কুলদা রায়
এমএমআর জালাল
১৮৯৮ সালের ৩ আগস্ট সপরিবারে রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে বাস করতে আসেন। রথীন্দ্রনাথ লিখেছেন, শিলাইদহে আমরা যে পরিবেশের মধ্যে বাস করতে লাগলাম, কলকাতার পারিবারিক ও সামাজিক জীবনধারা থেকে তা সম্পুর্ণ বিপরীত। আমাদের বাড়িটা খোলা মাঠের মধ্যে, খরশেদপুর গ্রাম, কাছাড়ি বাড়ি বা শিলাইদহের ঘাট থেকে খানিকটা তফাতে। বাবা মা ও আমরা পাঁচ ভাইবোন থাকি।
তখন রবীন্দ্রনাথ বড় মেয়ে বেলা ও ছেলে রথীন্দ্রনাথের জন্য বাড়িতেই লেখাপড়ার ব্যবস্থা করলেন। কুঠীবাড়ির মধ্যেই স্কুল খুললেন। সেখানে প্রতিবেশী কিছু বালক-বালিকারাও পড়ত। ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিল লরেন্স নামে একজন খাঁটি ইংরেজ। বেতন মাসিক ৫০ টাকা। লরেন্স সাহেব নানা দেশে ঘুরেছেন। শেষ জীবনটা ভারতেই কাটিয়েছেন।
লরেন্স মিষ্টভাষী, সরল, কর্তব্যনিষ্ঠ। ইংরেজিটা পড়াতেন ভালই। রথীন্দ্রনাথ স্মৃতিকথায় এই সাহেব টিচারকে মজার, পাগলাটে গোছের বলেছেন। কিন্তু তার সমস্যা ছিল প্রায়ই মাতাল হয়ে যেতেন। তবুও রবীন্দ্রনাথ তাকে পছন্দ করতেন। তার সকল আবদার পূরণ করতেন।
রবীন্দ্রনাথ আশ্রমের রূপ ও বিকাশ প্রবন্ধে লিখেছেন--এক পাগলা মেজাজের চালচুলোহীন ইংরেজ শিক্ষক হঠাৎ গেল জুটে। তার পড়াবার কায়দা খুবই ভালো, আরো ভালো এই যে কাজে ফাঁকি দেওয়া তার ধাতে ছিল না। মাঝে মাঝে মদ খাবার দুর্নিবার উত্তেজনায় সে পালিয়ে গেছে কলকাতায়, তার পর মাথা হেঁট করে ফিরে এসেছে লজ্জিত অনুতপ্ত চিত্তে। কিন্তু কোনোদিন শিলাইদহে মত্ততায় আত্মবিস্মৃত হয়ে ছাত্রদের কাছে শ্রদ্ধা হারাবার কোনো কারণ ঘটায় নি। ভৃত্যদের ভাষা বুঝতে পারত না, সেটাকে অনেক সময়ে সে মনে করেছে ভৃত্যদেরই অসৌজন্য। তা ছাড়া সে আমার প্রাচীন মুসলমান চাকরকে তার পিতৃদত্ত ফটিক নামে কোনোমতেই ডাকত না। তাকে অকারণে সম্বোধন করত সুলেমান। এর মনস্তত্ত্বরহস্য কী জানি নে। এতে বার বার অসুবিধা ঘটত। কারণ চাষিঘরের সেই চাকরটি বরাবরই ভুলত তার অপরিচিত নামের মর্যাদা।
লরেন্স শিলাইদহে প্রায় রবীন্দ্রনাথের পরিবারের একজনই হয়ে গিয়েছিলেন। তার জন্মদিবসও কবি পালন করেছিলেন।
সে সময়ে পতিসরের কালিগ্রামে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসলহানি হয়েছে। প্রজারা দুর্দশায় পড়েছে। কালিগ্রামের নায়েব শৈলেশ্চন্দ্র মজুমদারকে একটি চিঠিতে লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ, কালিগ্রামের অবস্থা (শুনিয়া) চিন্তিত হইলাম। প্রজাগণ (যাহাতে অতিষ্ঠ) হইয়া না ওঠে তৎপ্রতি দৃষ্টি রাখিয়া (কর) আদায় করিবে। ১৬ জুনে শৈলেশচন্দ্রকে আরেকটি চিঠিতে কবি লিখেছেন, মধু নামে এক লোককে কালিগ্রামে পাঠান হয়েছে। মধু শুধু প্রজাদের অবস্থা সরেজমিনে তদন্ত করবে।
প্রজাদের অবস্থা বোঝার জন্য নায়েবের উপর কবি নির্ভর করছেন না। সে সময়ে তিনি জমিদারী পরিচালিনার দ্বায়িত্ব পালন করেছেন মাত্র—এই জমিদারীতি ছিল এজমালি সম্পত্তি। সুতরাং একা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তাঁর ছিল না। এই তদন্ত রিপোর্টির ভিত্তিতে তিনি জমিদারীর অংশীদারীদের কাছে প্রজাদের খাজনা মওকুফের দেনদরবার করার সুযোগটি নিয়েছিলেন। পরে যখন তিনি নিজেই কালিগ্রাম পরগণার জমিদার হয়েছিলেন তখন এইরকম ফসলহানীর ঘটনা ঘটলে প্রজাদের খাজনা মওকুফ করে দিয়েছেন।
১৮৯৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারী কালিগ্রামের নায়েব শৈলেশচন্দ্রকে আরেকটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ আরেকটি চিঠিতে জানাচ্ছেন, আমরা (শিলাইদহে) গুটিপোকা চাষের পরীক্ষা করে দেখলুম বিশেষ লাভজনক। তোমাদের ওখানে চালাতে পারলে প্রজাদের বিশেষ উপকার হয়। খুব সহজ এবং খরচ প্রায় নেই বললেই চলে।
এই সময়কালে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় রাজশাহীর জেলা শহরে রামপুরা-বোয়ালিয়ায় রেশম-শিল্প বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সুহৃদ ছিলেন। তাঁর ইতিহাস রচনার কাজে ও রেশম বিদ্যালয়ের কাজে রবীন্দ্রনাথ সর্বতোভাবে সহযোগিতা করেছেন। এই বিদ্যালয়ে উৎপাদিত রেশম বস্ত্র তিনি নিজে ব্যবহার করতেন। বন্ধুদের উপহার দিয়ে তাদেরকেও কিনতে উৎসাহী করে তুলতেন।
ত্রিপুরার মহারাজা ছিলেন রবীন্দ্রনাথের বন্ধু। তাঁর জন্য তিনি রেশম-বস্ত্র পাঠিয়েছেন। মন্ত্রী মহিমচন্দ্র ঠাকুরকে এক চিঠিতে লিখেছেন, মহারাজার জন্য সর্বানন্দের হস্তে একটি সাদা রেশমের থান উপহার পাঠাইলাম। আপনার জন্য রাজশাহী শিল্প বিদ্যালয় হইতে মটকার থান প্রস্তুত হইয়া আসিয়াছে, উপহার পাঠাইব--ইহার প্রস্তুত এক সুট সাজ পরিয়া আমার সহিত শিলাইদহে যখন সাক্ষাৎ করিতে আসিবেন বিশেষ আনন্দ লাভ করিব। শিল্প বিদ্যালয়কে উৎসাহ দিবার জন্য সেখান আমি সর্বদাই রেশমের বস্ত্রাদি ক্রয় করিয়া থাকি—দোষের মধ্যে লোক ও সামর্থ্য অল্প হওয়াতে তাহার সাধ্য ও অধিক পরিমাণে কাপড় যোগাইতে পারে না। বন্ধুদের নিকট আমার এই সকল বস্ত্র উপহার কেবল আমার উপহার নহে—তাহা স্বদেশের উপহার।
ঐ ফেব্রুয়ারী মাসেই আরেকটি চিঠি নায়েব শৈলেশচন্দ্রকে লিখেছেন কবি। লিখেছেন—রামপুর শিল্প বিদ্যালয়ে রেশমতত্ব শিক্ষার জন্য কালিগ্রাম হইতে দুইজন ছাত্র পাঠাইবার কথা ছিল। তাহা কি করিলে?
শুধু রেশম বিদ্যালয়ে ছাত্র পাঠিয়েই কবি সন্তুষ্ট ছিলেন না। তিনি নিজেই শিলাইদহে রেশম চাষের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এ ব্যপারে তাঁর সহায় হয়েছিলেন ছেলেমেয়েদের ইংরেজি শিক্ষক লরেন্স সাহেব।
আশ্রমের রূপ ও বিকাশ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ এই রেশম চাষ বিষয়ে বিস্তারিতভাবে লিখেছেন –
লরেন্সকে পেয়ে বসল রেশমের চাষের নেশায়। শিলাইদহের নিকটবর্তী কুমারখালি ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির আমলে রেশম-ব্যবসায়ের একটা প্রধান আড্ডা ছিল। সেখানকার রেশমের বিশিষ্টতা খ্যাতিলাভ করেছিল বিদেশী হাটে।
সেখানে ছিল রেশমের মস্ত বড়ো কুঠি। একদা রেশমের তাঁত বন্ধ হল সমস্ত বাংলাদেশ, পূর্বস্মৃতির স্বপ্নাবিষ্ট হয়ে কুঠি রইল শূন্য পড়ে। যখন পিতৃঋণের প্রকাণ্ড বোঝা আমার পিতার সংসার চেপে ধরল বোধ করি তারই কোনো এক সময়ে তিনি রেলওয়ে কোম্পানিকে এই কুঠি বিক্রি করেন। সে সময়ে গোরাই নদীর উপরে ব্রিজ তৈরি হচ্ছে। এই সেকেলে প্রাসাদের প্রভূত ইঁট পাথর ভেঙে নিয়ে সেই কোম্পানি নদীর বেগ ঠেকাবার কাজে সেগুলি জলাঞ্জলি দিলে। কিন্তু যেমন বাংলার তাঁতির দুর্দিনকে কেউ ঠেকাতে পারলে না, যেমন সাংসারিক দুর্যোগে পিতামহের বিপুল ঐশ্বর্যের ধ্বংস কিছুতে ঠেকানো গেল না— তেমনি কুঠিবাড়ির ভগ্নাবশেষ নিয়ে নদীর ভাঙন রোধ মানলে না; সমস্তই গেল ভেসে; সুসময়ের চিহ্নগুলোকে কালস্রোত যেটুকু রেখেছিল নদীর স্রোতে তাকে দিলে ভাসিয়ে।
লরেন্সের কানে গেল রেশমের সেই ইতিবৃত্ত। ওর মনে লাগল, আর একবার সেই চেষ্টার প্রবর্তন করলে ফল পাওয়া যেতে পারে; দুর্গতি যদি খুব বেশি হয় অন্তত আলুর চাষকে ছাড়িয়ে যাবে না। চিঠি লিখে যথারীতি বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে সে খবর আনালে। কীটদের আহার জোগাবার জন্যে প্রয়োজন ভেরেণ্ডা গাছের। তাড়াতাড়ি জন্মানো গেল কিছু গাছ কিন্তু লরেন্সের সবুর সইল না। রাজশাহি থেকে গুটি আনিয়ে পালনে প্রবৃত্ত হল অচিরাৎ। প্রথমত বিশেষজ্ঞদের কথাকে বেদবাক্য বলে মানলে না, নিজের মতে নতুন পরীক্ষা করতে করতে চলল। কীটগুলোর ক্ষুদে ক্ষুদে মুখ, ক্ষুদে ক্ষুদে গ্রাস, কিন্তু ক্ষুধার অবসান নেই। তাদের বংশবৃদ্ধি হতে লাগল খাদ্যের পরিমিত আয়োজনকে লঙ্ঘন করে। গাড়ি থেকে দূর দূর থেকে অনবরত পাতার জোগান চলল। লরেন্সের বিছানাপত্র, তার চৌকি টেবিল, খাতা বই, তার টুপি পকেট কোর্তা— সর্বত্রই হল গুটির জনতা। তার ঘর দুর্গম হয়ে উঠল দুর্গন্ধের ঘন আবেষ্টনে। প্রচুর ব্যয় ও অক্লান্ত অধ্যবসায়ের পর মাল জমল বিস্তর, বিশেষজ্ঞেরা বললেন অতি উৎকৃষ্ট, এ জাতের রেশমের এমন সাদা রঙ হয় না। প্রত্যক্ষ দেখতে পাওয়া গেল সফলতার রূপ— কেবল একটুখানি ত্রুটি রয়ে গেল। লরেন্স বাজার যাচাই করে জানলে তখনকার দিনে এ মালের কাটতি অল্প, তার দাম সামান্য। বন্ধ হল ভেরেণ্ডা পাতার অনবরত গাড়ি-চলাচল, অনেকদিন পড়ে রইল ছালাভরা গুটিগুলো; তার পরে তাদের কী ঘটল তার কোনো হিসেব আজ কোথাও নেই। সেদিন বাংলাদেশে এই গুটিগুলোর উৎপত্তি হল অসময়ে। কিন্তু যে শিক্ষালয় খুলেছিলেম তার সময় পালন তারা করেছিল।
এখানেই শেষ নয়। এই অভিজ্ঞতা রবীন্দ্রনাথ নানা জায়গায় উল্লেখ করেছেন। অযোগ্য ভক্তি নামে আরেকটি প্রবন্ধে কবি রেশম চাষের কিছু সমস্যা বিষয়ে আলোকপাত করেছিলেন-- লিখেছেন,
আমাদের দেশে যাহারা রেশম কীটের চাষ করে তাহাদের মধ্যে একটা প্রবাদ আছে যে , নিরামিষ আহার , নিয়ম পালন ও গঙ্গাজল প্রভৃতি দ্বারা নিজেকে সর্বদা পবিত্র না রাখিলে রেশমব্যবসায়ীর সাংসারিক অমঙ্গল ঘটে ।
শিক্ষিত ব্যক্তিরা বলিয়া উঠিবেন , পাছে মলিনতা দ্বারা রেশমকীটের মধ্যে সংক্রামক রোগবীজ প্রবেশ করিয়া ফসল নষ্ট হয় এইজন্য বুদ্ধিমান কর্তৃক এইরূপ প্রবাদ প্রচারিত হইয়াছে । কিন্তু চাষাকে প্রকৃত তত্ত্ব না বুঝাইয়া দিয়া তাহার বুদ্ধিকে চিরকালের মতো অন্ধ করিয়া পরিণামে বিষময় ফল হয় । চাষা অনির্দিষ্ট অমঙ্গল আশঙ্কায় নিজে নিয়ম পালন করে কিন্তু কীটদের সম্বন্ধে নিয়ম রক্ষা করে না—স্নানপানাদির দ্বারা নিজে পবিত্র থাকে কিন্তু কীটের ঘরে এক পাতায় তিন দিন চলিতেছে , মলিনতা সঞ্চিত হইতেছে তাহাতে দৃষ্টি নাই ।
মন্তব্য
বাহ! জানতাম না তো এত খুঁটিনাটি। ধন্যবাদ।
আপনার লেখা পড়ি নিয়মিত কিন্তু মন্তব্য করা হয় না। অনেক কিছু জানলাম এই লেখার মাধ্যমে।
ভালো থাকবেন।
অসাধারণ লেখা কুলদা রায়। লরেন্স সাহেব কী কোনো স্মৃতিকথা লিখেছেন রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে?
শনিবারের চিঠি
দারুণ লেগেছে লেখাটি।
"কিন্তু চাষাকে প্রকৃত তত্ত্ব না বুঝাইয়া দিয়া তাহার বুদ্ধিকে চিরকালের মতো অন্ধ করিয়া পরিণামে বিষময় ফল হয় । চাষা অনির্দিষ্ট অমঙ্গল আশঙ্কায় নিজে নিয়ম পালন করে কিন্তু কীটদের সম্বন্ধে নিয়ম রক্ষা করে না—"
'রবীন্দ্রনাথের জমিদারগিরি--জমিদারের রবীন্দ্রগিরি' এখানে সিরিজটির পর্বসংখ্যা উল্লেখ করা হয়নি কেনো জানতে ইচ্ছে করছে।
সৌরভ কবীর
নতুন মন্তব্য করুন