কুলদা রায়
এমএমআর জালাল
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন ও রবীন্দ্রনাথ—৬
জাতীয় শিক্ষার আন্দোলন নিয়ে মতবিরোধ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সুবিধাবাদিতাও রবীন্দ্রনাথকে হতাশ করে ফেলে। ১৯০৫ সালের ৮ ডিসেম্বর তিনি শান্তিনিকেতনে চলে যাওয়ার আগে পর্যন্ত তাঁকে কোনো ধরনের সভাসমিতিতে যোগ দিতে দেখা যায় না। ১১ ডিসেম্বর মনোরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়কে তিনি একটি চিঠিতে লিখেছেন—কিছুদিনের জন্য সভাসমিতি হইতে পলায়ন করিয়া বোলপুরে আশ্রয় লইয়াছি। বেশিদিন এমন আরামে কাটিবে না। আবার কখন জনতার হঠাৎ ডাক পড়িবে, নির্জনতা হইতে বিদায় লইতে হইবে।
১১৯০৬ সালের ১১ মার্চ রবীন্দ্রনাথের মেজো দাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শিক্ষা কমিটির সভায় শিক্ষাসমাজের গঠনপ্রণালীর চূড়ান্ত রিপোর্ট গৃহীত হয়। রবীন্দ্রনাথ এ সভায় অনুপস্থিত ছিলেন।
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের রাজনৈতিক অংশে রবীন্দ্রনাথ কিছুটা যোগ দিলেও জাতীয় শিক্ষা-আন্দোলনে তাঁর যোগ ছিল সর্বাঙ্গীন। কিন্তু জাতীয় নেতাদের মতিগতি দেখে মাস-দেড়েকের মধ্যেই তাঁর মোহমুক্তি ঘটে। ১২ ডিসেম্বর রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীকে চিঠিতে লেখেন, আমাকে লইয়া টানাটানি করিয়া কি লাভ? বস্তুত দেশ যদি প্রস্তুত হইয়া না থাকে তবে আমি মাথা খুঁড়িয়া মরিলে কেবল আমারই মাথার পক্ষে অসুবিধা—তাহাতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মত বৃহৎ ব্যাপারের কোনোই সুবিধা হইবে না।...আমি ইহাঁদের কাছে যাতায়াত করিয়া বৃথাই সময় নষ্ট করিয়াছি।
ইহা নিশ্চয়ই জানিবেন উচ্চতর লক্ষ্য বিস্তৃত হইয়া যাঁহারা গবর্নমেন্টের বিরুদ্ধে স্পর্দ্ধা প্রকাশ করাকেই আত্মশক্তি-সাধনা ও আত্মপ্রতিষ্ঠা বলিয়া মনে করেন—যাঁহারা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনাকে এই স্পর্দ্ধা প্রকাশেরই একটা উপলক্ষ্য বলিয়া জ্ঞান করেন তাঁহাদের দ্বারা স্থিরভাবে দেশের স্থায়ী মঙ্গল সাধন হইতে পারিবে না। দেশে যদি এরূপ লোকেরই সংখ্যা এবং ইহাদের প্রভাবই অধিক থাকে তবে আমাদের মত লোকের কর্তব্য নিভৃতে যথাসাধ্য নিজের কাজে মনোযোগ করা। বৃথা চেষ্টায় নিষ্ফল আন্দোলনে শক্তি ও সময় ক্ষয় করা আমাদের পক্ষে অন্যায় হইবে।..আমি তাই ঠিক করিয়াছি যে, অগ্নিকাণ্ডের আয়োজনে উন্মত্ত না হইয়া যতদিন আয়ূ আছে আমার এই প্রদীপটি জ্বালিয়া পথের ধারে বসিয়া থাকিব। আমি কোনো জন্মেই লীডার বা জনসংঘের চালক নই—আমি ভাট মাত্র—যুদ্ধ উপস্থিত হইলে গান গাহিতে পারি এবং যদি আদেশ দিবার কেহ থাকেন তাঁহার আদেশ পালনেই প্রস্তুত আছি। যদি দেশ কোনোদিন দেশীয় বিদ্যালয় গড়িয়া তোলেন এবং তাহার কোনো সেবাকার্যে আমাকে আহ্বান করেন তবে আমি অগ্রসর হইব—কিন্তু কোনো নেতা হইবার দুরাশা আমার মনে নাই—যাহারা নেতা বলিয়া পরিচিত তাহাদিগকে আমি নমস্কার করি—ঈশ্বর তাঁহাদিগকে শুভবুদ্ধি প্রদান করুন।
এই আন্দোলনে শুধু রাজনীতিকরা নয়—আমলাতন্ত্রে কাজ করেছেন এমন লোকজনও যোগ দিয়েছিলেন। তাঁদের দুর্বলতা নিয়েও কবি সরব হয়েছিলেন। বিপিনগুপ্তকে ১৯১১ সালে ২৮ সেপ্টেম্বর চিঠিতে লিখেছিলেন, একটা Sysmem এর যাঁরা মানুষ হয়ে কর্মক্ষেত্রে খুব সফলতা লাভ করেন, তাঁরা সেই সে Sysmem থেকে কিছুতেই নিজেকে মুক্ত করতে পারেন না। গুরুদাস বাবু হাইকোর্টের জজ হলেন, কিন্তু পুরাতন শিক্ষা-পদ্ধতি থেকে মুক্ত করতে পারেননি। আবার যেটা ন্যাশনাল হওয়া দরকার, সেটাকে হিন্দু করবার চেষ্টা দেখে সফলতার আশা বড় করতে পারিনি। দেশের শিক্ষাপদ্ধতির মর্মকথাটুকু বুঝতে না পারলে, নিজেকে ভাল করে চিনতে না পারলে একটা মিথ্যে মেকি নিয়ে আত্মবঞ্চনা করা ত স্বদেশের অপমান করা হয়।
১৯০৫ সালের ২৭-৩০ ডিসেম্বর বারানসিতে জাতীয় কংগ্রেসের একুশতম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। গোপালকৃষ্ণ গোখলের সভাপতিত্বে এই অধিবেশনে বঙ্গভঙ্গের নিন্দা করা হয়। স্বদেশী আন্দোলনকে প্রশংসা করলেও বয়কটকে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যপূরণের উদ্দেশ্যে একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারেনি তারা। তাদের ভাষায়—Perhaps the constitutional and effective means ছিল বয়কট। বয়কট আন্দোলনকে সর্বভারতীয় করতে আগ্রহী ছিল না। বস্ত্র-বয়কটের ফলে সে সময় বোম্বে ও আহমেদাবাদের ব্যবসায়ীরা একচেটিয়া ব্যবসা করে লাভবান হচ্ছিল। কংগ্রসের অবাঙালি নেতৃবৃন্দ তাদের ব্যবসাটাকে বড়ো করে দেখেছিল—বাংলার স্বার্থ নিয়ে তাদের মাথাব্যথা ছিল না। রবীন্দ্রনাথের মত ব্যক্তিবর্গের দাবী ছিল বস্ত্রবয়কট করলেই হবে না, তার বদলে বঙ্গে বস্ত্রকারখানা গড়ে উঠুক বাঙালিদের উদ্যোগে। এজন্য জাতীয় ধনভাণ্ডারও গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এখানে বাঙালিদেরকে অর্থদান করার অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু কংগ্রেসীরা বোম্বে ও আহমেদাবাদের স্বার্থে এই উদ্যোগকে বাতিল করে দেয়। গোপালকৃষ্ণ গোখলে বলেছিলেন—চিরস্থায় বন্দোবস্তের কল্যাণে বাঙালি জমিদাররা অনেক টাকা পয়সা কামাই করেছে। সুতরাং তাদের দায়িত্ব—স্বদেশী মিল গড়ে তোলার জন্য মূলধন দেওয়া। রবীন্দ্রনাথ এর উত্তরে লিখেছিলেন বিলাসের ফাঁদ নামে একটি প্রবন্ধ। সেখানে বলেছিলেন, ইংরেজের অনুকরণে ব্যক্তিগত ভোগস্পৃহা চরিতার্থ করতে গিয়ে সেই অর্থ সমাজের কল্যাণে ব্যয়িত হতে পারছে না। তিনি লিখেছেন-- দেশের অধিকাংশ (জমিদারদের) অর্থ শহরে আকৃষ্ট হইয়া , কোঠাবাড়ি গাড়িঘোড়া সাজসরঞ্জাম আহারবিহারেই উড়িয়া যাইতেছে । অথচ যাঁহারা এইরূপ ভোগবিলাসে ও আড়ম্বরে আত্মসমর্পণ করিয়াছেন , তাঁহারা প্রায় কেহই সুখে স্বচ্ছন্দে নাই ; তাঁহাদের অনেকেরই টানাটানি , অনেকেরই ঋণ , অনেকেরই পৈতৃক সম্পত্তি মহাজনের দায়মুক্ত করিবার জন্য চিরজীবন নষ্ট হইতেছে—কন্যার বিবাহ দেওয়া , পুত্রকে মানুষ করিয়া তোলা , পৈতৃক কীর্তি রক্ষা করিয়া চলা , অনেকেরই পক্ষে বিশেষ কষ্টসাধ্য হইয়াছে।
বঙ্গভঙ্গ চলমান আন্দোলনের ক্ষেত্রে কংগ্রেসের দ্বিধা ও পশ্চাদপসারণ লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। বাংলার চরমপন্থী রাজনীতিকরা বয়কট ও স্বদেশীকে স্বরাজের প্রধান হাতিয়ার রূপে ভাবতে শুরু করেছিল।
সে সময় সপ্তম এডওয়ার্ডের পুত্র যুবরাজ ও তাঁ স্ত্রী ভারত সফরে এসেছিলেন। কংগ্রেসের পক্ষ থেকে তাদেরকে স্বাগত জানানো হয়েছিল। তারা এই জন্যই চেয়েছিলেন বৃটিশকে বেশী ঘাটানো যাবে না। কংগ্রেসে অন্যতম নেতা ভূপেন্দ্রনাথ বসু ২৯ পিসেম্বর বারানসির কংগ্রেস সম্মলনের অধিবেশন থেকে ছুটে এসে কোলকাতায় স্টীমার ঘাটায় উপস্থিত হয়েছিলেন যুবরাজকে অভ্যর্থনা জানাতে। সেদিন কোলকাতার গোলদীঘিতে স্বদেশী সভা চলছিল। ভূপেন্দ্রনাথ বসু যুবরাজকে অভ্যর্থনা জানিয়েই জাহাজ ঘাটা থেকে গোলদীঘীর স্বদেশী সভায় যোগ দেন। হোমপ্রসাদ ঘোষ লিখেছেন, লোকে তাঁকে দেখিয়া উত্তজিত হইয়া উঠিয়া—তাহাকে ধিক্কার দিল। দুই দলে মতান্তর যত স্পষ্ট হইতে লাগিল, ততই ছাড়াছাড়ি হইতে লাগিল।
বঙ্গভঙ্গ ও স্বদেশী আন্দোলন শুরু হলে ইংরেজ সরকার দমননীতি গ্রহণ করে। পূর্ব ও আসামের লেফটেন্যান্ট স্যার বামফিল্ড ফুলার ন্যায়বিচারের তোয়াক্কা না করে নির্বিচারে দমন-পীড়ন শুরু করে দেয়। এটা নিয়েও রবীন্দ্রনাথের অনেক ক্ষোভ ছিল। ১৯০৬ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি কোলকাতায় গ্রান্ড থিয়েটারে স্বদেশী আন্দোলনরত নির্বাচিত কিছু ব্যক্তিকে সম্বর্ধনা দেওয়া হয়। রবীন্দ্রনাথ সেখানে একটি লিখিত বক্তব্য পাঠিয়েছিলেন। লিখেছিলেন, বাংলাদেশের বর্তমান স্বদেশী আন্দোলনে কুপিত রাজদণ্ড যাঁহাদিগকে পীড়িত করিয়াছে, তাঁহাদের প্রতি আমার নিবেদন এই যে, তাহাদের বেদনা যখন আজ সমস্ত বাংলাদেশের হৃদয়ের মধ্যে বহন করিয়া লইল, তখন এত বেদনা অমৃতে পরিণত হইয়া তাহাদিগকে অমর করিয়া তুলিয়াছে। রাজচক্রের যে অপমান তাঁহাদের অভিমুখে নিক্ষিপ্ত হইয়াছিল, মাতৃভূমির করুণ করস্পর্শ তাহা বরমাল্যরূপে ধারণ করিয়া তাহাদের ললাটকে আজ ভূষিত করিয়াছে।
দেশী শিল্প-ব্যবসা-বানিজ্য গড়ে তোলার লক্ষ্যে ১৮ মার্চ কোলকাতায় একটি দেশী ইন্সুরেন্স কোম্পানী যাত্রা শুরু হয়। রবীন্দ্রনাথও এই ইন্সুরেন্স কোম্পনীর সঙ্গে ছিলেন।
এই সময়কালে রবীন্দ্রনাথ আরও বেশি করে বঙ্গভঙ্গ ও স্বদেশী আন্দোলন থেকে সরে এসেছেন। জাতীয় শিক্ষাআন্দোলনের নেতৃবৃন্দের ব্যক্তিগত মতবিরোধ ও রাজনৈতিক নেতৃত্ত্বের এই আন্দোলনের প্রতি অনীহাকে তিনি অপছন্দ করেছেন। কিন্তু পুরোপুরি শিক্ষার আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করেননি।
ইতিমধ্যে রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী মারা গেছেন। সেজো মেয়েটিরও অসুস্থ হয়ে হয়ে আছে। মাতৃহীন ছোটো ছেলেটি আর ছোটো মেয়েটিকে দেখভাল করার মত লোকও তেমন পাচ্ছেন না। বড়ো ছেলেকে পাঠিয়ে দিয়েছেন বিলেতে কৃষি বিদ্যা শেখার জন্য। অর্থ সংকট রয়েছে। ধীরে ধীরে গড়ে তুলতেন শান্তি নিকেতন—বিদ্যালয়। তার সকল দ্বায়িত্ব তাঁর একার উপর। আর রয়েছে বিপুল রচনাকর্মের তাড়না। সংসার এবং কর্মজাল থেকে ধীর ধীরে মুক্তি চাচ্ছিলেন। তাছাড়া ঈশ্বরমুখীন এক ধরনের আধ্যাত্মিকতাও তাঁর মধ্যে কাজ করছে। ফলে তিনি এইসব সংশয়াপন্ন, দোদুল্যমান, সুবিধাবাদী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে আগ্রহ প্রকাশ করছিলেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন হৃদয়বৃত্তি আর রাজনীতির মধ্যে ব্যবধান দুস্তর। রাজনীতি ছলনাপূর্ণ হতে পারে—হৃদয়কে সে গণ্যকে করে না।
১৪ এপ্রিল বরিশালে তিনদিনব্যাপী সাহিত্য সম্মেলন শুরু হয়। ব্যারিস্টার আবদুল রসুল সম্মেলনের সভাপতি ছিলেন। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এমারসন বরিশালের রাস্তায় তখন বন্দে মাতরম ধ্বনি দেওয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। ব্যারিস্টার আবদুল রসুলকে সামনে রেখে শোভাযাত্রা বের হয়েছিল। রাস্তায় বেরিয়েই শোভাযাত্রা থেকে বন্দেমাতরম ধ্বনি দেওয়া শুরু হয়। পুলিশ তখন বেধড়ক মারপিঠ করে শোভাযাত্রায়। কংগ্রসের নেতা সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদ করায় পুলিশের হাতে তিনি আটক হন। ৪০০ টাকা জরিমানা দিয়ে তিনি ছাড়া পান। দ্বিতীয় দিনের সম্মেলন শুরু হলে পুলিশের সুপারিনটেনডেন্ট কেম্প ঘোষণা কর সম্মেলনস্থলে বন্দেমাতরম ধ্বনি দেওয়া হবে না এই মর্মে নিশ্চিত করা হলে সম্মেলনের অনুমতি দেওয়া হবে। কেম্পের এই দাবী মানতে নেতৃবৃন্দ অস্বীকার করলে তখন সম্মেলন বন্ধ করে দেয় পুলিশ। তৃতীয় দিনে সম্মলনে রবীন্দ্রনাথের অংশ নেওয়ার কথা ছিল। তিনি এই উপলক্ষ্যে বরিশালে উপস্থিতও হয়েছিলেন। তাঁকে রাখা হয়েছিল কীর্ত্তনখোলা নদীবক্ষে। সম্মেলনে পণ্ড হয়ে গেলে তিনি ফিরে যান। এ ঘটনায় কংগ্রেস নেতা সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় হিরো মর্যাদাপ্রাপ্ত হন বঙ্গে। কোলকাতা ফেরার সময় তাঁর গাড়ি মানুষেরা টেনে শোভাযাত্রা সহকারে ইংরেজ স্টাইলে শহরে আনা হয়। রবীন্দ্রনাথ এই বিদেশী প্রথার সমালোচনা অনেক থেকেই করে আসছিলেন। তিনি জানেন, দেশ থেকে ইংরেজ তাড়ালেই হয় না—মন থেকে ইংরেজকে তাড়ানোর দরকার আগে। দেহের আগে আত্মার স্বাধীনতা দরকার। বিদেশী তাড়ানোর আগে স্বদেশী হওয়াটাই সবার চেয়ে জরুরী।
রবীন্দ্রনাথ ২১ এপ্রিল দীনেশচন্দ্র সেনকে চিঠিতে লেখেন, আত্মার স্বাধীনতা ছাড়া আর কোনো স্বাধীনতা নাই—আমরা নতুন বন্ধনকেই মুক্তি বলিয়া ভ্রম করি। আমি এ সময়ে জঞ্জালের মধ্যে নিজেকে জড়াইয়া লক্ষ্যভ্রষ্ট হইতে চাই না—বেশ একটু নিরালায় ভাল করিয়া নিজের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করিয়া লই—আগে নির্মল অন্তঃকরণে সমস্ত জিনিসটাকে তলাইয়া দেখি—তারপর যদি কথা বলার আবশ্যক হয় ত কথা বলিব। আমি এখন লোকলোচনের অন্তরালে থাকিতে ইচ্ছা করি—আমার আর যশোমানে কাজ নাই। ভিড়ের মধ্যেই যদি দিন কাটাই তবে ঘরের কাজ কখন করিব? এতএব এবারে আমি সরিয়া পড়িলাম।
২৬ এপ্রিল বরিশাল নির্যাতন-পীড়নের প্রতিবাদে রাই পশুপতিনাথের বাড়িতে আয়োজিত সভায় রবীন্দ্রনাথ দেশনায়ক প্রবন্ধটি পড়েন। তিনি লিখেছেন--আপনারা ভাবিয়া দেখুন, বাংলার পার্টিশনটা আজ খুব একটা বড়ো ব্যাপার নহে। আমরা তাহাকে ছোটো করিয়া ফেলিয়াছি। ...এই পার্টিশনের আঘাত উপলক্ষে আমরা সমস্ত বাঙালি মিলিয়া পরম বেদনার সহিত স্বদেশের দিকে যেমনি ফিরিয়া চাহিলাম অমনি এই পার্টিশনের কৃত্রিম রেখা ক্ষুদ্র হইতে ক্ষুদ্র হইয়া গেল। আমরা যে আজ সমস্ত মোহ কাটাইয়া স্বহস্তে স্বদেশের সেবা করিবার জন্য প্রস্তুত হইয়া দাঁড়াইয়াছি, ইহার কাছে পার্টিশনের আঁচড়টা কতই তুচ্ছ হইয়া গেছে। কিন্তু আমরা যদি কেবল পিটিশন ও প্রোটেস্ট্, বয়কট ও বাচালতা লইয়াই থাকিতাম, তবে এই পার্টিশনই বৃহৎ হইয়া উঠিত—আমরা ক্ষুদ্র হইতাম, পরাভূত হইতাম। কার্লাইলের শিক্ষা-সার্ক্যুলর আজ কোথায় মিলাইয়া গেছে। আমরা তাহাকে নগণ্য করিয়া দিয়াছি। গালাগালি করিয়া নয়, হাতাহাতি করিয়াও নয়। গালাগালি-হাতাহাতি করিতে থাকিলে তো তাহাকে বড়ো করাই হইত।
যাঁহারা পিটিশন বা প্রোটেস্ট্, প্রণয় বা কলহ করিবার জন্য রাজবাড়ির বাঁধা রাস্তাটাতেই ঘন ঘন দৌড়াদৌড়ি করাকেই দেশের প্রধান কাজ বলিয়া গণ্য করেন আমি সে দলের লোক নই সে কথা পুনশ্চ বলা বাহুল্য। আজ পর্যন্ত যাঁহার দেশহিতব্রতিদের নায়কতা করিয়া আসিতেছেন তাঁহারা রাজপথের শুষ্ক বালুকায় অশ্রু ও ধর্ম সেচন করিয়া তাহাকে উর্বরা করিবার চেষ্টা করিয়া আসিয়াছেন, তাহাও জানি। ইহাও দেখিয়াছি, মৎস্যবিরল জলে যাহারা ছিপ ফেলিয়া প্রত্যহ বসিয়া থাকে অবশেষে তাহাদের, মাছ পাওয়া নয়, ঐ আশা করিয়া থাকাই একটা নেশা হইয়া যায়। ইহাকে নিঃস্বার্থ নিষ্ফলতার নেশা বলা যাইতে পারে, মানবস্বভাবে ইহারও একটা স্থান আছে। কিন্তু এজন্য নায়কদিগকে দোষ দিতে পারি না, ইহা আমাদের ভাগ্যেরই দোষ। দেশের আকাঙ্ক্ষা যদি মরীচিকার দিকে না ছুটিয়ে জলাশয়ের দিকেই ছুটিত তবে তাঁহারা নিশ্চয় তাহাকে সেই দিকে বহন করিয়া লইয়া যাইতেন, তাহার বিরুদ্ধপথে চলিতে পারিতেন না।
দেশের হিতসাধন একটা বৃহৎ মঙ্গলের ব্যাপার, নিজের প্রবৃত্তির উপস্থিত চরিত্রার্থসাধন তাঁর কাছে তুচ্ছ। ঠিক এই উপস্থিত চরিতার্থসাধনটিকে রবীন্দ্রনাথকে হতাশ করেছিল। তিনি দেখেছিলেন এর মধ্যে দেশের বৃহৎ মঙ্গল সাধনের আকাঙ্খাটা নেই। এ কারণে এই তার কাছে দেশে সম্প্রতি যে আন্দোলন-আলোচনার ঢেউ উঠেছে তার অনেকটাই কলহ মাত্র মনে হয়েছে। কলহ অক্ষমের উত্তেজনাপ্রকাশ, তাহা অকর্মণ্যের একপ্রকার আত্মনিবেদন। এইখানে এসে তিনি বয়কট আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর বিরোধীতার জায়গাটিকে পরিস্কার করে দিচ্ছেন। তিনি বলেছেন, আপনাদের কাছে আমি স্পষ্টই স্বীকার করিতেছি, বাঙালির মুখে ‘বয়কট’ শব্দের আস্ফোলনে আমি বারংবার মাথা হেঁট করিয়াছি। আমাদের পক্ষে এমন সংকোচজনক কথা আর নাই। বয়কট দুর্বলের প্রয়াস নহে, ইহা দুর্বলের কলহ। আমি নিজের মঙ্গলসাধনের উপলক্ষ্যে নিজের ভালো করিলাম না, আজ পরের মন্দ করিবার উৎসাহেই নিজের ভালো করিতে বসিয়াছি, এ কথা মুখে উচ্চারণ করিবার নহে। আমি অনেক বক্তাকে উচ্চৈঃস্বরে বলিতে শুনিয়াছি--’আমরা য়ুনিভার্সিটি বর্জন করিব।‘ কেন করিব। য়ুনিভার্সিটি যদি ভালো জিনিস হয়, তবে তাহার সঙ্গে গায়ে পড়িয়া আড়ি করিয়া দেশের অহিত করিবার অধিকার আমাদের কাহারো নাই।...দেশের যাহাতে ইষ্ট, তাহা যেমন করিয়াই হউক সংগ্রহ করিতে হইবে, সেজন্য সমস্ত সহ্য করা পৌরুষের লক্ষণ—তাহার পর সংগ্রহকার্য শেষ হইলে স্বাতন্ত্র্যপ্রকাশ করিবার দিন আসিতে পারে।
তিনি আরও সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, আজ আমরা দেশের কাপড় পরিতেছি কেবল পরের উপর রাগ করিয়া, এই যদি সত্য হয়, তবে দেশের কাপড়ের এতবড়ো অবমাননা আর হইতেই পারে না। আজ আমরা স্বায়ত্তভাবে দেশের শিক্ষার উন্নতিসাধনে প্রবৃত্ত হইয়াছি, রাগারাগিই যদি তাহার ভিত্তিভূমি হয়, তবে এই বিদ্যালয়ে আমরা জাতীয় অগৌরবের স্মরণস্তম্ভ রচনা করিতেছি।
১৯০৬ সালের ৪ জুন কোলকাতার পান্তির মাঠে শিবাজী-উৎসব পালিত হয়। সেখানে শিবাজী-মেলা উপলক্ষ্যে উৎসবের প্রবর্তক চরমপন্থী বালগঙ্গাধ তিলককে সম্বর্ধনা দেওয়া হয়। উৎসবে সখারাম গণেশ দেউস্কর-প্রণীত শিবাজী পুস্তিকাটি বিতরণ করা হয়। স্বদেশি আন্দোলনকে হিন্দুরূপ দেওয়ার প্ররোচনামুলক ও অদূরদর্শী প্রচেষ্টা সূত্রপাত হয় এই উৎসব থেকেই। রবীন্দ্রনাথ এই উৎসবকে লক্ষ্মীছাড়া বিশেষণে ভূষিত করেন। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের ক্রমবর্ধমান হিন্দুয়ানী রূপটিও তাঁর এই আন্দোলন থেকে সরে আসার অন্যতম কারণ। তিনি চরমপন্থী আন্দোলনেরও তীব্র বিরোধিতা করেন। ঘরে বাইরে উপন্যাসে চরমপন্থী আন্দোলন বিষয়ে তার বক্তব্য পাওয়া যায়।
বয়কট আন্দোলন জোরদার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এইসব চরমপন্থীরা ব্রিটিশ পণ্য না-কেনা, তাতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া ইত্যাদি কাণ্ডগুলো ঘটনাতে শুরু করে। তাতে সাফল্য আসে খুব অল্পই। এ আন্দোলনের ফলে কোনো কোনো পণ্যের দাম বেড়ে যায়। কোনো কোনো পণ্য রাতারাতি বাজার থেকে উধাও হয়ে যায়। সেটা কিনতে হয় চড়া দামে লুকিয়ে চুরিয়ে। বিশেষ করে বস্ত্র ব্যবসায়ী মুসলমান তাঁতী বা জোলা সম্প্রদায় ক্ষতিগ্রস্থ হয় সবচেয়ে বেশি। ফলে অধিকাংশ মুসলমান এর বিরোধিতা করেছিলেন। তারা ছিলেন নিম্নবর্গের মানুষ। তাদের আয়ই ছিল এই বস্ত্রব্যবসা। তাদের পূঁজীও ছিল সামান্য। বিদেশী সুতার দাম অপেক্ষাকৃত কম হওয়ায় এই সুতা কিনে তারা বস্ত্র বয়ন করত। তার দামও ছিল কম। পাশাপাশি বিদেশী বস্ত্রের দামও কম থাকায় এগুলোও তারা হাটে বিক্রি করত। এই ছোট ব্যবসা থেকে তারা কোনোক্রমে বেঁচেবর্তে থাকত। কিন্তু স্বদেশী শিক্ষিত বাবুরা যখন গ্রাম্য হাঁটে-বাজারে তাদের এই বিদেশী বস্ত্র বিক্রি বন্ধ করে দিল, তাদের কারো কারো বস্ত্র পুড়িয়ে দিয়ে তাদের কপর্দক শূন্য করে দিল, এর বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ গর্জে উঠেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এভাবে জোর করে আদর্শ চাপানো যায় না। তিনি ঘরে-বাইরে উপন্যাসে এর তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন।
ঘরে বাইরের মাস্টার মশায়ের বয়ানে স্বদেশীদের বয়কটপন্থীদের উদ্দেশ্য বলেছিলেন—
তোমাদের মনে (বৃটিশের উপর) রাগ হয়েছে, জেদ হয়েছে, সেই নেশায় তোমরা যা করছ খুশি হয়ে করছ। তোমাদের পয়সা আছে, তোমরা দু পয়সা বেশি দিয়ে দিশি জিনিস কিনছ, তোমাদের সেই খুশিতে ওরা তো বাধা দিচ্ছে না। কিন্তু ওদের তোমরা যা করাতে চাচ্ছ সেটা কেবল জোরের উপরে। ওরা প্রতিদিনই মরণ-বাঁচনের টানাটানিতে পড়ে ওদের শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত লড়ছে কেবলমাত্র কোনোমতে টিঁকে থাকবার জন্যে— ওদের কাছে দুটো পয়সার দাম কত সে তোমরা কল্পনাও করতে পার না— ওদের সঙ্গে তোমাদের তুলনা কোথায়? জীবনের মহলে বরাবর তোমরা এক কোঠায়, ওরা আর-এক কোঠায় কাটিয়ে এসেছে ; আর আজ তোমাদের দায় ওদের কাঁধের উপর চাপাতে চাও, তোমাদের রাগের ঝাল ওদের দিয়ে মিটিয়ে নেবে? আমি তো একে কাপুরুষতা মনে করি। তোমরা নিজে যত দূর পর্যন্ত পার করো, মরণ পর্যন্ত— আমি বুড়োমানুষ, নেতা বলে তোমাদের নমস্কার করে পিছনে পিছনে চলতে রাজি আছি। কিন্তু ঐ গরিবদের স্বাধীনতা দলন করে তোমরা যখন স্বাধীনতার জয়পতাকা আস্ফালন করে বেড়াবে তখন আমি তোমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াব, তাতে যদি মরতে হয় সেও স্বীকার।
... মাস্টারমশায় বললেন, শুধু তাই নয়, যারা (বয়কট) ব্রত নিয়েছে তারা বিব্রত করবারই ব্রত নিয়েছে। তোমরা চাও, যারা ব্রত নেয় নি তারাই ঐ (দেশী দামী) সুতো কিনে যারা ব্রত নেয় নি এমন লোককে দিয়ে কাপড় বোনাবে, আর যারা ব্রত নেয় নি তাদের দিয়ে এই কাপড় কেনাবে। কী উপায়ে? না তোমাদের গায়ের জোরে আর জমিদারের পেয়াদার তাড়ায়। অর্থাৎ ব্রত তোমাদের কিন্তু উপবাস করবে ওরা, আর উপবাসের পারণ করবে তোমরা।
এই বস্ত্রবয়কটের জোরজবরদস্তির কারণে সে সময় ফরিদপুরে ছোটোখাটো দাঙ্গা পর্যন্ত হয়েছিল। দরিদ্র জোলা সম্প্রদায়ের মানুষ এই স্বদেশী বাবুদের রুখে দিয়েছিল। এই আন্দোলনের সঙ্গে নিম্নবিত্ত মানুষেরও যোগ ছিল না। তাদের মতামত কখনোই নেওয়া হয়নি। তাদের স্বার্থের দিকে রাজনৈতিক নেতারা বা এই স্বদেশীবাবুরা খুব কমই তাকিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ এগিয়ে এসেছিলেন। তিনি তাঁর পূর্ববঙ্গের জমিদারী এলাকায় তাঁতের স্কুল বসিয়েছিলেন। তাঁদেরকে কম দামে সুতো কিনে দিয়েছিলেন। জোলা প্রজাদের উৎপাদিত বস্ত্রবিক্রির চেষ্টাও করেছিলেন। তবে এই কাজে যাদের উপর তিনি নির্ভর করেছিলেন—তারা তাঁকে আর্থিকভাবে ঠকিয়েছিল। সেটা অন্য ইতিহাস।
বঙ্গভঙ্গকে উপলক্ষ্য করে বাংলাদেশের হিন্দু-মুসলমানের ভেদরেখাটি প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছিল। এই ধরনের বিরোধের নজির ইতিপূর্বে ছিল না। মুসলমানদের মনে তাদের না পাওয়ার বেদনাটি জেগে উঠেছিল। মুসলমান শাসনকালে মুসলমান সম্প্রদায় হিন্দুদের সংকীর্ণতাকে ক্ষমার চোখে দেখেছে, দেখে তারা ঠকেছে—কিন্তু ইংরেজ আমলে হিন্দুদের এই সংকীর্ণতা প্রবল হয়েছে, তখন মুসলমান সমাজ সে ক্ষমার জগৎ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তারা বৈষম্যকে রুখে দাঁড়াতে চেয়েছে বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করে। শিক্ষিত মুসলমান আবিষ্কার করলেন, তারা রাষ্ট্র কাঠামোতে হিন্দুদের চেয়ে অনেক পিছিয়ে। এই পিছিয়ে থাকার কারণটি দুরীভূত করার কোনো চেষ্টাই করেনি হিন্দু জমিদার-উচ্চবিত্ত শ্রেণী। হিন্দুদের সঙ্গে থাকলে তাঁরা সে ধরনের সুযোগও পাবে না। পরিস্থিতিটা সত্যি ছিল। তবে এই পরিস্থিতিটা ইংরেজের সৃষ্টি ছিল। ইংরেজরা হিন্দুদেরই রাষ্ট্রে বেশী বেশী সুযোগ সুযোগ দিয়েছে, আর মুসলমানদের বঞ্চিত করে রেখেছে। কিন্তু যখন বঙ্গদেশে ইংরেজবিরোধী চেতনা জাগতে শুরু করেছে—তখন থেকেই চেতনার শক্তিটাকে নস্যাৎ করার জন্য ইংরেজরা মুসলমানদের মনে এই বঞ্চনার কারণটি হিন্দুদের ঘাড়ে চাপায়। এবং তাদের প্রতি বিভেদ সৃষ্টির কৌশল করে সফল হয়। এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদী নেতারা এই হিন্দু-মুসলমানদের বিভেদের কারণটি কখনো কার্যকরভাবে দূর করার কোনো উদ্যোগ নেয়নি। একমাত্র রবীন্দ্রনাথই শুরু থেকে এই বিভেদের দিকে সকলের উদ্দেশ্য বক্তব্য দিয়েছে। বলেছেন শিক্ষা-দীক্ষা-পেশাসহ অর্থনৈতিক দিক থেকে মুসলমানদের হিন্দুদের সমকক্ষ করার ব্যবস্থা করা ছাড়া এই বিভেদ দূর হতে পারে না। জীবিকার মিলে, সামাজিক আচার-আচরণের মিলে, সাহিত্য-সাধনার মিলে, সর্বোপরি মনুষ্যত্বের মিলে এ ভেদবুদ্ধি দূর হতে পারে। দুই সম্প্রদায়ের আর্থ-সামাজিক সমতা মিলনের, সেই সূত্রে স্বশাসনের চাবিকাঠি। এ জন্য প্রয়োজনে হিন্দুদেরই বেশী ছাড় দিতে হবে। এক্ষেত্রে রাজনীতিকরা ছিলেন রবীন্দ্রনাথের উল্টোপথে। তারা মিলনের কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। ফলে, বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনটা হয়ে উঠেছিল—একটা যতুগৃহ বা মোমের ঘর। একটু স্ফুলিঙ্গ পেলেই ফস করে জ্বলে উঠেছিল। পুরো গৃহটি পুড়ে গিয়েছিল। ঠেকানোর কোনো সুযোগ ছিল না। পুরো বঙ্গদেশটি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে ৪০-৪২ বৎসর সময়ের মধ্যে। দেখা যায় ১৯০৬ সালে রাজনৈতিক কারণে হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গারও শুরু হয়। এই সময় থেকে হিন্দুরা মসজিদের সামনে জোরে জোরে ঢাক ঢোল পিটাতে শুরু করে, আর মুসলমানরাও বেশি বেশি প্রকাশে গরু কোরবানী দিতে শুরু করে। সহনশীলতাটার হ্রাস ঘটতে শুরু করে।
এই বিভেদ রেখাটি ধরে ১৯০৬ সালে ডিসেম্বর মাসে স্যার সলিমুল্লাহর আহ্বানে ঢাকায় মুসলিম লীগের জন্ম হয়। এই মুসলিম লীগ মুসলমান জমিদার, উচ্চবিত্ত মুসলমানদের উদ্যোগে গড়ে উঠলেও সকল শ্রেণীর মুসলমানের সমর্থন লাভ করে। ভাগ্যের পরিহাস যে, একই সময়ে হিন্দু মহাসভা নামে হিন্দু মৌলবাদী সংগঠনও গড়ে ওঠে।
বঙ্গভঙ্গের সময়ে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন দানা বাঁধে। তখনকার শিক্ষিত তরুণদের এক অংশ মনে করেছে—কংগ্রেসের সাংবিধানিক আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আসবে না। এলেও সেটা দেরী করে আসবে। অথবা বৃটিশ যদি দয়া করে দেয়, তবেই সেই স্বাধীনতা পাওয়া যাবে।
১৯০৫ সালে বারীন্দ্রকুমার ঘোষের নেতৃত্বে অনুশীলন নামে একটি গড়ে ওঠে। এই গোষ্ঠীর লক্ষ্য ছিল সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতকে স্বাধীন করা। এই আন্দোলন তখনকার শিক্ষিত হিন্দুদের মনে অসাধারণ উৎসাহ সৃষ্টি সৃষ্টি করেছিল। এ আন্দোলনের একটা সাম্প্রদায়িক রূপও প্রকট ছিল। মুসলমান সম্প্রদায় সে কারণেই এই সন্ত্রাসবাদি আন্দোলনে যোগ দেননি। বা তাকে সমর্থনও দেননি। এমন কি বন্দে মাতরম গানটিও ছিল মুসলমানদের কাছে অসহনীয়। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, বন্দে মাতরম গানটিতে মুসলমানদের আপত্তি করার জায়গা আছে। পরে জহরলাল নেহেরুর অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ গানটির সাম্প্রদায়িক অংশটি বাদ দেওয়ার প্রস্তাব করেন। সন্ত্রাসবাদীরা এই সংশোধিত বন্দে মাতরমকে মেনে নেননি। তারা তাদের আন্দোলনের শক্তি হিসাবে কালীকে/দুর্গাকে দেখতে শুরু করেছিলেন। তাঁদের মন্ত্র হয়ে উঠেছিল গীতা। এই সব কারণ এই আন্দোলনে মুসলমানদের অংশগ্রহণের বাঁধা সৃষ্টি করেছে। তাঁদেরকে দূরে সরিয়ে রেখেছে।
রবীন্দ্রনাথ এই সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের সবর্নাশা রূপটি একেছেন তার ঘরে বাইরে উপন্যাসে। তারা ছিল ব্যক্তিগত লোভমোহের উর্ধ্ব উঠতে পারেনি। বিপ্লবীপনাতে এসেও বাবুপনা এদের ঘোঁচেনি। ফলে দরিদ্র মানুষ তখনো তাদের কাছে ব্রাত্যই ছিল। জনগণের কাছ থেকে ছিল বিচ্ছিন্ন। একপর্যায়ে ডাকাতি-দস্যুতার মত উপায়ও তারা গ্রহণ করেছে। রবীন্দ্রনাথের ঘরে বাইরের সন্দ্বীপ চরিত্রটি এই সন্ত্রাসবাদি নেতাদের মনে রেখেই নির্মাণ করেছিলেন। এরা স্বদেশকে গড়ার ব্রতটা গ্রহণ করেনি। এদের সে ধরনের পরিকল্পনাও ছিল না। ফলে শুধু মুসলমান সম্প্রদায়ই নয়, এদের আন্দোলনের সঙ্গে নিম্নবর্গের হিন্দুদেরও সমর্থন ছিল না।
জাতীয় শিক্ষার আন্দোলনটি বাস্তববুদ্ধি ও আন্তরিকতার অভাবে দ্বিধাবিভক্ত হয়েছিল। সাহিত্য, বিজ্ঞান ও কারিগরী এই ত্রিমুখী শিক্ষার সংকল্প নিয়ে পরিষদ গঠিত হয়েছিল। কিন্তু তারকানাথ পালিত, ডাঃ নীলরতন সরকার, মণীন্দ্রনাথ সরকার প্রমুখ নেতারা কারিগরী শিক্ষার উপর জোর দিয়েছিলেন পরিষদের আর্থিক সংগতি ও দেশের প্রয়োজনের দিকটির কথা মনে রেখে। অন্যরা এটা মানেননি। ১৯০৬ সালের ১ জুন জাতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একটি নয়—দুপক্ষ দুটি প্রতিষ্ঠানকে ইংরেজের আইনঅনুসারে রেজিস্ট্রশন করা হয়। তবে বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ এন্ড স্কুলই সক্রিয় ছিল। রবীন্দ্রনাথকে এই প্রতিষ্ঠানের বাংলা বিভাগের ডাইরেক্টর করা হয়েছিল। জাতীয় প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু হলে হলেও কলকাতা ও মফস্বলের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই এই জাতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অন্তর্ভুক্ত হয়নি। তারা ইংরেজের কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংঙ্গেই থেকেছে। জাতীয় শিক্ষাপরিষদের পরিকল্পনাঅনুসারে পাঠ্যপুস্তক রচিত হয়নি। উত্তীর্ণ ছাত্রদেরকে উচ্চশিক্ষা ও কর্মনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়নি। ফলে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিট্যুটের সঙ্গে মিলিত হয়ে বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ এন্ড টেকনিক্যাল ইনস্টিট্যুট নাম ধারণ করে। এবং অধিকাংশ সম্পদ কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে বিজ্ঞান কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য দান করে দেয়। ১৯০৬ সালের মার্চ মাসে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর পদে ডঃ আশুতোষ মুখোপাধ্যায় নিয়োগ পেলে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ পুরোপুরি মুখ থুবড়ে পড়ে।
রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পারেন—তাঁর স্বদেশ অন্যদের স্বদেশের চেয়ে আলাদা। তিনি তাঁর মতো করে তাঁর স্বদেশের কাছে ফিরে গেলেন—গেলেন পূর্ববঙ্গে, পল্লীপূনর্গঠনে।
মন্তব্য
এখানে নতুন বলে সিরিজটা প্রথম থেকে ফলো করা হয়নি। সময় করে একদম প্রথম থেকে পড়ে নেব। তখন হয়তো আরো কথা ব্ আমার কোন জিজ্ঞাসা থাকলে সেটা নিয়ে আলোচনা করা যাবে। খুব তাড়াতাড়ি ই শুরু করবো।
আপনার লেখা খুব সাবলীল, তাই পড়তে খব বেশী দিন লাগবে না আশা করি।
ভালো থাকা হোক।
__________________________
বুক পকেটে খুচরো পয়সার মতো কিছু গোলাপের পাঁপড়ি;
ধন্যবাদ আপনাকে। এখানে পুরো সিরিজের লিংক--
...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'
মন্তব্য করা হয়ে উঠেনা নানা কারনে, তবে আপনার এই সিরিজটা আমি নিয়মিতো পড়ি। আপনাকে আমার একটা প্রশ্ন করার ছিলো। লেখাটাতে লেখক হিসেবে আপনার ও জালাল ভায়ের দুজনেরই নাম আছে। আমি আপনার লেখার সাথে পরিচিত, এটা আপনার লেখা। তাহলে জালাল ভায়ের নাম ব্যবহার করছেন কেন? তিনি কী আপনাকে তথ্য দিয়ে সাহায্য করছেন?
--------------------------------------------------------------------------------
নতুন মন্তব্য করুন