কুলদা রায়
এমএমআর জালাল
এক.
নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকাটি নিয়মিত পড়ি। এ পত্রিকায় কারেকশন নামে একটা টুল আছে। ১৬ এপ্রিলে দেখি সেখানে কয়েকটি সংশোধনী দেওয়া আছে।
১। প্রথম পৃষ্ঠায়—রুজভেল্ট আইল্যান্ড গার্ডেন ক্লাবের একটি ছবি ছাপার ক্যাপশন ভুল হয়েছিল।
২। নর্থ করিয়ার একজন নেতার নাম ভুল ছাপা হয়েছে একটা খবরে।
৩। নিউ ইয়র্কে ঘোড়ার গাড়ির বন্ধের জন্য একটা আন্দোলন করেছেন একটা গ্রুপ। গ্রুপটির প্রতিষ্ঠাতার নামটি সঠিক ভাবে ছাপা হয়নি এই খবরে।
এভাবে আরো কয়েকটি সংশোধনী দেওয়া হয়েছে নিউ ইয়র্ক টাইমসের কারেকশন পাতায়। সবগুলোরই হয় ক্যাপশন ভুল, নয় কারো নাম ভুল। অর্থাৎ কিছু তথ্যগত ভুল পত্রিকাটিতে প্রকাশিত হয়েছিল। কর্তৃপক্ষ সেগুলোর সংশোধনী এনেছেন। কিন্তু কোনো মতামত বা মন্তব্য বা মননশীল বা সৃজনশীল বিষয় যাকে এককথায় বলা যায় ‘কনসেপশন’ জাতীয় ভুল তারা করেনি। সেগুলোর কোনও সংশোধনী নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকা দেয়নি। এই পাতাটি স্রেফ তথ্যগত ভুল সংশোধনী পাতা।
একটি ধারণা বা নীতি বা দর্শন বা বিষয়ের পূর্ণতা জাতীয় লেখাগুলো বিষয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকা নিজে দ্বায়িত্ব গ্রহণ করে প্রকাশ করে। তারা সে বিষয়ে অস্বীকার করে না যে এটা অসাবধানতাবশত ভুল হল হয়েছে। তারা প্রত্যাহার করে না। তথ্যগত ভুল থাকলেই তা সংশোধন করে।
দুই।
পয়লা বৈশাখের প্রথম আলোতে হাসনাত আবদুল হাইয়ের একটা গল্প প্রকাশিত হয়েছে। সেটা অসাবধানতাবশত প্রকাশিত হয়েছে বলে গল্পটি প্রথম আলো প্রত্যাহার করেছে। ১৭ এপ্রিল প্রথম আলোর জেষ্ঠ্য সম্পা্দক সাজ্জাদ শরীফ বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন—আমরা ইচ্ছে করে লেখাটি প্রকাশ করিনি। ভুল করে ছেপেছি বলেই ক্ষমা চাওয়া হয়েছে। পৃথিবীর বহু পত্রিকায় কারেকশন বলে একটি কলাম আছে। তারা কোন ভুল তথ্য দিলে বা কিছু ছাপলে তাতে তাদের নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করেন।
তাহলে হাসনাত আবদুল হাই যে গল্পটি লিখেছেন সেটি কি একটি তথ্য? গল্প নয়?
গল্পটিতে দুটি তথ্য আছে। এক. গল্পটির ক্যাপশন বা শিরোনাম। দুই. গল্পকারের নাম। এ দুটিতে কোনো ভুল নেই। ঠিকঠাক মত প্রকাশিত হয়েছে। মূল রচনাটি নিয়ে লেখকের লেখা অনুসারেই হয়েছে। কোনো থিম, বানানঘটিত ভুল হয়নি বলেও লেখক দাবী করেননি। তাহলে এই গল্পটির কারেকশন কোথায় করা হল? প্রথম আলো কর্তৃপক্ষ বলেছেন যে এটা অসাবধানতাবশত ছাপা হয়েছে—তাহলে অসাবধানতা কি?
তিন.
হাসনাত আবদুল হাই বুড়ো লোক। আমলা ছিলেন। তিনি আমলাদের মত পৃথিবীর সব কিছু জানেন। আমলারা কখনো ভুল করেন না। হাসনাত আবদুল হাই মাঝে মধ্যে লেখালেখি করেন। লিখে বাংলা একাডেমী পদক পেয়েছেন। একুশে পদকও পেয়েছেন। তিনি টিভি ক্যামেরার সামনে মেয়েটি নামে একটি গল্প লিখেছেন। গল্পটিতে শাহবাগে আন্দোলনরত নারীদের অতি অবমাননা করা হয়েছে। প্রথম আলোর নববর্ষ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে।
হাসনাত আবদুল হাইয়ের গল্পের মূল চরিত্র এক নারী, যিনি মফস্বল থেকে ঢাকায় পড়তে এসে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। স্লোগান দিয়ে জনপ্রিয়তা পেলেও তিনি এই সঙ্কটে পড়েন যে, মঞ্চে স্লোগান অব্যাহত রাখতে তাকে ছাত্রনেতাদের ‘খাদ্য’ হতে হবে। শুধু তাই নয়, যে রাজনীতিক তাকে রাজনীতিতে এনেছে, সে এখন তারও ‘খাদ্য’। নারীটি এখন রাজনীতি ছাড়তে চান। একটু সাদা মাটা ভাবে ধরে নিলে বোঝা যায় যে—শাহবাগে যে সব নারীরা যায় তারা কোনো না কোনো ভাবে প্রগতিশীল রাজনীতিকদের খাদ্য।
হাসনাত আবদুল হাই এই লেখার সময়ে বা প্রথম আলোতে প্রকাশিত হওয়ার পরে কখনো বলেননি যে তিনি ভুল লিখেছেন।
এ ধরনের ভুলের জন্য প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে প্রথম আলোর জেষ্ঠ্য সম্পাদক সাজ্জাদ শরীফ বলেন, গল্পটি ছাপা আমাদের ভুল হয়েছে। যদিও আমরা গল্পটি ছেপেছি। পরে আমদের মনে হয়েছে এটি ভুল হয়েছে। ভুলের ব্যাপারটি আমরা নিঃসংকোচে ব্যক্ত করতে চাই।
কর্তৃপক্ষের দায়িত্ববোধের বিষয়ে তিনি বলেন, ভুল তো ভুলই। তাহলে পত্রিকার পাতায় কারেকশনের প্রয়োজন হত না। আমাদের দায়িত্বহীনতার ঘটনা ঘটেছে। কাজের জায়গায় নিশ্চয় বড় ধরনের ভুল হয়েছে। যিনি পাতাটি সম্পাদনা করেন তিনি যথাযথ দূরদর্শতার পরিচয় দেননি। সম্পাদকীয় নীতির ক্ষেত্রে তার প্রজ্ঞার অভাব ছিল। এ জন্যই আমরা লেখাটি প্রত্যাহার করেছি।
তাহলে এটা তথ্যগত ভুল নয়। তথ্যগত ভুল হলে সেটার কারেকশন আনা যেত। ভুলটি সংশোধন করে আবার প্রকাশিত হত। কিন্তু লেখাটি আবার প্রকাশিত হয়নি।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে রাত বারটার সময়ে। পাঠক পড়তে শুরু করেছেন। লেখাটি বিষয়ে অন্তর্জালে ব্লগারগণ অভিযোগ তোলা শুরু করেছেন। ঢাকাতেও পত্রপত্রিকায় প্রতিক্রিয়া আসছে। সোমবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে প্রথম আলোর কয়েকটি কপিতে অগ্নিসংযোগ করেন অল্প কয়েকজন তরুণ। তাঁদের দাবি, ওই গল্পে গণজাগরণ মঞ্চের নারী আন্দোলনকারীদের বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক আমিনুল ইসলাম পরদিন প্রথম আলোর কার্যালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে ওই ছোটগল্পের প্রতিবাদ করেন।
সুদূর মার্কিন দেশ থেকে প্রথম আলোর একজন নিয়মিত লেখক আলী রিয়াজ লেখেন-- গল্পটি পড়ে আমি একাধারে হতবাক ও ক্ষুব্ধ। আমার কাছে এটি একটি আপত্তিকর রচনা বলে মনে হয়েছে। এটি শাহবাগ আন্দোলনের ব্যাপারে কট্টর ইসলামপন্থীদের ভিত্তিহীন অপপ্রচারের ভাষায় রচিত এবং তা বাংলাদেশের নারীদের প্রতি মারাত্মক অবমাননাসূচক। ...এই গল্পটি এমন এক সময়ে প্রকাশ করা হয়েছে যখন হেফাজতে ইসলাম নামের একটি সংগঠন নারী প্রগতির বিরুদ্ধে অগ্রহণযোগ্য দাবি তুলেছে এবং তাঁদের সমাবেশ থেকে একজন নারী সাংবাদিকের ওপর হামলাও চালিয়েছে। দেশের ইসলামপন্থীরা ফেব্রুয়ারি থেকে গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে যে সব কল্পনাপ্রসূত, আপত্তিকর অপপ্রচার চালিয়ে আসছিলো এই লেখা তাকে আরো উৎসাহিত করবে বলে আমার ধারণা। লেখাটিতে কেবল যে চূড়ান্ত পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবই প্রকাশিত হয়েছে তা নয়, এক ধরণের পশ্চাদপদ মানসিকতারও দলিল বলেই একে চিহ্নিত করা যায়। লেখাটির রচনাভঙ্গির কারণে এটি সুস্পষ্টভাবেই সুনির্দিষ্ট নারী রাজনৈতিক কর্মির প্রতি ইঙ্গিতবাহী। এটি ব্যক্তিগত অবমাননা এবং মানহানি দোষেও দুষ্ট।।
এই ঘটনা ঘটে যাওয়ার প্রায় দুদিন পরে প্রথম আলো ক্ষমা চেয়ে বলে-- তাদের ভুল হয়েছে। দুদিন সময় লেগেছে এই ভুলটি বুঝতে। সেটাও নিজেরা নয়-পাঠকদের প্রতিক্রিয়ার পরে বুঝতে পেরেছে। পাঠকদের প্রতিক্রিয়া না থাকলে সেটা ভুল হত বলে মনে হয় না। কিন্তু তারা কোনো তথ্যগত ভুল সংশোধন না করে পুরো গল্পটিই প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। বলেছেন—এটা তাদের নীতির সঙ্গে যায় না—আদর্শের সঙ্গে মেলে না।
সাজ্জাদ শরিফ এই নীতিমালা ও আদর্শ প্রসঙ্গে বলেন—আমাদের নীতিমালা হল আমরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। আমরা গণতন্ত্র এবং প্রগতিশীলতার পক্ষে। ...নারীর সার্বিক মুক্তি এবং স্বাধীনতা বিশ্বাস করি। আমরা এমন কোনো লেখা ছাপবো না যাতে করে নারী অবমাননার শিকার এবং মুক্তিযুদ্ধের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়। যদি তাই সত্যি হত তাহলে গল্পটি যখন এসেছে, তখনই এটা বাতিল করে দিতেন। গল্পটি পড়েছেন দুজন সাহিত্য সম্পাদক। এদের উপরে আছেন জেষ্ঠ্য সম্পাদক সাজ্জাদ শরীফ নিজে। তাকে টপকে প্রথম আলোর সাহিত্য বের হয় না। সেটা করা হয়নি। বরঞ্চ সেটা টাইপ করা হয়েছে। বানান সংশোধন করা হয়েছে। ছবি আঁকা হয়েছে। ছবির সঙ্গে মিলিয়ে গল্পটিকে পত্রিকায় সেট করা হয়েছে। পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে দুইটি দিন চলে গেছে। কারো মনেই হয়নি এটা পত্রিকার নীতিমালা ও আদর্শের পরিপন্থী।
এবং যখন পাঠকগণ প্রতিবাদ করলেন—তখন বললেন এটা একটা ভুল হয়েছে। অসাবধানতাবশত ছাপা হয়েছে।
তিন তিন জন সম্পাদক এবং এতো জন লোকের চোখ এড়িয়ে একটি ভুল হল, তিন তিন জন লোকই অসাবধান এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? তার চেয়েও বড় কথা একই সংখ্যায় একটি গল্প অসাবধানে ভুল করে ছাপা হতে পারে তাদের দাবী অনুসারে—কিন্তু আরো কয়েকজন পাঠকের মতে একই বিষয়, একই পটভূমি ও একই উদ্দেশ্য সম্বলিত দুটি লেখা ভুল করে ছাপা হয় কিভাবে?
চার.
প্রথম আলোতে প্রকাশিত দ্বিতীয় গল্পটি একটু খুলে দেখা যাক। নাম উন্মাদিনী কাল। গল্পের স্থান শাহবাগ এবং একটি মেয়ের স্বপ্ন বা দুঃস্বপ্ন।
গল্পটিতে তিনটি পর্ব আছে।
প্রথম পর্বে একজন নামহীন পাগলী শাহবাগে গত দুইমাস যাবত নিয়মিত যাচ্ছে। সেখানে উপস্থিত এক ছেলের কাছে সিগারেট চায়। সে শাহবাগের শ্লোগানগুলি জানে—যেমন ক-তে কাদের মোল্লার ফাঁসি চাই। ইত্যাদি। এই শ্লোগান দেওয়ার বিনিময়ে পাগলী একটি মেয়ের কাছে টাকা চায়। শ্রাবস্তী নামের মেয়েটির কাছ থেকে ১০ টাকা পেয়ে পাগলি শাহবাগ ছেড়ে চলে যায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। ওই টাকা দিয়ে রাতের খাবে কিনে খাবে।
দ্বিতীয় পর্বে কয়েকজন তরুণ-তরুণীকে দেখা যাচ্ছে শাহবাগে। তাদের নামগুলো--
সাদী--ধনী ব্যবসায়ীর ছেলে। চীনাপন্থী রাজনীতিতে বিশ্বাসী। গিটার বাজিয়ে গান করেন। তিনি জর্জ হ্যারিসন হতে চান। এজন্য বিয়ে করছেন না। কিন্তু তার অনেকগুলো গার্লফ্রেন্ড ছিল। তার সম্পর্ক বেশীদিন টেকে না। দীর্ঘদিন ধরে শ্রাবস্তীকে গোপনে ভালোবাসেন। কিন্তু বলতে পারেন না।
অনুপম—রাবীন্দ্রিক। বিজ্ঞাপনী সংস্থায় চাকরি করেন। মস্কোপন্থী। বিবাহিত।
মোস্তাফিজ—মোবাইল কোম্পানীতে চাকরিরত। ফটোগ্রাফী তার শখ। বিয়ে করেছেন। কিন্তু বউকে বাসায় রেখে ঘুরে বেড়ান।
শ্রাবস্তী—মস্কোপন্থী। লালটিপ পরেন। বিয়ে করেননি। মহাশ্বেতা দেবী হবেন বলে কোন বিবাহেচ্ছুক যুবককে বিয়ে করেন না।
মোহসীনা—চীনাপন্থী। জিন্স পরেন। সিগারেট খান। এক কাজিনকে প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন। তার একটা মেয়েও আছেন এখন ডিভোর্সের মামলা চলছে।
এই কটি তরুণ-তরুণীদের কেউই পাগল নয়। কেউই গরীব বেকার বা পাগল নয়। পড়াশুনা শেষ করেছেন। এদের জীবনে ভাত-কাপড় বা আর্থিক কোনো সমস্যা নেই—তাদের প্রধান সমস্যাই হল প্রেমের সমস্যা। চীনাপন্থী, মস্কোপন্থী-- শাহবাগের রাজনীতি, দেশের রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তিক দ্বন্দ্ব থাকলেও শেষে বিবাহিতরা বউকে ঘরে রেখে, আর ডিভোর্সী ঘরে সন্তান রেখে ও অবিবাহিতরা আস্তিনে দীর্ঘশ্বাস গুপ্ত করে পুরনো প্রেমিক খুঁজতে শাহবাগে আসেন।
তৃতীয় পর্বে আছে—শ্রাবস্তী একটি দুঃস্বপ্ন দেখছে। একাত্তরে এক ধর্ষিত মেয়ের ছবি দেখেছিল ফেসবুকে। সেই বিরঙ্গনা মেয়ে হিসেবে নিজেকে মনে করছে। এই মেয়ের আত্মত্যাগের মধ্যে দিয়েই বাংলাদেশের জন্ম। আবার নিজেকে মনে করছে শাহবাগে আসা সেই পাগলী যে স্বাধীন বাংলাদেশে পুলিশ-র্যা ব দ্বারা ধর্ষিত হয়। কিন্তু তার ভাতের যোগাড় হয় না। ভাতের যোগাড় করতে তাকে শেষ পর্যন্ত শাহবাগের তরুণ-তরুণীদের কাছে হাত পাততে হয়। দেশে তেল-গ্যাসের সমস্যা আছে। সংখ্যালঘু নির্যাতন আছে। শাহবাগ সেই আন্দোলনে নেই। এবং সবশেষে তার মনে প্রশ্ন জেগেছে শাহবাগের গণজাগরণ হলে কি এই পাগলীর ভাতের যোগাড় হবে কিনা? যদি না হয় তাহলে শাহবাগ করে কী লাভ?
গল্পটিতে শাহবাগের চেহারা বিষয়ে বলছেন গল্পকার—
শাহবাগের শুরুর সময় লোকজন বাস ভর্তি করে আসত। আর আসত গাড়ি ভর্তি করে মিডিয়া। তাদের ক্যামেরায় ছবি তোলা হত। শাহবাগের ছেলেমেয়েদের মুখে লেখা রাজাকারের ফাঁসি চাই। আর দেখা যেত লাকীকে। লাকী শ্লোগান দিত-ক-তে কাদের মোল্লা, তুই রাজাকার। ইত্যাদি। লাকীকে দেখা যায় না। গল্পে লাকীকে শ্লোগান দিতে দেখা যায় না। শোনা যায় লাকী তখনো আসেনি। পাগলীর মুখেই লাকীর মুখের শ্লোগানগুলোর ভাষ্য পাওয়া যায়। শাহবাগের শুরুতে দিনরাত গান হত। এর পর গল্পকার সতর্কভাবে বলছেন—শাহবাগে ধীরে ধীরে লোক কমে গেছে।
এখান থেকে বোঝা যাচ্ছে—শাহবাগ মিডিয়ার একটি সাজানো ঘটনা। সেখানে যেসব ছেলে মেয়েরা যায় তাদের ভাত-কাপড়ের অভাব নেই। তারা সুন্দর সেজে গুজে আসে। মেয়েরা টিপ পরে। লিপিস্টিক দেয়। চাচর করা তাদের কেশ। এগুলো পাগলীর নেই। পাগলী তাদের এই সব সাজুনী চাইলে তারা তাকে দেয় না। পাগলীর চাওয়া-পাওয়ার সঙ্গে শাহবাগীদের চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে আকাশ সমান ব্যবধান। এই শাহবাগে সমবেতকারীরা কারা? হেফাজতের সমর্থক ফরহাদ মজহার বলেছেন—শাহবাগ নষ্ট শহরের নষ্ট লোকদের সমাবেশ। এখানে দেশের প্রধান অংশ গরীব মানুষেরা নাই। খালেদা জিয়া আর হেফাজতের লোকজন যেমন বলেন—সেখানে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা হয়। ওখানে বেলাল্লাপনা করতে যায়। এই গল্পের এই প্রতিনিধিত্বশীল তরুণ-তরুণীরা সেই দাবীকেই প্রমাণ করে। তারা দেশের দেশের মানুষের ভাত-কাপড়ের আন্দোলন বাদ দিয়ে শুধু রাজাকারদের একমাত্র ফাঁসীর দাবী নিয়ে আছে। এতে দেশের মানুষের মুক্তি নেই।
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেটা তো সত্য নয়। শাহবাগে ব্লগার তরুণ-তরুণীরা শুরুতে সমবেত হয়েছিল যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবীতে। তাদের সমাবেশে সকল শ্রেণীর মানুষের স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহণ ঘটে। সেটা শাহবাগের জাগরণ হিসেবে পরিচিত হয়। সেটা নানাপ্রকার অপপ্রচার-ষড়যন্ত্র, হুমকি ধামকি উস্কানী সত্ত্বেও অহিংস আন্দোলন হিসেবে সারা পৃথিবীতে প্রশংসিত হয়েছে। এবং সমাবেশের জাগরণ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এমনকি সারা পৃথিবীতেই এর সমর্থনে সমাবেশ হচ্ছে। দেশের মানুষ নতুন করে দেশের যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবীতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। দেশের মস্কোপন্থী, চীনাপন্থী, পাতিবুর্জোয়া, উঠতি বুর্জোয়া, পুরো বুর্জোয়া, খেটে খাওয়া-না খেতে পাওয়া মানুষ একাট্টা হয়েছে। এটা তো সহজ কথা নয়। এই ঐক্যের অভাবেই পাকিস্তানপন্থীরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে গলা টিপে ধরেছে। স্বাধীনতার মূলনীতিমালাকে হত্যা করছে। এই ঐক্যের মধ্যে দিয়েই স্বাধীনতার শত্রুদের পরাজিত করা সম্ভব। স্বাধীনতার মূলনীতিমালা বাঙালী জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতায় ফিরে যাওয়ার পথে এগোনো যাবে।
এবং শাহবাগের গণজাগরণ জনগণের ভাত-কাপড়ের সংগ্রামের বিরোধিতা করেনি। তার সঙ্গেই আছে। এরাই দেশে গ্যাস-তেল-ভাত-কাপড়ের আন্দোলন-সংগ্রামেই যুক্ত আছে কোনো না কোনোভাবে। এই আন্দোলন জারী থাকে। শাহবাগের গণজাগরণের মধ্যে দিয়ে শক্তি অর্জন করে।
যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ বিচারের দাবীটি সময়ের দাবী। এই দাবীকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এগুলোই শাহবাগের ইতিবাচক চেহারা। শাহবাগের আন্দোলনটাই সবচেয়ে সুস্থ এবং প্রাণবন্ত। এ কারণেই শাহবাগের গণজাগরণকে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ হিসেবে অভিহিত করেছেন কেউ কেউ। একে কোন অর্থে উন্মাদ বলা যায়? কোন অর্থে এই গণজাগরণের কালকে উন্মাদকাল বলা যেতে পারে?
কিন্তু উন্মাদকাল গল্পটিতে শাহবাগের একটি নেতিবাচক চেহারাই গল্পকার তুলে ধরেছেন। তাকে তিনি উন্মাদকাল বলেছেন। শাহবাগের গণজাগরণের পক্ষের লোকজনকে উন্মাদ বলেছেন।
শাহবাগের চেতনার সঙ্গে এই গল্প যায় না। শাহবাগের গণচেতনার বিরুদ্ধতাই করে।এই গল্পে শাহবাগ শেষ পর্যন্ত অর্থহীন হয়ে ওঠে।
গল্পকার শাহবাগকে এইভাবেই দেখছেন। সেভাবেই তিনি এই গল্পটি লিখেছেন। এই ভিন্নমতের লেখারলেখির অধিকার গল্পকারের রয়েছে। তা নিয়ে তাকে প্রশ্ন করা অর্থহীন। তাকে করাও হচ্ছে না।
এই গল্পটি প্রথম আলো প্রকাশ করারও অধিকার রাখে। অতীতে এ ধরনের কাণ্ড তারা করেছে। যেমন রাজু আলাউদ্দিনের বিরুদ্ধে প্রথম আলোর সাহিত্য সম্পাদক আলীম আজিজ কুৎসিত গল্প লিখেছিলেন। পাঠকদের দাবীর মুখে সেটাও অসাবধনতাবশত প্রকাশিত হয়ে বলে প্রত্যাহার করেছিল প্রথম আলো। কার্টুনিস্ট আরিফের নির্দোষ কার্টুনটিকে মৌলবাদীদের দাবীর মুখে প্রত্যাহার করে তাকে পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। আর মৌলবাদীদের কাছে গিয়ে তওবা করেছিলেন মূল সম্পাদক। আরিফ ব্যক্তিগতভাবে বিপদে পড়েছিলেন। এগুলোর কোনোটিই কারেকশন করা হয়নি। প্রত্যাহার করা হয়েছে প্রকাশিত হওয়ার কয়েকদিন পরে। ততক্ষণে ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে।
পাঁচ.
প্রথম আলোর নববর্ষ সংখ্যায় প্রকাশিত দুটি গল্পের পটভূমি, বিষয় ও উদ্দেশ্য এক প্রকার। অর্থাৎ নববর্ষের বিশেষ সংখ্যাটি বের করার সময়ে প্রথম আলো পরিকল্পনা করেছিল তারা শাহবাগের গণজাগরণকে ভিত্তি করে ভিন্নধারার দুটি গল্প প্রকাশ করবেন। সে জন্য তারা তাদের দুজন গল্পকারকে অনুরোধ করেছেন এই বিষয়, পটভূমি ও উদ্দেশ্যভিত্তিক গল্প লিখতে। তারা লিখেছেনও। তারা যে ফরমায়েসী লেখা লিখেছেন বা লিখে থাকেন তার প্রমাণ রয়েছে এই দুজন গল্পকারের একজনের ফেসবুকীয় স্টাটাসে। তিনি শাহবাগ গণজাগরণকে নিয়ে আরো একটি গল্প লিখেছিলেন। সেটা প্রথম আলো গেল মাসে প্রকাশ করেছিল। তার লিংক ফেসবুকে দিয়ে গল্পকার লিখেছিলেন-এই গল্পটি খুবই দুর্বল গল্প। প্রথম আলোর দুইজন সাহিত্য সম্পাদক কাজল রশীদ ও নির্লিপ্ত নয়নের অনুরোধে ও পীড়াপীড়িতে তিনি গল্পটি লিখেছেন। এ রকম লেখালেখি দেশে নতুন নয়। ফরমায়েসী গল্প সব সময়ই নির্মাণকৌশলের দিক থেকে দুর্বল হয়ে থাকে। এই দুর্বলতা এই গল্প দুটিতেও প্রকট।
প্রথম আলো অতি সাবধানতার সঙ্গে তাদের ফরমায়েস মোতাবেক লেখা দুটি গল্প পেয়েএক সঙ্গে প্রকাশও করেছে। কোনো ভুল তাদের হয়নি। কোনো অসাবধানতাও হয়নি। ভুল আর অসাবধানতারবশত প্রকাশের দাবীটা চরম অসত্য বলেই মনে হয়।
প্রথম আলো এই ধরনের অসাবধানতাবশত ভুল এবারই প্রথম নয়—এর আগেও করেছে। তার ফলে আরিফের জীবন বিপন্ন হয়েছে। মৌলবাদীরা শক্তি অর্জন করেছে। স্বাধীন মত প্রকাশের স্বাধীনতা হুমকির সম্মুখিন হয়েছে। রাজু আলাদ্দিনের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়ে গেছে। এবারে দুটো গল্পের মধ্যে দিয়ে শাহবাগের গণজাগরণের নেতিবাচক চেহারা বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হয়েছে।
মন্তব্য
চমৎকার বিশ্লেষন করেছেন ।
প্রথম আলো বর্জন করা উচিত সবার । প্রথম আলোর মতলববাজ মানসিকতা নগ্ন ভাবে প্রকাশে হয়েছে এর আগেও
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
এই গল্পটাতো পড়িনি! একেবারে প্রেমের বন্যা বইয়ে দিয়েছে বলতে হবে লেখক। মনে হচ্ছে বাংলাদেশের সকল প্রেমিক-প্রেমিকা শাহবাগ আন্দোলনের অপেক্ষায় ছিল। এর আগে তাদের প্রেম করার কোন মওকাই ছিল না। দারুন কল্পনাশক্তি!
কুলদা, আপনার লেখায়
__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার
চমৎকার লিখেছেন।
মূর্তালা রামাত
"প্রথম আলো অতি সাবধানতার সঙ্গে তাদের ফরমায়েস মোতাবেক লেখা দুটি গল্প পেয়েএক সঙ্গে প্রকাশও করেছে। কোনো ভুল তাদের হয়নি। কোনো অসাবধানতাও হয়নি। ভুল আর অসাবধানতারবশত প্রকাশের দাবীটা চরম অসত্য বলেই মনে হয়।"
সহমত।
আর লেখাতে
সুবোধ অবোধ
গতরাতে এটিএনে মুন্নী সাহা তার সঞ্চালিত টকশোতে মন্ত্রী হাসানুল হক ইইনুর কাছে এই প্রসঙ্গটি তুলেছিলেন। এমন কমেডি অনেক দিন দেখিনি। মহিলার অনেক কিছু বলার ইচ্ছা ছিল মনে হয়, কিন্তু কি যে বললেন - কিছুই বুঝা গেল না ঠিক মত! অসম্পূর্ণ, ভাঙাচোরা, আধাখেঁচড়া বাক্যবিন্যাসে হড়বড়-তড়বড় করে এলোমেলো ভাবে যা বললেন তাতে একটা পুরোপুরি অর্থপূর্ণ বাক্যও মনে হয় ছিল না! সমস্যাটা কি বুঝলাম না - চিন্তাটাই পরিষ্কার ছিল না, নাকি কথা শুরু করে তারপর ভয় পেয়ে কতটুকু বলা যাবে আর কতটুকু যাবে না সেই স্বিধায় তালগোল পাকিয়ে লেজেগোবরে করে ফেলেছেন বুঝা গেল না। তবে এইসব সিনিয়র সাংবাদিকদের এইরকম অবস্থা দেখে আমাদের টিভি হাম্বাদিকতার ছন্নছাড়া হালটা খুব ভাল ভাবেই বুঝা গেল।
****************************************
আরিফের কার্টুন ঘটনায় আলপিন সম্পাদক সুমন্ত আসলামকে বহিষ্কার করা হয়েছিলো
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
১। অদিতি মানুষ হয়ত খারাপ নন; তবে তিনি পূর্ণমাত্রার ভোদাই। তাঁকে বেশিরিভাগ ক্ষেত্রেই অন্যরা ব্যবহার করেন। তিনি লোভে পড়ে ব্যবহৃত হন। মাঝারি মানের লোকজন উচ্চাভিলাষী হয়ে পড়লে যেসব দুর্যোগ সৃষ্টি হয়, অদিতি ফাল্গুনী প্রায়ই সেইসব দুর্যোগ তৈরি করেন।
২। হাসনাত হাই এর ব্যাপারটা অন্যরকম। এইটা হাড়েমজ্জায় হারামজাদা।
৩। ফারুক-সাজ্জাদ শরিসৃপ গং আলুরকেল্লায় ফরহাদ মজহার এর হিডেন কর্মকর্তা। এইসব ঘটনা প্রধানত তারাই উৎসাহী হয়ে ঘটায়। এতে এক ঢিলে কয়েকটা পাখি মরে। মগবাজারি এজেন্টা বাস্তবায়ন হয়। আবার ক্ষমাটমা চাওয়ায়ে মতির লেজেগোবরে অবস্থাও দ্যাখানো হয় (অর্থাৎ মতিকে দিয়ে আর হবে না, আমাদেরকে দ্যান)। শরিসৃপ গং আলুরকেল্লার সেনাপতি হতে আগ্রহী। এইসব সফল অন্তর্ঘাতের মাধ্যমে ফরহাদ মগবাজারের পা চাটা ফারুক-শরিসৃপ গং আলুরকেল্লার সেনাপতি হবার দিকে দক্ষতার সাথে এগিয়ে যাচ্ছেন।
এবার কি প্রুফরিডার আর টাইপিস্টের চাকুরিটা যাবে??
হাসেন কিল্লাই? আঁই কি কইচ্চি??
সরল মনে প্রশ্ন জিগাইলাম... না পারলে কয়া দেন, পারেননা
দুঃখজনক।
চমৎকার বিশ্লেষন।
আলু সম্পাদক দের জন্য প্রতিটা শব্দ একটা করে থাপ্পড় ছিলো। ভালো লিখেছেন
কসাই মওলানা
এরকম একটি পর্যবেক্ষণমূলক প্রতিবেদনের দরকার ছিলো
ধন্যবাদ আপনাকে। নিউ ইয়র্ক টাইম্স এর রেফেরেন্সটা দরকার ছিল।
@জোহরা ফেরদৌসীঃ আপা, আপনার কাঙ্ক্ষিত লিঙ্কটি (এখানে কিছুতেই পেস্ট করতে পারছি না), সচাল পারমিশন দিচ্ছে না। একটু কষ্ট করে খোঁজ করুন-
উন্মাদিনী কাল,
অদিতি ফাল্গুনী | তারিখ: ১৩-০৪-২০১৩
ধন্যবাদ, মেঘলা আকাশ, অনেক ধন্যবাদ।
__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার
কোন ভাল কিছুকে আমরা সহজে গ্রহণ করতে পারি না কেন ? এতটা নোংরা মানসিকতা লালন করেন আমাদের তথাকথিত প্রগতিশীলরা.......
চমকপ্রদ।
আঃ হাকিম চাকলাদার।
বিশ্লেষণ ভালো লাগলো।
প্রথম আলোর প্রগতিশীল ভড়ং-এর নিচের গান্ধা পশ্চাদ্দেশ এর আগেও উন্মোচিত হয়ে গেছিলো, আবার হইলো।
- সুচিন্তিত ভুল
চমৎকার বিশ্লেষন !
__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---
বিশ্লেষণ ভালো লেগেছে। প্রথম আলো অন্য দশটি করপোরেট প্রতিষ্ঠানের মতো, যেমন স্কয়ার, বেক্সিমকো ইত্যাদি। তাদের আছে একটি নির্দিষ্ট কাস্টমার বেইজ। তাদের যত নীতিমালা পলিসি - সব কিছুই প্রথমত বাণিজ্যকে সুরক্ষার জন্য।
সুন্দর বিশ্লেষণ।
স্বপ্নহারা মানব
---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।
বিশ্লেষণ ভালো লাগল।
শেয়ার দিলাম
স্বয়ম
প্রচুর শেয়ার হওয়া উচিৎ লেখাটার।
_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না
নতুন মন্তব্য করুন