ব্রজেন্দ্রনাথ মল্লিক
(বরিশালের পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি উপজেলাইয় আটঘর কুড়িয়ানায় দেশের সবচেয়ে বড় পেয়ারাবাগান অবস্থিত। এর পাশাপাশি বানারীপাড়া ও ঝালকাঠির কিছু অংশেও পেয়ারা বাগান আছে। এই এলাকাগুলো হিন্দু সম্প্রদায়ের নমশুদ্র অধ্যুষিত। একাত্তর সালে এই পেয়ারা বাগানে পাকবাহিনী নৃশংস গণহত্যা চালায়। সেখানে গড়ে ওঠে মুক্তিবাহিনী। তাদের মধ্যে নারী মুক্তিযোদ্ধাদের টিম পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে মরণপণ প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
এই পাকবাহিনীর গণহত্যা আর নারী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের কাহিনীটি বলেছেন নারী মুক্তিযোদ্ধা বিভা মল্লিক। তার দাদা ব্রজেন্দ্রনাথ মল্লিক ঊনসত্তরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। কুড়িয়ানা বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন একাত্তরে। তাঁর অনুলিখনেই বিভা মল্লিক, শিখা, সুনন্দাদের মুক্তিযুদ্ধের ডাইরী ধারাবাহিকভাবে সচলায়তনে প্রকাশিত হবে। উন্মোচিত হবে পেয়েরা বাগানের অকথিত একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের একটি অধ্যায়। এই ডাইরী লিখিত হয় ১৯৭৮-৮০ সালের দিকে।)
এক
শর্ষিনায় অভিযান
প্রতিটি মানুষ সে যত খারাপ বা চরিত্রহীন হোক না কেন তার একটা না একটা সদগুণ থাকে। কথাটা কে বলেছিল জানি না। কথাটাকে আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি। বিশ্বাস করি আরও একটা কথা। শুধু বিশ্বাস নয় জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েছি অনুভূতির রসে সিঞ্চিত করে। তা হল, একটা ব্যক্তি মানুষের সমগ্র জীবন বিচার করে দেখলে তার মধ্যে একটা স্বর্ণযুগ খুঁজে পাওয়া যায়। তার জীবন-ইতিহাসের পাতায় সোনার অক্ষরে লেখা থাকে জীবনের একটা পরিসর—একটা ব্যাপ্তিকাল। অন্যের কাছে তা থাকতে পারে অজানা—থাকতে পারে একান্ত গোপন। তবুও প্রতিটি ক্ষণভঙ্গুর জীবনে এক আধটু ক্ষণ বাস্তবিকই গৌরবের আলোকে আলোকিত হয়। সেটা নিছক ব্যক্তিগত হতে পারে। সেটা হতে পারে কারও বাল্যজীবনে, কারও ছাত্র জীবনে, কারও বা কর্মজীবনে।
হ্যাঁ, আমার জীবন-ইতিহাসের সেই স্বর্ণযুগ এসেছিল। আমার জীবনের ভবিষ্যৎ ঘটনাগুলো এখনো ঘটতে বাকি আছে। আমি সাতাশ বছরের একটি মেয়ে মাত্র। তবুও বলব আমার জীবনের স্বর্ণযুগ চলে গেছে। চলে গেছে বলেই স্মৃতিকে রোমন্থন করে চলেছি। স্মৃতির ভাণ্ডার থেকে কাগজের পাতায় তুলে ধরতে পারব এমন ধারণা আমার ছিল না।
আমার জীবন-ইতিহাসের সেই স্বর্ণযুগ ক্ষণস্থায়ী। একটা জীবনের বিভিন্ন ঘটনা পরম্পরা বিচার করলে একটা মুহুর্ত বলে মনে হবে। একবার মাত্র উজ্জ্বল আলো বিকিরণ করে নিভে শেষ হয়ে গেছে উল্কার মত। উদাহরণটা অনেকের ভালো না লাগতে পারে অথবা কেউ ভাবতে পারেন আমি বাড়িয়ে বলছি। কিন্তু আমি বলব আমার মত সামান্য একটা মেয়ের জীবনে তা উল্কার আলোর মত।
মাত্র আড়াই মাসের ঘটনা। একটা পূর্ণ জীবনের সুদীর্ঘ সময়ের মধ্যে বিচিত্র সব ঘটনা ঘটে থাকে। তার মধ্যে মাত্র আড়াই মাসের কিছু ঘটনা সমুদ্রের বুদ্বুদ মাত্র। নিমিষে বিলীন হয়ে যাবার অপেক্ষা শুধু।
বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসে আজ বাংলাদেশ একটা সার্বভৌম রাষ্ট্রের নাম। একটা রাষ্ট্র, দেশ বা জাতির স্বাধীনতা লাভের ইতিহাস মাত্র ন’মাসের সংগ্রামের কাহিনী। উনিশশো একাত্তরের পঁচিশে মার্চ থেকে ষোলোই ডিসেম্বরের ইতিহাসের কয়েকটা বুদ্বুদেরই মত। মহাকালের মহাসাগরে এ-কটি মাত্র বুদ্বুদ হলেও এর উপর পড়েছিল শতসূর্যের বর্ণচ্ছটা। বিভিন্ন বর্ণের প্রতিবিম্ব পড়ে ঝলমল করে উঠেছিল সেই কটি মাত্র বুদ্বুদ। ছোট বাংলাদেশটি জন্মেছিল বিশ্বের বড় বড় শক্তির চোখ রাঙানী উপেক্ষা করে। পৃথিবীর বৃহত্তম শক্তিবর্গ চমকে উঠেছিল বাংলাদেশের গণভ্যুত্থানে। দৃঢ় মনোবল আর অটুট আত্মবিশ্বাস জাতীয় জীবনে দানা বাঁধলে তার মুক্তি কেউ রুখতে পারে না। তার প্রমাণ বাঙালীরা।
আজ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে স্মরণ করছি। তার মধ্যে একান্তই ক্ষণকালের মাত্র আড়াই মাসের কিছু ঘটনার সঙ্গে আমাকে যুক্ত করতে পেরেছিলাম। সেজন্য আজ আমি গর্বিত। মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত তা আমি গর্বের সঙ্গেই স্মরণ করে যাব।
মৃত্যু আমার হয়ে গেছে। আত্মিক মৃত্যু। ভাবছি জাগতিক মৃত্যু হওয়াই আমার পক্ষে বাঞ্ছনীয় ছিল। আজ আমি পঙ্গু—বাঁ পায়ে জোর নেই। পাক-সেনাদের গুলির শিকার হয়েছে। আমার বিয়ের চিন্তা অবান্তর। নারীজাতির একান্তকাম্য নারীত্ব এবং মাতৃত্ব থেকে আজ আমি বঞ্চিত। তাই ভাবছি সেদিন গুলিটা বুকে এসে লাগল না কেন! শরীরের নিচের দিকে গুলি লাগার ফলে আজ আমি মাতৃত্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছি। রোশেনারার মত ভাগ্য আমার হয়নি—বাঙালির জাতীয় ইতিহাসে রোশেনারার নাম চিরস্মরণীয় হয়ে থাকল।
রোশেনারাকে আমি দেখিনি। তার সঙ্গে আমার চেহারার কি মিল বা অমিল তা আমি জানি না। তবে আমিও তার সমবয়েসী ছিলাম। সে হায়ার সেকেন্ডারীর ক্লাশের ছাত্রী ছিল। আমিও ও একই ক্লাশের ছাত্রী ছিলাম। পার্থক্য শুধু সে ছিল রাজধানী ঢাকা শহরে, আর আমি ছিলাম গ্রামের নিরিবিলি এক কলেজে। ডিনামাইট নিয়ে রোশেনারার মত ট্যাঙ্কের সামনে বুক পেতে দিতে নাই বা পারলাম। কিন্তু গ্রেনেড নিয়ে যা করেছিলাম সে সময় খানসেনার গুলিটা অন্তত আমার বুকে এসে লাগতে পারত।
মানুষ দেশের জন্য আদর্শের জন্য মরতে চায়। মরতেও পারে। হাসতে হাসতে মেশিনগানের গুলির সামনে বুক পেতে দিতে পারে। ইতিহাসে তেমন অনেক শুনেছি। বারুদ জ্বলতে পারে—জ্বলবার ক্ষমতা আছে। বারুদের বিভিন্ন রকমের উপাদান ভিন্ন ভিন্ন পাত্রে থাকলে তা আলাদাভাবে জ্বলবার শক্তি রাখে না। আর একত্রে মেশাবার পরেও চাই একটু আগুনের স্পর্শ। দরকার দেশলাই-এর একটা কাঠি।
শেখ মুজিবুর রহমানকে আমি জীবনে একবার মাত্র দেখেছি। তিনিই সেই দেশলাই-এর কাঠিটি ধরিয়ে দিয়েছিলেন আমার মনের বারুদে। জ্বালিয়ে দিয়েছিলে্ন একদিনের বক্তৃতায়। তার কথা স্মরণ করে তাই সেদিন নির্ভিকভাবেই এগিয়ে গিয়েছিলাম। সেদিন ছিল আমার জীবনের প্রধান দুর্ধর্ষ অভিযান তথা মুক্তিযুদ্ধের জীবনের মেজর অপারেশন। শত্রুর ব্যুহের মধ্যে ঢুকে ভয়াবহ অভিজ্ঞতা আর লোমহর্ষক ঘটনা ঘটিয়েছিলাম! একটু হেরফের হলেই মেশিনগানের গুলিতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতাম। রেণু রেণু হয়ে হাওয়ায় ভেসে যেত আমাদের দুজনের দেহ। দুজন মেয়ে মাত্র আমরা। আর আমাদের সাহায্য করেছিল জেলে যৈজ্ঞকাকা আর কালু।
স্বরূপকাঠিতে শর্ষিনার পীর সাহেবের বাড়ি। বাড়ির সঙ্গে সন্ধ্যা নদীতে বিরাট চর। চরের উপর দিয়ে লম্বা কাঠের সিঁড়ি আছে নদীর মাঝ বরাবর। সিঁড়ির শেষ প্রান্তে জেটি। লঞ্চঘাট। সেই ঘাটে—অস্ত্রশস্ত্র সহ একখানা গানবোট আর দুখানা লঞ্চ। তিনখানাতেই রয়েছে পাক-সেনা। মাঝে ছোট লঞ্চে রয়েছেন কর্নেল আতিক মালিক এবং ক্যাপ্টেন এজাজ। পিরোজপুরে পা দিয়েই যে কর্নেল মালিক ক্যাপ্টেন এজাজের সাহায্যে এরেস্ট করেন এস.ডি.ও, এস.ডি.পি ও ( কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমদের পিতা ফয়জুর রহমান আহমেদ), একজন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সহ পিরোজপুর মহকুমার প্রশাসনের পাঁচ প্রধান ব্যক্তিকে। পরের দিনেই বলেশ্বর নদীর তীরে তাদেরকে নিয়ে গুলি করে ফেলে দিয়ে সৃষ্টি করেন চরম সন্ত্রাস। স্থানীয় শান্তিকমিটির কর্তারা দেখলেন সমূহ বিপদ। তারা যুক্তি করে কর্নেল মালিকের গতিটাকে ঘুরিয়ে দিলেন হিন্দু এলাকার দিকে। কাফের হিন্দুদের খতম করতে মালিক-এজাজের জুড়ি নেই। তারা দশবারো দিনের মধ্যেই ছয় থেকে সাতশ হিন্দুকে খতম করে হয়ে উঠলেন দোজোখের আজরাইল। এরপরেই মালিক এজাজের হিংস্র দৃষ্টি হিন্দু-প্রধান স্বরূপকাঠি থানার দিকে পড়ল। এই এলাকায় ধংসযজ্ঞ করার পরিকল্পনা করার জন্যই গেল শর্ষিণার পীরের বাড়ি। এই পীরের বাড়িতে রয়েছে ট্রেনিং প্রাপ্ত এক হাজার সহস্র রাজাকার। এরা আগে ছিল আনছার বাহিনীর সদস্য। পাক-মিলিটারীর নিকট থেকে অস্ত্রশস্ত্র পেয়ে রাজাকার বাহিনীতে ঢুকে গেল রাতারাতি।
সেদিন রাত নটা হবে। আমাদেরকে নিয়ে যৈজ্ঞকাকার বাচাড়ি নৌকা এসে লাগল চরের মাঝ বরাবর। একটু ওপাশেই কাঠের সিঁড়ি। সেই সিঁড়ির শেষ প্রান্তে গানবোট এবং লঞ্চ। আমাদের জীবনের প্রথম গেরিলা অপারেশন। শত্রুব্যুহের মধ্যে প্রবেশ করেছি। দলে মাত্র দুজন--শিখা আর আমি। দুজনেই কোমরে আটকে নিয়েছি দুটো রিভলভার। কাপড়ের মধ্যে হ্যান্ড গ্রেনেড দুটোকে হাত দিয়ে আন্দাজ করে নিলাম। মনে মনে জয় বাংলা বলে নেমে পড়লাম হেউলি ও নলবনের মধ্যে। চরে কাদা। পা দুখানি অনেকখানি বসে গেল কাদার মধ্যে।
লগির খোঁচা দিয়ে বাচাড়ী নৌকাটাকে দূরে নিয়ে গেল যৈজ্ঞকাকা। একবার মাঝ নদীতে পড়তে পারলেই হল। নৌকার পাছায় বৈঠা হাতে কালু।
এর মধ্যে একখানা ছিপ ডিংগি এসে লাগল যৈজ্ঞকাকার বাচাড়ী নৌকার সঙ্গে।
আমরা হেউলি বনের মধ্যে বসে পড়লাম অন্ধকারে। শুনতে পাচ্ছি ওদের কথাবার্তা। ওরা একদম খাস পীরের বাড়ির রাজাকার। নদীতে টহলধারী গ্রুপ। ভাগ্যিস আমরা নেমে পড়ার একটু পরে এসেছে রাজাকারের দলটি।
--কে রে? রাজাকাররা টর্চ মেরে জিজ্ঞেস করল যৈজ্ঞকাকাকে। টর্চের আলোতে ফর্সা হয়ে গেল জায়গাটা। চক চক করছে চরের কাদাবালি।
--আমি যৈজ্ঞ।
--যৈজ্ঞ কিরে? হিন্দু—শালা মালাউন। বল, তোরা কোন দলের স্পাই?
যৈজ্ঞকাকা কাচুমাচু করে বললেন, যে কন সাইবেরা। মোরা জাইল্যা। এই পীর সাইব আমাগো মা-বাপ। মোরা নদীতে জাল পাতি আর মাছ ধরি।
--এই রাতে কী মাছ ধরিস?
--এইতো ভাটার শেষ। জোয়ার লাগলেই আগ-জোয়ারে জাল পাতমু। তামাক টামাক খেয়ে নিলাম এট্টু।
--দেখি তোদের নৌকার কি আছে? দু-তিনটে রাজাকার উঠে পড়ে বাচাড়ি নৌকার পাটাতনের উপর।
-মাছটাছ কই? মাছ দে আমাদের। বলে আরেক রাজাকার।
--জাল পাতমু তো জোয়ারে। আর জাল উডামু হেই বেয়ান (ভোর) রাইতে, এহোন মাছ পামু কই?
রাজাকাররা বাচাড়ির মধ্যেও আরো দু-একবার টর্চ মারল। কিছু না পেয়ে নিজেদের ছিপ ডিংগিতে নেমে চলে গেল। সড় সড় করে চলে গেলো ওদের নৌকা। কর্নেল মালিক রয়েছেন পীরের ঘাটে। তাই এখন টহল দেবার বিরাম নেই এদের।
তারিখটা মনে আছে স্পষ্ট করে, উনিশ শো একাত্তরের এগারোই জুন। বৃষ্টি বাদলের সময়। আকাশ আগে থেকেই মেঘলা ছিল। টিপ-টিপ করে বৃষ্টি শুরু হচ্ছে। ভগবানকে ধন্যবাদ। বৃষ্টি হলে আমাদের ভালোই হয়। রাজাকারদের তৎপরতা একটু কমে যাবে। আমরা হামাগুড়ি দিয়ে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি হেউলিবনের ভিতর দিয়ে। সারা গায়ে কাদা। একাকার হয়ে গেছি।
প্রায় একশ গজ দূরে পাকিস্তানী মিলিটারির লঞ্চ। গানবোট থেকে ঘুরে ঘুরে সার্চ লাইটের আলো পড়ছে নদীতে। এ পাশে আলো পড়তেই ফর্সা হয়ে যায় দিনের মত।
বৃষ্টিতে ভিজে গায়ে কাদা মেখেও খানিকটা এগোলাম আমরা। হ্যান্ড গ্রেনেডের রিং হাত দিয়ে আন্দাজ করে নিচ্ছি আর একবার। ন-দশ মিনিট চলে গেল। সার্চ লাইটের আলো এমনভাবে এসে পড়ছে জলে, নামার সাহস পাচ্ছি না। লাইটের আলোতে দেখলাম কচুড়িপানার দাম ভাটির স্রোতে ভেসে গিয়ে লঞ্চের গায়ে লাগছে। লঞ্চের গা ঘেঁসে চলে যাচ্ছে। আমাদের লক্ষ্য একদম মাঝের লঞ্চখানা। আমাদের কমান্ডার ক্যাপ্টেন বেগ বলে দিয়েছেন স্টিলবডির সাদা লঞ্চে থাকবেন কর্নেল মালিক এবং কাপ্টেন এজাজ। সে লঞ্চ হয় মাঝখানে-- নয়ত পিছনে থাকবে। সেই সাদা লঞ্চখানাই রয়েছে মাঝখানে। সামনের গানবোটে কামান, অস্ত্রশস্ত্র এবং পাক-সেনা বোঝাই। পিছনের লঞ্চে হয়ত মালিক-এজাজের সিকিউরিটি ফোর্স। ওদের আলোতে আবার ভালো একবার দেখে নিলাম। স্টিলবডির সাদা লঞ্চখানির ইঞ্জিনের কাছাকাছি জায়গাটা আড়াই ফুটের মত জেগে আছে জল থেকে। আর সেখানে একটা শিকল ঝুলে আছে জলের দিকে।
জীবনের চরমতম পরীক্ষা। ক্যাপ্টেন বেগের নির্দেশ। অপারেশনে সফলকাম হতেই হবে। মনে একটু বল আনার চেষ্টা করছি। আমি রঞ্জনবাবুকে দেবতার মত ভক্তি করি। তিনি শেখ সাহেবের বন্ধু এবং প্রকৃত সহকর্মী। সেই রঞ্জনবাবুর একটা কথা মনে পড়ে গেল। তিনি বলতেন, স্যাক্রিফাইস করার সদিচ্ছা নেই, হঠাৎ একটা লোক মরে গেল, সে মরণের কোনো দাম নেই। যাদের স্যাক্রিফাইস করার মনোবল থাকে তারাই গুলির সামনে দাঁড়িয়ে মরতে পারে। আর সেই মরাটা হিসাবে ওঠে। সে আত্মদানের ফলে অন্যের মনেও জেগে ওঠে আত্মপ্রেরণা। জনগণের মনে সেই প্রেরণা এক সঙ্গে জেগে উঠলে—তার বিনিময়ে মুক্তি আসে জাতীয় জীবনে।
কাদার মধ্যে শুয়ে অপেক্ষা করছি। আলোতে একটা জিনিস লক্ষ্য করে শিখা আমাকে ফিসফিস করে বলল, দেখছিস তো, সার্চলাইটের আলোতে সব জায়গা পরিস্কার দেখা যায়। কিন্তু জেটির সঙ্গে সিঁড়িটা যেখানে মিশেছে সেখানে দশ-বারো গজ জায়গাতে অন্ধকার। একান্ত নিচ থেকে ঘুরিয়ে আলো না ফেললে কিছু দেখা যায় না ওখানে। আজকের অপারেশনে যদি বেঁচে যাই তাহলে ঐ জায়গাটাই হবে আমাদের আশ্রয়।
ঝুপ ঝুপ করে বৃষ্টি এলো আবার। জোলো বাতাসে লঞ্চ থেকে ভালো রান্নার ঘ্রাণ ভেসে আসছে। খানা তৈরী হচ্ছে খান সেনাদের। কর্নেল-ক্যাপ্টেনের জন্য খাবার—কোপ্তা, কাবাব, বিরিয়ানী তো হচ্ছেই। বৃষ্টিটা জোরে আসতে আলোটাও যেন বারে বারে আসছে গানবোট থেকে।
অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছি জলের স্রোতের দিকে। পাঁচ ছ গজের মধ্যে ভেসে আসছে দুটো কচুড়িপানার দাম। শিখা আমার হাতে টিপ দিয়ে নেমে পড়ল গলা জলে। সঙ্গে সঙ্গে নেমে পড়লাম আমিও। আলো ঘোরাবার এক ফাঁকে কচুড়িপানা ধরে ঠেলে নেমে গেলাম স্রোতের দিকে।
তখন আমার মনের অবস্থা যে কী হয়েছিল তা এখন আর আমি বলতে পারব না। বুকের মধ্যে তখন কী ঢিপ ঢিপ করেছিল—না, একদম নিরেট হয়ে গিয়েছিল মৃত্যুর আতঙ্কে, তা আমার মনে নেই। তবে হ্যাঁ মৃত্যুর আগে বা চরম বিপদের মুখে মানুষের মুখে মানুষের দেহে ও মনে এক অলৌকিক শক্তির উদয় হয়। সেই শক্তি দেহটাকে চালিয়ে নিয়ে যেতে পারে। তেমন একটা মহাশক্তির অনুভূতি আমার হয়েছিল।
কচুড়িপানা মাথায় দিয়ে স্রোতের সঙ্গে গিয়ে লেগে গেলাম সাদা লঞ্চের গায়ে। ইঞ্জিনের পাশে ঝুলানো শিকলটা ধরলাম। ধরল শিখাও। একটু আরাম বোধ করলাম। শ্বাস-প্রশ্বাসটাকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছি। শিখার নাকের গরম নিঃশ্বাস আমার কাঁধের উপর লাগছে। আমার কাঁধে শিখা একটু চাপ দিল। সে যেন এক বিদ্যুতের স্পর্শ। আর অপেক্ষা নেই—মরিয়া হয়ে দাঁতে কামড়ে ধরেছি গ্রেনেডের রিং। মুহুর্তমাত্র। ফিতাটাকে টান মেরে ছুড়ে মারলাম ইঞ্জিন লক্ষ্য করে। শিখাও মারল একই সঙ্গে।
মাত্র কয়েকটা সেকেন্ড। কী যে ঘটে গেল তা একের পর এক মনে করতে অনেকটা ভাবতে হয়। এখন সেই স্মৃতি মনে পড়লে আতঙ্কে কাঁপুনি ওঠে।
দু-দুটো হ্যান্ড গ্রেনেড। কয়েক মুহুর্তের মধ্যেই ভীষণ গর্জন করে ছিন্ন ভিন্ন করে দিল অমন মজবুত লঞ্চের ভিতরের সব কিছু। আর কয়েক সেকেন্ড পরেই গর্জে উঠল গানবোটের মেশিনগান। কামানের গোলা ছুটল নদীর ওপারে, নদীর অপর পারের ভুরিয়ারী গ্রামের নারকেল শুপারির বাগান ছিন্ন ভিন্ন করে।
আর আমরা দুজন? কী করে যে জেটির দক্ষিণ পাশ ঘেঁসে সেই সিঁড়ির নিচে এসেছি, কী করে খুঁটির সঙ্গে আটকানো তেরছি বেয়ে সিঁড়ির পাটাতনের একেবারে তক্তার নিচে গিয়ে দুজনে উঠেছি, তা মনে করতে এখন আমার চৈতন্যকে অনেকখানি পীড়া দিতে হয়।
সে যাত্রা বেঁচে গিয়েছিলাম আমি আর শিখা। বেঁচে গিয়েছিলেন কুখ্যাত মালিক-এজাজ জুটিও। তারা দুজনে তখন ঐ একদম পিছনের লঞ্চে ছিলেন। তবে কজন পাকসেনার সঙ্গে তাদের দুই সহকারী অফিসার মারা গিয়েছিল। তা আমরা পরে জানতে পেরেছিলাম।
(চলবে)
মন্তব্য
ভালো লেগেছে
চলুক ।
এই ঘটনাগুলি আজ ইতিহাস। যথাযথ সংরক্ষণ ও প্রচার না পেলে ক্রমে এগুলি গল্পকথা ও শেষে 'লোকে-বলে-আসলে-নয়'-তে পরিণত হবে। আপনি একটি অসামান্য কাজ করছেন এদের এখানে তুলে এনে।
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
দারুন লিখেছেন !
নতুন মন্তব্য করুন