ব্রজেন্দ্রনাথ মল্লিক
কুড়িয়ানায় পাকবাহিনীর আক্রমণের প্রস্তুতি
(স্বরূপকাঠির আটঘর কুড়িয়ানার হিন্দু নমশুদ্র এলাকায় নির্মম হত্যাযজ্ঞ সংগঠিত করেছিল পাকবাহিনী। তার সব আয়োজন করেছিলেন শর্ষিণার তৎকালীন গদিনসীন পীর। এই এলাকায় উনিশ একাত্তর সালের মার্চের আগে থেকেই প্রস্তুতি চলে স্বাধীনতা সংগ্রামের। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আহবানে মানুষ সংগঠিত হয়। মেয়েরাও মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ গ্রহণ করে।
সে সময়ে মেজর জলিল পাকিস্তান থেকে ছুটিতে এসেছিলেন। বরিশালের সংগ্রাম কমিটির অনুরোধে তিনি বরিশাল এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের সেনাপতির দ্বায়িত্ব গ্রহণ করেন। ক্যাপ্টেন বেগ স্বরূপকাঠি এলাকার দ্বায়িত্বে ছিলেন।
এই ধারাবাহিকে নারী মুক্তিযোদ্ধা বিভা রানীর ডাইরী লিখেছেন তাঁর ভাই ব্রজেন্দ্রনাথ মণ্ডেল।) )
প্রথম পর্ব (লিংক)
দুই
আগুনের মধ্যে পোড়া না দিলে কোনটা খাঁটি সোনা ঠিক চেনা যায় না। বিপদ ঘনিয়ে আসে ভয়ঙ্কর দুর্দিনে। তখন চেনা যায় মানুষের আসল রূপ। পাক-সেনা তাণ্ডবের ভয়ঙ্কর দুর্দিনে কিছু লোককে চিনেছিলাম। তার মধ্যে দুজন লোকের কথা একটু খুটিয়ে না বললে ত্রুটি থেকে যাবে। তাদের মধ্যে আমাদের যৈজ্ঞকাকা--আরেক জন ফকির মাঝি। দুজনেই তেমন লেখাপড়া জানে না এবং সমাজের উঁচু স্তরে তাদের বাস নয়। অথচ মুক্তিযুদ্ধে তারা যে কাজ করেছে—যে আত্মত্যাগ করেছে তা মানুষের চরিত্রে বিরল। একজন যৈজ্ঞকাকা মরে শহীদ হয়ে অমর হয়ে থাকল আমাদের স্মৃতিতে। অন্যজন ফকির মাঝি জীবিত থেকেও মৃতপ্রায়। আশি বছরের বৃদ্ধ করুণ নয়নে তাকিয়ে আছে পরপারের দিকে। তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবছে বিশ্বাস ঘাতক ছেলের কথা। তাদের কথা মনে মনে ভাবছি কত অখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা এভাবে প্রাণ বিলীন করে দিয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে, কে তাদের হিসাব রাখবে?
আমাদের পুব পাড়ায় যৈজ্ঞকাকার বাড়ি। নদীতে মাছধরা আর মাছ বিক্রি করা তার পেশা। ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি বিয়াল্লিশ ঈঞ্চি বুকের ছিনাওয়ালা সেই শক্ত সামর্থ মানুষটিকে। নির্ভীক ও দুঃসাহসী। আমরা তাকে কাকা বলে ডাকতাম।
যৈজ্ঞকাকার বাচারি নৌকা থাকত সন্ধ্যা নদীতে। সে নদীতে পাততো ছান্দিজাল আর বাদাজাল। তখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে ঢাকায়। আমরা হিন্দুরা আর বের হতাম না এলাকার বাইরে। যৈজ্ঞকাকা তখনও নিয়মিত জাল পাততে যেত সন্ধ্যা নদীতে। শর্ষিনার পীরসাহেবের বাড়ি আর স্বরূপকাঠি থানা—এর মাঝ বরাবর নদীতে থাকত তার নৌকা। দিনে রাতে গোণ মত জাল পাততো। সেই মাছ বিক্রি করত স্বরূপকাঠি বাজারে।
এই যৈজ্ঞকাকার কাছে মিলিটারিদের খবর পেতাম আমরা। এক কথায় কাকা ছিল আমাদের স্পাই। কী করে সে এই খবর সংগ্রহের কাজে বহাল হয়েছিল সেও এক ইতিহাস।
পীর সাহেবের পেয়ারা লোক শরিফ মিয়া। শরিফ মিয়া ছিলেন মুসলিম লীগের জোর পাণ্ডা। তার যাতায়াত ছিল পীর সাহেবের বাড়িতে আর স্বরূপকাঠির থানায়। পাক-সেনাদেরো তখন প্রধান যোগাযোগ ছিল পীর সাহেবের বাড়িতে এবং থানায়। আর মিলিটারির খবর পীরের বাড়িতে কখন কে আসে তা জানতেন শরীফ মিয়া।
শরীফ মিয়ার ভাইপো হাসেম থার্ড ইয়ারের ছাত্র। সে মনে প্রাণে আওয়ামী লীগে বিশ্বাসী। সহজ সরল জোয়ান ছেলে। এই জোয়ান ছেলেরা অধিকাংশই তখন শেখ সাহেবের কথায় চলে। হাসেমও আওয়ামী লীগের কাজ করার জন্য মনে প্রাণে প্রস্তুত। চাচা শরীফ মিয়ার নিকট থেকে পাকসেনাদের অনেক খবরই সংগ্রহ করার চেষ্টা করত হাসেম। আর সেই খবর অতি গোপনে আমাদের এলাকায় পাচার করতো যৈজ্ঞকাকার মারফত।
ধূর্ত শরীফ মিয়ার কাছে হাসেমের মতিগতি ঠিক ভাল লাগছিল না। তিনি একদিন হাসেমকে ডেকে সরাসরি বলে দিলেন, কলেজে পড়ে ওসব আওয়ামী লীগ করা চলবে না হাসেম। কথায় বলে নুন খাই যার গুণ গাই তার। আইজ পশ্চিমা খানেদের নুন খাইয়া নিমকহারামি? বলে একটু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন হাসেমের মুখের দিকে।
হাসেম চুপচাপ ছিল কোনো কথা না বলে।
শরীফ মিয়া কণ্ঠস্বর আরও দৃঢ় করে বললেন, হারামি, আওয়ামী লীগের বেবাক কাফের আর হারামি। ক্যা মেয়া, পাকিস্তান আমাগো বাদশা। তাগো বিরুদ্ধে তোমরা লড়বা ক্যা? একজন খাঁটি মোছলমান হইয়া আর একজন মোছলমানের গায়ে অস্তর ধরবা ক্যা? কাফের, আওয়ামী লীগের বেবাক শালা কাফের আর নিমকহারাম।
শরীফ মিয়ার মুখের উপর তর্ক করার সাহস তখনও হাসেমের হয় নি। তবুও একটু আমতা আমতা করে বলল, পশ্চিম পাকিস্তানের খানেরা যে আমাদের শোষণ—
হাসেমের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে শরীফ মিয়া আরও শক্তভাবে বলতে লাগলেন, আইজ সুযোগ পাইয়া ভাইরে তোমরা ভুইলা যাও?—ঐ তো তোমাগো কলেজে পড়ার দোষ। এই পীরের মাদ্রাসায় কেতাব পড়লে অমন বেনামাজি আর বেয়াদব হইতে পারতা না। ক্যা মেয়া, হিন্দু গো লগে বোঝপাড়া কইরা ঐ পশ্চিমা খানসেনারাই পাকিস্তান ভাগ কইরা আনছে। সে কেরামতি তোমাগো কি আছে মিয়া? আইজ পশ্চিমা খানে গো লগে কাইজা কইরা পাকিস্তানডারে দুই ভাগ করতে চাও? আর এট্টা আলাদা দ্যাশ বানাইতে চাও? এ নেমক হারামি খোদাতাল্লা সইবে না। ঘাস নিড়াবার কাঁচি দিয়া করবা লড়াই?
স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হতেই শরীফ মিয়া হাসেমকে চোখে চোখে রাখতে শুরু করলেন। হাসেমকে এলাকার বাইরে বের হতেই দিতেন না।
তখনও আটঘর-কুড়িয়ানা এলাকায় পাকিস্তানী মিলিটারি অপারেশন হয়নি। বরিশাল শহরের পতনের পর পাক মিলিটারির কাছে খবর ছিল পূর্ব পাকিস্তানের দ্বিতীয় নদীবন্দর ঝালকাঠির অধিকাংশ ব্যবসায়ীরা হিন্দু। পাল এন্ড কোম্পানীর সব ব্যবসা এবং বার্মাশেল অয়েল কোম্পানির এজেন্সি প্রাপ্ত তাদের অয়েল ট্যাংকারো ঝালকাঠিতে। বরিশালের পাক সামরিক কর্মকর্তা কর্নেল আতিক মালিকের নির্দেশে ঝালকাঠি বন্দর জ্বালিয়ে দেওয়া হল রাতারাতি। তারপর তিনি নিজেই তার দ্লবল নিয়ে চলে এলেন পিরোজপুরে। ক্যাপ্টেন এজাজের সহযোগিতায় এক প্রস্থ কাফের খতম করলেন। ক্যাপ্টেন এজাজকে পিরোজপুরে রেখে তিনি পটুয়াখালি অভিযানের ছক কষলেন। সেখানে তার ধ্বংসের কাজ এবং কাফের খতমের সঙ্গী হলেন দোজখের আরেক আজরাইল মেজর ইয়াহিয়া হামিদ।
বরিশাল শহরের উপকণ্ঠে সাগরদীতে ওয়াপদার বিরাট চত্বর। সেখানে পাক-মিলিটারির ক্যান্টনমেন্ট হল বরিশাল-পটুয়াখালি সদর দপ্তর। কর্নেল মালিক সাগরদীর এই প্রধান মিলিটারির ঘাঁটি থেকেই তার যুদ্ধ পরিচালনা করছেন।
শর্ষিণা পীরের বাড়িতে বিড়াট জামিয়া উলেমা মাদ্রাসা। তাতে প্রায় হাজার দশেক ছাত্র। এও অবৈতনিক মাদ্রাসার সব খরচ চলত মধ্যপ্রাচ্যের টাকায় এবং পাকিস্তান সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায়। তাই পীর সাহেব পাকিস্তান সরকারের প্রতি চির-অনুগত এবং বিশ্বস্ত।
পীরসাহেবের বাড়িতে আনছার ট্রেনিং-এর ক্যাম্প ছিল অনেক আগে থেকে। প্রায় হাজারের কাছাকাছি আনছার সংগ্রহ করতে পীরকে দূরে যেতে হয়নি। মাদ্রাসার ছাত্র থেকেই সব নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই আনছারদের কোনো অস্ত্রশস্ত্র ছিল না। ওদিকে আটঘর-কুড়িয়ানায় মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং শুরু হয়েছে। পীর সাহেবের কাছে সেই কাফেরদের বাড়বাড়ন্তের খবর ছিল। সেজন্য পীরের রাতে ঘুম ছিল না। টাইটেল পাশ উর্দু জানা এক আনছার কমান্ডার পীরসাহেবের হয়ে ফোন করল সাগরদী ক্যান্ট্নমেন্টে। ফোনে জানিয়েছিলেন আটঘর-কুড়িয়ানা সব হিন্দু কাফেরদের এলাকা। তারা সব পাকিস্তানের দুশমন। বিরাট এক মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটি সেখানে। সেখানে মুক্তিবাহিনীর আটটা সেক্টর কাজ করত। ভারত থেকে গোপন পথে অস্ত্রশস্ত্র আনছে। ওয়ারলেসে তারা খবর পাঠায় ভারতে। তারা যে-কোনো দিন আমাদের মাদ্রাসাও আক্রমণ করতে পারে। সেখানে মিলিটারি অপারেশন না হলে আমরা সুস্থ হয়ে ঘুমাতেও পারছি না ইত্যাদি।
বরিশালের সাগরদী ক্যান্টনমেন্ট থেকে ওয়ারলেসে অর্ডার এল পিরোজপুরের ক্যাপ্টেন এজাজের কাছে। সে অর্ডারের বিষয় ছিল : স্বরূপকাঠি যাও, শর্ষিণা পীরের বাড়ি যাও, তাঁকে সেফগার্ড দেও। আটঘর-কুড়িয়ানা সরেজমিনে তদন্ত করো। সেখানে এপারেশন করে দুশমন খতম করো—কাফের খতম করো।
সেই অর্ডার পেয়ে পিরোজপুরের ক্যাপ্টেন এজাজের অফিসের একজন ফোন ধরলেন শর্ষিণার পীরের বাড়িতে। ফোনের খবর সংক্ষিপ্ত : ক্যাপ্টেন এজাজ পরের দিনই পীরের বাড়ি আসছেন। তিনি পীরকে নিয়ে প্রথমে যাবেন স্বরূপকাঠি থানায়। তারপর তিনি আটঘর-কুড়িয়ানা এলাকায় যাবেন। সঙ্গে যেতে হবে থানার ও.সি. এবং পীর সাহেবকে। তাদের দুজনের কাজ হবে মিলিটারিদের পথঘাট চিনিয়ে দেওয়া। এবং কোথায় দুষমন বা কাফের আছে তাদের হাল হকিকত বলে দেওয়া।
ফোন পেয়ে গলা শুকিয়ে গেল খোদ পীর সাহেবের। পাক-সেনা যাবে হিন্দু এলাকায়, লড়াই করবে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে। তাতে পীরকে নিয়ে টানাটানি কেন, বাবা? তোরা বল অন্য কাজের লোক তোদের সঙ্গে পাঠিয়ে দেই। তা নয় স্বয়ং পীরকে নিয়ে টানাটানি।
পীর সাহেবের চামচা শরীফ মিয়া উপস্থিত ছিলেন সেখানে। তিনি বললেন, আপনি ফাও এত ভয় পাইতেছেন, ক্যা, সাইব। মিলিটারি আইবো তার ফোর্স নিয়া। তাতে অত ভয়ডরের কথা কী আছে?
--তুমি তার কী বুঝবে শরীফ মিয়া? আটঘর-কুড়িয়ানা এখনও হিন্দুস্থান। ভারত থেকে সুন্দরবনের পথে অস্ত্রশস্ত্র আসছে সেখানে। সেখানে কাফেরদের মুক্তিবাহিনীর আড্ডা। আমাকে যেতে হবে সেই খোদ হিন্দু এলাকায়—খাস কাফেরদের আড্ডার মধ্যে?
ধূর্ত শরীফ মিয়ার গোল গোল চোখের মণি ঘুরছিল। তিনি নুয়ে পীর সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি কী যে কন সাইব? যত রাজ্যের গুজব। অস্ত্র যদি আইসাও থাকে তা চালাবার মত কেরামতি থাকন লাগে। ফুঃ ঐ সব গর্তের ইঁদুরেরা অস্ত্র চালাবে?
--গর্তের ইঁদুর?
--হ, ঐ সব গর্তের ইঁদুর গাছের দু একটা কচি শিকড় কাটতে পারে। আর খান সেনারা হইল গিয়া এক একটা বাঘ। ঐ পাকিস্তানী ফোর্সের সামনে আইসা দেখুক না একেবারে মালাউনরা।
শরিফ মিয়া পীর সাহেবের মনে এমনি করে সাহস যোগানোর চেষ্টা করতে থাকেন।
পীর সাহেব ভাবতে থাকেন। তার উদ্বেগ কমে না। বললেন, আবার একবার ফোনটা ধর না শরিফ। ক্যাপ্টেন সাহেব ফোর্স নিয়া আসবে কি না কথাটা একটু জান তো ভালো করে। পীর সাহেবের কণ্ঠে অনুনয়ের সুর।
শরীফ মিয়ার ভয়টা কী? খান সেনাদের সঙ্গে সামনাসামনি কথা নয় যে একটু এদিক ওদিক হলেই গুলি লাগিয়ে দেবে। তিনি এই পীরের মাদ্রাসায় পরার সময় উর্দুও শিখেছিলেন।
শরীফ মিয়া মনের আনন্দে ফোন ধরলেন পিরোজপুর ক্যান্টনমেন্টে। আধা উর্দু আধা বাংলায় জানতে চাইলেন আগামীদিন কোনো ফোর্স স্বরূপকাঠি আসবে কিনা।
ফোনের ও প্রান্ত থেকে ভেসে এলো বাঘের গর্জন, কেয়া, ফোর্স কেয়া?
পরক্ষণেই ও প্রান্তের লোক পালটে গেল। এবারে পরিস্কার বাংলায়। এখন খানসেনারা অন্যত্র অপারেশন করছে। কোনো গানবোট থাকবে না। লড়াই করতে তারা যাচ্ছে না। যাবে শুধু এলাকাটা চিনতে। এটাই বরিশালের ডিস্ট্রিক-মিলিটারি হেড কোয়ার্টার্সের অর্ডার।
পীর সাহেব তখন রাগে ভয়ে এবং আতঙ্কে কেঁদে ফেলেন আর কি।
ঠিক সে সময় পীরসাহেবের আর এক সহকারি জয়নাল এসে প্রবেশ করেন সেখানে।
ধূর্ত শরীফ মিয়াই তখন পীর সাহেবকে মিলিটারির হাত থেকে এড়িয়ে যাবার পথ বাতলে দিলেন একটু চালাকি করে।
জয়নাল ভয়ঙ্কর রকমের হিন্দু বিদ্বেষী। তার বাড়িটা ছিল আটঘর-কুড়িয়ানার হিন্দু এলাকার কাছাকাছি। কুড়িয়ানা ইউনিয়ন এলাকার মধ্যে তার কিছু জমি-জমা ছিল। এই শরীফ মিয়াই একবার যুক্তি করে জয়নালকে ভোটার করে দিয়েছিলেন আটঘর-কুড়িয়ানা ইউনিয়নের। হিন্দু মালাউনদের কী করে শায়েস্তা করা যায়—তার ফন্দি-ফিকিরের চিন্তা সব সময় চলতে থাকত শরিফ মিয়ার মাথায়। আইয়ুব খানের প্রথম আমলে এই শরীফ মিয়াই বুদ্ধি করে সরকারি নমিনেশনে জয়নালকে মেম্বর করে দিয়েছিলেন আটঘর-কুড়িয়ানার ইউনিয়নের। তারপর পীর সাহেবের সঙ্গে যুক্তি করে আর এক কৌশলে জয়নালকে ঐ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান করে দিলেন সরাসরি।
জয়নাল মিয়া প্রবেশ করতেই শরীফ মিয়া বলে উঠলেন, আপনার কথাই হইছিল, চাচা মিয়া।
--আমার কথা!
--হ, আপনারে লইয়া মিলিটারী যাইব কুড়িয়ানায়।
পীরসাহেব বললেন, তোমাকে তো যেতেই হবে জয়নাল। তোমাদের এলাকা, তুমি ছিলে সেখানকার চেয়ারম্যান। সব এলাকা তোমার চেনা। থানার দারোগা আর চেয়ারম্যানরাই তো মিলিটাইরির সঙ্গে থাকে এলাকা চিনাবার জন্য। স্বরূপকাঠি থানার দারোগা পালিয়েছে। তুমি তো আর পালাতে পারবে না বাড়ি ছেড়ে।
--না না, পালাব কেন? মিলিটারি তো চাই-ই আমরা, বললেন জয়নাল।
পীর সাহেব আশার আলো দেখলেন এবার। জয়নাল যে এতো অল্পতেই রাজী হয়ে যাবেন তা তিনি ভাবতে পারেন নি।
জয়নাল চলে গেলেন। শরীফ মিয়া পীর সাহেবকে দিয়ে ডাকালেন মাদ্রাসার উর্দু মাওলানাকে। মাওলানা সাহেব পশ্চিম পাকিস্তানের লোক। তাঁকে দিয়েই ফোন করালেন বরিশালের সাগরদি ক্যান্টনমেন্টে। বিশেষভাবে অনুরোধ করে বলা হল কর্নেল সাহেবকে যে বর্তমান গদিনশীন পীরের বাবা মূল পীর নেছারুদ্দিন সাহেবের ইন্তিকালের দিন হল আগামীকাল। আগামীকাল সারাদিন তাঁর মাজার জিয়ারত করতে হবে। পীর সাহেবের বহু মুরীদ সেখানে উপস্থিত থাকবেন। পীর সাহেব তাই মিলিটারির সঙ্গে যেতে পারবেন না। মিলিটারির সঙ্গে যাবে এলাকার একজন উপুযুক্ত লোক। সে এই এলাকার এক্স চেয়ারম্যান—তার এলাকা সম্পর্কে ভালো চেনা-জানা আছে।
পীর সাহেব দোহাই দিলেন মূল পীর সাহেবের। তাঁর দোহাই দিয়ে এড়িয়ে যেতে চাইলেন যাতে তাকে কাফেরদের এলাকায় যেতে না হয়। অথচ মূল পীর সাহেব নেছারুদ্দিন সাহেবের কাছে হিন্দু-মুসলমানের কোনো বিভেদ ছিল না। তার যেমন ছিল মুসলমান মুরীদ—তেমন ছিল হিন্দু ভক্ত। তাঁর মাজারে মুসলমানরা জিয়ারত করে। হিন্দুরাও সে কবরে গিয়ে মোমবাতী দেয়, মানত করে। পরিবারের মঙ্গল কামনায় দোয়া করে।
আজ তারই বাড়িতে চলছে হিন্দু খতমের প্রস্তুতি। হিন্দু নিধনের জন্য চলছে রাজাকারের ট্রেনিং। কবরে বসে তিনি এটা দেখে নিশ্চয়ই বিচলিত হয়ে পড়েছেন।, শিউরে উঠছেন। আর এই অশান্তি নিয়েই হয়ত থাকবেন রোজ কেয়ামতের অপেক্ষায়।
মন্তব্য
একসঙ্গে দুটো পর্ব পড়লাম। খুবই ভালো লেগেছে।
__________________
জানি নিসর্গ এক নিপুণ জেলে
কখনো গোধূলির হাওয়া, নিস্তরঙ্গ জ্যোৎস্নার ফাঁদ পেতে রাখে
নতুন মন্তব্য করুন