারাপ নয়। একাত্তরের সামরিক অভ্যুত্থান বিষয়ে কোনো পূর্ব ধারনাই ছিলনা তার। রশিদও তাকে পঁচাত্তরে ক্যু বিষয়ে আগে কিছু বলে নি। আর ফারুক তার ব্যক্তিগত পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করেছে একজন উর্দুভাষী আন্ধা পীরের মদতে। হায় ইতিহাস। তাহলে ইতিহাস নির্মিত হয়। এই ইতিহাসকে কি ভয় পাওয়ার আছে? প্রশ্নটা এখানেই।
হুমায়ূন লেখেন, সেদিন ১৯৭৫ সালের পনেরই আগস্টে ফারুকের দল যখন শেখ মুজিবকে হত্যা করে ফেলেছে শিশুসন্তান রাসেলসহ পরিবারের সবাইকে নিয়ে—সেইদিন প্রাতে সেনাঘাতক খোন্দকার আব্দুর রশিদ প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেওয়ার দাবী নিয়ে খোন্দকার মোশতাকের বাসায় আসে —তখন মোশতাকের মাথায়নেহেরুর টুপি। কে এই নেহেরু? ভারতের প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু। নেহেরু কংগ্রেসী নেতা। তিনি এই ধরনের টুপি পরতেন। সে টুপির রং সাদা। শুভ্রতার প্রতীক হিসেবে কংগ্রেসীরা সাদা টুপি পরে থাকেন। খোন্দকার মোশতাক ব্যবহার করত সাদা নয়- ফুট ফুট কালো টুপি। মোশতাক কখনো নেহেরুর রাজনীতির সমর্থক ছিলেন না। তাঁর সমর্থন ছিল জিন্নার রাজনীতির প্রতিই। পাকিস্তানের জনক জিন্নাহও টুপি পরতেন। কোট পরতেন। সে টুপির রং ছিল ফুট ফুট কালো। আদর্শগতভাবে জিন্নাহর সমর্থক হয়ে—তাঁর মুরীদ হয়ে মাথায় জিন্নাহর বিরোধী শিবিরের রাজনীতিক নেহেরুর টুপি মোশতাক মাথা দেবেন—এটা পাগলেও বিশ্বাস করবে না। পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টে বঙ্গবন্ধু হত্যার মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ পন্থাকে হটিয়ে পাকিস্তান পন্থার দিকে দেশকে প্রবাহিত করার শুরুটা হল যার হাত ধরে—যিনি ভারতবিরোধীতার আওয়াজ তুলেই বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডকে জায়েজ করার চেষ্টা করেছেন আমৃত্যু—সেই হনন-ক্ষণেই যখন সেই খুনী মোশতাকের মাথার জিন্নাহর ফুট ফুট কালো রংয়ের টুপিটাকে নেহেরু টুপি বানিয়ে দেন হুমায়ূন আহমেদ, তখন একটু বিমূঢ় হয়ে পড়তে হয়। সম্বিত পেলে বোঝা যায় ডাল মে কুচ কালা হ্যায়। পাঠককে তিনি কায়দা করে বোঝানোর চেষ্টা করেন—১৫ আগস্টের সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড-সামরিক অভ্যুত্থানের সঙ্গে পাকিস্তানপন্থার কোনো যোগ নেই। যোগ ভারতপন্থারই ছিল। ভারতপন্থীরাই বঙ্গবন্ধুকে মেরেছে—সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে। এবং বিস্ময়কর যে এই ভয়ঙ্কর হত্যকাণ্ডের ভেতরে যে হত্যাকাণ্ডটি ইতিহাসে নির্মমতার চূড়ান্ত ঘটনা হিসেবে ঘৃণিত হয়ে আছে--যেখানে মাত্র ১০ বছরের নিষ্পাপ বালককে নির্দয়ভাবে গুলি করে হত্যা করে তাঁর বাঁচার আকুতিসহ, তার সেই হৃদয়বিদারক আঁকুতিটির মধ্যে দিয়ে--সেই গলগলে রক্তপাতের মধ্যে দিয়ে, বালকটির বিস্মিত হয়ে মরে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে একটি সভ্যতারই ইতি ঘটে যায়, আমাদের দুঃস্বপ্নের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে পড়ে, একটি জাতির সমষ্টিগত বিষাদের প্রকট উপাদান হয়ে থাকে--সেই ঐতিহাসিক বালকের সভ্যতাবিনাশী হত্যাকাণ্ডটি লেখক হুমায়ূনের মনে বিন্দুমাত্র রেখাপাত করে না। মাত্র এক লাইনেই তার মৃত্যু ঘটানো হয়। সে মৃত্যুর দৃশ্যটিও ইতিহাসের সঙ্গে মেলে না। যেন বালকটির মৃত্যু খুব খোলো এবং নিয়তি নির্ধারিত। অথচ একজন মহৎ লেখকের জন্য এই বাংলা ভূখণ্ডে এই নিরাপরাধ বালকহত্যাকাণ্ডটিই শুধুমাত্র একটি মহাকাব্যিক রচনার সূত্র নয়--কেন্দ্র হতে পারে। অথচ সে ঘটনার বদলে তিনি ফারুকের মত একজন স্বঘোষিত খুনীকে মায়াময় ভাষায় পবিত্রমর্যাদা প্রদানের উদ্দেশ্য প্রচুর শব্দ ব্যয় করেন, যুদ্ধেক্ষেত্রে একজন সৈনিক বরফ মিশ্রিত পানি পান করতে পারেন না। এটা নৈতিকতার বিরোধী। তার পরও প্রশ্ন জাগে যুদ্ধক্ষেত্রে বরফমিশ্রিত পানি পাওয়া সম্ভব? সেকালে--সেই ১৯৭১ সালে আমাদের দেশে ফ্রিজ কি সুলভ ছিল? যুদ্ধক্ষেত্র ফ্রিজ নেওয়ার সুযোগ ছিল? কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের দেয়াল উপন্যাসে ফারুককে মহান দেখানোর উদ্দেশ্য--পেশার প্রতি আদর্শনিষ্ঠ সৎ প্রমাণ করতে যুদ্ধক্ষেত্রে বরফ মিশ্রিত পানির ব্যবস্থা করেছেন। তার পিপাসার মেটানোর জন্য বরফমিশ্রিত পানি আনলে ফারুক পেশাদারী সৈনিকের আদর্শনিষ্ঠতা প্রকাশ করে ছবক দিয়েছে, যুদ্ধক্ষেত্রে আরাম-আয়েশের সুযোগ নেই। একজন সৈনিক হিসেবে সে সুযোগটি নিতে পারেন না। সেটা হারাম। এই হল আসল হিরো!
তারপর এই পর্বের শেষ দিকে লেখক হুমায়ূন আহমেদ একটি তথ্য দিয়ে শেষ করেন--সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের বিখ্যাত গ্রন্থ লিগেসি অব ব্লাড-এ উল্লেখ করা হয়েছে, শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুসংবাদ প্রচারিত হওয়ার পর পরই টুঙ্গিপাড়ার তাঁর পৈতৃক বাড়িতে স্থানীয় জনগণ হামলা করে এবং বাড়ির সব জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে যায়। এটা বিকৃত ইতিহাস। অ্যান্থনী মাসকারেনহাস বঙ্গবন্ধুর খুনিদের মিথ্যে কথাকে ইতিহাস হিসেবে তাঁর বইতে চালিয়ে দিয়েছেন। সেই মিথ্যে ভাষ্যের নির্বাচিত বিভ্রান্তকারী তথ্য হুমায়ূন আহমেদ অবলীলায় তার দেয়াল উপন্যাসে ব্যবহার করেছেন। বোঝানোর চেষ্টা করেছেন মুজিব এত অজনপ্রিয় লোক ছিলেন যে, তাঁর মৃত্যুর পরে দেশে কোনো প্রতিবাদ মিছিল হয়নি, জনগণ মাঠে নামেনি। শুধু তাই নয়—তাঁর নিজের গ্রামের লোক—তার প্রতিবেশীরাও ক্ষুদ্ধ হয়ে তাঁর বাড়িঘর লুটপাট করেছে। স্পষ্ট কথা হল, পঁচাত্তরের সামরিক শাসন এসেছিল এমন ব্যবস্থা পাকা করে যাতে জনগণের কেউ মাঠে নামতে না পারে। সন্ত্রাসবাদের আধুনিক সংজ্ঞায় বলা হয়েছে premeditated, politically motivated violence—অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অন্যতর মানুষের মনে ভীতি সঞ্চার করার জন্যই এই সন্ত্রাস করা হয়, ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করার জন্য অনেক গুলি খরচ করার দরকার নেই—কয়েকটি গুলি খরচ করে প্রধান প্রধান দুএকজনকে মেরে ফেললেই বাকীরা আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে পড়বে। তারা মনোজাগতিকভাবে মরে যাবে অন্তত কিছুদিনের জন্য। তাদের মনোজগতের এই মৃতবোধটি কাটিয়ে উঠতে কিছুদিন সময় লাগবে। এই অবসরে সন্ত্রাসবাদিরা গুছিয়ে নেবে। এই হল সন্ত্রাসের কৌশল। সেই কৌশলটিই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে অনুসরণ করা হয়েছিল।
১৫ আগস্টের খুনীদেরই এরকম দুটো পদ্ধতি ছিল। এক. মুজিবকে মেরে ফেললেও তার কেবিনেটের লোকজনকেও বন্দুক ধরে রেখে দিয়েছিল। এভাবে সকলকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা করা হয়েছিল—অপপ্রচার করার চেষ্টা হয়েছিল যে নির্মম হতাকাণ্ডটি—অভ্যুত্থানটি অন্য কেউ নয়—আওয়ামী লীগই করেছে। দুই. পথে ঘাটে মিলিটারি নামিয়ে দেয়া হয়েছিল। দেওয়া হয়েছিল কারফিউ। মুজিবকে মারার সঙ্গে সঙ্গে আরও অনেক প্রভাবশালী নেতার বাড়িতে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল। সে হত্যাকাণ্ডগুলো বিষয়ে এমনভাবে সারাদেশে প্রচার দেওয়া হয়েছিল যে এই সামরিক ক্যুদেতারা নির্মম এবং ভয়ঙ্কর—এই নির্মমতা এবং ভয়ঙ্করতা অন্য যে কোনো সময়ের চেয়েও অনেক বেশী শক্তিশালী। সামরিক শাসক আইয়ূব খান মুজিবকে মারতে পারেনি, ইয়াহিয়া খানও পারে নি---কিন্তু ১৫ আগস্টে পাকিস্তান থেকে প্রশিক্ষিত বাঙালি আর্মিদের একটি অংশ সেটা পেরেছে। এটা ছিল সন্ত্রাসের চিরাচরিত একটি ক্লাসিক ব্যবহার। এটা তথ্য সন্ত্রাস।
সে সময়ে বঙ্গবন্ধু-হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে দেশে অনেক জায়গায়ই মিছিল নেমেছিল। বঙ্গবন্ধুর নিজের মহকুমা খোদ গোপালগঞ্জেই মিছিল নেমেছিল। সে মিছিলে অংশ নেওয়ার অপরাধে তৎকালীন ন্যাপ নেতা শওকত চৌধুরীসহ অনেককে আটক করা হয়েছিল। তাদেরকে নির্মমভাবে নির্যাতন করা করা হয়েছিল। আর টুঙ্গিপাড়ায়? টুঙ্গিপাড়া নামের গ্রামটিতে সেদিন অনেকগুলো মিলিটারি হেলিকপ্টার নেমেছিল। ভয়ঙ্কর সব আগ্নয়াস্ত্র উঁচিয়ে খুনী সৈন্যরা বঙ্গবন্ধুর কফিনটি বের করেছিল। হেলিকপ্টারের শব্দ শুনে গ্রামবাসী বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে এগিয়ে আসছিল। কিন্তু বন্দুকের নলের খোঁচায় তাঁদেরকে ঠেকিয়ে রাখা হয়েছিল। তারা, নিরস্ত্র-বিমূঢ় জনতা, সেই মিলিটারি কর্ডন ভেদ করে আগাতে পারে নি। মাত্র সাড়ে তিন বছর আগেই এই গ্রামে—এই জনপদে পাকবাহিনী নির্মিমভাবে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল। সেই যৌথআতঙ্কটা তাদের মনোজগত থেকে হারিয়ে যাবার কথা নয়। আবার সেই রকমই আর্মিদের তৎপরতার আশঙ্কা দেখে তারা বিমূঢ় ও আতঙ্কিত হবেন সেটাই স্বাভাবিক। ইতিহাস বলে, বঙ্গবন্ধুর কফিন নিয়ে যারা টুঙ্গপাড়া গিয়েছিল, সেই ঘাতক সেনাদল চেয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে মাটি চাপা দিতে। কিন্তু স্থানীয় জনগণের আপত্তির মুখে তারা চাপা দিতে পারেনি। স্থানীয় জনগণ ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী নিহত বঙ্গবন্ধুকে তাৎক্ষণিকভাবে প্রাপ্ত ৫৭০ সাবান দিয়ে গোসল করিয়েছে—স্থানীয় রেডক্রস হাসপাতাল থেকে সংগ্রহ করে আনা মার্কিন থান কাপড় দিয়ে তাকে কাফন পরিয়েছে। জানাজাও পড়িয়েছে। তারপর দাফন করেছে। এগুলো সবই হয়েছে টুঙ্গিপাড়ার জনগনের মাধ্যমে। সেকালে, সেই বঙ্গবন্ধু হননকালে এই কাজটি কি একটি তীব্র প্রতিবাদ ছিল না খুনীদের বিরুদ্ধে? এই জনগণ কিভাবে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি লুটপাট করে? তথ্য বলে সেখানে দীর্ঘদিন বন্দুক উঁচানো পুলিশ পাহারা ছিল। তাহলে? হুমায়ূন আহমেদ এই মিথ্যে বিকৃত ইতিহাস বলেছেন কেন? তাঁর উদ্দেশ্য কি?
ইতিহাস বলে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে সন্ত্রাসবিদ্ধ বাঙালিরা এক সময় ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। তারা সামরিক শাসনকে রুখে দাড়িয়েছে। একবার নয়-- বহুবার। এবং বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া রাজনৈতিক সংগঠনটিকেই ক্ষমতায় বসিয়েছে। এবং সেই খুনী মোশতাকই তার জীবিতকালেই ঘৃণিত ও বিস্মৃত হয়েছে, খুনী কর্নেল ফারুকদের বিচার হয়েছে—তাদের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। তাদের ফাঁসির ঘটনাটায় সারা দেশের মানুষ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছে। তাদের মৃতদেহ নিয়ে যখন গ্রামের দিকে তাদের গাড়ি যাচ্ছিল—পথে পথে সে গাড়ির উপর জুতা বর্ষিত হয়েছে। ইতিহাসটাতো এরকম। ইতিহাসের নিজের পা আছে। নিজের শক্তি আছে। নিজের মেরুদণ্ড আছে। ইতিহাস নিজের পায়ে হাঁটে। তাকে জোর করে হাঁটানো যায় না। তাকে দেয়াল চাপা দেওয়া যায় না। ইতিহাস ঠিকই এই দেয়াল সরিয়ে তাঁর অমিত শক্তি ও সম্ভাবনা নিয়ে উঠে দাঁড়ায়—নিজের পায়ে হাঁটে—মেরুদণ্ড সোজা করে সবার সামনে প্রকাশিত হয়—বলে, এই দেখো—আমিই ইতিহাস। তাহলে ইতিহাস বিকৃতি নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ইতিহাস বিকৃত হয় না।
সেক্ষেত্রে লেখকের দায় ইতিহাসের প্রতি সত্যনিষ্ঠ থাকা—দায়বদ্ধ থাকা। সেটা ইতিহাস না হয়ে সাহিত্য হলেও তাতে ইতিহাসের মূলকাঠামো ঠিক রেখে লেখক লিখবেন—তাঁর সাহিত্যকর্মের মধ্য দিয়ে ইতিহাসের বিনির্মাণ ঘটবে। বিকৃত নির্মাণ ঘটবে না। ভিক্টর হুগোর হ্যাঞ্চ ব্যাক নটরড্যামে ফরাসী বিপ্লবের সময়কালের ইতিহাসটি আছে। হুগো এই ইতিহাস নিয়ে ফিকশন নির্মাণ করেছেন। কিন্তু ভুল তথ্য দেননি। ইতিহাসের তথ্যের সপক্ষে নতুন আখ্যান নতুন চরিত্র দিয়েছেন মাত্র। ফলে সেটা কালজয়ী সাহিত্যের মর্যাদা পেয়েছে। আবার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই সময় উপন্যাস, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের শাহাজাদা দারাশুকো, আমাদের দেশের আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের চিলেকোঠার সেপাই অথবা অপেক্ষাকৃত নবীনতর কথাকার আনোয়ার শাহাদাত তাঁর সাঁজোয়া তলে মুরগা উপন্যাসে ইতিহাসকে নিয়েই লিখেছেন। ইতিহাসকে বিনির্মাণ করেছেন ইতিহাসের অস্থি-মজ্জা, রক্ত-মাংশ ও প্রাণবস্তুসমেত। কখনো পাঠকের মনে উদয় হয়নি—তারা উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে পাঠককে বিকৃত ইতিহাস গেলাচ্ছেন। এই খানেই হুমায়ূন আহমেদ একটু পিছিয়ে পড়েন—দূরে সরে যান তার সেই অমিত শক্তশালী মেধা নিয়ে, লেখার যাদুবিদ্যা নিয়ে—অবশেষে ধরা পড়ে তাঁর এই যাদুবিদ্যাটি আসলে নির্মল যাদু নয়—কালো জাদু, ভুডু যাদু। এবং কে-না জানে মেধা একটি টুলস—এই মেধাকে স্বচ্ছ চিন্তা দ্বারা কাজে না নাগালে তা অপকর্মই হয়ে উঠে। সভ্য মানুষের বদলে অসভ্য বানর তৈরি হয়ে যায়।
৫.
বদলে দেওয়ার মাকড়সা প্রকল্প : ওরফে বদলে দাও ইতিহাস-------------------
দৈনিক প্রথম আলো গোষ্ঠীর ইতিহাস নির্মাণের একটি প্রবণতা লক্ষ করা যায়। তারা একাত্তরের পাকিস্তান বাহিনীর গণহত্যাকে একটু কোমল আকারে প্রচার করে থাকে। তাদের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান প্রথমা গোলাম মুরশিদের মুক্তিযুদ্ধের নিরপেক্ষ ইতিহাস বের করেছে। সেখানে গোলাম মুরশিদ লিখেছেন--মনে হয়,(একাত্তরে) তিরিশ লাখ লোকের জীবনহানি হয়েছিলো বলে যে দাবি করা হয়, তা কিংবদন্তী মাত্র। বাংলাদেশে ফিরে এসে শেখ মুজিব রেসকোর্সের ভাষণে তিরিশ লাখের কথা বলেছিলেন। তিনি অনুমান করেই বলে থাকবেন।“
তারপরই গোলাম মুরশিদ লিখেছেন “রুডলফ রামেলের অনুমান পাকিস্তান দশ লাখের চেয়েও বেশি লোককে হত্যা করেছিলো। (আর.জে. রামেল ১৯৯৬) যদি তিরিশ লাখ অথবা দশ লাখের বেশির অনুমানে অতিরঞ্জনও থাকে, তা হলে অন্তত তিন/চার লাখ লোক যে নিহত হয়েছিলেন, সে বিষয়ে সন্দেহ করার কারণ নেই।“ এই অন্তত তিনচার লাখ লোক যে নিহত হয়েছিলেন---সে বিষয়ে সন্দেহ করার কারণ নেই’ বাক্যটির কোনো সূত্র কিন্তু গোলাম মুরশিদ দেন না। কিন্তু সন্দেহহীন ভাবে এই সূত্রহীন তথ্যটিকে তিনি প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন প্রথমা প্রকাশিত বইটিতে। এটা যুদ্ধাপরাধীদের একটা প্রকল্প। তারা দেশী-বিদেশী লেখক বা গবেষকদের দিয়ে গণহত্যার সংখ্যা নিয়ে সংশয় প্রতিষ্ঠিত করে দিচ্ছে। তারা বলছে—এই গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, সম্পদ লুট, দেশত্যাগে বাধ্য করা এটা এখন আর মনে রাখার দরকার নেই। অনেক দিন হয়ে গেছে। সুতরাং সেটা ভুলে যেতে হবে। পাকিস্তানের সঙ্গে পুনর্মিত্রতা করতে হবে। এই পুনর্মিত্রতার অংশ হিসাবে পাকিপন্থী মেহেরজান সিনেমা মুক্তি পাওয়ার আগে-পরে প্রথম আলো তাদের পত্রিকায় সিনেমাটির বহুল প্রচারের চেষ্টা করে। কিন্তু আনোয়ার শাহাদাত যখন একাত্তরের সত্য নিয়ে চলচ্চিত্র কারিগর নির্মাণ করেন, সেটা যখন বলাকা সিনেমা হলে মুক্তি পায়, সেটা যখন ২৬ মার্চে চ্যানেল আই-তে প্রচার করা হয়—সেটা নিয়ে প্রথম আলো একটি লাইনও ব্যয় করে নি। তাহলে পরিস্কারভাবে বোঝা যায় প্রথম আলোর মুক্তিযুদ্ধ চর্চার আড়ালে একটা উদ্দেশ্য আছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটাকে বদলে দেওয়ার উদ্দেশ্য। সত্যকে বদলে দাও--মিথ্যাতে বদলে যাও।
সুতরাং এই প্রথমা আলো পত্রিকাটি যখন হুমায়ূন আহমেদের দেয়াল উপন্যাস বই আকারে ছাপা হওয়ার আগেই দুপর্ব তাদের সাহিত্য সাময়িকীতে প্রকাশ করে তখন তাকে সাদা চোখে দেখার কোনো সুযোগ নেই।
৬.
সামরিকস্বৈরাচার বিরোধীতা বনাম স্পন্ডিলাইটিস আক্রান্ত লেখক--------------------
বাংলাদেশের মত তৃতীয় বিশ্বে সামরিক শাসন এক ভয়াবহ প্রপঞ্চ। কোনো না কোনোভাবে এরা আছে ক্ষমতার কেন্দ্রে। কখনো সরবে—কখনো নিরবে। কিন্তু সবসময়ই তারা ঠিক ক্ষমতার কেন্দ্রে ঘাপটি মেরে বসে আছে। এদের নিয়ে নিয়ে কথা বলাটাও বিপজ্জনক। অথচ এই সামরিক শাসন যবে থেকে এই ভুখণ্ডে এসেছে তবে থেকেই তারা জনগণের প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছে। আইয়ুব খানের মত স্বঘোষিত লৌহমানব পড়ে গেছে কোনো পাল্টা সেনাঅভ্যুত্থানে নয়-- জনগণের দাবড়ানিতেই। জিয়া নিহত না হলে তিনি জনগণের পেদানিতে যেতেন। এরশাদের পতনটাতো ইতিহাস। তার মানে সেনাতন্ত্র যত শক্তিশালীই হোক না কেন জনগণই আসল শক্তিধর। তাদের শক্তিটা জেগে উঠলে কারো বাপের সাধ্যি নাই—ধানাইপানাই করার সুযোগ নাই, যে কোনো স্বৈরশাসকের ক্ষমতায় ঠিকে থাকা অসম্ভব। কিন্তু সেনাতন্ত্র বা ব্যবস্থা ঠিকমতই আছে। কিভাবে? রাষ্ট্র তাদেরকে বিশেষ ব্যবস্থা করে দিয়েছে। জনগণ এরশাদকে ফেলে দিয়েছে—কিন্তু রাষ্ট্র এরশাদকে বাঁচিয়ে রেখেছে, দুধ কলা দিয়ে পুষে রেখেছে। এরশাদ যদি সে সময়ে মারা যেত তাহলে তাকে মনে রাখার কোনো প্রশ্নই ছিল না। কিন্তু রাষ্ট্রের সুবিধা নিয়ে বেঁচেবর্তে আছে—সুতরাং তাকে সুবিধা দিতে হবে। কারণ তাকে অসুবিধায় ফেললেই সামরিক শাসনব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। রাজনীতিকরা সে সরকারী দলই হোক—আর বিপক্ষের দলই হোক এই শাসনব্যবস্থাকে সমঝে চলে। একটা সমান্তরাল শাসনব্যবস্থা এভাবে তৃতীয় বিশ্বের মত বাংলাদেশে চলে। পরিহাসের বিষয় হল—এই সামরিক অপব্যাবস্থা নিয়ে দেশে লেখালেখির সংখ্যা খুবই কম। আর কথাসাহিত্যে বিরল। সামরিক শাসনকে নিয়ে লেখার মতো সাহস লেখকদের নেই। হুমায়ূন আহমেদ সেই সাহসহীনদের দলেরই অন্যতম হয়ে লিখছেন। কখনো তাদের হয়েই লিখছেন। এ লেখার সর্বশেষ প্রমাণ প্রথম আলোতে আগাম প্রকাশিত দেয়াল উপান্যাসের দুটি পর্ব।
সাহসের সমাচার : ফ্রম হুমায়ূন টু আনোয়ার শাহাদাত------------------------
এইখানে এসেই আমরা পেয়ে যাই একজন সাহসী আনোয়ার শাহাদাতকে। তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে—বিশ্বস্ততার সঙ্গে ইতিহাসের পথে হাঁটছেন। ইতোমধ্যে তাঁর দুটো গল্পগ্রন্থ ও একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। নির্মাণ করেছেন নিজের উপন্যাস নিয়ে একটি চলচ্চিত্র কারিগর। তার রচিত সাহিত্যে—তার নির্মিত চলচ্চিত্রে, সব কয়েকটি মাধ্যমে অতি বিশ্বস্ততার সঙ্গে —দক্ষতার সঙ্গে—শিল্পীতভাবে ইতিহাসের পথরেখা ধরেই মুক্তিযুদ্ধকে হাজির করেছেন। সেনাতন্ত্রের কালো চেহারাটিকে ফালা ফালা করে উন্মোচন করেছেন। কোনো ছাড় দেন নি। তাঁর কলম একটিও কাঁপেনি।
তিনি উপন্যাস লিখেছেন সাঁজোয়া তলে মুরগা। নামটিই বলে দিচ্ছে জনগণকে মুরগী করেছে সেনাতন্ত্র। তাদের এই মুরগীপনাটাকে আনোয়ার শাহাদাত ল্যাংটা করে ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন—কিভাবে সামরিক শাসন আসে, কিভাবে সামরিক শাসনের লোকগুলো পাকিপন্থায় প্রশিক্ষিত হয় এবং কিভাবে তারা জনগণকে মুরগী করে খায়। ইতিহাসের আলোকেই তাঁর উপন্যাসের চরিত্র হয়ে এসেছে আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান, জিয়া, তাহের, খালেদ মোশাররফ, এরশাদ, হারুনুর রশীদ। চরিত্র করেছেন হাসিনা, খালেদাকে। ইতিহাসের মূলসূত্রটাকে মাথায় রেখেই তাঁর উপন্যাসে শেষ পর্যন্ত প্রধান চরিত্র হয়ে দাঁড়ায় প্রান্তিক মানুষ। এই চরিত্রগুলোকে কখনোই অবিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না--মনে হয় পাঠক ইতিহাসের হাত ধরেই হাঁটছেন। সেই বিশ্বাসযোগ্য প্রান্তিক মানুষের সবেধন সামান্য মুরগী যখন সামরিক অভ্যুত্থানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করা একটি সাঁজোয়া গাড়ির চাকার তলে চাপা পড়ে তখন সেই প্রান্তিক মানুষটি বুঝতে পারে সাঁজোয়া তলে চাপায পড়েছে তাদের অস্তিত্ব, চেতনা এবং জীবন-যাপন। এবং তাকে রুখে দাঁড়ায় তাদের সমস্ত শক্তি নিয়ে-সম্ভাবনা নিয়ে—থেমে যায় সাঁজোয়া গাড়ি। ভেঙ্গে পড়ে তার চাকা। ইতিহাসটা তো এরকমই। ইতিহাসের মধ্যে দিয়েই হেঁটে যায় এই সব গল্পের চরিত্ররা।
আনোয়ার শাহাদাতের ক্যানভেসার গল্পের চরিত্র আব্দুর রহমান একাত্তরের খান সেনাদের সামনে আইয়ূব খানের উদ্দেশ্যে গালি দিলে তারা তাকে গুলি করতে যায়। তিনি তখন পিঠে নয়—বুকে গুলি করতে বলেন খানসেনাদের। এবং বলেন, এইএ বুকে নবীজীর চুম্বন আছে। সুতরাং বুকে গুলি করলেও সে গুলি পিছলে যাবে। পাক সেনারা সেইকালে অসংখ্য মানুষকে মারলেও আব্দুর রহমানকে মারতে পারে না। তার সামনে নতজানু হয়ে চলে যায়। যখন উনিশ শ পঁচাত্তরে শেখ মুজিবকে হত্যা করে সামরিক শাসকরা ক্ষমতায় এলো তখন এই আবদুর রহমানই আবার সেই শাসনকে আইয়ূব খানের শাসন বলে ধরে নিয়েছে। সেনাশাসক আইয়ূব খানকে ধরে নিয়েই তাঁকে গালি দিয়েছে—এই কারণে তাকে ধরে নিয়ে যশোর ক্যান্টনমেন্টে সামরিক ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে হত্যা করা হয়। এখানে ইতিহাসের সূত্রটা সেই আইয়ূব খান। আইয়ূব-ইয়াহিয়া-জিয়া-এরশাদ সেটা যে নামেই আসুক না কেন—সেটা একটা তন্ত্র-- একটা ব্যবস্থা বা সিস্টেম—যার জন্ম হয়েছিল পাকিস্তানের গর্ভে আইয়ূব খানের স্বৈরশাসনের মধ্যে দিয়ে, সে শাসনটা ব্যক্তি আউইয়ূব খানের হতে পারে না, সেটা একটা সিস্টেমই হয়—এই সিস্টেমকে উন্মোচন করাই একজন মহৎ লেখকরে কাজ। এবং আমার বিস্মিত হই হুমায়ূন আহমেদের দেয়াল উপন্যাসেও সেনাতন্ত্রের খুনি ফারুক আছে—একজন ধর্মীয় পীর আছেন। তারা কাজ করে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমের অর্জিত স্বাধীনতার চেতনাকে হত্যা করতে। সেটা বর্ণনাতেই হুমায়ুন সহজ এবং আবেগমথিত হয়ে যান। আর আনোয়ার শাহাদাত কোনো ব্যক্তি ফারুককে নয়—একটা গোটা সেনাতন্ত্রকেই হাজির করেন—প্রিয় নবীজীকেও রাখেন তার বিপরীতে। আখ্যানটি একটি তন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। যেমন তাঁর ওস্তাগারের তালিকা গল্পে পবিত্র কোরআন শরিফ এবং একটি মিথ্যা বাঁচায় একটা জনপদের হিন্দু জনগোষ্ঠিকে।
আনোয়ার শাহাদাতের ওস্তাগরের তালিকা বা এই গল্প থেকে নির্মিত চলচ্চিত্র 'কারিগরে'র একটি চরিত্র—যিনি মুসলিম লীগের প্রতিনিধি, সেই ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময়ে পাকিস্তানপন্থার বিরুদ্ধে পাদ্রীশিবপুর গ্রামে মিছিল হয়, তখন এই মিছিলে যোগ দেওয়ার অভিযোগে গ্রাম্য নাপিতকে ধমক দিতে যায়—তখন সেই পাকিস্তানপন্থী লোকটি মাথায় একটি টুপি পরে নেয়। এই টুপিটা তখন পাকিস্তানপন্থার প্রতীক হয়ে ওঠে। আবার এই কারিগর গল্পটিতে যখন পাক হানাদার বাহিনী ঐ পাদ্রীশিবপুর গ্রামে হিন্দু নিধন করতে আসে, তখন গ্রামের অতি দরিদ্র লোকটি, যিনি কিনা কারিগর বা গ্রাম্য হাজাম, যিনি খাতনা করে বালকদের মুসলমানী করেন, সেই মোতালেব কারিগর মাথায় একটি টুপি পরে নেন—হাতে তুলে নেন একটি পবিত্র কোরআন শরীফ। পাকবাহিনীর সামনে গিয়ে মেরুদণ্ড সোজা করে অতি বিশ্বস্ততার সঙ্গে তিনি একটি মিথ্যা কথা বলেন, এই গ্রামে কোনো হিন্দু নাই। যারা হিন্দু ছিল তাদেরকে তিনি আগেই মুসলমান করেছেন। তার টুপি ও পবিত্র কোরআন শরীফ এবং তাঁর একটি পবিত্র মিথ্যা কথার মধ্যে দিয়ে ঐ জনপদের অসংখ্য হিন্দু মানুষ বেঁচে যায়। তারা হিন্দু হিসেবে নয়—মানুষ হিসেবেই বেঁচে থাকে। আনোয়ার শাহাদোতের এই মোতালেব কারিগরের মাথায় পরা এই টুপিটি তখন মুক্তিযুদ্ধেরই প্রতীক হয়ে ওঠে।
এটাই ইতিহাসের বিনির্মাণ। বিকৃতি নয়। এইভাবে প্রকৃত লেখক উঠে আসেন—প্রকৃত লেখা টিকে থাকে। হয়তো একটু সময় নিতে পারে। তাতে কুচ পরোয়া নেই।
সুতরাং হুমায়ূন আহমদ যখন লেখেন দেয়াল উপন্যাসে সামরিক শাসনতন্ত্রকে এড়িয়ে নায়কোচিত ভিলেনের মর্যাদায় হাজির করে খুনী কর্নেল ফারুককে তা দেখে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। সত্যিকারের ইতিহাস নিয়ে লিখেবেন প্রকৃত লেখকরা। আনোয়ার শাহাদাতরা। তবে মুখে বললেই হবে না। শ্লোগান রেখে কলম নিয়ে বসতে হবে— মেরুদণ্ডটাকে সোজা রেখে কি-বোর্ডে ঠক ঠক করে মুদ্রিত করতে হবে সত্যিকারের লেখাটা। সেই লেখালেখি একদিন সামনে আসবে। সেটাকে সামনে আনার দ্বায়িত্ব আমাদের অগ্রসর পাঠকে শ্রেণীর। শুরু করতে হবে প্রকাশনার বিকল্প মিডিয়া অন্তর্জাল দিয়ে। সেখান থেকে চলে যাবে ছাপামাধ্যমে। তাহলেই সাহিত্যের বেনিয়াগিরি—কুটকৌশল মুখ থুবড়ে পড়বে। দেয়ালে নয়—কোটি কোটি পায়ের তলায় চাপা পড়বে-- মুছে যাবে অপসাহিত্য।
একজন হুমায়ূন আহমেদ নয়—এভাবে পাওয়া যাবে হুমায়ূন আহমেদের চেয়েও অনেক বেশী শক্তিশালী যাদুকরী মেধা ও স্বচ্ছ চিন্তা-আদর্শের অধিকারী অসংখ্য লেখককে। এই লেখকদের দায় শুধু অর্থের কাছে নয়—বিত্ত-বাসনার কাছে নয়,--আসৎ উদ্দেশ্যের কাছে নয়—সত্যের কাছে, মানুষের কাছে, সভ্যতার কাছে, ইতিহাসের কাছে।
মন্তব্য
_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩
-এবিএম
একটু সময় নিয়ে পড়ব, চিহ্ন রেখে গেলাম প্রচেষ্টায়
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
ব্যবসা ভালই জমবে সেটা বুঝতে পারছি-- কেউ করে সুদের ব্যবসা, কেউ সামাজিক, কেউ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে।
এইটাই হইতেছে আসল কথা। বোকাদের দেশে যাই করবেন তাই ব্যবসা।
অলস সময়
>> লিগেসি অফ ব্লাড
****************************************
আমরা সব কিছু ভুলে যেতে চাই কেন? আজ বোধহয় ভাবার সময় এসেছে সত্যের কাছ থেকে কেউ মুক্তি পেয়েছে কিনা......................
আলু গুষ্ঠি একরৈখিকভাবে ইতিহাস 'বিনিমর্াণ' করে যাচ্ছে, এটা আশঙ্কাজনক। এখতিয়ারের অস্পষ্ট লাইন ধরে যতোদূর যাওয়া যায়, সেখানে দাঁড়িয়ে আদালত একটা পদক্ষেপ নিয়েছে। আদালত নিষিদ্ধের পক্ষে হাঁটছে বলে মনে হয় না, বা হাঁটবে বলেও মনে হয় না। কিন্তু শীঘ্রই আলু গোষ্ঠি খেলাটা কিন্তু চান্সে অন্য টপিকে নিয়ে যাবে। নিষিদ্ধ নিষিদ্ধ খেলা টপিকে। মেহেরজান কেইসে যা হয়েছিলো। নিষিদ্ধ না হলেও কান্নাকাটি শুরু করবে যে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, হচ্ছে, হতে যাচ্ছে। ইতিহাসের শুদ্ধতা সাইডলাইনে পড়ে থাকবে। তখন আমরা হবো ভিলেন। এই ব্যাপারে তাই অগ্রিম সতর্কতা কাম্য। সেই একই খেলা যাতে আবার শুরু না হয়। আমিও তাই আপনার কথাটা উচ্চারণ করছি। যতোক্ষণ আমরা হাতেনাতে ধরিয়ে দিচ্ছি, ভয়ের কিছু নেই।
(ক) সিরিয়াস লেখাতে ভুল বানান এবং বাক্য গঠনে দুর্বলতা বাঞ্ছনীয় নয়। লেখাটিতে এই উভয় প্রকার ত্রুটি আছে। এডিট করার জন্য অনুরোধ করছি।
(খ) হুমায়ুন আহমেদ বিষয়ক আলোচনায় বিপরীতের উদাহরণ হিসেবে আনোয়ার শাহাদাত নিয়ে এতো বিস্তারিত আলোচনা ঠিক বলে মনে হয়নি। এটা "কে ভালো" বা "কে সেরা" জাতীয় ফালতু বিতর্ককে উসকে দিতে পারে। আনোয়ার শাহাদাতের রচনা ও সৃষ্টি স্বতন্ত্রভাবে বিস্তারিত আলোচনার দাবী রাখে।
(গ) অনিন্দ্য রহমানের ভাষায় - ট্যাকাটুকা একটা বিরাট যাদুবাস্তবতা। প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের এই যাদুবাস্তবতায় অনেক হাজী-গাজী-কাপ্তান-মৌলানা শরীক হয়েছেন। যতই দিন যাবে ততই বড় বড় নক্ষত্ররা এই যাদুবাস্তবতায় শামিল হবেন। আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধি বলে, এই যাদুবাস্তবতার তেল-পানিটা প্রতিক্রিয়াশীল চক্র নিজের পৈত্রিক সম্পত্তি বিক্রি করে যোগাড় করে না। এটা সাধারণ জনগণের পকেট কেটেই যোগাড় হয়। সাধারণ জনগণকে সচেতন করতে হবে যাতে এই তেল-পানির সাপ্লাই বন্ধ করা যায়।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩
নানাব্যস্ততার কারণে টাইপোগুলো ঠিকমতো চেক করা হয় না। আর আমার যেমন স্বভাব, পোস্ট দিয়ে ব্যস্ততার ফাঁকে ফাঁকে এডিট করা। আপনার পরামর্শটি সুন্দর। অনেকটা ঠিক করার চেষ্টা করেছি। আপনাকে ধন্যবাদ।
...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'
আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল, এবারে 'লিগেসি অফ ব্লাড' যে একটা ফালতু জিনিস সে ব্যাপারে লিখতে কেউ এগিয়ে আসবে। ধারনাটা এখন সঠিক মনে হচ্ছে। কিছু দিনের মধ্যে এটা মহামারি আকারে দেখা যাবার আশংকা করছি। কিন্তু কুলদা রায়ের লেখা পড়ে মনে হচ্ছে, উনি বইটা না পড়েই লেগে গেলেন, এটা দুঃখজনক।
বাকি লেখা ভাল লেগেছে আনোয়ার শাহাদাতের পর্ব আরেকটু সংক্ষিপ্ত হলে ভাল হত। বাদাম বিক্রিয় অহেতুক অভিযোগ এসে আলোচনা ভিন্ন দিকে চলে যেতে পারে।
রক্ষীবাহিনী দ্বারা নির্যাতিত হয়েছে তাদের পরিবার। এ কথা তাদের পরিবারের সবার লেখায় অসংখ্যবার উঠে এসেছে। তখনকার রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে সবার দুয়ারে ধর্না দিয়েও তার কোন প্রতিকার তারা পাননি। তাই জীবনের শেষ বেলায় এসে একটা মধুর প্রতিশোধ নিলেন হুমায়ুন।
কয়দিন আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে নিউইয়ররকের বাংলাদেশ দুতাবাসে “কাজ নাই-খামাখা বেতন”
জাতীয় পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন জনগনের অর্থ শ্রাদ্ধ করে। হুমায়ুন তার পুর্ন প্রতিদান দু’হাত ভরে দিলেন।
সমস্যা হলো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। বেচারা প্রথম আলো, সেই সময়, পূর্ব পশ্চিম নামক ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখে "হিট" হয়ে গেছেন। সেই হাওয়া আমাদের এখানেও লেগেছে।
আফসুস, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর ইতিহাসের প্রতি যে কমিটমেন্ট আছে তার ছিটাফোটাও হুমায়ুন আহমেদ এর মধ্যে দেখতে পেলাম না।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কমিটমেন্ট জায়গাটায় এসে আটকে গেলাম।
প্রতিভা বা কৃতকষ্ট নিয়ে কোন বিতর্ক নেই।
কিন্তু সুনীলের ঐতিহাসিক উপন্যাসে বারবার এসেছে ব্যক্তির একেবারে ভিতরের কিছু দিকের তীর্যক উপস্থাপন, বারবার এসেছে নিজ মতাদর্শের অনেকটা জোরপূর্বক চাপিয়ে দেয়ার ভাবধারা।
প্রথম ক্ষেত্রটার জন্য-
তাঁর উপন্যাসগুলো থেকে চিত্রিত সোহরাওয়ার্দী, ফজলুল হক, মধুসূদন এবং আরো অনেকে... একসময় ব্যক্তিনির্ভর উপন্যাসগুলো পড়া বাদই দিয়েছিলাম। আজো পড়ি না। মনে হয়েছিল, সুনীলের অবশ্যই কোন মনোবৈকল্য আছে, তাঁর ঐতিহাসিক ব্যক্তিনির্ভর লেখাগুলো যেন সেসব ব্যক্তিকে অশ্রদ্ধেয় পর্যায়ে আনার একটা চেষ্টা।
আর বেশকিছু ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক মানুষগুলোকে নিজের আদর্শিকতার সাথে প্রভাবিত করার একটা সচেতন প্রয়াস দেখা যায়- লালন নিয়ে উপন্যসই যথেষ্ট।
সব মিলিয়ে, তথ্য উপস্থাপনে সুনীল সেরা, লেখক তো অনন্যসাধারণ, বইও লেখেন মোটা মোটা এবং বিশাল সংখ্যক- কিন্তু দূর থেকে সালাম পাবার যোগ্য। কাছে গেলে তাঁর মানসিকতার উৎকট গন্ধ চলে আসে।
তবে ঐতিহাসিক গ্রন্থগুলো বাদ দিয়ে, তাঁর মত লেখক পাওয়া যাবে না।
এত বেশি পরিমাণে ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখার আগে তাঁর উচিত ছিল মনোবৈকল্য থেকে মুক্তি নেয়া। তিনি অবজার্ভার হিসাবে দেখতে শিখেছেন, বাকি ছিল অবজার্ভার হিসাবে লিখতে শেখা।
লেখা ভালো লেগেছে।
আনোয়ার শাহাদাতকে নিয়ে আলাদা পোস্ট হতে পারতো। এখানে হুমায়ূনের বিপরীতে আ/শা-কে দাঁড় করানোয় কিছুটা বেখাপ্পা লাগছে।
কৌতুহলবশতঃ এ পাড়ায় এসেছিলাম। হুমায়ুন আহমেদ দেখে একটু উঁকি দিয়ে গেলাম। আমার নিজস্ব ক্ষ্যাপামির কারণে আমি হুমায়ুন আহমদের সংগে থাকি। আমি কখনও তাঁকে মূল্যায়নের চেষ্টা করিনা। এমন কি আমার নামে তাঁর একটি গল্পগ্রন্থ উৎসর্গের পরেও। শামসুর রাহমান ছোটদের জন্য লেখা তাঁর বইটির উৎসর্গ হিসাবে যে ছড়াটি লিখেছেন তাতে একটি লাইন আছে এরকম, 'যারা জ্যোসনা রাতে দেখে পরীর নাচ'। মানুষের জীবনের সকল ঘটনা ও অসংগতিগুলিকে হুমায়ুন আহমেদ ওরকম একটা চোখে দেখেন। এককালে লেখা তাঁর একমাত্র পেশা থাকায় সেটাকে তিনি একজন আমেরিকান লেখকের মত খুব নিষ্ঠার সংগে ব্যবহার করেছেন। বলা বাহুল্য লিখে পয়সা কামানর ক্ষেত্রে যেমন তেমনই পাঠকের বিনোদন দেবার ক্ষেত্রে বাংলা সাহিত্যে অদ্বিতীয়ই বলে মনে হয়। এই যে আপনারা লেখালেখি করছেন, এটাও তাঁর পছন্দ। মোদ্দা কথা হুমায়ুন সব সময় আলোচনায় থাকতে পছন্দ করেন এবং সে ক্ষমতাও তাঁর আছে। এমন কি আপনাদের লেখালেখি থেকে হয়ত বা নতু উপাদানও খুঁজে নেবেন।
মোদ্দা কথা হুমায়ুন সব সময় আলোচনায় থাকতে পছন্দ করেন এবং সে ক্ষমতাও তাঁর আছে।
হুমায়ুন আহমেদ তাঁর ক্ষমতা সুপথে ব্যবহার করুন, ইতিহাসকে বিকৃত করে নয়।
হিটলারকেও তার মত করে অদ্বিতীয়ই বলা যায়, তার মত আর কে আছে? সেও আলোচনায় থাকতে পছন্দ করতেন বলে মনে হয় এবং সে ক্ষমতাও তার ছিল , আমরা পৃথিবীর মানুষেরা সবসময়ই তাকে নিয়ে আলোচনা করিও ,কিন্তু সমস্যা হল কিভাবে করি? হুমায়ূন আহমেদ তার এত বুদ্ধি নিয়ে এটুকু কেন বুঝেন না যে দুদিনের জনপ্রিয়তার চেয়ে সৎ থাকাটা বেশী দরকারী, আর ভবিষ্যতের পৃথিবী অসত মানুষকে আস্তাকুরেই ছুড়ে ফেলে, তারপর গারবেজ মনে করেই তাকে নিয়ে আলোচনা করে।
একটা লাল জাঙ্গিয়া মাথায় বেঁধে ঘুরতে বইলেন, মনোযোগ একপিসও মাটিতে পড়বে না।
সাহিত্য আর ইতিহাস এক হতে হবে কেন? উপন্যাসতো ডকুমেনটরি ছায়াছবি নয়। মীর মোশাররফ তো সীমারকে হোসেনের বুকে বসিয়ে ছুড়ি চালিয়েছেন, তাতে তো কারো সমস্যা হয়নি।
মানুষ ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে। সাহিত্যের কাজ হলো সেই শিক্ষাকে মহিমান্নিত করা। নির্মোহ ইতিহাসের শিক্ষাকে সাহিত্যের মাধুরী মিশিয়ে পাঠকের মনের গভীরে প্রথিত করা। বিশেষ করে সেই সাহিত্য যদি হয় ইতিহাস নির্ভর। আর সাহিত্য যদি সেই শিক্ষাকে ভুল পথে নিয়ে যায় তবে তা আর সাহিত্য থাকে না, হয়ে যায় বিকৃতি। ইতিহাসের পরিমার্জন ততটাই গ্রহনীয় যতটা সেই শিক্ষাকে বিশিষ্টতা দান করে। হুমায়ুন আহমেদ ঘাতকদেরকে মহিমান্নিত করে ইতিহাসের শিক্ষাকে ভুল পথে চালিত করেছেন যা এক ধরনের বিকৃতি।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
খাটি কথা।
হুমায়ুন আহমেদ এবং প্রথম আলো দুটি প্রতিষ্টান ই বাংলাদেশের পাঠক মহলে বেশ প্রভাব বিস্তার করেছে। কুলদ রায় এদের যে অন্ধকার দিকের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন তা খতিয়ে দেখা দরকার। বিশেষ করে আমাদের তরুণ প্রজন্ম এর দ্বারা কোনো ভুল সংকেত পাচ্ছে কিনা সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
একজন লেখক আর একজন লেখককে সম্মান করবেন এটাই স্বাভাবিক। হুমায়ুন আহমেদ লেখক হয়েও সম্মানিত লেখক হুমায়ুন আজাদকে অসম্মান করেছেন। হুমায়ুন আহমেদ কুতসিত শব্দটি ব্যবহার করেছেন হুমায়ুন আজাদের পাকসার জামিন সাদবাদ সম্পর্কে। হুমায়ুন আহমেদের আসলে ধারনা নেই কুত্সিত আর সুন্দর সম্পর্কে। পাকসার জামিন সাদবাদ উপন্যাসটি প্রচলিত ধারার বাইরে অন্য ফর্মে লেখা। এটি একধরনের 'literary rhetoric' যা পাঠক হৃদয়কে নারা দেয়ার জন্য হয়তবা প্রয়োজন ছিল। এর চেয়ে সুন্দর ভাবে আর জামাতিদের চরিত্র সম্পর্কে ধারণা দেয়া সম্ভব হত না।
এই সমাজে একজন হুমায়ুন আজাদের খুব দরকার যিনি সত্য প্রকাশে কুন্ঠিত হবেন না।
চরম একটা লেখা। আরেকটি কথা, হুমায়ুন আহমেদের জোসনা ও জননী বইতিতেই নয়, সূর্যের দিন নামের চমৎকার একটি উপন্যাসেও আমরা বড় চাচার মত একটি চরিত্র পাই। আবার বাবা (যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক) তিনিও তার বড় ভাই অর্থাৎ বড় চাচা অবস্থানটিকে কোমলভাবে ব্যাখ্যা করেন!
লেখা খুবই ভাল হইছে। কিন্তু, হুমায়ুন আহমেদকে রাজাকার বানিয়ে দিলেন?
"দেয়াল" বইটিকে সংশোধন করার জন্য আমাদের মহামান্য উচ্চবিচারালয় যে আদেশ দিয়েছে তা আমার কাছে অপ্রয়োজনীয় মনে হয়েছে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা একটি সত্যিকার গণতান্ত্রিক সমাজের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। আমরা ভিন্ন মতের তীব্র সমালোচনা করতে পারি, ভুল তথ্যের অসারতা প্রমাণ করতে পারি; কিন্তু কারো লেখার স্বাধীনতা কেড়ে নিতে পারি না, কারো লেখালেখির জন্য সীমানা নির্ধারণ করে দিতে পারি না।
আপনার মত শক্তিশালী লেখাই আমাদের প্রয়োজন হুমায়ুন আহমেদকে ভুল প্রমাণ করার জন্য। তবে রাজাকার বানানোটা বেশি হয়ে যাচ্ছে।
ছাগুদের এই স্টাইলটা খুব লক্ষণীয়। এই পোস্টে কিন্তু কোথাও হুমায়ূন আহমেদকে 'রাজাকার' বলা হয় নাই। রাজাকার বলা হয়েছে তার নানাকে, এবং হুমায়ূন যে সেই রাজাকারের প্রতি সফট কর্নার সৃষ্টির অপচেষ্টা করেছে, সেটা দেখানো হয়েছে। কিন্তু কালা পাহাড় তাকে ঠিকই দলে টেনে নিয়েছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা মানে বাংলাদেশের ইতিহাসের ওপর হাগু করার স্বাধীনতা না। ছাগুরা কি এটা জানে না? জানে। কিন্তু এটার অজুহাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃতির পক্ষে ওকালতি করা গেলে সে সুযোগ ছাড়ার মতো বোকা ছাগুরা না। সচলও দেখা যাচ্ছে, ছাগুমত প্রকাশ করার সুযোগ দিয়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সোনাউজ্জ্বল উদাহরণ সৃষ্টি করছে।
---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো
কালাপাহাড় তার লেজ এর আগেও বহুবার দেখিয়েছে এই সচলেই, হয়তোবা এই নামের আড়ালে একজন নয়, বহুজন মন্তব্য করে, চমৎকার দলগত প্রচেষ্টা। লেজের বিড়ম্বনা পৃথিবীর সবচাইতে বড় বিড়ম্বনা, লুকোতে গিয়েই বেরিয়ে যায় বেশি। বেজান্মাত!
একটা ছোট্ট তথ্যগত সংশোধনী আসা উচিত বলে মনে করছি লেখাটায়। আমার জানামতে হুমায়ুন আজাদ এর হত্যা বিষয়ক নিম্নরূচির সাক্ষাৎকারটি হুমায়ূন আহমেদ দিয়েছিলেন সুইডেন'এ বসে। যতদুর জানি অস্ট্রেলিয়া থেকে নয়।
লেখাটা দারুন
আনোয়ার শাহাদাতের লেখাগুলো পড়বো। লেখা পড়ে যা বলতে চেয়েছিলাম তার সবই মন্তব্যে চলে এসেছে। অপ্রাসঙ্গিক ভাবেই জানতে চাইছি, আনোয়ার শাহাদত বিষয়ক আলোচনার শুরুতে হ্যাট পড়া, হাতে লাইটার আর মুখে সিগারেট নিয়ে যার ছবি তিনিই কি আনোয়ার শাহাদাত? ছবিতো কঠিন!
সিগারেট ছাড়া যদি কোন ছবি থেকে থাকে তাহলে দয়া করে সেটাই দিন।
সেটা দেওয়া যেত। কিন্তু এই আলোচনায় যাদের ছবি ব্যবহৃত হয়েছে, তাদের সবার মাথায় টুপি আছে। টুপি নিয়ে একটি আলোচনা আছে। সে কারণে আনোয়ার শাহাদাতের টুপিসহ ছবিটা নেওয়া হয়েছে। সিগার আছে, লাইটারও আছে, ধরানোর ভঙ্গিটাও আছে। কিন্তু আনোয়ার শাহাদাত সিগারটিতে আগুন ধরাচ্ছেন না। তিনি আগুন ধরিয়েছেন তাঁর লেখায়।
ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য।
...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'
আচ্ছা।
দুর্দান্ত একটা লেখা, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
"হিমু" নাকি মৌলোবাদি চিনতার ধারক ছাড়া কিছুই না। ভাইজান কি গনজিকা সেবন করে লেখাটা লিখতে বসছিলেন কিনা, জানতে মন চাইছে। উনার আগের লেখাটা (দাংগা বিষয়ক) ভাল লেগেছিল। এটা আজব লেগেছে। জোর করে হুমায়ুন আহমেদ-কে রাজাকার-ানুরাগি বানানোর চেষটা বলে মনে হল যেন। সচলের ানেক লেখাই পড়ি, কমেনট করা হয়না। ১ম বার কমেনট করতে এসে টের পেলাম, েভাবে লেখাটা খুব টাফ। ানেক বানান লিখতে পারছিনা। আরো ানেক কিছু বলার ছিলো, লেখার ঝামেলায় বাদ দিলাম।
আনোয়ার শাহাদাতের লেখাগুলো পড়বো।
হুমায়ানের লেখা কে ঘরুৎো না ডিলে অ চোলবে,জে মানুস নিজ মেয়ের বোনঢুকে বিচানাটে নিটে পারে,ৈলোক ফারুক কে মুকটিঝোডডা বোলটে পারে,াটে োবাক হোবার কিসু নেি।
নতুন মন্তব্য করুন