কুলদা রায়
এমএমআর জালাল
মণ্ডলীপ্রথা
১৯০৯ সালে রবীন্দ্রনাথ বিরাহিমপুর পরগণা্র জমিদারীকে পাঁচটি মণ্ডলীতে ভাগ করেন। এই প্রথার উদ্দেশ্য ছিল সরাসরি গ্রামোন্নয়নে প্রজাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। তারা একত্রে মিলে তাদের নিজেদের সমস্যাটি নিরুপণ করবেন। সমস্যা-সমাধান কল্পে পরিকল্পনা প্রণয়ন করবেন। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তারা নিজেরাই তাদের বাজেট করবেন। প্রয়োজনীয় অর্থ, সম্পদ, শ্রমদান করবেন। এবং তাদের নেতৃত্বেই সকল কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হবে। তারা নিজেদের উন্নয়ন ঘটাবেন নিজেরাই। এখানে জমিদারের প্রতিনিধি সহযোগী সসস্য হিসেবে থাকবেন। তাদেরকে প্রয়োজনীয় সকল সহায়তা দেবেন। এই মণ্ডলী প্রথা স্বায়ত্বশাসন হিসেবে প্রজাদের মধ্যে কাজ করবে। একে রবীন্দ্রনাথ পঞ্চায়েত প্রথা হিসেবে অভিহিত করেছিলেন।
বিরাহিমপুর পরগণার মণ্ডলীর ম্যানেজার সতীশচন্দ্র ঘোষকে ররীন্দ্রনাথ ১৯০৯ সালের ৪ জানুয়ারি একটি চিঠিতে লিখেছেন, সর্বোত্তমভাবে প্রজাদের সহিত ধর্মসম্বন্ধ রক্ষা করিয়া তাহাদের পূর্ণ বিশ্বাস আকর্ষণ করিতে হইবে। আমরা যে সর্বপ্রকারে প্রজাদের উন্নতিসাধন হিত করিতে ইচ্ছা করি, তোমাদের ব্যবহারে তাহা প্রতিপন্ন করিতে হইবে। তোমার অধীনস্ত মণ্ডলীর অন্তর্গত পল্লীগুলির যাহাতে সর্বপ্রকারে উন্নতিসাধন হয় প্রজাদিগকে সর্বদাই সচেষ্ট করিয়া দিবে। নতুন ফসলের প্রবর্তনের জন্যও বিশেষ চেষ্টা করিবে। ইতিপুর্বে তোমাদের প্রতি যে মুদ্রিত উপদেশ বিতরণ হইয়াছে তদানুসারে কাজ করিতে থাকিবে।
রবীন্দ্রনাথ জমিদারী পরিচালনার অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছিলেন, পুর্বে সমাজ সক্রিয় ছিল। সমাজই পল্লীর সব উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করত। কিন্তু ইংরেজ শাসক এই সমাজ ব্যবস্থাটাই ভেঙ্গে দিয়েছিল। পল্লীর উন্নয়নে শাসক, উচ্চবিত্ত, সমাজ কেউ-ই আর তাদের দ্বায়িত্ব পালন করেনি। এ ক্ষেত্রে শাসক, উচ্চাবিত্ত, জমিদার—সবাই নানা কায়দায় প্রজাদের শোষণ করেছে। ফলে প্রজাদের সঙ্গে সকলের বিচ্ছেদ প্রকট হয়ে পড়েছে। তাদের যে কেউ উন্নতি করতে পারে—সে ধারণাটাই ভেঙ্গে গিয়েছিল। এই সমষ্টিগত বিশ্বাসহীনতা থেকেই প্রজাসাধারণ সে সময়ের সব ধরনের উদ্যোগকেই সন্দেহের চোখে দেখেছে। সকলের সঙ্গে দুরত্ব বজায় রেখে নিজেরা পীড়ণ ভোগ করেছে। সমাজ বা কোনো ব্যক্তির উদ্যোগে নির্মিত রাস্তা-ঘাট-পুকুর যাই-ই পল্লীতে ছিল সেগুলো সংস্কারের কোনো প্রয়োজনীয়তাই তারা বোধ করেনি। তারা মনে করেছে যারা নির্মাণ করেছে তারাই সংস্কার করবে। সেটা হয়নি।
রবীন্দ্রনাথ ঠিক এই অচলায়তনটিতেই আঘাত করতে চেয়েছেন। জাগাতে চেয়েছেন মরে যাওয়া গ্রামগুলিকে। এই জাগানোর জন্য প্রজাদের ভেতরে শুকিয়ে যাওয়া শক্তিকে প্রাণদান করতে চেয়েছেন। এই শক্তিকে তিনি বলেছেন আত্মশক্তি। তিনি এই আত্ম শক্তির উদ্বোধন করতে চেয়েছেন সারাজীবন ভর।
তিনি চেয়েছেন প্রজারা নিজেদের জলাশয় নিজেরাই নির্মাণ করুক নিজেদের উদ্যোগে—নিজেদের সংগঠনে—নিজেদের সামর্থ্য—শক্তিতে। তাহলে পরবর্তিতে যখন এটার সংস্কার প্রয়োজন হবে, তখন কারো অপেক্ষায় চেয়ে থাকতে হবে না। তারা নিজেদের মমতায়—নিজেদের হাতে গড়া জলাশয়টি সংরক্ষণ করবে—সংস্কার করবে। এভাবেই একটা টেকসই উন্নয়ন ঘটবে। নিজেদের বিচার-আচারও তারা করে সমস্যা মিটিয়ে ফেলবে। এভাবে প্রজাসাধারণ নিজেদের ক্ষমতায়ন ঘটাতে পারবে।
এই উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথ বিরাহিমপুরে পঞ্চায়েত প্রথার আদলে মণ্ডলীপ্রথার প্রবর্তন করলেন। এই বিরাহিমপুর হিন্দু প্রধান এলাকা হওয়ায় তাদের মধ্যে নানাধরনের সমাজ-ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণী সংস্কার প্রবল ছিল। ফলে সেখানে এই কার্যক্রমে সফলতা তেমন পাওয়া যায়নি। কিন্তু কালিগ্রাম পরগণাটি মুসলমান প্রধান হওয়ায় সেখানে এই মণ্ডলীপ্রথা সফলতা লাভ করে।
রবীন্দ্রনাথ কর্মচারী জানকীনাথ রায়কে ৪ মে একটা চিঠিতে লিখেছেন—কালিগ্রাম পরগণাকেও আমি মহলে মহলে বিভক্ত করিয়া কার্যের ব্যবস্থা করিব। কিরূপ ভাগ করা যাইতে পারে এবং সেরেস্তার বর্তমান কোন কোন কর্মচারী দ্বারা তাহার কাজ কিরূপ চালানো যাইবে তাহাও চিন্তা করিয়া দেখিবে। যদি কালিগ্রামে ইতিমধ্যে সুবৃষ্টি হয় তবে পুন্যাহের সময় আমি স্বয়ং গিয়া নতুন ব্যবস্থার প্রবর্তন করিব। এ কাজটাকে তিনি হৃদয় চাষ দেবার কাজ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি লিখেছেন, অনেক ঢেলা ভাঙতে হবে—জমিকে প্রীতিবর্ষণের দ্বারা সরস করতে না পারলে কোনো ফসল ফলবে না।
বিরাহিমপুর পরগণার মণ্ডলী--
বিরাহিমপুরের জমিদারীতে গৃহীত কাজের তালিকা নিম্নরূপ—পথঘাট সংস্কার করা, জলকষ্ট দূর করা, শালিসের বিচারে বিবাদ নিষ্পত্তি করা, বিদ্যালয় স্থাপন, জঙ্গল পরিস্কার করা, দুর্ভিক্ষের জন্য ধর্মগোলা বসিয়ে গ্রামের লোককে নিজের হিতসাধনে প্রবৃত্ত করা, আধুনিক কৃষির প্রচলন করা ইত্যাদি।
পরগণাকে পাঁচটি মণ্ডলীতে বিভক্ত করে প্রত্যেক মণ্ডলীতে একজন করে অধ্যক্ষ নিযুক্ত করা হয়।
কালিগ্রাম পরগণার হিতৈষী সভা
কালিগ্রাম পরগণাকে পতিসর, রামতা ও রাতোয়াল—এই তিনটি বিভাগে বিভক্ত করা হয়। প্রতিটি গ্রামের বাসিন্দারা সেই গ্রামের একজন প্রবীণ ব্যক্তিকে ‘প্রধান’ নির্বাচন করে। প্রতি বিভাগের সকল গ্রাম প্রধানকে নিয়ে গঠিত হয় বিভাগীয় হিতৈষী সভা। তিন বিভাগের প্রধানরা মিলে পাঁচজনকে কেন্দ্রীয় হিতৈষী সভার সভ্য নির্বাচন করে। এদেরকে বলা হয় পরগণার পঞ্চ প্রধান। কেন্দ্রীয় সভার নাম কালিগ্রাম হিতৈষী সভা। কেন্দ্রীয় সভায় জমিদারের একজন প্রতিনিধি থাকে।
হিতৈষী সভার তহবিল
খাজনা দেওয়ার সময় প্রজারা খাজনার প্রতি টাকায় তিন পয়সা হারে চাঁদা দেয়। সেই টাকাই হয় হিতৈষী সভার তহবিল। আদায়ী টাকা তিন অংশে ভাগ করে তিনটি বিভাগীয় হিতৈষী সভার হাতে দেওয়া হয়। সভার পক্ষ থেকে একজন করে বেতনভোগী কর্মচারী নিযুক্ত করা হয়। সভার নির্দেশঅনুসারে তিনিই সমস্ত কাজকর্ম তত্ত্ববধান করেন। প্রজাদের চাঁদা থেকে হিতৈষী সভার পাঁচ হাজার টাকা আয় ছিল। তাদের উৎসাহ দেবার জন্য রবীন্দ্রনাথ এস্টেট থেকে আরো দু’হাজার টাকা দেবার ব্যবস্থা করেন।
বার্ষিক অধিবেশন
সাধারণত বছরে একবার কেন্দ্রীয় হিতৈষী সভার অধিবেশন হয়। পুর্ব বছরের হিসাব পরীক্ষা ও কাজকর্মের পর্যালোচনা এবং আগামী বছরের বাজেট প্রস্তুত করা এই অধিবেশনের প্রধান কাজ। আর একটি কাজ কাজ ছিল—জমিদারী পরিচালনায় কর্মচারীদের কোনো ত্রুটি বা প্রজাদের প্রতি অত্যাচার ঘটলে জমিদার মহাশয়কে সে বিষয়ে জানানো। জমিদার সেই কর্মচারীর শাস্তি বিধান করতেন।
বাস্তবায়নকৃত কাজ
কালিগ্রাম হিতৈষী সভা কয়েক বছরের মধ্যে বিভিন্ন গ্রামে পাঠশালা, তিন বিভাগে তিনটি মধ্য ইংরেজী স্কুল স্থাপন করে, পতিসর হাই স্কুলটির উন্নতিসাধন করে, স্কুলবাড়ি ও ছাত্রাবাস নির্মাণের ব্যয় ঠাকুর এস্টেট বহন করে। চিকিৎসার ব্যবস্থাও করা হয়। প্রথমে পতিসরে একটি ডাক্তারখানা খোলা হয়। পরে অন্য বিভাগগুলিতেও ডাক্তারসহ ডিসপেন্সারি স্থাপিত হয়। পতিসরের চিকিৎসালয়টি ছিল বড়ো। প্রতিদিন বহুসংখ্যক রোগী এখান থেকে চিকিৎসা-সেবা নিয়েছে।
রাস্তাঘাট তৈরি করা, মজা ডোবা ও পুকুরের সংস্কার করা, জঙ্গল পরিস্কার করা, কূপ খনন, উউনত কৃষিব্যবস্থার প্রচলন ইত্যাদি জনহিতকর কাজের দ্বায়িত্বও হিতৈষী সভা গ্রহণ করেছিল। দেওয়ানী বিচারের ক্ষেত্রে সালিশ ব্যবস্থার প্রবর্তনও জনকল্যাণ সাধন করে।
এসব ব্যবস্থা একদিনে তা এক সঙ্গে আরম্ভ করা যায়নি। ধীরে ধীরে কর্মব্যবস্থা প্রবর্তিত হয় ও কর্মবিধির সংস্কার ঘটানো হয়।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন
কালিগ্রাম হিতৈষী সভার উদ্যোগে প্রায় দুই শতাধিক অবৈতনিক নিম্ন প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছিল। ছোটদের জন্য দিনের বেলায় এবং বয়স্কদের জন্য রাতে শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল।
রাতোয়ালের সম্পন্ন জোদ্দার খান চৌধুরী শাহরুল্লাহ আকন্দের এলাকায় নাম ডাক ছিল। তাদের সঙ্গে ঠাকুর পরিবারের সুসম্পর্ক ছিল। রবীন্দ্রানুরাগী এ পরিবার রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা ও উন্নয়ন কাজে সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে গেছেন বারবার।
গবেষক আহমদ রফিক লিখেছেন, হয়তো এসব কারণে ঠাকুর এস্টেটের তহশিল কাছারি স্থাপিত হয় রাতোয়ালে। ওদের হাতে রাতোয়ালে প্রতিষ্ঠিত হয় রবীন্দ্রনাথের নামে স্কুল। কামতায় হিতৈষী সভার উদ্যোগে স্থাপিত হয় সত্যেন্দ্রনাথের নামে স্কুল। পতিসরের কাছারিবাড়ির ডান দিক দিয়ে সামান্য কিছু আঁকাবাঁকা কাঁচা মাটির পথ ধরে এগিয়ে গেলে দেখা মিলবে কবিপুত্রের নামে চিহ্ণিত ‘রথীন্দ্রনাথ ইন্সটিটিউশন’ স্কুলটির। এই স্কুলটি বাধাবন্ধনহীন পরিচালনার জন্য রবীন্দ্রনাথ বরাদ্দ করেছিলেন বিস্তর ‘ক্ষেত জমি’—কারো হিসেবে দুশো বিঘে। কালিগ্রাম রথীন্দ্রনাথ ইন্সটিটিউশন দেখতে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি লিখেছেন—সেবার পতিসরে পৌঁছে গ্রামবাসীদের অবস্থার উন্নতি দেখে মন পুলকিত হয়ে উঠলো। পতিসরের হাই স্কুলে ছাত্র আর ধরছে না। দেখলুম—নৌকার পর নৌকা নাবিয়ে দিয়ে যাচ্ছে ছেলের দল স্কুলের ঘাটে। এমন কি আট দশ মাইল দুরের গ্রাম থেকেও ছাত্র আসছে। পড়াশোনার ব্যবস্থা প্রথম শ্রেণীর কোনো ইস্কুলের চেয়ে নিকৃষ্ট নয়। পাঠশালা, মাইনর স্কুল সর্বত্র ছড়িয়ে গেছে।
কুটির শিল্প-স্থাপন
কালিগ্রামের বাসিন্দাদের বড় অংশই ছিল তাঁতি। এই তাঁত শিল্পের উন্নতির জন্য রবীন্দ্রনাথ বিশেষ উৎসাহী ছিলেন। বয়ন-শিল্পের উন্নতির জন্য শ্রীরামপুর থেকে একজন ভালো তাঁতিকে এখানে আনা হয়েছিল কবির উদ্যোগে। পরে কালীগ্রামেরই একজন উদ্যোগী মুসলমান জোলা বা তাঁতিকে শান্তিনিকেতনে পাঠিয়েছিলেন নানারকমের নকশা তোলা কাপড় বোনা শেখার জন্য। এক সময় এখানে ছোটোখাটো বয়ন স্কুল খোলা হয়। তাঁতিকে কাজ দেওয়া এবং তাদের জন্য সুতার ব্যবস্থাও করেছিলেন। এই সুতো কেনার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের সেরেস্থার কিছু লোকজন বেশী দাম দেখিয়ে রবীন্দ্রনাথকে ঠকিয়েছিলেন।
এছাড়া কবি বিভিন্ন ধরনের কুটির শিল্প স্থাপনেরও চেষ্টা করেন। যেমন মৃৎশিল্প, ছাতা তৈরী ইত্যাদি।
কৃষি ব্যাংক স্থাপন
রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, ১৯০৫ সালে বাংলাদেশে সরকারী কো-অপারাটিভ আন্দোলন আরম্ভ হয় নাই। ১৯০৫ সালে ব্যাংক বলিতে কী বুঝাইতো, তাহার কোনো ধারণা সাধারণ লোকের ছিল না।
সে সময়ে সাধারণ লোকের টাকা পয়সা লেনদেনের একমাত্র ভরসা ছিল মহাজন। তারা চক্রবৃদ্ধিহারে সুদ নিয়ে তাদের ঋণজালে বেঁধে ফেলত। এভাবে তারা সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ত। এটা ছিল সে সময়ের মানুষের সর্বনাশের মূল। এই মহাজনরা তখন সাহা সম্প্রদায়ের লোক ছিল। আর শোষিত হত তৎকালীন প্রজা অর্থাৎ শেখ সম্প্রদায়ের লোকজন। রবীন্দ্রনাথ সাহাদের হাত থেকে শেখদের বাঁচানোর উদ্দেশ্যে পতিসরে কালিগ্রাম কৃষি ব্যাংক স্থাপন করেন। প্রবর্তন করেন ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবস্থা।
সে সময়ে রবীন্দ্রনাথের প্রবল অর্থসংকট ছিল। কিন্তু ঋণগ্রস্থগ্রামবাসীদের ঋণমুক্ত করার জন্য তিনি অস্থির হয়ে উঠলেন। শেষ পর্যন্ত তাঁর নিজের বন্ধুবান্ধব এবং দু’একজন ধনী মহাজনের কাছ থেকে কয়েক হাজার টাকা সুদে টাকা ধার নিয়ে স্থাপন করলেন এই কৃষিব্যাংকটি।
চাষীরা মহাজনদের কাছ থেকে মাসিক শতকরা ১০ টাকা বা আরও বেশি সুদে টাকা ধার নিত। রবীন্দ্রনাথের পতিসর কৃষি থেকে সুদ নিত বছরে শতকরা ১২ টাকা। এই ব্যাংক বিনা বন্ধক ছাড়াই ঋণ দিত। ফলে পতিসর ও কলিগ্রামে স্থানীয় মহাজনদের টাকা ধার দেওয়ার ব্যবসা প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কৃষকদের মধ্যে এই ব্যাংক এতোই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে, তাদের ঋণের চাহিদা মিটানো স্বল্পশক্তির এ ব্যাংকের পক্ষে সম্ভব ছিল না। পরে যখন কবি ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার পেলেন, সেই নোবেল পুরস্কার থেকে পাওয়া ১০৮,০০০ টাকা তিনি দিলেন শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মবিদ্যালয়কে। কবির শর্তনুসারে বিদ্যালয় সে টাকা জমা রাখল পতিসর কৃষি ব্যাংকে। বাংক বিদ্যালয়কে বার্ষিক ৭ টাকা হারে সুদ দিত। ফলে ব্যাংক আরো স্বচ্ছল হয়ে ওঠে--চাষীদের ঋণদানের সুযোগ আরো বেড়ে যায়। ১৯১৬ সালে রাজশাহী জেলা গেজেটিয়ারে আই,সি,এস ও’ম্যালে সাহেব মন্তব্য লিখেছিলেন—‘(ঠাকুর জমিদারিতে) একটি কৃষি ব্যাংক আছে, সেখান থেকে রায়তদের শতকরা বার্ষিক ১২ টাকা হার সুদে ঋণ দেওয়া হয়। বাংকে যাঁরা টাকা রেখেছেন তাঁরা মূলত কবির কলকাতার বন্ধুবান্ধবেরা—তারা সুদ পান শতকরা ৭ টাকা হারে। এই ব্যাংক প্রায় ৯০,০০০ টাকা ঋণ দিয়েছে।‘
আরো স্বচ্ছল করার জন্য কবি ৯৭১৭ সালে তাঁর বইয়ের রয়ালিটি এবং আমেরিকায় বক্তৃতা বাবদ প্রাপ্ত টাকা থেকে ৯০০০ টাকা ব্যাংকে জমা দেন।
ব্যাংক চলেছিল পুর কুড়ি বছর। অমিতাভ চৌধুরীর হিসেব মতে ১৯০৫ সাল থাকে ১৯২৫ সাল পর্যন্ত চলেছে ব্যাংক। রবীন্দ্রভবনে ব্যাংকের শেষবারের হিসেবপাতির বিবরণ পাওয়া যায় জুলাই ১৯২৩ সালে। রথীন্দ্রনাথ লিখেছেন পিতৃস্মৃতি’তে –‘ ব্যাংক খোলার পর বহু গরীব প্রজা প্রথম সুযোগ পেল ঋণমুক্ত হওয়ার। কৃষি ব্যাংকের কাজ কিন্তু বন্ধ হয়ে যখন Rural Indebtedness—এর আইন প্রবর্তিত হল। প্রজাদের ধার দেয়া টাকা টাকা আদায়ের উপায় রইল না।‘
এভাবেই রবীন্দ্রনাথের ব্যাংক অর্থাৎ পতিসর কৃষি ব্যাঙ্ক এবং কবির নোবেল পুরস্কারের টাকা প্রজা-হিতে পানিতে ডুবে যায়। ব্যাংককে রক্ষা করার জন্য কবি ব্যাংকটিকে জয়েন্ট স্টক কোম্পানিতে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। সে সুযোগ আর ঘটেনি।
রবীন্দ্রনাথ যখন প্রজাহিতে কৃষি ব্যাংক খুলেছিলেন পতিসরের মত খুদে এক অজপাড়া গাঁয়ে—তখন একালের ক্ষুদ্র ঋণের জনক বলে স্বীকৃত ড. মুহাম্মদ ইউনুসের জন্মই হয়নি। ইউনুসের ব্যাঙ্কের সুদের হার সর্বসাকুল্যে ২৮—৩২ % মত। রবীন্দ্রনাথের ব্যাংকের সুদের হার ছিল ১২%। ইউনুসও নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন। এই টাকাকে তিনি দেন দরবার করে সরকারের তরফ থেকে ট্যাক্স ফ্রি করে নিয়েছেন। কোনো জনহিতকর কাজে দান করেননি। নিজের ব্যাক্তিগত ফান্ডেই জমা রেখেছেন।
সুত্র।
১. রবীন্দ্রজীবনকথা : প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়
২. রবিজীবিনী : প্রশান্তকুমার পাল
৩. রবীন্দ্রভুবনে পতিসর
৪. কৃষকজীবনের শরিক যে জন : অমিতাভ চৌধু্রী
৫. রবীন্দ্রনাথের আত্মীয়স্বজন : সমীর সেনগুপ্ত
৬. পিতৃস্মৃতি : রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৭. তপন চট্টোপাধ্যায় : রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ
মন্তব্য
টেগোর এন্ড কোং - নামে কোন ব্যাংক ছিল কি?
পতিসর কৃষি ব্যাংকের ঋণ প্রদানের খাত- আদায়ের কিস্তি- ব্যাংকের জনবল ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত জানার আগ্রহ হচ্ছে। ধন্যবাদ।
রবীন্দ্রনাথ যখন প্রজাহিতে কৃষি ব্যাংক খুলেছিলেন পতিসরের মত খুদে এক অজপাড়া গাঁয়ে—তখন একালের ক্ষুদ্র ঋণের জনক বলে স্বীকৃত ড. মুহাম্মদ ইউনুসের জন্মই হয়নি। ইউনুসের ব্যাঙ্কের সুদের হার সর্বসাকুল্যে ২৮—৩২ % মত। রবীন্দ্রনাথের ব্যাংকের সুদের হার ছিল ১২%। ইউনুসও নোবেল প্রাইজ পেয়েছেনএই
#রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে ক্ষুদ্র ঋনের জনক ছিলেন তা প্রথম জানতে পারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৌমিত্র শেখর রচিত একটি প্রতিযোগীতামূলক পরীক্ষার বই থেকে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ নিয়ে যে হারে অতীতে আলোকপাত করা হয়েছে কিংবা এখনো হচ্ছে সেখানে উনার ক্ষুদ্র ঋনের দিকটি নিয়ে খুব কমই আলোকপাত করা হয়েছে, শুধু তাই নয় তিনি আরো যে বৃহৎ কর্মযজ্ঞের সূচনা করেছিলেন তা জানতে পারছি আপনার পোষ্টের মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে, অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাদেরকে।
#ভাল থাকবেন সবসময়
রবীন্দ্রনাথকে একটা নব্যসুদখোরী ব্যবসার প্রবর্তক বলা যায়?
আহারে!
এটা নিয়ে বিস্তারিত বললে ভালো হতো। কী সেই আইন? আগে কীভাবে ধার দেয়া টাকা আদায় হতো, আইনটার কারণে কেনো আর আদায় করা গেলো না? গরীবরা স্বেচ্ছায় তো ধার দেয়া টাকা তারপরেও ফেরত দিতেই পারতো, যেই আইনই হোক। যেহেতু আইনের পর আর ব্যবসা চললো না, তাহলে কি আগে প্রজাদের অনিচ্ছাতেও টাকা আদায় চলতো?
নতুন মন্তব্য করুন