কুলদা রায়
এমএমআর জালাল
রবীন্দ্রনাথের পল্লী-পূনর্গঠন খণ্ড-১
লর্ড কর্নওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বঙ্গদেশে যে জমিদারী প্রথার সৃষ্টি করেছিল-তাদের সঙ্গে প্রজাদের সম্পর্ক খুবই কম ছিল। তারা বাস করতেন কোলকাতা শহরে। লোকজন দিয়ে জমিদারী এলাকার প্রজাদের ঘাড় ভেঙে খাজনা আদায় করতেন। আর কোলকাতায় বাবুবিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দিতেন। প্রজারা বাঁচল কি মরল এটা তাদের জানার বাইরে ছিল। এদের মধ্যে যারা মাঝেসাজে প্রজাশাসনে জমিদারী এলাকায় গিয়েছেন তাদের একটি অংশ শিকারটিকার করে ঘুরে আসতেন। ঠাকুরবাড়ির দেবেন্দ্রনাথ, গনেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এই ঘরাণারই জমিদার ছিলেন। তবে শিকারের বাইরে দেবেন্দ্রনাথ ধর্মপ্রচার করতেন, জ্যোতিরিন্দ্র ছবিও আঁকতেন। এই সব বিলাসী জমিদাররা কখনো কৃষি ও কৃষির সমস্যা নিয়ে ভাবেননি। বৃটিশ শাসনে সে সময়ে বঙ্গদেশের কৃষি ও কুটিরশিল্প প্রায় ধ্বংসের মুখে এসে দাঁড়িয়েছিল।
এর মধ্যে পিতার আদেশে রবীন্দ্রনাথ জমিদারী পরিচালনায় শিলাইদহে এসেছিলেন ১৮৮৯ সালে। পতিসরে ১৮৯১ সালে। ১৮৯৬ সালে মৃণালিনীদেবীসহ ছেলেমেয়েদের বাস করতে শুরু করেন। তার জমিদারী পরিচালনার বেশীরভাগ সময়টাই কুঠিবাড়ি ছেড়ে নদীর বুকে বোটে থেকেছেন। শিলাইদহ থেকে পতিসরের দূরত্ব অনধিক ৫০ মাইল। নদীপথে যেতে লাগত তিনদিন। রবীন্দ্রনাথ এই তিনদিনের পথেই যেতেন। ধীর লয়ে তার বোট চলত। নদীর তীরবর্তী গ্রামগুলো দেখতে দেখতে যেতেন। কখনো কোনো ঘাটে থেমে যেত। সেখানে নাইতে আসত গ্রামের মানুষ। গরুকে জল খাওয়াত আসত চাষীরা। তাদের আলাপ শুনতেন। কখনো হাঁটের পাশে রাখা হত তাঁর বোট। এই বোটের জানালার পাশে বসে দেখতেন মানুষকে, প্রকৃতিকে—আর মাঠের ফসলকে। তিনি এখানে শুধু দেখতেনই না—ভাবতেনও। পড়তেন। এবং লিখতেন। এ সময়ে তিনি শুধু প্রকৃতিকে দেখেই সময় কাটাননি—দেখেছেন প্রকৃতির কোলে বেড়ে ওঠা অসহায় মানুষগুলোকে। তিনি কেবল সুখকেই দেখেননি, দুঃখকেও দেখেছেন। দুঃখ দূর করার উপায় নিয়েও ভেবেছেন। দূঃখ দূর করার ভাবনাকে কাজে লাগিয়েছেন।
শিলাইদহের কাছারির কর্মচারী শচীন্দ্রনাথ অধিকারীর লেখায় রবীন্দ্রনাথের জমিদারী জীবনযাত্রার সুন্দর বিবরণী পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথ প্রতিদিন ব্রাহ্মমুহূর্তে ঘুম থেকে উঠে পড়তেন। উপাসনা করে সামান্য জলযোগ সেরে নিতেন। এর মধ্যে সূর্য লাল হতে শুরু করেছে। চারিদিকে মধুর হাওয়া। নরম আলো জাগছে। পাখিরা ডাকছে। রবীন্দ্রনাথ এর মধ্যে একাকী হাঁটতে বেরিয়েছেন। এভাবে প্রতিদিন ২-৩ মাইল হাঁটতেন। তাঁর একজন বরকন্দাজ দূরে থেকে তাঁকে অনুসরণ করত। কাছে এসে কবির নিজের মতো দেখা কাজে বিঘ্ন ঘটাত না। চাষীরা ততক্ষণে মাঠে কাজ করছে। তাঁকে দেখে বলছে, সালাম হুজুর। তিনি মৃদু হেসে তাঁদের কাছে এগিয়ে গেছেন। আলাপ করছেন তাদের জমিজিরেত নিয়ে। বলছেন তাদের ফসল নিয়ে কথা। শুনছেন তাঁদের আনন্দ বেদনার কথা। স্বপ্নভঙ্গ আর স্বপ্নগড়ার কথা।
সে সময়ে কৃষিবিভাগের কর্মরত ছিলেন কবি, গীতিকার ও নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। কবির সঙ্গে তাঁর ছিল বন্ধুত্ব। তাঁর কাছে যেতেন। আবার তাঁকে ডেকেও নিয়ে আসতেন শিলাইদহে। চাষীদের সমস্যা নিয়ে চলত তার সঙ্গে আলোচনা। জেনে নিতেন কৃষি উন্নয়নের কলাকৌশল। সে-খবরগুলো আবার পৌঁছে দিতেন চাষীদের কাছে কবি। বলেছেন উন্নত বীজ, সার, কৃষিযন্ত্র, ফলন, ফসলের রোগপোকা নিয়ে কথা।
চাষীসঙ্গ শেষে কুঠিবাড়িতে কবি ফিরতেন গুণ গুণ করে গান গাইতে গাইতে। বেলা এগারোটা পর্যন্ত বসত তাঁর কাছারি। আমলা ও প্রজাদের সঙ্গে হত তাঁর জমিদারী দরবার।
বেলা এগারোটা থেকে বারোটার মধ্যে খাবার খেয়ে নিতেন। তারপর সামান্য বিশ্রাম। দিবানিদ্রার অভ্যাস ছিল না। বসতেন লিখতে—পড়তে। বিকেলে আবার বেরোতেন হাঁটতে। এবার হাঁটতে হাঁটতে যেতেন গ্রামের পথে। দেখা হত গ্রামের মানুষের সঙ্গে। এভাবে তিনি বুঝে নিয়েছেন পল্লীপ্রকৃতির প্রকৃত রূপটি। তিনি বুঝে নিয়েছিলেন, এই পল্লীগ্রাম, গ্রামের মানুষ-ই স্বদেশ। গ্রামের উন্নয়ন হলে স্বদেশের উন্নতি হতে। সারা শরীরকে বাদ দিয়ে শুধু মুখমণ্ডলে রক্তপ্রবাহ হলে তাকে স্বাস্থ্য বলে না। রক্তপ্রবাহটা মুখমণ্ডলের মত সারা শরীরেই প্রবাহিত করা দরকার।
শ্রীনিকেতনে ইতিহাস ও আদর্শ ভাষণে কবি বলেছেন, প্রজারা আমাকে দর্শন করতে আসত, তাদের জন্য আমার দ্বার ছিল অবারিত—সন্ধ্যা হোক, রাত্রি হোক, তাদের কোনো মানা ছিল না। এক-এক সময় সমস্তদিন তাদের দরবার নিয়ে দিন কেটে গেছে, খাবার সময় কখন অতীত হয়ে যেত টের পেতাম না। আনন্দ ও উৎসাহের সঙ্গে এ কাজ করেছি। যে ব্যক্তি বালককাল থেকে ঘরের কোণে কাটিয়েছে, তার কাছে গ্রামের অভিজ্ঞতা এই প্রথম। কিন্তু কাজের দুরূহতা আমাকে তৃপ্তি দিয়েছে, উৎসাহিত করেছে, নূতন পথনির্মাণের আনন্দ আমি লাভ করেছি।
যতদিন পল্লীগ্রামে ছিলেম, ততদিন তাকে তন্ন তন্ন করে জানবার চেষ্টা আমার মনে ছিল। কাজের উপলক্ষে এক গ্রাম থেকে আর-এক দুর গ্রামের যেতে হয়েছে, শিলাইদহ থেকে পতিসর, নদীনালা-বিলের মধ্য দিয়ে—তখন গ্রামের বিচিত্র দৃশ্য দেখেছি। পল্লীবাসীদের দিনকৃত্য, তাদের জীবনযাত্রার বিচিত্র চিত্র দেখে প্রাণ ঔৎসুক্যে ভরে উঠত। আমি নগরে পালিত, এসে পড়লুম পল্লীশ্রীর কোলে—মনের আনন্দে কৌতুহল মিটিয়ে দেখতে লাগলুম। ক্রমে এই পল্লীর দুঃখদৈন্য আমার কাছে সুস্পষ্ট হয়ে উঠল, তার জন্য কিছু করব এই আকাঙ্ক্ষায় আমার মন ছটফট করে উঠেছিল। তখন আমি যে জমিদারি-ব্যবসায় করি, নিজের আয়-ব্যয় নিয়ে ব্যস্ত, কেবল বণিক-বৃত্তি করে দিন কাটাই, এটা নিতান্তই লজ্জার বিষয় মনে হয়েছিল। তারপর থেকে চেষ্টা করতুম—কী করলে এদের মধ্যে জীবনসঞ্চার হবে, এই প্রশ্নই আমাকে ভাবিয়ে তুলেছিল।
পূর্ববঙ্গের চাষীরা সে সময় ধানভিত্তিক এক ফসলী প্রকৃতিনির্ভর চাষব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল ছিল। আউশ বা গ্রীষ্মকালীন আমন বা বর্ষাকালটায় বন্যা খরার আক্রমণে প্রায় প্রতিবছরই ফসল নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আর এ মৌসুমেই ফসলের রোগপোকার উৎপাতও হয় বেশী। সে কারণে বঙ্গেদেশে চিরকাল সরব বা নীরব দুর্ভিক্ষ লেগেই থাকত। ফলে কৃষকের দুঃখের কোনো শেষ ছিল না। এই দুঃখ মোচনেরও কেউ ছিল না।
ধান কাটা শেষ হলে শীতকালে ফসলের মাঠ অবনাবাদী পড়ে থাকত। শীতকালে ফসলের রোগ-পোকার আক্রমণ কম থাকে। প্রয়োজনে কৃত্রিমভাবে পানি সেচ দেওয়া যায়। আবার বাঁধ দিয়ে পানি নিয়ন্ত্রণও করা যায়। এই মৌসুমে ফসল চাষটা অনেকটা নিরাপদ। ফসলের ফলনও বেশী হয়। এই কারণে এই শীতকালটা অনাবাদি মাঠগুলোকে ফসলের আওতায় আনা গেলে কৃষকের আয় বাড়ে। তাদের দুঃখ কমে। এবং নতুন ফসলের বাজার দরও ভালো পাওয়া যায়। কিন্তু দরিদ্র কৃষক আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে নতুন ফসল চাষে আগ্রহী হতে পারে না। নতুন ফসলের লাভজনক ফলন নিশ্চিত হলে তারা সেটাকে গ্রহণ করতে পারে।
এই পরিকল্পনাটিকে রবীন্দ্রনাথ কাজে লাগাতে শুরু করলেন। শুরু করলেন নতুন ফসল আলু চাষ দিয়ে। সে সময় কুষ্টিয়া পাবনা এলাকায় আলু চাষ ছিল না। আলু খাওয়ারও প্রচলন খুব বেশী ছিল না। কিছু আলু বাইরে থেকে আসত।
আলু দক্ষিণ আমেরিকার ফসল। ষোড়শ শতকে ইউরোপীয় নাবিক এই কন্দাল ফসলটি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়। ভারতে ওলন্দাজ নাবিকেরা আলু নিয়ে আসে। এবং তারপর চাষ শুরু হয়। রবীন্দ্রনাথ নৈনিতালে আলুচাষ দেখে এসেছিলেন। শীতকালীন ফসল হিসেবে এই আলু ফসলটি চাষ করার উদ্যোগ নেন তিনি শিলাইদহে। কৃষিবিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তারা এ ব্যাপারে তাঁকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করে। তিনি আলুচাষের জন্য কুঠিবাড়ির কাছে ২৫ একর জমি নেন। সে সময়ে ৫০ শতকে এক বিঘা হিসেব ধরা হত। বর্তমানে ৩৩ শতকে এক বিঘা জমির হিসাব করা হয় সরকারীভাবে।
কবি কিশোরী গ্রন্থে দ্বিজেন্দ্রনাথ বসু লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথ বর্ষান্তে, শীতের প্রারম্ভেই নৈনিতাল আলুর চাষ করিবেন, মনে মনে সংকল্প করিয়াছিলেন। রবীন্দ্রনাথ পশ্চিম দেশে গিয়া এই আলুর চাষ দেখিয়া আসিয়া, নিজের দেশে প্রবর্ত্তিত করিবেন, অনেক দিন হইতে তাঁহার অভিপ্রায় ছিল। ...আলুর চাষের প্রণালী বিশেষরূপে জানা আবশ্যক বিবেচনা করিয়া, ভারতের এগ্রিকালচার ডিপার্টমেন্টের অন্যতম সহকারী ডিরেক্টর, তাঁহার অন্যতম সুহৃদ, বঙ্গের সুপরিচিত ব্যঙ্গ ‘কবি’ শ্রীযুক্ত দ্বিজেন্দ্রলাল রায়কে নিমন্ত্রণ করিয়া শিলাইদহে লইয়া গিয়াছিলেন। তাঁহার নিকট হইতে আলু চাষের প্রকৃষ্ট পদ্ধতি সমস্ত অবগত হইলেন। তিনি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের মাধ্যমে ২৫ একর জমিতে চাষ করার প্রয়োজনীয় বীজ ও সার সরবারহ করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ১৮৯৯ সালের ৫ সেপ্টেম্বর চিঠি লিখে জানিয়েছেন রবীন্দ্রনাথকে, প্রিয় বরেষু/ কিছুমাত্র চিন্তিত হইবেন না। ঠিক সময়ে বীজ ও সার পহুছিবে। আপনি ইত্যবসরে জমীতে চাষ দিবার বন্দোবস্ত করেন।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের এই চিঠি থেকে জানা যাচ্ছে, রবীন্দ্রনাথ পানি সেচ দেওয়ার জন্যএকটি মোটরচালিত সেচযন্ত্র কিনতে চেয়েছেন। সেচ যন্ত্রটির দাম ৫০০ টাকা। এবং চালানোর জন্য ১৫০ টাকা ব্যয় হবে হবে কবিকে তিনি জানিয়েছেন।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায় লিখেছেন, পরীক্ষা কৃষিক্ষেত্র সম্বন্ধে, আপনার বাটির সম্মুখে পূর্ব্বনির্দিষ্ট জমি হইতে ধান কাটা হইয়া গেলে ২৫ একর মাপিয়া লইতে এবং তাহার বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রবিভাগ করিতে ওভার্সিয়ারকে পাঠাইব, ও আপনি ইচ্ছা করেন ত আমিও যাইব।
...আলুর চাষ সম্বন্ধে যে পুস্তিকা পাইয়াছেন তদনুসারে জমিতে লাঙ্গলাদি দিতে আরম্ভ করুন ও জলসেচনের বন্দোবস্ত করুন। অক্টোবরের প্রথমেই বীজ বুনিতে হইবে। সার ও বীজ এই মাসের শেষে অর্থাৎ বীজ বুনিবার ঠিক পূর্ব্বে পাইবেন। নির্ব্বাচিত জমি যেন কাদা জমী না হয়। ও তাহা যেন আপনার বাটির নিকটে হয় যাহাতে সদা সর্ব্বদা পর্যবেক্ষণ করিতে পারেন। এক একর ৪ সমান ভাগে অমরাগাছি আলুও সঙ্গে সঙ্গে চেষ্টা করা যাবে। নৈনিতাল আলুর চেয়ে তার উৎপন্ন ফসল বেশী বোধ হয়। যাহা হউক দেখা যাইবে কোন রকম ফলে ভাল।
এই চিঠিতে বীজ ও সারের জন্য অগ্রিম ১০০ টাকা দাম পাঠিয়ে দিতে কবিকে অনুরোধ করেছিলেন। সে সময় মাটি পরীক্ষা নামে যে একটি ব্যাপার ছিল সেটা বঙ্গদেশে অজানা ছিল। এখনো বাংলাদেশের কৃষক মাটি পরীক্ষার বিষয়ে সচেতন হয়নি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আলু চাষ করার আগে কৃষি বিভাগের মাধ্যমে তার নির্ব্বাচিত ২৫ একর জমির মাটি পরীক্ষা করে নিয়েছিলেন। জেনে নিয়েছিলেন, মাটির উর্বরতা শক্তিটা কেমন আছে।
দ্বিজেন্দ্রনাথ বসু লিখেছেন, কার্ত্তিক মাসের প্রারম্ভেই আলুর চাষ আরম্ভ করিলেন। কলিকাতা এগ্রিকালচার অফিস হইতে আলু চাষের উপযুক্ত ‘বীজ’ ও ‘সার’ আনায়ন করিয়া স্থানীয় কৃষকদিগকে আলুর ক্ষেত্রের কার্য্যে নিযুক্ত করতঃ কার্য্যের সঙ্গে সঙ্গে আলুর চাষ-প্রণালী অর্থাৎ আলুর ক্ষেত্রকর্ষণ, সার দেওন, বীজ রোপণ, জলসেচন প্রভৃতির পদ্ধতি কর্ম্মক্ষেত্রেই শিক্ষা দিতে লাগিলেন। ...রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং কৃষিক্ষেত্রে উপস্থিত থাকিয়া কৃষকদিগের আলুর চাষ সম্বন্ধে জ্ঞান জন্মিল কি না, এক আধটা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিয়া তাহা অবগত হইতেন। আলু গাছগুলি যথানিয়মে বর্দ্ধিত হইতেছে কি না, চাষের কার্য্য-প্রণালী-সিদ্ধ হইয়াছে হইতেছে কিনা, তাহা পরীক্ষা করিবার জন্য কলিকাতা এগ্রিকালচার অফিস হইতে ইন্সপেক্টার লইয়া যাইতেন। আলু চাষের কার্য্য সর্ব্বাঙ্গ সুন্দর করিবার পক্ষে তাঁহার যত্ন, চেষ্টা, পরিশ্রম অসাধারণ।
প্রশান্তকুমার পালের রবিজীবনী থেকে জানা যাচ্ছে, এই ২৫ একর জমিতে পরীক্ষামূলক আলু চাষে রবীন্দ্রনাথ বিস্তর অর্থ ব্যয় করেছিলেন। কৃষি বিভাগের লোকজনও সহযোগিতা করেছিলেন। দ্বিজেন্দ্রলাল কখনো একা, কখনো সপরিবারে বেশ কবার শিলাইদহে এসেছেন। আলু ক্ষেত পরিদর্শন করেছেন।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, শিলাইদহের কুঠিবাড়ির চার দিকে যে জমি ছিল প্রজাদের মধ্যে নতুন ফসল প্রচারের উদ্দেশ্যে সেখানে নানা পরীক্ষায় লেগেছিলেম। এই পরীক্ষাব্যাপারে সরকারী কৃষিবিভাগের বিশেষজ্ঞদের সহায়তা অত্যধিক পরিমাণেই মিলেছিল। তাঁদের আদিষ্ট উপাদানের তালিকা দেখে চিচেস্টারে যারা এগ্রিকালচারাল কলেজে পাস করে নি এমন-সব চাষীরা হেসেছিল; তাদেরই হাসিটা টিকেছিল শেষ পর্যন্ত। মরার লক্ষণ আসন্ন হলেও শ্রদ্ধাবান রোগীরা যেমন করে চিকিৎসকের সমস্ত উপদেশ অক্ষুণ্ন রেখে পালন করে, পঞ্চাশ বিঘে জমিতে আলু চাষের পরীক্ষায় সরকারি কৃষিতত্ত্বপ্রবীণদের নির্দেশ সেইরকম একান্ত নিষ্ঠার সঙ্গেই পালন করেছি। তাঁরাও আমার ভরসা জাগিয়ে রাখবার জন্য পরিদর্শনকার্যে সর্ব্বদাই যাতায়াত করেছেন।
পল্লীসেবা প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, এক সময়ে আমার মনে হয়েছিল যে শিলাইদহে আলুর চাষ বিস্তৃত ভাবে প্রচলন করব। আমার প্রস্তাব শুনে কৃষিবিভাগের কর্তৃপক্ষ বললেন যে, আমার নির্দিষ্ট জমিতে আলুর চাষ করতে হলে একশো মন সার দরকার হবে ইত্যাদি। আমি কৃষিবিভাগের প্রকাণ্ড তালিকা অনুসারে কাজ করলুম, ফসলও ফলল, কিন্তু ব্যয়ের সঙ্গে আয়ের কোনোই সামঞ্জস্য রইল না। এ সব দেখে আমার এক চাষী প্রজা বললে, ‘আমার ‘পরে ভার দিন বাবু।‘ সে কৃষিবিভাগের তালিকাকে অবজ্ঞা করেও প্রচুর ফসল ফলিয়ে আমাকে লজ্জিত করলে।
সেই চাষীর নাম চামারু। তার এক হাত কাটা। রাজবংশীর ঘরের এই চামারু কবির কাছ থেকে আলু বীজ নিয়ে তার পাঁচ কাঠা জমিতে সেই সময়েই আলু চাষ করেছিল নিজের মতো করে। তার আলু ফলেছিল রেকর্ড পরিমাণ। তবে কবির নিজের ২৫ একর জমিতে আলুর ফলন কম হলেও তার আকার হয়েছিল বেশ বড় বড়। এবং স্বাদেও ভালো হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের ২৫ একর জমির ফলন কম হলেও চামারুর ক্ষেত্রে সাফল্যে এলাকার চাষীদের মধ্যে সাড়া ফেলেছির। তারা আলু চাষে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। সেখান থেকে পরবর্তী বছরগুলো ঐ এলাকায় আলু চাষ বেড়ে যায়। কৃষকদের নিজেদের উদ্যোগেই শীতকালীন ফসল হিসেবে আলু চাষের প্রচলন ঘটে।
আলু চাষের বেশ কিছু সমস্যাও আছে। এটা শীতনির্ভর ফসল। বাংলাদেশের শীতকাল ছোটো বলে আলুচাষের রোপণ সময়টা দেরী হয়ে গেলে আলুর ফলন মার খায়। তাছাড়া অতিরিক্ত কুয়াশা আর সে সময়ে যদি ঝিরঝিরে বৃষ্টি হয়, তাহলে আলুতে নাবীধ্বসা মড়ক রোগের আক্রমণের ব্যাপক ঘটতে পারে। নিয়মিত পানি সেচ দেওয়া না হলে বাড়বাড়তি যথাযথ হয় না। আবার বেশী পানি জমে গেলেও গোড়া পচে যেতে পারে। আর আছে কাটুই পোকার আক্রমণ। ইঁদুরের উৎপাতও ব্যাপক হতে পারে। এজন্য আলুচাষে বিশেষ যত্ন নেওয়ার দরকার পড়ে। সে সময়ে এইসব অভিজ্ঞতা এলাকার চাষীদের ছিল না। তাছাড়া ফ্রি চাষের ব্যবস্থা করলে যা হয়, সেভাবেই হেলা ভরে জমিদারের লোকজন লোকদেখানো যত্ন করেছিল। আসল যত্নে হয়তো তাদের ঘাটতি ছিল। তাছাড়া ২৫ একর জমি তো অনেক বড়ো। যেখানে আলু চাষই প্রচলিত নয়—নতুন, সেখানে পরীক্ষামুলকভাবে ছোটো ক্ষেতে চাষের ব্যবস্থা করাটাই উত্তম ছিল। এবংবিধ কারণে হয়তো সে সময়ে রবীন্দ্রনাথের আলুক্ষেত্রে ফলন ভালো হয়নি। কিন্তু ছোটো ক্ষেতে চামারু সঠিকভাবে যত্ন নিতে পেরেছিল। তাঁর ফলন সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। এই চামারুর সাফল্যটাও রবীন্দ্রনাথের আলুচাষেরই সাফল্য হিসেবে দেখা হয়েছিল। এলাকায় আলু চাষ তারপর থেকেই কৃষকরা গ্রহণ করেছিল।
১৮৯৯ সালে বৃটিশ ল্যান্ড রেকর্ডস অব এগ্রিকালচার’এ লেখা হয়েছিল, Experiment with national potatoes were made by Mr. Rabindranath Tagore in Tagore Estate at Shilalidah in the Kusthia Sub-division. The crop was not satisfactory owing to defecting cultivation. One Mr. Tagore’s continents, however working under more favourable circumstances obtained crop from a portion of the same seed and success of the experiment is said to have induced several neighbouring Rayots to take the cultivation. Their experiments together with others introduced by Mr. Tagore take the potato cultivation on his farm will be continued.
মন্তব্য
চমৎকার। অনেক কিছু জানলাম।
______
বুনোফুল
----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony
...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'
ধন্যবাদ।
...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'
>অনেক অনেক দারুন লেখা। ধন্যবাদ আপনাকে, আচ্ছা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এ ধারাবাহিক লিখায় কবির বর্তমান প্রজন্মের বর্ণনা কি আসবে?
>রবীন্দ্রনাথের চালু করা ক্ষুদ্র ঋন কার্যক্রমের বর্ণনা কি ইতিমধ্যে চলে এসেছে নাকি সামনে আসবে? যদি এসে থাকে তাহলে আপনার পোষ্ট দেয়া কোন পর্বে আছে, জানালে উপকৃত হই।
>ভাল থাকুন।
সুদখোরও আছিলেন নাকি? সুদ মদ জেনায় আমার অবশ্য আপত্তি নাই। তয় গরিবের বন্ধু পশ্চিমের অবতার সুদখোর মহানবিকবি টাইপ একটা কন্ছপিরেছির তাজা প্লট হাজির আছে কইলাম।
সুদ খোর ছিলেন কিনা সেটা নিয়ে আলাপ হবে। অপেক্ষা করুন।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'
বলেন কি রবীন্দ্রনাথও!!!
তাহলে আর ইউনূসকে ক্ষুদ্র ঋণের পায়োনিয়ার ধরে কেন?
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
এই পল্লীপূনর্গঠন খণ্ডেই রবীন্দ্রনাথের ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম নিয়ে বিস্তারিত আলাপ আসছে।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'
এই পল্লীপূনর্গঠন খণ্ডেই রবীন্দ্রনাথের ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম নিয়ে বিস্তারিত আলাপ আসছে। অনেক ধন্যবাদ(বাঘুবাচ্চা)
অনেক কিছু জানা হচ্ছে আপনার এই সিরিজ থেকে। ধন্যবাদ।
জে স্কট তার এক বইতে (Bengali Flower: 50 Selected Poems from India and Bangladesh) উল্লেখ করেছেন রবীন্দ্রনাথ ১৮৯০ সালে প্রথম শিলাইদহ আসেন। তার পরিবার ১৮৯৮ সালে তার সাথে যোগ দেয়। আরও কয়েকটি লেখায় যতদূর মনে পড়ে তার আগমনের সময়টি কোথাও ১৮৯০, কোথাও আবার ১৮৯১ উল্লেখ রয়েছে। আপনি বলছেন ১৮৮৯ সাল। কোন তথ্যটি সঠিক, জানতে ইচ্ছে করছে।
আরেকটি বিষয়। উদ্ধৃতাংশ একটা উদ্ধৃতি চিহ্ন দিয়ে পৃথক করে দিলে পড়তে আরাম হবে বোধ হয়।
পথিক পরাণ
-----------------------------
পথেই আমার পথ হারিয়ে
চালচুলোহীন ছন্নছাড়া ঘুরছি ভীষণ---
১৮৮৯ সালে রবীন্দ্রনাথ জমিদারী পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে শিলাইদহে এসেছেন।
কিন্তু ১৮৭৫ সালের ৬ ডিসেম্বর তিনি পিতা দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রথম শিলাইদহে বেড়াতে আসেন।
সূত্র। রবীন্দ্রজীবন কথা : প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়।
রবিজীবনী : প্রশান্তকুমার পাল। প্রথম খণ্ড। পৃষ্ঠা ২১২।
...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'
নতুন মন্তব্য করুন